২১৫তম অধ্যায়
মনঃসংযমের বিশেষ উপায়
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! মানবগণ দুর্নিবার ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত হইয়াই এককালে অবসন্ন হইয়া পড়ে। যে মহাত্মারা সেই সুখে আসক্ত না হয়েন, তাঁহারাই পরমগতি লাভ করিতে পারেন। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি ও মানসিক ক্লেশে সমুদয় জগৎ সমাচ্ছন্ন সন্দর্শন করিয়া মোক্ষপদলাভে. যত্নবান্ হইবেন এবং কায়মনোবাক্যে পবিত্র, অহঙ্কারপরিশূন্য ও সংসারে নির্লিপ্ত হইয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনপূৰ্ব্বক সুখে বিহার করিবেন। প্রাণীগণের প্রতি দয়া করিলে তাহাদের উপর অনুরাগ জন্মিতে পারে; অতএব লোকানুকম্পায় উপেক্ষা করাও জ্ঞানবান্দিগের উচিত। শুভকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া যদি দুঃখভোগ করিতে হয়, তথাপি কায়মনোবাক্যে তাহারই অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। যিনি অহিংসা, সত্যবাক্য, ভূতানুকম্পা, ক্ষমা ও সাবধানতা অবলম্বন করেন, তিনিই সৰ্ব্বজ্ঞ ও যথার্থ সুখী হইতে পারেন। অতএব অবহিতচিত্তে সমুদয় জীবের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখা কর্ত্তব্য। পরের অনিষ্টচিন্তা, অসম্ভব স্পৃহা এবং ভবিষ্যৎ বা অতীত বিষয়ের অনুষ্ঠান করা কাহারও কর্ত্তব্য নহে। দৃঢ়তর যত্নসহকারে জ্ঞানসাধনে মনোনিবেশ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অমোঘ বেদবাক্য অনুশীলনপ্রভাবে জ্ঞান প্রবর্তিত হইয়া থাকে। যাঁহারা সুক্ষ্মধৰ্ম্ম দর্শন ও সদ্বাক্য প্রয়োগ করিতে বাসনা করেন, অবিচলিতচিত্তে হিংসা, অপবাদ, শঠতা, পরুষতা ও ক্রূরতাপরিশূন্য, পরিমিত সত্যবাক্য প্রয়োগ করাই তাঁহাদের কর্ত্তব্য। ঐহিক কাৰ্য্যসমুদয় বাক্যেই নিবদ্ধ রহিয়াছে। অতএব সাধুবাক্য প্রয়োগ করা বিধেয়। যাঁহার সংসারে বিরাগ জন্মিবে, তিনি স্বমুখে স্বীয় হিংসাদি তামসিক কার্য্যসমুদয় প্রকাশ করিবেন। যিনি রজোগুণপ্রভাবে কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন, তাঁহাকে যারপরনাই দুঃখ ভোগ করিয়া নরকে নিপতিত হইতে হয়।
“দস্যুগণ যেমন অপহৃত সামগ্ৰীসম্ভার বহন করে, মূঢ় ব্যক্তিরা তদ্রূপ সংসারভার বহন করিয়া থাকে। চৌরেরা যেমন রাজপুরুষের ভয়ে অপহৃত দ্রব্যচয় পরিত্যাগ করিয়া বিঘ্নশূন্য পথে গমনপূর্ব্বক জীবন রক্ষা করে, তদ্রূপ মানবগণ সংসারভয়ে ভীত হইয়া সাত্ত্বিক ও রাজসিক কাৰ্য্যসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সংসারযাত্রা হইতে মুক্ত হয়। যিনি বীতস্পৃহ, পরিগ্রহপরিশূন্য, নির্জ্জনবিহারী [একাকী বিচরণকারী], অল্পাহারনিরত ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি জ্ঞানপ্রভাবে সমুদয় ক্লেশ নিবারণ ও যোগাঙ্গ অনুষ্ঠানে একান্ত অনুরাগ প্রদর্শন করেন, তিনি নিশ্চয়ই স্বীয় বশীকৃত-চিত্ত প্রভাবে পরমগতি লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। ধৈৰ্য্যশালী বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা। অগ্রে বুদ্ধিবৃত্তিকে নিগৃহীত করিয়া পরিশেষে সেই ধীশক্তিপ্রভাবে মনকে এবং মনঃপ্রভাবে শব্দাদি ইন্দ্রিয়বিষয়সমুদয়কে নিগৃহীত করেন। জিতেন্দ্রিয় হইয়া চিত্তকে বশীভূত করিলে ইন্দ্রিয়সমুদয় প্রসন্ন হইয়া পরমাত্মাদে ঈশ্বরে লীন হয়। ইন্দ্রিয়ের সহিত মনের একতা সম্পাদিত হইলেই ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে এবং তৎকালে মনে ব্রহ্মভাবপ্রাপ্তি হয়। ব্রহ্মজ্ঞানলিড্সু ব্যক্তির জনসমাজে স্বীয় ঐশ্বৰ্য্য প্রকাশপুর্ব্বক গৌরব লাভ করা বিধেয় নহে। যোগতন্ত্র[যোগশাস্ত্র]প্রভাবে ইন্দ্রিয়াদি রোধ করিতে যত্ন করাই তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। বিশুদ্ধবৃত্তি অবলম্বনপূৰ্ব্বক পর্য্যায়ক্রমে তণ্ডুলকণা, সুপক্ক মাষ, শাক, উষ্ণ জল, পক্ক যবচূর্ণ, শক্তু[ছাতু] ও ফলমূল প্রভৃতি ভিক্ষালব্ধ সামগ্রীসমুদয় ভোজন করা বিধেয়। দেশকালের গতি বিবেচনাপূৰ্ব্বক আহার নিয়মের অনুবর্তী হওয়া উচিত।
“যোগকাৰ্য্য আরম্ভ হইলে তাহার ব্যাঘাত করা কর্ত্তব্য নহে; অগ্নির ন্যায় ক্রমশঃ তাহার উত্তেজনা করাই বিধেয়; তাহা হইলে সূর্য্যের ন্যায় ক্রমে ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞান প্রকাশিত হইতে থাকে। জ্ঞানানুগত অজ্ঞান জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি, এই তিন অবস্থাতেই লোককে অভিভূত করে; আর বুদ্ধিবৃত্তির অনুগত জ্ঞান ও অজ্ঞানদ্বারা উপহত হইয়া থাকে। লোকে যতকাল অবস্থাত্রয়াতীত পরমাত্মাকে ঐ তিন অবস্থাযুক্ত বলিয়া বোধ করে, ততকাল তাহারা কিছুমাত্র অবগত হইতে সমর্থ হয় না, আর যখন তাঁহার পৃথকত্ত্ব ও অপৃথকত্ব বিষয় বিশেষরূপে বিদিত হইতে সক্ষম হয়, তখন তাহার স্পৃহা এককালে দূরীভূত হইয়া যায় এবং সে কাল, জরা ও মৃত্যুকে পরাজয় করিয়া শাশ্বত পরমব্রহ্মলাভের অধিকারী হয়।”