২১৪. অর্জুনের উলুপী-পরিণয়
চতুর্দশাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, কুরুকুলপ্রদীপ মহাবাহু অর্জুন বনে প্রস্থান করিলে, বেদবেদাঙ্গ ও দিব্যাখ্যানবেত্তা এবং অধ্যাত্মশাস্ত্রবিশারদ ব্রাহ্মণগণ, ভিপোঙ্গীবিসকল, পৌরাণিক সূতগণ, কথকগণ এবং বনবাসী সন্ন্যাসিসকল তাঁহার অনুগমন করিলেন। পাণ্ডুনন্দন সেই সমস্ত মধুরভাষী মহাত্মাগণ ও অন্যান্য সহায়ে পরিবৃত হইয়া দেবগণ-সমাবৃত অমররাজের ন্যায় গমন করিতে লাগিলেন। গমন করিতে করিতে রমণীয় বিচিত্র কানন, সরোবর, নদী, সাগর, বিবিধ দেশ ও পুণ্য তীর্থ সকল দর্শন করিলেন। তিনি ক্রমে ক্রমে গঙ্গাদ্বারে গমন করিয়া তথায় আশ্রম নির্ধারিত করিলেন।
বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে সম্বোধিয়া কহিলেন,–হে রাজন! সেই স্থানে বিশুদ্ধাত্মা ধনঞ্জয় যে অদ্ভুত কর্ম করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ কর। কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয় ব্রাহ্মণগণ সমভিব্যাহারে তথায় বাস করিলে, বিপ্রগণ স্থানে স্থানে অগ্নিহোত্র আরম্ভ করিলেন। গঙ্গাতীরস্থ পুষ্পোপহারীলঙ্কত সেই সমস্ত মন্ত্রপূত হুতাশন এবং কৃতাভিষেক, সংযমী, সৎপথাবলম্বী মহাত্মা দ্বিজগণদ্বারা গঙ্গাদ্বার অতীব শোভাকর হইল। এইরূপে অমি পৰ্যাকুল হইলে একদা অর্জুন অভিষেকাৰ্থ গঙ্গায় অবতীর্ণ হইলেন। তথায় স্নান ও পিতামহগণেরতৰ্পণ করিয়া অগ্নিকাৰ্য করিবার নিমিত্ত যেমন জল হইতে উঠিতেছিলেন, অমনি নাগরাজদুহিতা উলুপী আপনার মনোরথ পূর্ণ করিবার আশয়ে তাহাকে জলমধ্যে আকর্ষণ করিয়া লইল। অর্জুন পরমার্জিত নাগরাজভবনে সমুপস্থিত হইয়া হুতাশন অরলোকন করিয়া সেই স্থানেই অগ্নিকাৰ্য্য সমাধা করিলেন। তিনি অসঙ্কুচিতচিত্তে হোমক্রিয়া সম্পাদিত করিলেন দেখিয়া,হুতাশন পরম পরিতুষ্ট হইলেন। অগ্নিকাৰ্য্য সমাধা হইলে অর্জুন ঈষৎ হাস্য করিয়া নাগরাজদুহিতাকে কহিলেন, হে ভীরু! তুমি কি সাহনে এরূপ সাহসিক কাৰ্য্য করিলে? হে ভাবিনি। এ প্রদেশের নাম কি? তুমিই বা কে এবং কাহার কন্যা?
উলুপী কহিল,—হৈ রাজন! ঐরাবতকুলে যমুদ্ভুত কৌরব্য নামে এক নাগ আছেন, আমি তাঁহার দুহিতা, আমার নাম উলুপী। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! আমি তোমাকে অভিষেকাৰ্থ গঙ্গায় অবতীর্ণ দেখিয়া কৰ্পশরে জর্জরিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আত্মপ্রদানদ্বারা এ অশরণা অবলার মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ কর।
অর্জুন কহিলেন, হে ভদ্রে! আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নির্দেশানুসারে দ্বাদশবার্ষিক ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়াছি; সুতরাং আমি স্বাধীন নহি। হে জলচারিণি! তোমার প্রিয়ানুষ্ঠান করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ আছে বটে, কিন্তু আমি পূর্বে কখনই মিথ্যা কহি নাই, অতএব হে ভুজঙ্গমে। যাহাতে আমার অমৃতানুষ্ঠান না হয়, তোমারও প্রিয়কার্য সম্পাদন করা হয় এবং ধর্ম হানি না হয়, এমন কোন উপায় চিন্তা কর।
উলুপী কহিল,-হে পাণ্ডবেয়! তুমি যে নিমিত্ত ভূমণ্ডলে ভ্রমণ করিতেছ এবং তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা যে নিমিত্ত তোমাকে ব্রহ্মচর্য্যানুষ্ঠানে অনুমতি করিয়াছেন, আমি তৎসমুদয় অবগত আছি। তোমরা পূর্বে প্রতিজ্ঞ করিয়াছিলে যে, সে সময় আমাদের এক জন দ্রৌপদীর সমীপে থাকিবেন, তৎকালে অন্য কেহ তথায় গমন করিলে তাঁহাকে দ্বাদশবর্ষ বনে বাস ও ব্রহ্মচৰ্যানুষ্ঠান করিতে হইবে। হে ধর্মাত্ম! তোমরা দ্রৌপদীর নিমিত্ত পরস্পর এইরূপ বনবাসের নিয়ম করিয়াছিলে, অতএব আমার অভিলাষ সফল করিলে তোমার অধর্ম হইবে না। হে পৃথুলোচন! আৰ্ত ব্যক্তিকে পরিত্রাণ করা তোমাদিগের অবশ্য কর্তব্য কৰ্ম; অতএব আমাকে পরিত্রাণ করিলে তোমার অধর্ম হইবে না। যদিও ইহাতে তোমার যৎকিঞ্চিৎ ধর্ম হানি হয়, আমার প্রাণ দান করিলে ততোধিক ধর্ম লাভ হইবে। হে পার্থ! আমি তোমাতে নিতান্ত ভক্ত এবং একান্ত অনুরক্ত হইয়াছি। তুমি সাধুগণের পদবী অবলম্বনপূর্বক আমার বাসনা পরিপূর্ণ কর। যদি তুমি ইহাতে অসম্মত হও, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই প্রাণত্যাগ করিব; অত এব আমার প্রাণদান করিয়া পরমোৎকৃষ্ট ধর্ম উপার্জন কর। হে পুরুষোওম কৌন্তেয়! তুমি প্রত্যহ অনাথ দীনগণকে রক্ষা করিয়া থাক, আমি অদ্য তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি এবং আমার অভিলাষ পূর্ণ কর বলিয়া বারংবার প্রার্থনা করিতেছি; তুমি আত্মপ্রদানধারা মনোরথ সফল করিয়া আমার প্রিয়ানুষ্ঠান কর।
কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয় নাগরাজদুহিতা উলুপী কর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ধর্মবুদ্ধিতে তদীয় মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলেন। তিনি সেই রাত্রি তথায় বাস করিয়া সূর্যোদয়কালে নাগভবন হইতে গাত্রোত্থানপূর্বক উলুপী সমভি ব্যাহারে পুনরায় গঙ্গাদ্বারে প্রত্যাগমন করিলেন। পতিব্রতা উলুপী, অর্জুনকে তুমি সমস্ত জলচরগণকে জয় করিতে পারিবে এই বর প্রদান করিয়া এবং তাহাকে তথায় রাখিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।