২১. আরো দুটো রাত দুটো দিন

আরো দুটো রাত দুটো দিন তারপর কেটেছে।

এবং একমাত্র শচীবিলাসবাবু ব্যতীত সকলেই তখনও সরকার ভিলাতেই উপস্থিত।

শচীবিলাসকে যেতে অনুমতি দিয়েছে বিমল সেন।

কিন্তু যাঁরা আছেন তখনও সরকার ভিলায় তারা বুঝি সত্যই পাগল হয়ে যাবে। সর্বক্ষণ এক দুর্বিষহ অকথিত মানসিক যন্ত্রণার পীড়ন সকলকেই যেন কেমন বিমূঢ় করে রেখেছে।

বিজনবাবুর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিরীটীর অনুমানটাও মিথ্যা হয়নি। নির্ভুল সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ বিজনবাবুর ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ মারাত্মক বিষ নিকোটিন বলেই প্রমাণিত হয়েছে ইতিমধ্যে।

সবাই যে যার ঘরে চুপচাপ সর্বক্ষণই প্রায় বসে বা শুয়ে কাটান। যাবতীয় পান ও আহারের ব্যাপারে সদা-সতর্ক পুলিসপ্রহরী নিযুক্ত করেছে কিরীটী বিমল সেনের সাহয্যে। তথাপি যেন আহারে ও পানে ভীতি রয়েছে সকলের।

কেউ যেন কিছুতেই মোয়াস্তি পাচ্ছে না।

মৃত্যুভয়ে, মৃত্যু-আশঙ্কায় এমনিই বুঝি মানুষ তার আপন অজ্ঞাতে ভীত, সশঙ্কিত।

তবু আশ্চর্য, মৃত্যু আসবেই এবং প্রতিনয়ত আসছেই!

জন্মের মতই মৃত্যু স্বাভাবিক এবং অনিবার্য, তবু মানুষ চিরদিনই জন্মের পর জ্ঞান হওয়া অবধি মৃত্যুভয়েই যে সিটিয়ে রয়েছে।

কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে।

মানুষের সহ্যশক্তির একটা সীমারেখা রয়েছে—সেই কথাটি ভেবেই সেদিন রাত্রে খাবারের টেবিলে বসে কিরীটী সকলকে লক্ষ্য করে বললে, কাল সকাল থেকেই আপনারা সবাই মুক্ত।

সকলেই একসঙ্গে কথাটা শোনামাত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

তাহলে সত্যিই অসহ্য এই প্রতি মুহূর্তের বোবা-যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্তি পেল সকলে!

অভিশপ্ত মত্যু-আতঙ্কে-ভরা এই সরকার ভিলা ছেড়ে তারা যেখানে যার খুশি চলে যেতে পারবেন!

একে একে সকলে খাবার টেবিল ছেড়ে ডাইনিং হল থেকে বের হয়ে গেলেন। শুধু টেবিলের সামনে বসে রইল কিরীটী আর শকুন্তলা।

টেবিলের উপর টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বলছে।

সহসা কিরীটী শকুন্তলাকে সম্বোধন করে বললে, আপনিও নিশ্চয় চলে যাচ্ছেন কালই শকুন্তলা দেবী?

য়্যাঁ! সহসা যেন নিদ্রোখিতের মতই তাকালো শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে, এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ, যাব।

কথাটা বলে আর দাঁড়াল না শকুন্তলা।

চেয়ার থেকে আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, নিঃশব্দে ঘর থেকে এবারে বের হয়ে গেল। কিরীটীও ঘর থেকে বের হয়ে তার নির্দিষ্ট ঘরে এসে প্রবেশ করল।

 

ঐদিনই দ্বিপ্রহরে সারদাচরণের লাইব্রেরী ঘরের বইগুলো দেখতে দেখতে একটা বাঁধানো ফটোর অ্যালবাম পেয়েছিল কিরীটী। অ্যালবামটা এনে নিজের শয্যার তলায় রেখে দিয়েছিল। সেটা বের করে টেবিলের সামনে আলোয় এসে বসল।

সারদাচরণের ফ্যামিলি অ্যালবাম।

একটার পর একটা পাতা উলটে যায় কিরীটী অ্যালবামের।

নানাবয়েসী মেয়ে-পুরুষের ফটো সেই অ্যালবামে রয়েছে আঁটা।

ফটোগুলো দেখতে দেখতে সহসা একটা ফ্যামিলি গ্রুপ ফটোর প্রতি নজর পড়ে কিরীটীর।

মধ্যস্থলে সারদাচরণ, তাকে বেশ চেনা যায়—বাইরের ঘরে ও লাইব্রেরী ঘরে সারদাচরণের যে ফটো আছে তার সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। তার এক পাশে বৃন্দাবন সরকার ও অন্যপাশে তার দাঁড়িয়ে মধুসূদনই সরকার নিশ্চয়ই।

ফটোটা অন্ততঃ দশ-বারো বৎসর পূর্বের। কারণ দশ বৎসর তো মধুসূদন গৃহছাড়াই।

পরিবর্তনও হয়েছে মধুসূদনের চেহারায় ইতিমধ্যে যথেষ্ট।

এবং দশ বৎসরে চেহারার পরিবর্তন তো হবারই কথা।

তখন মধুসূদন দাড়ি-গোফ রাখতেন না, এখন চাপদাড়ি ও ভারী গোঁফ মুখে শোভা পাচ্ছে।

চাপদাড়ি ও গোঁফ।

কিরীটী বোধ হয় নিজের চিন্তায় তম্ময় হয়ে গিয়েছিল, সহসা একটা দীর্ণ আর্ত চিৎকার ও দুড়ম দুড়ুম পর পর দুটো গুলির শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে কিরীটী।

চকিতে কিরীটী অ্যালবামটা টেবিলের উপরেই ফেলে রেখে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসে।

গুলির শব্দ ও চিৎকার সকলেই শুনেছিলেন নিশ্চয়ই, কারণ কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সকলকেই বাইরের বারান্দায় দেখতে পায়।

কিরীটীর নির্দেশমতই গত কদিন ধরে বারান্দা ও সিঁড়ির সামনে যে আলোটা ছিল সেটা সারারাত ধরেই জ্বালানো থাকত।

আলোটা অবিশ্যি খুব পর্যাপ্ত নয়। তবে পর্যাপ্ত না হলেও সমস্ত বারান্দা ও সিঁড়ির অর্ধেকটা ভালই দেখা যাচ্ছিল।

সিঁড়ির কাছাকাছিই বারান্দাটা ডাইনে বেঁকে গিয়েছে পশ্চিম দিকে।

ডাঃ অধিকারী, মিঃ মল্লিক, শকুন্তলা ও বৃন্দাবন সরকারকে দেখতে পেল কিরীটী।

কেবল মধুসূদন সরকারকেই দেখতে পেল না তাদের মধ্যে।

কথা বললেন প্রথমে বৃন্দাবন সরকারই, পর পর দুটো গুলির আওয়াজ আর কার যেন চিৎকারের শব্দ শুনলাম।

হ্যাঁ, কিন্তু মধুসূদনবাবু কোথায়? তাঁকে দেখছি না? বললে কিরীটী।

দাদা তো পশ্চিমের ঘরে—বললেন বৃন্দাবন সরকার।

চলুন তো-বলে সর্বাগ্রে এগিয়ে গেল কিরীটী এবং তাকে অনুসরণ করে অন্যান্য সকলেই যেন কেমন ভীতভাবে অগ্রসর হল।

মধুসূদন সরকারের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। এবং ঘরে আলো জ্বলছিল।

সর্বাগ্রে সেই ঘরে কিরীটীই পা দিয়ে থমকে দাঁড়াল।

ঘরের মেঝেতে কে একটা লোক উবুড় হয়ে পড়ে আছে আর তার চারপাশে রক্তের যেন একেবারে ঢেউ খেলে যাচ্ছে এবং দক্ষিণ বাহুমূলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় বসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মধুসূদন সরকার ক্ষতস্থানটা বাঁ হাতে চেপে।

এ কি! কি সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি কথাটা বলে সর্বাগ্রে ডাঃ অধিকারীই আহত মধুসূদনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কি হয়েছে? ব্যাপার কি দাদা? বৃন্দাবনও এগিয়ে যান।

কিরীটী ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ভূপতিত মৃত রক্তাক্ত দেহটা উটে দিতেই যেন সকলে চমকে উঠল মৃতের দিকে তাকিয়ে এবারে।

গুলিবিদ্ধ মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়-ভৃত্য গোকুল।

এ কি! এ যে দেখছি গোকুল! বললেন মিঃ মল্লিক।

হ্যাঁ-ওই বেটাই। যন্ত্রণা-ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন মধুসূদন সরকার, ঘরের দরজা আমার ভেজানোই ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে পড়তে বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল, হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতেই চেয়ে দেখি আমার জলের গ্লাসে শিশি থেকে কি একটা ঢালছে ঐ গোকুল। তাই দেখেই সঙ্গে সঙ্গে আমি বালিশের তলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে ওকে গুলি করতে যাব হঠাৎও আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ধস্তাধস্তি করতে করতে একটা ফায়ার আমার হাতে লাগে, আর একটায় বোধ হয় ওই বেটা ফিনিশ হয়েছে

ঘরের মেঝেতেই একটা বেঁটে মত কালো শিশিও পাওয়া গেল মৃত গোকুলের পাশেই।

কি সর্বনাশ! ডাঃ অধিকারী বললেন, শেষ পর্যন্ত ঐ বেটাই—

পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে শিশিটা আলগোছে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে বৃন্দাবন সরকারের দিকে চেয়ে কিরীটী বললে, থানায় বিমলবাবুকে এখনি একটা খবর দিন বৃন্দাবনবাবু!

থানায়?

হ্যাঁ, যান—গোকুলের ব্যাপারটা বিমলবাবুকে এখুনি জানানো কর্তব্য।

বেশ।

বৃন্দাবন সরকার তখুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

এবার কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললে, ওঁর হাতের উৎটা পরীক্ষা করে দেখলেন ডাঃ অধিকারী?

নাঃ, এই দেখছি-বলে ডাঃ অধিকারী মধুসূদন সরকারের হাতের উৎটা পরীক্ষা করে বললেন, না সামান্যই, সুপারফিসিয়াল একটা স্কিন ডিপ উণ্ডের উপর দিয়ে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

তা হোক, ড্রেস করে দিন। কিরীটী বললে শান্তকণ্ঠে।

ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই থানা থেকে বিমল সেন এসে গেল। সে আবার মধুসূদন সরকারের জবানবন্দি নিল। জবানবন্দি নিতে নিতেই একসময় বললে বিমল, যাক, শেষ পর্যন্ত যে বেটা ঘায়েল হয়েছে এই রক্ষে! নইলে আরও যে এমন কতগুলো খুন করত কে জানে! উঃ সাংঘাতিক!

 

সকলে লাইব্রেরী ঘরের মধ্যেই জমায়েত হয়েছিলেন আজও।

ডাঃ অধিকারী বললেন, যা বলেছেন মিঃ সেন। মধু আজ খুব বেঁচে গিয়েছে।

লাকিই বলতে হবে। মিঃ মল্লিক বললেন।

যাহোক সে-রাত্রিও অতিবাহিত হল একসময়।

এবং পরের দিন সকাল দশটার ট্রেনেই মিঃ মল্লিক ও ডাঃ অধিকারী চলে গেলেন কলকাতায়।

কিরীটীও তাদের সঙ্গে একই ট্রেনে কলকাতায় গেল।

পরের দিন শকুন্তলাও কলকাতা চলে গেল।

 

দিন সাতেক বাদে।

বৈকালের দিকে সরকার ভিলায় যখন কিরীটী, সুশান্ত ও বিমল সেন এসে প্রবেশ করল, মধুসূদন সরকার তখন বাইরের ঘরে বসে একজন বৃদ্ধ বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মধুসূদন সাদরে আহ্বান জানালেন, আসুন, আসুন–বসুন।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললেন, তাহলে আজ আমি উঠি মিঃ সরকার। তাহলে ঐ কথাই রইল। সামনের সপ্তাহেই রেজেস্ট্রি হবে।

বেশ।

ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। আপনারা বসুন মিঃ রায়, আমি কাউকে চা দিতে বলে আসি।

না, না—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না মিঃ সরকার, বসুন। চা একটু আগেই থানা থেকে খেয়ে আসছি। কিরীটী বললেন।

আমার এখানেও না হয় এক কাপ করে থোক। বলেই মধুসূদন মৃদু হেসে কথাটা শেষ করলেন, এখানে চা খেতে আপনাদের ভো আর ভয় নেই। চা রহস্যের তো মীমাংসা হয়েই গিয়েছে, কি বলেন মিঃ রায়!

তা হয়েছে বটে। তবে চা পরে হবেখন। আপনি বসুন।

কিরীটীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরের বারান্দায় কয়েকজোড়া মিলিত জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

কারা যেন আসছে বলে মনে হচ্ছে! মিঃ সরকার বললেন।

বোধ হয় ডাঃ অধিকারী, বৃন্দাবনবাবু ওঁরা সব এলেন। বললে কিরীটী।

সত্যিই পরমুহূর্তেই ডাঃ অধিকারী, তার পশ্চাতে মিঃ মল্লিক, বৃন্দাবন সরকার ও শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।

কি ব্যাপার ডাঃ অধিকারী, আপনারা–

মধুসূদনকে কথাটা শেষ করতে দিল না কিরীটী। সে বললে, সকলকেই আজ এখানে আমি ডেকে আনিয়েছি।

কিন্তু ব্যাপারটা কি?

আপনি শুনে হয়ত খুশী হবেন মিঃ সরকার, কিরীটী বললে, সারদাবাবু দশরথ, বিজনবাবু ও গোকুলের হত্যারহস্যের মীমাংসা

মীমাংসা! কথাটা বললেন বৃন্দাবন সরকার।

হ্যাঁ বৃন্দাবনবাবু, সেই রহস্যের মীমাংসার জন্যই আজ সকলে আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি।

কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই কেমন যেন একটু বিব্রত ও অস্বােয়াস্তি বোধ করছেন বোঝা গেল।

কিরীটী কিন্তু একান্ত নির্বিকার।

একটা অখণ্ড স্তব্ধতা যেন ঘরের মধ্যে থমথম করছে।