২১৫. অর্জুনের চিত্রাঙ্গদার পাণিগ্রহণ
পঞ্চদশাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন-মহারাজ! তদনন্তর ইন্দ্রাত্মজ অর্জুন ব্রাহ্মণদিগকে সেই সমস্ত বৃতান্ত নিবেদন করিয়া হিমাচলের পার্শ্বদেশে গমন করিলেন। তিনি ক্রমে ক্রমে অগস্ত্যবট, বশিষ্ঠপর্বত ও ভৃগুতুঙ্গে গমন করিয়া পরম পবিত্রতা লাভ করিলেন। কুরুসতম অর্জুন অসংখ্য বাসভবন ও সহস্র সহস্র গোন বিপ্রসাৎ করিয়া হিরণ্যবিন্দুর তীর্থে অবগাহনপূর্বক অনেকানেক পুণ্যস্থান সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। পরে বিগণ সমভিব্যাহারে হিমগিরি হইতে অবতীর্ণ হইয়া উৎসুকমনে পূৰ্বদিক দর্শনে যাত্রা করিলেন। এইরূপে নন্দা, অপরনন্দা, কৌশিকী, গঙ্গা প্রভৃতি মহানদী সকল এবং গয়া প্রভৃতি পুণ্যতীর্থ পৰ্যটন করিয়া আপনাকে পবিত্র করি কেন। অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ প্রভৃতি জনপদে যে সকল তীর্থ, দেবালয় এবং সিদ্ধাশ্রম আছে, অর্জুন সর্বত্র গমন, দর্শন ও ধনদান করিয়াছিলেন। অনন্তর সমভিব্যাহারী ব্রাহ্মণের কলিঙ্গ রাজ্যের দ্বারদেশ পর্যন্ত আসিয়া তাঁহার অনুমতি গ্রহণপূর্বক প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয়, অত্যল্পমাত্র সহায়সম্পন্ন হইয়া সাগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। তিনি কলিঙ্গদেশ ও তত্ৰত্য পুণ্যতীর্থ সকল অতিক্রম করিয়া সুরম্য হাবলী অবলোকন করিতে করিতে চলিলেন। মহাবাহু অর্জুন তাপসগণ-পরিশোভিত মহেন্দ্রপৰ্বত নিরীক্ষণ করিয়া মহাসাগরের উপকূলমার্গে মণিপুরে গমন করিলে এবং তত্ৰত্য দেবালয় ও পুণ্যতীর্থ সকল সন্দর্শন করিয়া তর্দেশীয় রাজার নিকটে উপনীত হইলেন। মণিপুরেশ্বর পরম ধার্মিক। চিত্রাঙ্গদা নামে তাঁহার এক পরম সুন্দরী সুহিত ছিল। রাজকুমারী স্বেচ্ছাক্রমে পুরমধ্যে ভ্রমণ করিতেছিলেন, এমন সময়ে অর্জুন তাঁহাকে নয়নগোচর করিয়া মনে মনে সেই বরবৰ্ণিনীর পাণি গ্রহণ করিবার বাসনা করিলেন। পরে রাজার নিকটে উপনীত হইয়া স্বীয় অভিলাষ প্রকাশপূর্বক কহিলেন, রাজন! আমি ক্ষত্রিয়, এই কন্যা আমাকে সম্প্রদান করুন। তাহা শ্রবণ করিয়া রাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কাহার পুত্র এবং তোমায় নাম কি? অর্জুন কবিলেন, আমি কুন্তীপুত্র, নাম ধনঞ্জয়। মণিপুরের তাঁহাকে পুনর্বার কাইলেন, হে ধনঞ্জয়! অংশে প্রভঞ্জন নামে একজন রাজর্ষি ছিলেন, তিনি নিঃসন্তানতাপ্রযুক্ত পুত্র কামনায় অতি কঠোর তপস্যা করেন। ভগবান ভবানীপতি তদীয় উগ্র তপস্যায় প্রসন্ন হইয়া তোমাদিগের প্রত্যেকের এক এক পুত্র হইবে বলিয়া তাঁহাকে বর প্রদান করিয়াছিলেন। তদবধি আমাদিগের বংশে এক একটি করিয়া পুত্র উৎপন্ন হয়। হে ভরতভ! আমার পূর্বপুরুষদিগের সকলেরই পুত্র জন্মিয়াছিল, কিন্তু আমার এই একমাত্র কন্যা, সুতরাং আমি ইহাকে পুত্র বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকি। ইহাদ্বারা বংশ রক্ষা হইবে, এই আশয়ে আমি ইহাকে পুত্রিকা গ্রহণ করিয়াছি, অতএব ইহার গর্ভজাত পুত্র আমারই বংশকর হইবে। হে পাণ্ডব! যদি এই নিয়মে সম্মত হও, তাহা হইলে আমার কন্যার পাণিপীড়ন করিতে পারিবে। অর্জুন নিয়মানুরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া সেই কামিনীর পাণিগ্রহণপূর্বক তথায় তিন বৎসরকাল বাস করিয়া রহিলেন। পরে পুত্র উৎপন্ন হইলে তিনি চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গনপূর্বক রাজার নিকট বিদায় লইয়া গমন করিলেন।