২১. অন্ধকার রাতে এক অন্ধ রেলগাড়ি

একুশ – অন্ধকার রাতে এক অন্ধ রেলগাড়ি

সেবছর বর্ষা খুব জমে উঠেছিল। স্বর্ণের উঠোনে লকলক করে লতিয়ে উঠে সবজিলতা, সন্ধ্যামণির ঝাড়ে ফুল ফোটে, গজিয়ে ওঠে ঘাস আর আগাছার ঝাড়। তার উদাসীন দৃষ্টিকে চমকে দেয় ওই আগুয়ান সবুজ ষড়যন্ত্রজাল। আঁরোয়ার জঙ্গলে চারদিক থেকে লতাপাতায় ঘিরেফেলা অনেক আচ্ছন্ন নির্জীব গাছ সে দেখেছে। তারপর একদা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে একটা ধূসর কংকাল, বাকলে ফাটল, খড়িখড়ি ও উদ্দেশ্যহীন একটা অস্তিত্ব শুধু। স্বর্ণ শিউরে উঠে। নিজের অস্তিত্বসুদ্ধ গোটা বাড়িটা আক্রান্ত।

আনন্দর দুষ্টামির শেষ নেই। বারবার তাকে খুঁজে আনতে হয়। কেউ ধরে দিয়ে যায়—’এই দেখুন, সিষ্টিছাড়া ছেলেটা কোদলার ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কোমরে দড়ি বেঁধে রাখুন ডাক্তারদিদি।’

একদিন সন্ধ্যার ট্রেনে তাকে কাটোয়া জংশন থেকে কুড়িয়ে এনে দিয়ে গেলেন এক গার্ডসায়েব। স্বর্ণকে এ লাইনে রেলের লোকজন সবাই চেনে।

এরপর তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হয়। পাদরির ভয় দেখাতে হয়। কিন্তু পাদরি সাইমনকেও আর ডরায় না ছেলেটা। অকুতোভয়ে তার আস্তানার সামনে দিয়ে কতবার আনাগোনা করেছে। দূর থেকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। কিন্তু ফাদার সাইমন এখন তল্পী গুটানোর তালে আছেন। যারা সব খ্রিস্টান হয়েছিল, ভেতর—ভেতর গোবর খেয়ে জাতে ঢুকছে ফের। তাতে স্বদেশিবাবুদের আনাগোনা বেড়েছে তল্লাটে। ফাদার সাইমন চলে যাবেন তাই পলাতক শিকারটির প্রতি তাঁর আগ্রহ আর নেই।

সেই সময় এক সকাল দশটায় চাঁদঘড়ি খবর আনল। আপে তিনপাহাড়ি স্টেশন থেকে সুধাবাবু টেলিগ্রাম করেছে। সুধাবাবু এখন স্টেশনমাস্টার। চিরোটির নতুন স্টেশনমাস্টারকে অনুরোধ করেছে যথাস্থানে বার্তাটি পৌঁছে দিতে।

বার্তাটি হল : ভোর ছটায় গোরাংবাবু আচমকা মূর্ছিত হয়ে পড়েন এবং ডাক্তার এসে পড়ার আগেই মারা যান। উন্মাদ আশ্রম থেকে লাশ ডেলিভারি নিয়ে সুধাময় অপেক্ষা করছে স্বর্ণলতার। বাবার লাশটি সে নিয়ে যাক। কারণ, গোরাংবাবুর বরাবর ইচ্ছে ছিল, কোদলাঘাটের প্রিয় পরিচিত শ্মশানেই তিনি পুড়বেন।

স্বর্ণ তখনই বেরিয়ে পড়েছিল। আনন্দকেও সঙ্গে নিয়েছিল। পরের আপ ট্রেন দুপুর একটায়। তার আগে মাথা খুঁড়লেও কিছু করার নেই।

তিনপাহাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বেজে যায়।

সুধাময় বলেছিল পৈতে ছুঁয়ে, বিয়ে করবে না এবং স্বর্ণের ভাই হয়ে থাকবে। প্রথম প্রতিজ্ঞাটা সে রাখতে পারেনি। বিমলা নামে এক দজ্জাল মোটাসোটা মেয়ের পাণিগ্রহণ করে ফেলেছিল। দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞাটা অবশ্য রাখতে অসুবিধা হবার নয়।

ভাইয়ের কাজ অনেকটাই সে করল। নিজের আসার অসুবিধে ছিল, সেজন্য খুব দুঃখপ্রকাশ করল। এবং একটা মালগাড়ির পিছনের দিকে গার্ডের কামরার সামনে একটা খালি বগি ছিল, তাতে গোরাংবাবুর লাশটা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। গাড়ি ছাড়ার মুখে বলে গেল—’কীভাবে পৌঁছলেন, সব জানাবেন।’ তারপর গাড়িটা চলতে শুরু করলে পাশে কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে এলোমেলো কিছু কথাও বলল। শেষে বলল—’কী মুশকিল! এঞ্জিনটা কানা দেখছি যে। ওহে গার্ডসাহেব আলোর কী হল?’

গার্ডসায়েব বললেন—’বিগড়েছে। জংশনে গিয়ে দেখব’খন।’

স্বর্ণ আর আনন্দ আসছিল গার্ডসায়েবের সঙ্গে। এঞ্জিনে আলো নেই শুনে স্বর্ণের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু গার্ডসায়েবটি বাঙালি। বিনয়ের অবতার। ঝিরঝিরে বৃষ্টির রাতে সুন্দরী স্ত্রীলোককে পরলোক—তত্ত্ব বোঝালেন। সান্ত্বনা দিলেন মুহুর্মুহু। বললেন, ‘তবে যদ্দিন আছি তদ্দিন লাইফটা কাজে লাগানো ভালো। আমরা কেউ কেউ বুঝিনা। যেমন দেখুন না, এই আমি। শুধু গাড়ির পেছনে পাথরের টুকরোর মতো নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছি। ঘোরো এখন খামোকা কাঁহা কাঁহা মুল্লুক, ঘট ঘটাং ঘট ঘটাং! বলুন না মাল যাচ্ছে গাড়ি যাচ্ছে তো আমি শালার কী? অহিভূষণ অহিভূষণই আছে। রেলের গার্ড! চালাকির আর জায়গা পাইনি! কে কাকে গার্ড দেয়? বলুন না, আপনিই বলুন?’

শোকাতুর স্বর্ণ কিছু বলতে পারে না। কিছু বুঝতেও পারে না। এত কাছে মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে বসে থাকতে তার অস্বস্তি হয়। সব গুলিয়ে যায়, জীবন ও মৃত্যুর যা কিছু ব্যাপার।

সুধাময় বলেছে, ‘আপনি তো এখন মুক্ত। কেন শোক করবেন? এবার নতুন দমে ছুটতে শুরু করুন। দেখবেন, পিছুটান না থাকলে কত জোরে দৌড়ানো যায়। আমি টের পেয়েও নিজেকে সামলাতে পারিনি। আটকে দিয়েছে খুঁটিতে।’

সুধাময় তাকে আপনি সম্বোধন করেছে। সুধাময়ের বউ বিমলা খুব একটা আলাপ করেনি। কোনোভাবে জেনে থাকবে যে এই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে তার স্বামীর কিছুকিঞ্চিৎ ঢ্যামনামো ছিল। হয়তো সুধাময় নিজেই নিজের উৎকর্ষ বোঝাতে সে প্রসঙ্গের অবতারণা করে থাকবে বউয়ের কাছে। বিমলা হিংসুটেপনা দেখিয়েছে সন্দেহ নেই। মেয়েদের চাহনি ও হাবভাবের যাবতীয় কোড ডিসাইফার করতে মেয়েরাই পারে। স্বর্ণর তখন হাসির মন ছিল না বা ক্রোধেরও। তাই এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফেরার পথে খচখচ করছিল কাঁটা।

‘—তা এই বুঝি আপনার ছেলে?’ বলেই জবাব না শুনে অহিভূষণ গার্ড আনন্দকে কোলে টানেন।—’কী নাম বাবা খোকা? কোন ক্লাসে পড়ো? স্কুলের নাম কী?’

আনন্দ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে যায়। খোলা জায়গাটায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। বৃষ্টিতে ভেজে। অহিভূষণ হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন। ‘—পড়ে যাবে, পড়ে যাবে খোকা!’

স্বর্ণ ডাকে—’চলে আয়। ভিজছিস কেন?’

‘ছেলেরা দুষ্টুই হয়। আমিও কম কি ছিলাম?’ গার্ডসায়েব বলেন। এসময় আনন্দ দৌড়ে ফিরে আসে। মুখে হাসি। গার্ডসাহেব ফের বলেন—’নাম বলোনি, আড়ি দাও।’ কড়ে আঙুল বাড়ান তিনি। আনন্দ তাকায়ও না।

স্বর্ণ নামটা বলে দেয় ভদ্রতাবশত। ‘—আনন্দ।’

‘আনন্দ! বাঃ বেশ নাম! আনন্দ কী?’

স্বর্ণ নির্দ্বিধায় বলে দেয়—’রায়।’

গার্ডসায়েব অপ্রস্তুত হাসেন। ….’হ্যাঁ, তাও তো বটে। সুধাবাবু বলেছিল, আপনারা ব্রাহ্মণ। এইরে! আবার জোর লাগল বিষ্টিটা! দরজা আটকে দিই।’

দরজা আটকে দিয়ে তিনি বড় সিন্দুকের মতো বাকসের পিঠে বসলেন। আনন্দ জানলায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বর্ণ বলে—’পৌঁছতে ভোর হয়ে যাবে, তাই না?’

‘ভোর কী বলছেন? গুডসট্রেনের এই তো ঝামেলা। আজিমগঞ্জ জংশনে কতক্ষণ আটকাবে ঠিক নেই। লুপ লাইন কিনা! আমার তো মনে হচ্ছে সকাল আটটা বাজতে পারে, আবার আগামী দিন সন্ধ্যা ছটায় পৌঁছানোও বিচিত্র নয়।’

স্বর্ণ অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয় একটু। কিছু বলে না।

‘জংশনে কেউ যেন টের না পায় ডেডবডি যাচ্ছে! শালা সায়েবদের মর্জি বোঝা বড্ড কঠিন। তবে ভাববেন না। বাই দা বাই, এত রাতে ডেডবডি নামাবার লোক পাবেন কোথায়, বলুন তো?’

স্বর্ণ কথাটা ভাবেইনি। এখন একটু চমকে ওঠে। তাই তো!

‘আমি আপনাকে সাহায্য করব, বরং। ভ্যাকুয়াম ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করার। তারপর…ঠিক আছে, ভাববেন না। বামুনের মড়া। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

স্বর্ণ ভাবে, চাঁদঘড়ি কি আসবে না তার ডাকে? দাহ করার ব্যবস্থায় কোনো অসুবিধে হবে মনে হয় না। চাঁইপাড়ায় খবর দিতে দেরি শুধু।

গার্ডসায়েবটি অনবরত বকবক করছে। একটু থামলে ভালো হয়। থামে না। ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট শব্দের সঙ্গে চাপা বৃষ্টির শনশন শব্দ মিশে একঘেয়েমির অন্ত নেই। বমিভাব আসে স্বর্ণের। সে হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকে।

অগত্যা গার্ডসায়েব আনন্দকে নিয়ে পড়েন। ….

আজিমগঞ্জ জংশনে আসতে সত্যিসত্যি অনেক রাত হল। ঘন কালো রঙ লেপটে আছে চারদিকে—তার মধ্যে আলোর কিছু ফুলকি। গঙ্গার স্টিমারের ভোঁ শোনা যাচ্ছিল। অহিভূষণ টানাটানি করে নিয়ে যান আনন্দকে। বাচ্চা ছেলের না খেলে চলে? বাইরের সান্টিং লাইনে মালগাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশেই ঘন জঙ্গল, তার ওপাশে কূলে কূলে ভরা গঙ্গা। ফাঁকে ফাঁকে আলো চিকমিক করছে দূরে। উলটো পাশে স্টেশনটা নিঃঝুম। জোর বৃষ্টি হচ্ছে। স্বর্ণ চুপচাপ জড়োসড়ো বসে থাকে। শীত শীত করছে এবার। সামনের কুলিবগীর দরজা আটকানো রয়েছে। একটু পরে ঝোপে শেয়াল দৌড়ে লাইনের ওপাশে, যাচ্ছে দেখা গেল। তখন স্বর্ণর বুক কাঁপে, জানালা গলিয়ে ঢুকে পড়বে না তো গোরাংবাবুর কাছে?

সময় আর কাটতে চায় না। বৃষ্টি ছাড়ে না, বাতাস থামে না। গঙ্গার স্টিমার দুর্জ্ঞেয় কারণে মাঝে মাঝে ভোঁ বাজায়। তারপর গার্ড সায়েব আর আনন্দ এল। গার্ড সায়েবের হাতে একটা মাটির মালসা। শালপাতায় ঢাকা। আনন্দর মুখ প্রসন্ন। কাছে এসে ফিসফিস করে সে—’ভাত মাছ ডাল তরকারি সব খেলাম। মা, তুমি খাবে না?’

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণ মাথা নাড়ে।

অহিভূষণ বলেন—’প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। আপনি একটু আধটু খেয়ে নিন—এতে দোষ নেই। ধরুন।’

স্বর্ণ তীব্র আপত্তি করে। —’না, না।’

‘না কেন? কখন ছাড়বে ব্যাটারা, ঠিক নেই। দু ঘণ্টা পরে লাইন ক্লিয়ার পেতে পারি শুনলাম। আপনি এগুলো….’

‘না।’

আরও কিছুক্ষণ অনুরোধের পর অহিভূষণ মালসাটা ওপরে বাঙ্কে তুলে রাখেন। আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলেন—’কী? ঘুম পেয়েছে তো? হু—না পেয়ে পারে?’ তারপর সেই বড় বাকসোটার ওপর কম্বল বিছিয়ে দেন।

আনন্দ অমনি শুয়ে পড়ে। অহিভূষণ স্বর্ণকে বলেন—’আপনারও তো শোওয়া দরকার। ওই বেঞ্চে শোন। একটা চাদর দিচ্ছি।’

স্বর্ণ বলে—’থাক শোব না।’

আনন্দর কাছে হেলান দিয়ে বসে অহিভূষণ গল্প করতে থাকে। তার জীবনী শোনান। সুধাময়েরই এলাকার লোক তিনি। তবে কোনো বন্ধন নেই, খুব মুক্ত মানুষ। ঘরসংসারের সাধ তাঁর নেই। বেশ তো আছেন! গাড়িতে গাড়িতে ঘুরছে কাঁহা কাঁহা মুল্লুক। সবখানেই ঘর, সব্বাই আপনজন। ঈশ্বর যাকে এতবড় সংসার দিয়েছেন, সে আর কোনো তুচ্ছ সংসারে আটকাতে চাইবে বলুন আপনি? এবার আপনার ঘুম পেয়েছে নির্ঘাৎ? পাইনি? আপনিও দেখছি রেলমানুষ হয়ে গেলেন। একবার হল কী, এমনি বৃষ্টির রাত। আসছি মোতিহারির দিক থেকে। সিগনাল না পেয়ে মাঠের মধ্যে মালগাড়িটা দাঁড়াল। দাঁড়াল, দাঁড়িয়েই রইল। খুব বিপজ্জনক সময় এগুলো। ডাকাতি ওদিকটায় প্রায় হয়। মালগাড়ির দরজা ভেঙে মাল লুঠ করে ব্যাটারা। বুঝলেন? যে—সে ডাকাত নয়, ঘোড়ায় চড়া ডাকাত সব। তা সেই মাঠে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ ভিজতে ভিজতে—বললে বিশ্বাস করবেন না, এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়েছেলে হাজির! আমি তো হতভম্ব। এই মাঠের মধ্যে বৃষ্টিতে এ কোত্থেকে এল রে বাবা? এসেই লাফ দিয়ে ওখানটায় চড়ে বসল। বললাম—কে আপনি? কী চান? বেশ ভদ্রলোকের মেয়ে। দিব্যি হাসছে। কোনো কোথা নেই মুখে। ভাবলাম, নির্ঘাৎ পালিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। যাই হোক, বৃষ্টির মধ্যে বেচারা আর যাবেই বা কোথায়? বললাম—স্টেশনে গিয়েই কিন্তু নামিয়ে দেব। কোনো কথা শুনব না। শুধু হাসে সে। পাগল নয় তো? সন্দেহ হল। কিন্তু বুঝতে পারলাম না। তীক্ষ্নদৃষ্টে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। মানুষের এমন চোখ হতে পারে, ভাবা যায় না! অদ্ভুত নীলচে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। অস্বাভাবিক। ইতিমধ্যে সিগনাল সবুজ হতেই গাড়ি চলতে শুরু করছে। সামনের স্টেশনটা ছোট। গাড়ি দাঁড়াবে না। গাড়ি ইচ্ছে করলে আমি অবশ্য থামাতে পারি। কিন্তু এমন হতচকিত অবস্থা যে স্টেশন কখন পেরিয়ে গেল। তারপর দেখি, মেয়েটি নিজের পরনের কাপড় খুলতে শুরু করেছে। আমি আরও হতভম্ব হয়ে মুখটা ঘোরালাম অন্যদিকে। টের পেলাম ও সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বুঝলেন? একেবারে নেকড। তখন গাড়ি বেশ জোরে ছুটেছে। আমি জেনে গেছি, এ পাগল ছাড়া কিছু নয়। জোর করে শাড়ি পরানোর জন্যে যেই গেছি, অমনি বেরিয়ে গাড়ি থেকে লাফ দিল! এই দেখুন, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। হ্যাঁ—লাফ দিল অন্ধকারে। একটা চেঁচানি শুনতে পেলাম যেন। কী করা উচিত ভাবছি হঠাৎ দেখি—আশ্চর্য, সেই উলঙ্গ মেয়ে ওখানটায় রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে তেমনি দৃষ্টি। আর এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, ওর গায়ে একফোঁটাও বৃষ্টি লাগছে না—শুকনো একেবারে। অমনি আমি ফেন্ট হয়ে গেলাম। তারপর কী হয়েছে জানি না। জ্ঞান যখন হল, দেখি ভোরের আলো ফুটেছে। গাড়ি সামনে চলেছে। সে এক আশ্চর্য ঘটনা!’

স্বর্ণ আসতে বলে—’ভূতপ্রেত?’

—’তাছাড়া কী বলব? কে কখন কী বেশে দেখা দেয়, বলা খুব কঠিন। এই যে আপনি’…গার্ডসায়েব হাসতে থাকেন। ‘কে বলবে আপনি কী?’

অগত্যা স্বর্ণ একটু হাসে মাত্র।

‘সত্যি। কিছু বলা যায় না! এমন তো হতে পারে, আমি যখন আনন্দকে নিয়ে খেতে গেলাম, তখন অন্য কেউ আপনার চেহারায় এসে ঢুকেছে!’

‘আমি গেলাম কোথায়?’

‘আপনাকে…ধরুন, মেরে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে! বিশ্বাস নেই কিচ্ছু!’

স্বর্ণ শিউরে ওঠে এতক্ষণে। না—ভূতের জন্যে নয়। সে ছেলেবেলা থেকে নিজের জোরে মানুষ। বনবাদাড় সন্ধ্যাসকাল নির্জনতা গভীর রাত তার জীবনের সঙ্গে একাকার। একলা থাকা যার অভ্যাস বরাবর, তার কাছে ভূত আসতে সাহস পায় না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেছে এই গাড়ির এঞ্জিনে কোনো আলো নেই। কোথায় নিয়ে যাবে তাকে এই অন্ধ ট্রেনটা?

একটু পরে স্বর্ণ বলে—’আমাকে মেরে ফেলা কি খুব সহজ মনে করেন?’

অহিভূষণ মাথা দুলিয়ে বলেন—’পাগল নাকি! ওটা কথা নয়! তবে কী জানেন, প্রেতশক্তি বলে একটা কিছু তো আছেই। বাসনাকামনা নিয়ে যে মরে যায় সে কি মরেও মরে?’

এই সময় লাইন ক্লিয়ার এল। খালাসি চলে গেল। একটু পরেই গাড়ি ছাড়ল। অহিভূষণ বেরিয়ে গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ফাঁকা পাটাতন থেকে নিশান দোলাতে থাকেন। হুইসল বাজান। স্টেশন এলাকা পেরিয়ে যেতে থাকে গাড়ি।

ফিরে এসে বলেন—’আর তো এসেই গেলেন! মধ্যে তিনটে স্টেশন মাত্র। টানা গেলে একঘণ্টাও লাগবে না। ঠিক জায়গায় ভ্যাকুয়াম ব্রেক কষব।’

রেল লন্ঠনটার দম বাড়িয়ে দেন গার্ডসায়েব। এই ভূতুড়ে আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। কিন্তু আবার অস্বস্তি জাগে স্বর্ণর। বৃষ্টি কমছে না, দরজা বন্ধ না করলে বাতাসের ঝাপটা আসছে পাটাতনের দিক থেকে। বৃষ্টির ছাঁটে মেঝে ভিজে রয়েছে। সে পা দুটো তুলে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। তারপর দেখে গার্ডসায়েব তার সাদা রেলকোট খুলল। তারপর দরজাটা ভালো করে আটকে দিল।…

অহিভূষণ বলেছিলেন—কে কাকে গার্ড দ্যায়!

এক প্রবল ও অতর্কিত প্রেমাবেগের গোড়ায় হিংসার চাপ ছিল কম। ক্রমে হিংসা হু হু করে এসে পড়েছিল। ধস্তাধস্তিতে চলন্ত মেঝের পাটাতন প্রচণ্ড কেঁপেছিল। মাটির মালসাটা এবং আরও কিছু খুচরো জিনিস উলটে পড়েছিল। অহিভূষণ পায়ে পা জড়িয়ে সাড়ে তিনহাত নারীমাংসকে ধরাশায়ী করতে লড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হতভাগা ছেলেটার ঘুম এতকরেও ভাঙেনি।

বাইরের দুর্যোগের মধ্যে এঞ্জিনের বাঁশি আবছা শোনা যাচ্ছিল। তারপর বেগ কমতে কমতে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। তখন অহিভূষণের দুটো হাতেই দাঁতের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত। গেঞ্জি তলপেটে ঝুলছে। ইতিমধ্যে রেললন্ঠনটাও উলটে যায় এবং বাতি নেভে। কাচ ভাঙে। তারপর অন্ধকারে ধুন্ধুমার উপদ্রব শুরু হয়।

স্বর্ণর শাড়িটা কোমর থেকে মেঝেয় ছড়ানো, সেমিজের ওপরদিকটা ফালা ফালা হয়ে ঝুলে পড়ল। তার বুকের ওপর আঁধোয়া জঙ্গলের ভূতুড়ে সেই বাঘটার মাথার মতো একটা মাথা নেমে এল। তখন স্বর্ণ মেঝেয় পড়ে গেল। অহিভূষণের ভারী শরীর তার ওপর চেপে বসল। আর অহিভূষণের গোঙানি শোনা গেল—’একবার মাইরি বলছি—মাত্র একবার।’

হঠাৎ তাঁর প্রেমজর্জরিত গোঙানি একটা প্রচণ্ড চিৎকারে ছত্রখান হয়। আ আঁ আঁ আঁ! স্বর্ণর দুইহাত প্রেমিকপুরুষটির ভাইটাল প্রত্যঙ্গে একটা কিছু ঘটায় নিশ্চয়। নেতিয়ে পাশে পড়ে যান ভদ্রলোক। ….অ্যাঁ…অ্যাঁ…আঁ…আঁ! আরও নিষ্ঠুর চাপ এবং বীভৎস চিৎকার ও ছটফটানি। স্বর্ণ উঠে বসতে বসতে আবার মোচড় দেয়। আঁউ—উ…উ…উ। অহিভূষণ প্রচণ্ড চেঁচিয়ে চুপ করে যায়।

অন্ধকারে হাঁফাতে হাঁফাতে ওঠে স্বর্ণ। হাতড়ে—হাতড়ে শাড়িটা পায়। বুকের কাছে সেমিজে গিঁট পাকায়। তারপর শাড়ি জড়িয়ে আনন্দকে ডাকে। আন্দাজে এগিয়ে তার গায়ে ধাক্কা দেয়। ছেলেটি ঘুমে ডুবে আছে। সাড়া পায় না। তাকে খামচাখামচি করে। টেনে ওঠায়। কিন্তু সে আবার গড়িয়ে পড়ে কম্বলে।

এই সময় হুইসেল দিয়ে আবার চলতে শুরু করে রাতের মালগাড়ি। তখন সাবধানে দরজা খোলে স্বর্ণ। জোরে বৃষ্টি পড়ছে। খোলে পাটাতনে বাতাসেরও ঝাপটানি প্রচণ্ড। ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে আসে সে। একটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। গতি কম থাকায় প্লাটফর্মের ল্যাম্পপোস্টে নামটা পড়া যায়। খাগড়াঘাট রোড। তাহলে এসে গেল চিরোটি! একটু ভেবে নেয়। একটা নদী পড়বে সামনে। এখন বর্ষার কূলেকূলে ভরে আছে নিশ্চয়। স্বর্ণ এবার নিজের কাজের পরিণাম হিসেব করতে গিয়ে প্রচণ্ড শিউরে ওঠে। এবার তার হু হু করে কান্না আসে। প্রচণ্ড কাঁদে সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। নির্ঘাৎ লোকটাকে সে মেরে ফেলেছে! তারপর সেই কান্নার মধ্যে অহিভূষণকে টানতে টানতে বের করে খোলা পাটাতনে; রেলিঙের কাছে নিয়ে রাখে। সামনে রেলিঙ, দুপাশে ফাঁকা। ঠেলে দিলেই গড়িয়ে নিচে পড়বে। আবার আতঙ্ক আর দ্বিধা জাগে। তখন চোখের জল মোছে। কান পাতে কখন সামনের দিকের চাকাগুলোয় চেনা সেই গুমগুম আওয়াজ শোনা যাবে।

কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়। আর সেইসময় হঠাৎ অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেরু বাউরিকে দৌড়তে দেখে। সামনে চলেছে সেই বিশাল ছায়া, স্বর্ণের দিকে মুখটা ফেরানো। স্বর্ণ চেঁচিয়ে ডাকতে চায় তাকে। গলায় বোবা ধরে যায়। সে হাঁপাতে থাকে। তার মনে হয়, হেরু তাকে কিছু বলছে। সে বুঝতে পারে না। হেরু কি পালিতবাবুর মতো আরেকটি লম্পটকে শাস্তি দিতে চাইছে? স্বর্ণ মনে জোর পায়।

হ্যাঁ, সামনের দিকে চাকায় যেন সেই প্রত্যাশিত শব্দটা উঠছে। গুম গুম গুম গুমা…বিসর্জনের ঢাকের শব্দ যেন, এঞ্জিনের বাঁশি বাজছে তীক্ষ্ন জোরালো, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে অজস্র সূচের মতো, দমকা বাতাস এসে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিচ্ছে শাঁ…আঁ…আঁ…আঁ…প্রকৃতি পরিব্যাপ্ত শোকে পাগল হয়ে হাত পেতেছে কি নিজের ভ্রষ্টা সন্তানকে লুফে নিতে? গুম গুম গুম গুম…আবার সামনে কোথাও বেজে ওঠে হাজার হাজার ঢাক, অন্ধকার রাতকে আরও অন্ধকার করে দিয়ে চলে আলোহীন ভয়ঙ্কর কালো এক ট্রেন, হুইসল বেজে ওঠে বুকফাটা চিৎকার মতো, বৃষ্টির ফোঁটা রক্তপাত হয়ে ঝরে, বাতাস আসে নিষ্ঠুর হুংকার দিয়ে শাঁ…আঁ…আঁ…আঁ…

ঠোঁট কামড়ে ধরে স্বর্ণ। মাথা ঘুরে ওঠে। ঝুঁকে যায় সে অহিভূষণের দিকে। একটা হাত একটা পা ধরে প্রচণ্ড জোরে ঠেলে ফেলার চেষ্টা করে। সেই মুহূর্তে অহিভূষণের অবচেতনা থেকে কী এক শক্তি ফুঁসে ওঠে। তাঁর মূর্ছার ঘোর কেটে যায়।

তারপর স্বর্ণের মনে হয়, অহিভূষণ পড়ে যাওয়ার মুখে আচমকা ধরে ফেলেছেন তার একটা পা। কিন্তু তখন আর ওই পতনশীল অন্ধ শক্তির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার মতো এতটুকু শক্তি নেই স্বর্ণের শরীরে।

তাই অহিভূষণ যাবার সময় স্বর্ণকে নিয়েই চলে যান। একটি ও আরেকটি চিৎকারকে চাপা দিয়ে অন্ধকারে ছুটে যেতে থাকে শব ও শস্যবাহী এক অন্ধ রেলগাড়ি।

ছেলেটা তখনও ঘুমিয়ে আছে।….

___

* বন্ধনী অংশ রসাভিলাসী পাঠক এড়িয়ে যেতে পারেন ।