২১৭তম অধ্যায়
নিবৃত্তিমূলক ধৰ্ম্ম—নিষ্কাম কৰ্ম্মপ্রশংসা
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি স্বপ্ন, সুষুপ্তি, সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মভাব এবং নারায়ণপ্রোক্ত ব্যক্ত ও অব্যক্তস্বরূপ অবগত না হইতে পারেন, তিনি ব্রহ্মকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন না। বেদে নির্দ্দিষ্ট আছে, আত্মার ব্যক্তভাব মৃত্যুর মুখ এবং অব্যক্তভাব অমৃতপদ। বিষয়প্রবৃত্তিমূলক ধর্ম্মে স্থাবরজঙ্গমাত্মক ত্রৈলোক্যের আধিপত্য প্রভৃতি সমুদয় কৰ্ম্মফল প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে এবং বিষয়নিবৃত্তিমূলক ধৰ্ম্মে অব্যক্তস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্ম প্রাপ্তিস্বরূপ ফল নিবদ্ধ আছে। ভগবান্ প্রজাপতি কহিয়াছেন, প্রবৃত্তিই ধর্ম্মের মূল। কিন্তু প্রবৃত্তির বশবর্ত্তী হইয়া চিরকাল ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিলে সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয়, আর নিষ্কাম হইয়া ধৰ্ম্মসংসাধন করিলে মোক্ষলাভ হইয়া থাকে। শুভাশুভদর্শী আত্মতত্ত্বপরায়ণ নিষ্কাম ধর্ম্মের উপাসক মুনিই সেই পরমগতি লাভ করিয়া থাকেন। অতএব সর্বাগ্রে প্রকৃতি ও পুরুষকে জ্ঞাত হওয়া কর্ত্তব্য। আর যিনি প্রকৃতি ও পুরুষ হইতে মহৎ, বিচক্ষণ ব্যক্তি সেই ক্লেশাদিশূন্য পরমাত্মার সাক্ষাৎকার লাভ করিবেন। প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়েই অনাদি, অনন্ত, অশরীরী, নিত্য, নিশ্চল এবং মহৎ হইতেও মহত্তর। উহাদের উভয়ের গুণের ইতরবিশেষ এই যে, প্রকৃতি গুণত্রয় অবলম্বনপূৰ্ব্বক সৃষ্টি করিতেছেন; কিন্তু পুরুষ উহাতে বিরত রহিয়াছেন; তিনি প্রবৃত্তি ও মহদাদি [ব্রহ্মাদি ঈশ্বর] পদার্থের দ্রষ্টা [সাক্ষী] এবং ত্রিগুণবিরহিত, ঈশ্বর, জীবচক্ষুর অগ্রাহ্য, গুণাদিরহিত এবং পরস্পর পৃথগ্ভূত। উহাদের এই ভেদ ঔপাধিকমাত্র [নামসম্বন্ধমাত্র]। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে জীবের আবির্ভাব হয়। জীব কৰ্ত্তা। উনি ইন্দ্রিয়াদিদ্বারা যে যে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন, উহাকে সেই সেই কর্ম্মের অনুষ্ঠাতা বলিয়া স্বীকার করা যায়। জীব আত্মজ্ঞান জন্মিবার পূৰ্ব্বে আপনাকে ব্রহ্ম হইতে পৃথক্ বলিয়া বোধ হওয়াতে ব্রহ্ম কি পদার্থ, তাহার অনুসন্ধন করেন; কিন্তু আত্মজ্ঞান জন্মিলে আপনাকেই ব্রহ্ম বলিয়া বোধ করেন। যেমন উষ্ণীষধারী ব্যক্তি উষ্ণীষ হইতে পৃথক্, সেইরূপ মনুষ্য সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণযুক্ত হইলেও তৎসমুদয় হইতে পৃথক্ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়। এই আমি প্রকৃতি এবং ঈশ্বর ও জীবের সাধর্ম্ম ও বৈধৰ্ম্ম সম্যক্রূপে কীৰ্ত্তন করিলাম। উহা যথার্থরূপে অবগত হইতে পারিলে সিদ্ধান্তকালে কখনই বিমোহিত হইতে হয় না। যে ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভের বাসনা করিবেন, কায়মনোবাক্যে কঠোর নিয়মানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক নিষ্কাম যোগের অনুষ্ঠান করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য।
জ্ঞানলাভের উপায়—যোগিচৰ্য্যা
“চৈতন্য প্রকাশাত্মক আন্তরিক তপস্যাদ্বারা ত্রৈলোক্য ব্যাপ্ত রহিয়াছে। সূর্য্য ও চন্দ্র তপঃপ্রভাবে নভোমণ্ডলে কিরণজাল বিস্তার করিতেছেন। যোগের ফল জ্ঞান। রজঃ ও তমোনাশক কৰ্ম্মের অনুষ্ঠানই যোগ। ব্রহ্মচর্য্য ও অহিংসা শারীরিক তপস্য এবং বাক্য ও মনের সংযম করাই মানসিক তপস্যা বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। বিধিজ্ঞ দ্বিজাতি হইতে যে অন্ন গ্রহণ করা যায়, তাহাই প্রশস্ত। সেই অন্ন নিয়মিতরূপে আহার করিলে রাজসিক পাপ বিনষ্ট হইয়া যায় এবং ইন্দ্রিয়সমুদয়ের বিষয়ভোগস্পৃহা শিথিল হইয়া পড়ে। অতএব রাজসিক পাপ অপনোদনের নিমিত্ত ধনাদিগ্রহণে পরায়ুখ হইয়া কেবল শরীররক্ষণােপযোগী অন্ন গ্রহণ করাই যোগিগণের কর্ত্তব্য। যোগযুক্ত মনদ্বারা ক্রমশঃ যে জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়, অন্তকালে অনাতুর হইয়া কাশীবাস করিলে সদ্য সেই জ্ঞানলাভ হইতে পারে। মনুষ্য বাহেন্দ্রিয়প্রবৃত্তিশূন্য হইয়া সমাধিবলে স্থূলশরীরবিমুক্ত হইলে সূক্ষ্মশরীর পরিগ্রহ করিয়া থাকে এবং স্থূল ও সূক্ষ্মশরীরভোগে নিস্পৃহ হইলে প্রকৃতিতে লীন হয়। আর যে ব্যক্তি স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন দেহ হইতে মুক্ত হইতে পারে, তাহার সদ্যোমুক্তিলাভ হইয়া থাকে। অবিদ্যাপ্রভাবেই প্রাণীগণের জন্ম ও মৃত্যু হয়। বিশুদ্ধ ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভ হইলে ধর্ম্মাধৰ্ম্মের সহিত আর সম্পর্ক থাকে না। আর যাহারা প্রকৃতি প্রভৃতিতে আত্মবোধ করিয়া থাকে, যাহাদের বুদ্ধি মহদাদি পদার্থের ক্ষয়-উদয়ের পর্য্যালোচনায় প্রবৃত্ত হয়, তাহাদিগের মুক্তিলাভ। সুদূরপরাহত হইয়া থাকে। যেসমস্ত যোগীরা কেবল ধৈৰ্য্যপ্রভাবে দেহধারণ করিতে পারেন, যাঁহারা বুদ্ধিবলে চিত্তবৃত্তিকে কেবল বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়াছেন এবং যাহাদের চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয় হইতে বিষয়সমুদয় নিবৃত্ত হইয়াছে, তাহারা ইন্দ্রিয়াদিকে দেহ হইতে সূক্ষ্ম বলিয়া বিবেচনা করিয়া উহাদের উপাসনা করিয়া থাকেন। উহাদের মধ্যে অনেকে আগমানুসারে ক্রমে ক্রমে ইন্দ্রিয়াদি উপাসনা অতিক্রম করিয়া পরিশেষে স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে পরমস্থানে গমনপূৰ্ব্বক উহা অবগত হইতে পারেন। কেহ কেহ আচার্য্যের উপদেশপ্রভাবে যোগদ্বারা বিশুদ্ধবুদ্ধি হইয়া অব্যক্ত হইতেও শ্রেষ্ঠ নিরাশ্রয় পরমপুরুষকে লাভ করেন। কেহ কেহ সেবকভাবাপন্ন হইয়া সগুণ ব্রহ্মের ও কেহ কেহ নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করিয়া থাকেন এবং কেহ কেহ অন্তকালে তপঃপ্রভাবে নিষ্পাপ হইয়া ব্ৰহ্মলাভ করেন। ইহাদের সকলেরই মোক্ষলাভ হয়। শাস্ত্রচক্ষুদ্বারা সগুণ ব্রহ্মের সূক্ষ্ম বিশেষণামুদয় অবগত হইবে। তিনি প্রকৃতির লয়ের অধিষ্ঠান। স্থূলদেহাভিমানশূন্য পরিগ্রহবিহীন যোগী ঈশ্বর হইতে অভিন্ন। লোকে বিদ্যাপ্রভাবে প্রথমতঃ মর্ত্ত্যদেহ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে, তৎপরে ক্রমে ক্রমে রজোগুণবিহীন ও ব্রহ্মভূত হইয়া মোক্ষলাভে সমর্থ হয়।
“বেদবেত্তা পণ্ডিতগণ এইরূপ ব্ৰহ্মলাভজনক ধর্ম্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। যাঁহারা জ্ঞানানুসারে ঐ ধৰ্ম্মের উপাসনা করিতে পারেন, তাঁহাদের উৎকৃষ্ট গতিলাভ হয়। শাস্ত্রীয় জ্ঞানপ্রভাবে যাঁহাদের রাগাদি তিরোহিত হয়, তাঁহারাও উৎকৃষ্ট লোকলাভে সমর্থ হয়েন। যিনি জ্ঞানতৃপ্ত ও পরিগ্রহশূন্য হইয়া বিশুদ্ধভাবে অব্যক্ত জন্মমৃত্যুবিরহিত ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করেন এবং তাঁহাকে আত্মস্থ বলিয়া জ্ঞান করিতে পারেন, তিনি চরমে অক্ষয় পরমস্থান লাভ করিয়া পরিতৃপ্ত হয়েন। ভ্রান্ত ব্যক্তিরা জগৎ সত্য বলিয়া জ্ঞান করে, কিন্তু অভ্রান্ত ব্যক্তিরা উহা মিথ্যা বোধ করিয়া থাকেন। সমুদয় জগৎ তৃষ্ণায় বদ্ধ হইয়া চক্রের ন্যায় পরিবর্তিত হইতেছে। মৃণালসূত্র যেমন মৃণালের মধ্যে সৰ্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে, তদ্রূপ তৃষ্ণা মনুষ্যের দেহমধ্যে অবস্থান করিতেছে। সূত্র যেমন তন্তুবায়ের সূচিদ্বারা বস্ত্রে নিবদ্ধ হয়, তদ্রূপ সংসার তৃষ্ণাদ্বারা নিবদ্ধ রহিয়াছে। বিকার, প্রকৃতি ও সনাতন পুরুষকে অবগত হইতে পারিলেই তৃষ্ণা-পরিহার ও মুক্তিলাভ করা যায়। ভগবান্ নারায়ণ প্রাণীগণের প্রতি অনুকম্পাদর্শনার্থ স্পষ্টাভিধানে এই মোক্ষের উপায় নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছেন।”