২১৬তম অধ্যায়
নিদ্রাদির সংযম—স্বপ্নতত্ত্ব
ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! যিনি নিরন্তর নিষ্পাপ ব্রহ্মচর্য্য অনুষ্ঠান করিতে যত্নবান হয়েন, স্বপ্নজনিত সুখদুঃখানুভব পরিহারার্থ সৰ্ব্বতোভাবে নিদ্রা পরিত্যাগ করা তাঁতাহার কৰ্ত্তব্য। মনুষ্য স্বপ্নযোগে রজঃ ও তমোগুণে অভিভূত হয় এবং সে নিস্পৃহ হইলেও দেশদেশান্তরে সঞ্চরণ করিতেছে, এইরূপ বিবেচনা করিয়া থাকে। জ্ঞানের অভ্যাস ও জ্ঞানের অনুসন্ধাননিবন্ধন লোকের জাগরণ অভ্যাস হইয়া থাকে এবং বিজ্ঞানে অভিনিবেশ হইলেই লোকে সতত জাগরিত থাকিতে পারে। যাহা হউক, মনুষ্য স্বপ্নযোগে ইন্দ্রিয়ের অপরিস্ফুটতানিবন্ধন আপনাকে বিষয় ব্যাসক্তের ন্যায় বিবেচনা করিয়া থাকে। অতএব জিজ্ঞাসা—স্বপ্ন সত্য, কি অসত্য? যোগীশ্বর হরি এই বিষয়ে কহিয়াছেন যে, স্বভাব সঙ্কল্পমাত্র। মহর্ষিগণও এই বাক্যের সবিশেষ পোষকতা করেন। ইন্দ্রিয়সমুদয় একান্ত ক্লান্ত হইলেও সঙ্কল্পস্বভাব মনের বিশ্রাম হয় না, তন্নিবন্ধন লোকের স্বপ্ন উপস্থিত হইয়া থাকে, ইহা সৰ্ব্ববাদিসম্মত। স্বপ্নভাব কার্য্যব্যাসক্ত ব্যক্তির মনোরথের ন্যায় সঙ্কল্পমূলক; জাগ্ৰতবস্থায় ইন্দ্রিয়ের পরিস্ফুটতানিবন্ধন মনোরথ সত্যের ন্যায় প্রতিভাত হয় না; কিন্তু নিদ্রিতাবস্থায় ইন্দ্রিয়ের অপরিস্ফুটতাবশতঃ স্বপ্নভাব সত্যের ন্যায় অনুভূত হইয়া থাকে। বিষয়াসক্তচেতাঃ মনুষ্য পূর্ব্বতন জন্মের সংস্কারনিবন্ধন স্বপ্নে ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিয়া থাকে। পরমাত্মাই মনোমধ্যে লীন সেই ঐশ্বৰ্য্য প্রকাশ করিয়া দেন।
“পূর্ব্বতন কর্ম্মপ্রভাবে লোকের সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ তাহাকে সুখদুঃখাদি ভোগ করাইবার নিমিত্ত তাহার দেহে আবির্ভূত হয়। মনুষ্য অজ্ঞানতানিবন্ধন রাজসিক ও তামসিক ভাবপ্রভাবে যে বায়ু পিত্ত ও কফপ্রধান দেহসমুদয় নিরীক্ষণ করে, পূৰ্ব্ববাসনার প্রাবল্যনিবন্ধন ঐ দর্শন নিরাকরণ করা নিতান্ত সুকঠিন। জাগ্রতাবস্থায় ইন্দ্রিয়গণের সুপ্রসন্নতানিবন্ধন মনোমধ্যে যেরূপ সঙ্কল্প উপস্থিত হয়, স্বপ্নযোগে উহাদের অপ্রসন্নতাবশতঃ মন তৎসমুদয় সন্দর্শন করিয়া থাকে। মন আত্মার প্রভাবে অপ্রতিহতভাবে সৰ্ব্বভূতে ব্যাপ্ত রহিয়াছে; অতএব আত্মাকে জ্ঞাত হওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য; আত্মজ্ঞান জন্মিলে সৰ্ব্বজ্ঞতালাভ হইয়া থাকে। সুষুপ্তির সময় মন স্বপ্নদর্শনের দ্বারভূত স্থূলদেহ অবলম্বনপূর্ব্বক আত্মাতে গমন করে এবং অহঙ্কারাদিও উহাতে লীন হয়। যোগিগণ আত্মার সুপ্রসন্নতানিবন্ধন জ্ঞান, বৈরাগ্য প্রভৃতি ঐশিক গুণলাভ করিয়া থাকেন। যে যোগীর মন বিষয়ালোচনে পরাঙ্মুখ হয় নাই, তাহারই ঐরূপ ঐশ্বৰ্য্যলাভ হয়। আর যাঁহার মন অজ্ঞান অতিক্রম করে, তিনি সূর্য্যের ন্যায় প্রকাশিত হইয়া পরমপবিত্র ব্রহ্মভাব লাভ করিতে সমর্থ হয়েন।
দেবগণ অগ্নিহোত্রাদির অনুষ্ঠান করেন এবং অসুরগণ ঐ সমুদয়ের প্রতিবন্ধকীভূত দম্ভদৰ্পাদি অবলম্বন করিয়া থাকে। সুতরাং জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম তাহাদিগের একান্ত দুষ্প্রাপ্য, সন্দেহ নাই। দেবতারা সত্ত্বগুণ অবলম্বন করেন এবং অসুরগণ রজঃ ও তমোগুণের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে; কিন্তু ব্ৰহ্ম সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জ্ঞানস্বরূপ; যাঁহারা তাঁহাকে অবগত হইতে পারেন, তাঁহারা যারপরনাই উৎকৃষ্ট গতিলাভে সমর্থ হয়েন। তিনি অমৃত, স্বপ্ৰকাশ ও অবিনাশী। তত্ত্বদর্শী ব্যক্তি হেতুবাদদ্বারা তাঁহাকে সগুণ ও নির্গুণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন এবং বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সমুদয়কে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া সেই অব্যক্ত স্বরূপকে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন।”