অর্জ্জুন বলেন, শুন বিরাট-নন্দন।
দশ নাম-হেতু তোমা বলিব এখন।।
হস্তিনা নগরে পূর্ব্বে ছিলাম যখন।
আমার জননী পূজা করে পঞ্চানন।।
স্বয়ম্ভূ পাষাণ লিঙ্গ নাম যোগেশ্বরে।
রাজপত্নী বিনা অন্যে পূজিতে না পারে।।
প্রভাতে উঠিয়া মাতা করি স্নান দান।
নানা উপচারে হরে পূজিবারে যান।।
যেইরূপে শিবলিঙ্গ পূজিতে জননী।
সেইরূপে সদা পূজে সুবলনন্দিনী।।
দোঁহে শিব পূজে, কেহ কাহারে না জানে।
দৈবযোগে দোঁহাকারে দেখা এক দিনে।।
গান্ধারী বলেন, কুন্তী কেন তুমি হেথা।
ফল পুষ্প দেখি, বুঝি পূজিতে দেবতা।।
মাতা বলে, সদা আমি করি যে পূজন।
তুমি বল এই স্থানে কিসের কারণ।।
গান্ধারী বলেন, রাঁড়ি এত গর্ব্ব তোর।
কিমতে পূজিস্ লিঙ্গ, সংপূজিত মোর।।
রাজার গৃহিনী আমি, রাজার জননী।
কোন ভরসায় তুমি পূজ শূলপাণি।।
মাতা বলে, গান্ধারী গো বল কেন এত।
তুমি জ্যেষ্ঠা ভগিনী যে, তেঁই বল যত।।
যেই দিন আমি আসিয়াছি কুরুকুলে।
সর্ব্বলোকে জানে আমি পূজি ফল ফুলে।।
কত দিন আছিলাম বনের ভিতর।
সেই হেতু পূজিবারে পেলে যোগেশ্বর।।
এখন আপন দেশে আসিলাম আমি।
আমার পূজিত লিঙ্গ কেন পূজা তুমি।।
জিজ্ঞাসহ ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র বিদুরেরে।
মম এই ইষ্টলিঙ্গ কে পূজিতে পারে।।
গান্ধারী বলিল, ছাড় পূর্ব্ব অহ্ঙ্কার।
এখন তোমার শিবে কোন্ অধিকার।।
সবাকার অনুমতি, পূজি আমি হরে।
আপনি জিজ্ঞাস গিয়া সবাকার তরে।।
দূর কর ফল পুষ্প, যাহ হেথা হৈতে।
ভাল নাহি হবে পুনঃ আসিলে পূজিতে।।
মাতা বলে, যত দিন নাহি ছিনু দেশে।
তেঁই সবে বুঝি বলে পূজিতে মহেশে।।
পুনশ্চ ভগিনী আর না আসিও হেথা।
শিবপূজা কৈলে দ্বন্দ্ব ঘটিবে সর্ব্বথা।।
এইমত দ্বন্দ্ব হয় দুই ভগিনীর।
লিঙ্গ ভেদি সদাশিব হলেন বাহির।।
কহিলেন, কেন দ্বন্দ্ব কর দুই জন।
দ্বন্দ্ব ত্যজি শুন দোঁহে আমার বচন।।
সবাকার ইষ্ট আমি, সবে পূজা করে।
কার শক্তি আছে মোরে অংশ করিবারে।।
অর্দ্ধ অঙ্গ হয় মম পর্ব্বত-কুমারী।
কোন জন নিতে নারে মোরে অংশ করি।।
তোমা দোঁহে কুরুবধূ সমান ভকতি।
দোঁহের পূজায় হয় মোর বড় প্রীতি।।
আপনার বলি বল, আমি কারু নই।
কিন্তু রাজরমণীর পূজ্য আমি হই।।
দোঁহে রাজপত্নী তোমা, দোঁহে রাজমাতা।
উভয়ে আমার পূজা করহ সর্ব্বথা।।
এক জন হয়ে যদি চাহ পূজিবারে।
তবে মম দৃঢ় বাক্য কহি দোঁহাকারে।।
কনকের দল হবে, মাণিক্য কেশর।
সুগন্ধি সহস্র চাঁপা, অতি মনোহর।।
রজনী প্রভাতে যেই প্রথমে পূজিবে।
নিশ্চয় জানিহ শিব তাহারি হইবে।।
এমত বিধানে যেই করিবেক পূজা।
তার পুত্র জানিহ এ রাজ্যে হবে রাজা।।
শুনিয়া শিবের বাক্য গান্ধারী উল্লাস।
মাতারে চাহিয়া বলে করি উপহাস।।
নিশ্চয় তোমার এবে হৈল মহেশ্বর।
পুত্রগণে চম্পা মাগি আনহ সত্বর।।
এত বলি নিজ গৃহে করিল গমন।
ডাকাইয়া আনাইল শত পুত্রগণ।।
কহিল কুন্তীর সহ দ্বন্দ্ব যেই মতে।
হেম চাঁপা দেহ, শিবে পূজিব প্রভাতে।।
সাক্ষাৎ ইহা কহিলেন ত্রিপুরারি।
যে পূজিবে, তার পুত্র রাজ্য-অধিকারী।।
শুনি দুর্য্যোধন আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।
সহস্র সহস্র আনাইল কর্ম্মিগণ।।
মণিমুক্তা দিল চন্দ্র জিনিয়া কিরণ।
ভাণ্ডার হইতে দিল স্বর্ণ শত মণ।।
আমার জননী শুনি হরের বচন।
অতি দুঃখ চিত্তে চলে, আপন ভবন।।
স্বামীহীন, পুত্র শিশু, সহজে দুঃখিত।
পরগৃহে বঞ্চি পর-অন্নেতে পালিত।।
কি করিব, কি হইবে, চিত্তে ভাবি দুঃখ।
কারে কিছু নাহি কহিবাহে অধোমুখ।।
ভোজন সময় হৈলে আসে ভ্রাতৃগণ।
ক্ষুধায় আকুল ভীম মাগিল ভোজন।।
অন্ন দেহ মাতা বলি ডাকে বৃকোদর।
দুঃখেতে আবৃত মাতা, না দিল উত্তর।।
উত্তর না পেয়ে ভীম অধিক কুপিল।
রন্ধন সামগ্রী ছিল সাক্ষাতে দেখিল।।
সকল লইল ভীম দুই হাতে করি।
থরে থরে রাখে বীর ধর্ম্ম বরাবরি।।
ধর্ম্ম কন, নিজে খাদ্য কেন আন হেথা।
ভীম কন, মাতা কেন নাহি কহে কথা।।
দ্বিতীয় প্রহর বেলা, অন্ন নাহি হয়।
জিজ্ঞাসিলে মাতা কিছু, কথা নাহি কয়।।
অস্ত্রশিক্ষা পরিশ্রমে দহে ক্ষুধানল।
সে কারণে আনিলাম আমান্ন সকল।।
রন্ধন হইলে অন্ন খাব রাজা পাছু।
আজ্ঞা হৈলে এইমত খাই কিছু কিছু।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, খাবে কোন্ সুখে।
জননী আছেন কেন জান অধোমুখে।।
কি দুঃখে তাপিতা মাতা, না জানি কারণ।
আমান্ন করিবে ভাই কিমতে ভক্ষণ।।
পুনঃ গিয়া শীঘ্র ভাই জিজ্ঞাসহ মায়।
কি হেতু বসিলে হেঁট করিয়া মাথায়।।
ভীম বলে, আমা হতে নহে নরবর।
অনেক ডাকিনু, মাতা না দিল উত্তর।।
ক্ষুধানলে দহে অঙ্গ, কম্পিত সঘন।
এত বলি বৈসে হেঁট করিয়া বদন।।
সহদেব নকুলেরে পাঠান রাজন।
কাহারে কিছুই মাতা না বলে বচন।।
আমারে করিল আজ্ঞা ধর্ম্ম নরপতি।
জননীর পায়ে ধরি করিনু মিনতি।।
তুমি দুঃখচিত্ত, রাজা দুঃখিত হইল।
ক্ষুধায় আকুল ভীম কুপিয়া রহিল।।
সহদেব নকুল যে ক্ষুধিত অপার।
আজ্ঞা কর জননী গো কি দুঃখ তোমার।।
শুনিয়া কহেন মাতা করিয়া ক্রন্দন।
দোঁহাকার পাশে যথা শঙ্কর বচন।।
সহস্র কাঞ্চন চাঁপা চাহে ত্রিলোচন।
গান্ধারী আজ্ঞায় সব গড়ে শিল্পিগণ।।
কি করিবে তোমা সবে, কি হবে কহিলে।
এই হেতু দহে অঙ্গ দুঃখের অনলে।।
আমি কহিলাম, মাতা এবা কোন্ কথা।
যত পুষ্প চাহ, আমি তত দিব মাতা।।
মাতা বলে, কেন তুমি করহ ভণ্ডন।
তুমি কোথা হৈতে দিবে, কোথা পাবে ধন।।
আমি কহিলাম, মাতা ত্যজ চিন্তা মন।
আমি কহিলাম, মাতা ত্যজ চিন্তা মন।
কোন্ বড় কথা হেতু করিব ভণ্ডন।।
রন্ধন করহ মাতা, অন্ন জল খাহ।
আমি দিব পুষ্প আনি, তুমি যত চাহ।।
শুনি হৃষ্টা হৈয়া মাতা করিল রন্ধন।
সবাকারে অন্ন দিয়া করান ভোজন।।
কতক্ষণে বলিলেন পুষ্প দেহ আনি।
সমস্ত দিবস গেল হইল রজনী।।
কখন কনক পুষ্প দিবে মোরে আর।
এইমত মাতা মোরে কহে বারে বার।।
আমি যত বলি মাতা প্রবোধ না হয়।
সমস্ত রজনী গেল প্রভাত সময়।।
ধনুক লইয়া আমি গুণ চড়াইয়া।
সন্ধানী যুগল অস্ত্র উত্তর চাহিয়া।।
দ্রোণাচার্য্য গুরুপদে নমস্কার করি।
বায়ব্য যুগল মনোভেদী অস্ত্র মারি।।
কাটিয়া কুবেরপুরী পুষ্পের কানন।
বায়ু অস্ত্রে উড়াইয়া করি বরিষণ।।
সুগন্ধি কনক-পদ্ম চম্পক-মিশ্রিত।
শিবের উপরে বৃষ্টি হৈল অপ্রমিত।।
বাহির ভিতর আর দেউল উদ্যান।
পুষ্পেতে পূর্ণিত হৈল, নাহি হেন স্থান।।
জননীকে বলিলাম, যাহ স্নান করি।
পুষ্প আনিলাম গিয়া পূজ ত্রিপুরারি।।
কৌতুকে জননী গিয়া মহেশে পূজিল।
তুষ্ট হয়ে সদানন্দ মায়ে বর দিল।।
তব পুত্রগণ হবে কুরুকুলে রাজা।
আজি হৈতে একা তুমি কর মম পূজা।।
আমারে সন্তুষ্ট হয়ে বলেন বচন।
ধনপতি জিনি তুমি করিলে পূজন।।
আজি হৈতে নাম তব হৈল ধনঞ্জয়।
সেই হৈতে মোর নাম ধনঞ্জয় হয়।।
উত্তর কহিল, কহ বীর চূড়ামণি।
কি করিল শুনি তবে সুবলনন্দিনী।।
অর্জ্জুন বলেন, প্রাতে উঠিয়া গান্ধারী।
সহস্র কনক-পুষ্প হেমপাত্রে করি।।
কুসুম চন্দন আর বহু উপাচারে।
নারীগণ সহ যান পূজিতে শঙ্করে।।
শিবের আলয় দেখি পুষ্পেতে পূর্ণিত।
যাইতে নাহিক পথ, কে করে গণিত।।
দেখিয়া গান্ধারী দেবী বিষণ্ণ বদন।
কুন্তীরে দেখিয়া বলে, কহ বিবরণ।।
মাতা বলে, এই পুষ্পে পূজিলাম আমি।
বর দিয়া নিজ স্থানে গেল উমাস্বামী।।
শুনিয়া গান্ধারী ক্রোধে পুষ্প জলে ফেলে।
গৃহে গিয়া নিজ পুত্রগণে মন্দ বলে।।
সাধু কুন্তী, সাধু পুত্র গর্ভেতে ধরিল।
অকারণে শত পুত্র আমার জন্মিল।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।