২১৩তম অধ্যায়
গুণত্রয়ের প্রবাহ—জীবজন্ম
ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহারাজ! রজোগুণপ্রভাবে মোহ এবং তমোগুণপ্রভাবেই লোভ, ভয় ও দর্প উপস্থিত হইয়া থাকে। যিনি ঐ সমস্ত বিনাশ করিতে সমর্থ হয়েন, তিনিই যথার্থ শুচি। শুচি ব্যক্তিরাই সেই বিনাশবিহীন, হ্রাসশূন্য, সৰ্ব্বব্যাপী, সূক্ষ্মস্বরূপ পরমাত্মাকে অবগত হইতে পারেন। মনুষ্যেরা তাঁহারই মায়াবলে রূপাদি বাহ্যপদার্থে অভিভূত, জ্ঞানভ্রষ্ট ও বিচেতন হইয়া ক্রোধের বশবর্তী হইয়া থাকে এবং ক্রোধপ্রভাবে কাম, লোভ ও মোহ প্রাপ্ত হয়। তৎপরে তাহাদের অভিমান, দর্প ও অহঙ্কার উদ্ভূত হইয়া থাকে। অহঙ্কার হইতে কাৰ্য্য, কাৰ্য্য হইতে স্নেহ ও স্নেহ হইতে শোক উপস্থিত হয়। মনুষ্যেরা সুখদুঃখমূলক কার্য্যের অনুষ্ঠাননিবন্ধন বারংবার জন্ম ও মৃত্যু লাভ করিয়া থাকে। উহারা কেবল তৃষ্ণায় অভিভূত হইয়া উহা চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত শুক্ৰশোণিতসম্ভূত পুরীষমূত্ৰক্লিন্ন গর্ভে বাস করিতেও স্বীকার করে। স্ত্রীলোকেরাই জীবপ্রবাহ প্রবাহিত করে। প্রকৃতি যেমন পুরুষকে, তদ্রূপ অপত্যোৎপত্তির ক্ষেত্রভূত স্ত্রীজাতিও জীবকে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। অতএব বিচক্ষণ ব্যক্তিরা সৰ্ব্বতোভাবে উহাদের সংসর্গ পরিত্যাগ করিবেন। ঐ ঘোররূপ স্ত্রীলোকেরা প্রতিনিয়ত অবিচক্ষণ মনুষ্যগণকে বিমোহিত করিয়া থাকে। উহাদের মূৰ্ত্তি রজোগুণে সূক্ষ্মরূপে স্থিতি করিতেছে; উহারা সাক্ষাৎ ইন্দ্রিয়দ্বারাই নির্ম্মিত হইয়াছে। উহাদের প্রতি লোকের অনুরাগ থাকাতেই জীবসকল উৎপন্ন হইতেছে। লোকে যেমন স্বদেহজ কৃমিগণকে অনাত্মীয়বোধে দেহ হইতে পরিত্যাগ করে সেইরূপ আত্মদেহসম্ভূত পুত্রগণকেও অনাত্মীয়বোধে পরিত্যাগ করিবে। দেহের রেতোরূপ স্নেহাংশদ্বারা পুত্রও দেহের স্বেদস্বরূপ। স্নেহাংশদ্বারা কৃমিকীটাদি স্বভাব বা কৰ্ম্মযোগপ্রভাবে উৎপন্ন হইয়া থাকে। অতএব বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি কৃমিকীটাদির ন্যায় পুত্রদিগকেও সতত উপেক্ষা করিবেন।
“সত্ত্বগুণ তমোগুণে ও তমোগুণ রজোগুণে অবস্থান করিতেছে। সেই অব্যক্ত তমোগুণ অধিষ্ঠানভূত জ্ঞানে অধিষ্ঠিত থাকিলে বুদ্ধিও অহঙ্কারের জ্ঞাপক হয়। উহা দেহীদিগের উৎপত্তির বীজ এবং উহাই জীব বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। উহা কালযুক্ত কৰ্ম্মপ্রভাবে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতেছে। জীব স্বপ্নাবস্থায় যেমন মনোবৃত্তি লইয়া শরীরীর ন্যায় ক্রীড়া করে, তদ্রূপ সে কৰ্ম্মসম্ভূত অহঙ্কারাদি গুণের সহিত মাতৃগর্ভে বাস করিয়া থাকে। তথায় বীজভূত কৰ্ম্মপ্রভাবে উহার যে যে ইন্দ্রিয় উত্তেজিত হয়, অনুরাগসহকৃত মনোবৃত্তিদ্বারা অহঙ্কার হইতে তৎসমুদয় প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে। বাসনাসম্পন্ন ব্যক্তির শব্দানুরাগনিবন্ধন শ্ৰোত্ৰ, রূপানুরাগনিবন্ধন চক্ষুঃ, গন্ধানুরাগনিবন্ধন ঘ্রাণ এবং স্পর্শানুরাগনিবন্ধন ত্বক্ উৎপন্ন হয়; আর প্রাণ, অপান প্রভৃতি পঞ্চবায়ু উহার দেহযাত্ৰা নির্ব্বাহ করে। এইরূপে মনুষ্য কৰ্ম্মজনিত ইন্দ্রিয়ের সহিত দেহ পরিগ্রহ করিয়া থাকে। তাহাকে আদি, মধ্য ও অন্তে শারীরিক ও মানসিক দুঃখ ভোগ করিতে হয়। ঐ দুঃখ মনুষ্যের মাতৃগর্ভে দেহ ও ইন্দ্রিয়াদির অঙ্গীকারনিবন্ধন উৎপন্ন এবং অভিমানপ্রভাবে পরিবর্দ্ধিত হয়। লোকের মৃত্যু হইলেও উহার কিছুই হ্রাস হয় না; অতএব দুঃখ নিরাকরণ করাই কৰ্ত্তব্য। যিনি দুঃখ রোধ করিতে পারেন, তিনিই মুক্তিলাভে সমর্থ হয়েন। রজোগুণই ইন্দ্রিয়গণের উৎপত্তি ও নাশের নিদান। অতএব সেই রজোগুণকে রুদ্ধ করিতে পারিলেই ইন্দ্রিয়গণ রুদ্ধ হয় এবং ইন্দ্রিয়গণ রুদ্ধ হইলেই দুঃখনাশ হইয়া যায়। তৃষাহীন ব্যক্তির জ্ঞানেন্দ্রিয় সমুদয় ইন্দ্রিয়ার্থ লাভ করিলেও তাহাকে অভিভূত করিতে পারে না। অতএব যে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সকল নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর, তাহাকে আর পুনরায় জন্মপরিগ্রহ করিতে হয় না।”