২০-২৫. মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায়

২১.

মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায় রেখে সুদর্শন ফিরে এল থানায়।

মৃতদেহটা মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কোয়ার্টারে হোমিসাইডাল স্কোয়াডকে একটা সংবাদ পাঠাতে হবে।

সব ব্যবস্থা করতে করতে ঘণ্টা দুই লেগে গেল সুদর্শনের।

ইতিমধ্যে দশের পল্লীর বাসিন্দাদের মধ্যে সংবাদটা ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই তল্লাটে আবার একজন খুন হয়েছে। মাঠের মধ্যে ক্রমশ ভিড় জমে যায়।

রামশরণ সিং অনেককেই প্রশ্ন করে, তাদের মধ্যে কেউ গুলজার সিংকে চিনতে পারছে কিনা, আগে কখনও কেউ তাকে দেখেছে কিনা ঐ তল্লাটে!

ভিড়ের মধ্যে হীরু সাহা, খগেন পাঠক, অমলেন্দু ও হরগোবিন্দ ঘোষও ছিল।

তাদেরও রামশরণ ওই একই প্রশ্ন করে। কিন্তু তারা মাথা নাড়ে সকলেই-কেউ তারা ইতিপূর্বে লোকটাকে দেখেওনি, চেনেও না।

কেবল একজন বললে, ওকে বার-দুই দেখেছে কানন রেস্টুরেন্টে অবিনাশের সঙ্গে। তবে সেও চেনে না লোকটাকে।

যে গুলজার সিংকে দেখেছে বললে, সকলেই তার মুখের দিকে তাকায়।

চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক যুবক। পরিচয় জানা গেল স্কুল-ফাইন্যাল পাস করে আর পড়াশুনা করেনি। খুরোট রোডে একটা ছাপাখানায় কাজ করে, কম্পোজিটার। বেশ নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। নাম জয়ন্ত বোস।

ইতিমধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল।

মৃতদেহটা স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে মর্গে রওনা করে দিয়ে জমাদার রামশরণ সিং একজন সেপাইকে অকুস্থলে প্রহরায় রেখে থানায় ফিরে এল।

সুদর্শন তখন ফোনে কিরীটীর সঙ্গে কথা বলছিল।

হ্যাঁ দাদা, আবার একটা খুন হয়েছে কাল রাত্রে।

কিরীটী ফোনে শুধায়, তোমার ঐ দশ নম্বর পল্লীরই কেউ নাকি?

না, পল্লীর কেউ নয়।… হ্যাঁ, আইডেনটি তার পকেটেই পাওয়া গেছে। লোকটা পাঞ্জাবী-নাম গুলজার সিং।

তাহলে গুলজার সিংহকে নিয়ে খুনের সংখ্যা হল সাত! কিরীটী বললে।

তাই। তবে ওই পল্লীর একজন মাধবী ছাড়া আর সব বাইরের লোক।

তারপর মোটামুটি মৃতদেহ সম্পর্কে ও যা বুঝতে পেরেছিল সব বলে গেল কিরীটীকে ফোনেই।

তোমার কি মনে হচ্ছে সুদর্শন?

কিরীটী প্রশ্ন করে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সুদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ শুনে।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে দাদা, সব হত্যা-ব্যাপারগুলোই এক সূত্রে গাঁথা। আপনার কি মনে হয়? সুদর্শন প্রশ্ন করে।

তাই তো মনে হচ্ছে আপাতত। কিরীটী জবাব দেয়।

কিন্তু একজন ছাড়া কেউ পল্লীর বাসিন্দা নয়।

না হোক, তবু একটা কথা ভুলো না ভায়া, সব কটি হত্যাই ওই পল্লীর আশেপাশে সংঘটিত হয়েছে-যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে একজন ছাড়া সবাই বাইরের লোক হলেও ঐ জায়গায় সবারই গতিবিধি হয়ত ছিল—which has got an importance।

সুদর্শন কোন জবাব দেয় না।

কিরীটী আরও বলে, তাছাড়া ঐ হত্যাকাণ্ডগুলোর আরও একটি দিক আছেতোমার মনে হয়েছে কিনা জানি না!

কি বলুন তো দাদা?

যদি ধরে নিই, প্রত্যেকটি হত্যার সঙ্গেই তোমার ওই দশ নম্বর পল্লীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এবং ওই পল্লীরই এক বা একাধিক ব্যক্তির বিশেষ কোন স্বার্থের সঙ্গে ও হত্যাকাণ্ডগুলো জড়িয়ে—তাহলে–

আপনি কি বলতে চান দাদা?

সুদর্শনকে থামিয়ে দিয়ে কিরীটী বলে, যা বলতে চাই তা যদি হয় তো ওই পল্লীর মধ্যেই কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই হত্যার বীজ লুকিয়ে আছে।

কিন্তু মাধবীর হত্যার ব্যাপারটা

তুমি কিন্তু প্রথম থেকেই একটু ভুল করছ সুদর্শন!

ভুল?

হ্যাঁ। মাধবীর হত্যার ব্যাপারটাকে প্রথম থেকেই আলাদা করে ভাবার বা দেখবার চেষ্টা করছ। প্রেম বা প্রতিহিংসা হয়ত কিছু তার হত্যার ব্যাপারে থাকতে পারে এবং থাকাটা অসম্ভবও নয়, তাহলেও আমার মনে হচ্ছে—কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটা তা নয়, মূলে হয়ত সেই একই কার্যকারণ যা গত তিন বছর ধরে এতগুলো লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে।

একটু থেমে তারপর কিরীটী বলে, ভাল কথা, সাবিত্রীর সঙ্গে আলাপ কেমন হল?

কেন বলুন তো?

Dont neglect her! বলে কিরীটী ওপাশে ফোনটা নামিয়ে রাখল মৃদু হাসির সঙ্গে।

.

২২.

কিরীটীর শেষ কথাগুলো সুদর্শনকে যেন নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।

সে ফোনটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়। মনে মনে ভাবে, তবে কি সে সত্যি-সত্যিই আগাগোড়া একটা ভুল পথ ধরে চলেছে?

কিন্তু তাহলেও মনে হচ্ছে, মাধবী-ওই ওয়াগন ভেঙে চুরি যারা করে এবং দীর্ঘদিন ধরে এ তল্লাটে যারা চোরা কারবার চালিয়ে এসেছে, তাদেরই দলের একজন—এ সম্ভাবনাটায় কেন যেন তার মন সায় দেয় না। ঐ দিক দিয়ে কথাটা যেন সে কিছুতেই ভাবতে পারে না।

মাধবী কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির ও showy টাইপের মেয়ে ছিল নিঃসন্দেহে এবং অফিসে চাকরি করার বাইরে তার অভিনেত্রী জীবনের মধ্যে হয়ত কিছুটা যৌন উচ্ছৃঙ্খলতাও ছিল।

কিন্তু তাই বলে অমন একটি শিক্ষিত মেয়ে চোরাকারবারীদের দলে যে ভিড়ে যেতে পারে, অতটা নিচে যে নামতে পারে—ভাবতে মনটা কেন যেন তার কিছুতেই সায় দেয় না।

তবে মনুষ্যচরিত্র নাকি বিচিত্র এবং বিশেষ করে নারীচরিত্র।

তাছাড়াও আজও কিরীটীর কথার ভাবে বোঝা গেল সাবিত্রী সম্পর্কে সে একটু উৎসুক, কিন্তু কেন? তবে কি সাবিত্রীকেই কিরীটী সন্দেহ করে।

কিরীটীর কথায় আরও একটা ব্যাপার স্পষ্টই মনে হল, এ তল্লাটের সব হত্যাব্যাপারগুলোই নাকি একই সূত্রে গাঁথা। সব কিছুর মূলে একই কার্যকারণ। এবং হত্যার বীজ ওই পল্লীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার মতে!

পল্লীর সকলকে সুদর্শন চেনে না। চেনার বা জানবার সুযোগও তার হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে মোটামুটি যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে বা যারা তার মনের মধ্যে আঁচড় কেটেছে, তারাও যে একেবারে সবাই খাঁটি ও নির্দোষ, তাও যেন মন তার মেনে নিতে চায় না।

হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, হরগোবিন্দ, নরহরি সরকার, অমলেন্দু, অবিনাশ…

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে অবিনাশ ও জয়ন্ত বোসের কথা এবং মনে পড়ে জমাদার রামশরণ সিং বলছিল, ওই জয়ন্ত বোসই গুলজার সিংকে নাকি দিন-দুই কানন রেস্টুরেন্টে অবিনাশের সঙ্গে দেখেছিল।

তাতে করে অন্তত এটা প্রমাণিত হচ্ছে গুলজার সিংয়ের এ তল্লাটে যাতায়াত ছিল। এ তল্লাটে গুলজার সিং লোকটা একেবারে অপরিচিত নয়।

আরও একটা কথা, পূর্বে মাধবী ছাড়া আরও পাঁচজন যে নিহত হয়েছিল গত তিন বছরে, তারাও পল্লীর কেউ নয়—বাইরেরই লোক।

তাদের মধ্যে দুজন ছিল যা পূর্ববর্তীদের থানার ডাইরির রেকর্ড থেকে জানতে পারা গেছে-দুজনেই বাঙালী, নাম সুধাংশু আর গোবিন্দ—দুজনেই লরী-ড্রাইভার।

আর একজন পাঞ্জাবী মুসলমান আনোয়ার খাঁ, সেও দূরপাল্লার লরী-ড্রাইভার ছিল।

একজন মাদ্রাজী সেলসম্যান একটা বিলাতি ওষুধ কোম্পানির, নাম থিরুমল ও একজনের পরিচয় যা সংগৃহীত হয়েছিল সে উত্তরপ্রদেশের লোক-মহারাজ চৌধুরী, লোকটার লরীর ব্যবসা ছিল।

গুলরাজ সিংয়ের অবিশ্যি পুরো পরিচয়টা এখনও পাওয়া যায়নি, তবে আর যাদের পরিচয় ডাইরির রেকর্ডে আছে, তারা সবাই লরী-ড্রাইভার বা লরীর মালিক।

কথাটা ভাবতে থাকে সুদর্শন।

লোকগুলো কেউ ছিল লরী-ড্রাইভার, কেউ ছিল লরীর মালিক।

অবিশ্যি থানার লিখিত ডাইরি ঐ লোকগুলো সম্পর্কে যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় তাহলে কেউই তাদের মধ্যে চোরাকারবারী বলে মনে হয় না।

হয়ত আসল কারবারী যারা তার নেপথ্যেই থেকে গিয়েছে বরাবর পুলিসের সন্দেহ দৃষ্টি বাঁচিয়ে-ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আচ্ছা এমন কি হতে পারে, তারা এই দশ নম্বর পল্লীর কেউ।

তাই যদি হয় তো কে হতে পারে?

.

২৩.

চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা সুদর্শনের মনে মধ্যে উদয় হয়। হয়ত ওয়াগন ভেঙে যেসব মাল চুরি করা হত, সে-সব কলকাতা শহরে বা অন্যান্য জায়গায় লরী করে পাচার করা হত এবং এখনও হচ্ছে।

ওয়াগন ভেঙে মাল চুরির ব্যাপারটাও গত তিন-চার বছর ধরে চলেছে-যা থানার পূর্ববর্তী অফিসারদের ডাইরির রেকর্ড থেকেই জানা যায়।

দশ নম্বর পল্লী ও তার পেছনের খোলা মাঠটার ওপাশেই রেলওয়ে ইয়ার্ড, যেখানে সব মালগাড়ি সান্টিং করা থাকে, অনেক সময় বাইরে থেকে লোডেড হয়ে আসবার পর ও এখান থেকে মাল লোডিংয়ের পরেও।

সব চাইতে বড় কথা, হত্যাগুলোও সব দশ নম্বর পল্লীর আশেপাশে সংঘটিত হয়েছে।

সব কিছু পর পর চিন্তা করলে স্বভাবতই মনে হয় একের সঙ্গে অন্যের একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র কোথাও যেন আছে। আর থাকাটা কিছু বিচিত্র নয়।

সব গিঁটগুলোই সম্ভবত একটা দড়ির মধ্যেই রয়েছে।

রামশরণ জয়ন্ত বোসকে মাঠ থেকে আসার সময় সঙ্গে করেই এনেছিল, যদি সুদর্শন তাকে কোন প্রশ্ন করতে চায় এই ভেবে। জয়ন্তকে রামশরণ থানার বাইরের ঘরেই বসিয়ে রেখেছিল।

থানার ছোটবাবু সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী সুদর্শনের সামনে এসে দাঁড়াল—স্যার?

অ্যাঁ? কিছু বলছিলেন মিস্টার চক্রবর্তী?

বলছিলাম স্যার, জয়ন্ত বোসকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন?

কে জয়ন্ত বোস?

ওই দশ নম্বর পল্লীতেই থাকে, একজন কম্পোজিটার। যে রামশরণকে বলেছে ওই মৃত ব্যক্তি গুলজার সিংকে নাকি দিন-দুই কানন রেস্টুরেন্টে দেখেছে।

হ্যাঁ, ডাকুন তো লোকটিকে।

জয়ন্ত এসে সুদর্শনের কামরায় ঢুকল।

সুদর্শন মুখ তুলে তাকাল লোকটার দিকে। বেশ নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। দু-চোখে শশকের ভীত-চকিত দৃষ্টি।

বসুন। আপনার নাম জয়ন্ত বোস? সুদর্শন প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে স্যার।

দশ নম্বর পল্লীতেই থাকেন?

আজ্ঞে না, খুরোট রোডে থাকি।

এখানকার দশ নম্বর পল্লীতে আপনার যাতায়াত আছে শুনলাম?

হ্যাঁ স্যার, এখানে আমার দু-চারজন জানা লোক থাকে।

হুঁ, তা আপনি কোথায় কাজ করেন?

সুধাকর প্রিন্টিং ওয়ার্কসের আমি একজন কম্পোজিটার স্যার।

গুলজার সিং—মানে ওই মৃত লোকটাকে আপনি দেখেছিলেন কানন রেস্টুরেন্টে?

হুঁ স্যার, দিন-দুই দেখেছি অবিনাশবাবুর সঙ্গে।

কি করছিল?

আজ্ঞে চা-টা খাচ্ছিল ওরা।

সঙ্গে অবিনাশ ছাড়া আর কেউ ছিল?

আজ্ঞে আর কাউকে দেখিনি। একাই ছিল।

কোন্ সময় ওদের রেস্টুরেন্টে দেখেছিলেন?

দুদিনই সন্ধ্যার পর—মানে তখন সাড়ে সাতটা-আটটা হবে।

ওই সময় আপনি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন কেন?

আজ্ঞে প্রেস থেকে ফেরার পথে ঐ সময় রোজই আমি ওখানে এক কাপ চা খেয়ে আসি।

ওখানে বুঝি খুব ভাল চা হয়?

হ্যাঁ স্যার। এলাচদানা-টানা কি সব মিশিয়ে একরকম স্পেশাল চা করে। চমৎকার খেতে।

স্পেশাল চা।

আজ্ঞে স্যার। ওই পথ দিয়ে মিলের সব পাঞ্জাবী লেবাররা যায়, তারা ওখানে চায়ের জন্য ভিড় করে। খুব বিক্রী।

হুঁ। রেস্টুরেন্টটার মালিক কে?

আজ্ঞে স্যার, গুলাব সিং।

পাঞ্জাবী?

হ্যাঁ। তবে অনেক দিন—প্রায় জন্ম থেকেই বাংলাদেশে আছে তো—ঠিক আমাদের মতই বাংলা বলতে পারে, পড়তেও পারে।

দশ নম্বর পল্লীর অনেকেই ওখানে চা খেতে যায় বোধ হয়?

তা ঠিক জানি না স্যার। তবে—

তবে?

দু-চারজন ছাড়া অন্য কেউ আমার নজরে বড় একটা পড়েনি। তবে আমি তো খানিকটা বে-টাইমে যাই

আর কাকে কাকে দেখেছেন?

আজ্ঞে আমাদের হীরু সাহা, অবিনাশ-অমলেন্দু, দুই ভাই, আর একদিন দেখেছিলাম সুবোধবাবুকেও।

মানে ওই সুবোধ মিত্র?

আজ্ঞে স্যার।

ওদের প্রত্যেককেই আপনি চেনেন?

চিনি।

রেস্টুরেন্টটা কেমন, পরিষ্কার?

হ্যাঁ স্যার। রেডিও আছে, রেডিওগ্রাম আছে, লেডিজদের জন্য স্পেশাল বন্দোবস্তও আছে দোতলায়।

দোতলা তো নয় রেস্টুরেন্টটা!

আজ্ঞে ঠিক তা নয়—তবে ভিতরে কাঠের আর একটা ফ্লোর আছে মাথার ওপরে, তাই বলছিলাম আর কি–

মেয়েছেলেরাও যায় তাহলে বলুন সেখানে?

নিশ্চয়ই, স্যার, যায় বৈকি। তাদের বসবার জন্য স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে কানন রেস্টুরেন্টে।

.

২৪.

সুদর্শন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করে।

জয়ন্তবাবু!

আজ্ঞে?

কয়েক দিন আগে এই পল্লীর যে মেয়েটি খুন হয়েছে, তাকে চিনতেন না?

কে, মাধবীদি তো স্যার? নিশ্চয়ই। ভাল চাকরি করত, সুন্দর থিয়েটারও করত। একবার দেখেছিলাম মাধবীদির থিয়েটার। কি ফার্স্ট ক্লাস যে অ্যাকটিং করত স্যার মাধবীদি। আহা, আমি তো কেঁদেই ফেলেছিলাম।

তাই বুঝি?

আজ্ঞে ভারি প্যাথেটিক সিনটা ছিল কিনা।

কোথায় দেখেছিলেন থিয়েটার তার?

কলকাতার রঙমহল থিয়েটারে। আমাকে হীরু একটা কার্ড দিয়েছিল।

কে দিয়েছিল কার্ড! সুদর্শন যেন চমকে প্রশ্নটা করে।

আজ্ঞে স্যার, হীরু সাহা। খুব গায়ে জোর, দশ পল্লীর শ্রী।

পল্লীর শ্রী?

আজ্ঞে স্যার, গত বছর সবাই ওকে ওই টাইটেল আর রুপোর মেডেল দিয়েছিল।

সুদর্শন বুঝতে পারে, মানুষটা সরল এবং কিছুটা বোকা টাইপের। নচেৎ থানায় বসে অমন করে থানা-অফিসারের সামনে মন খুলে কথা বলতে পারত না।

জয়ন্তবাবু!

বলুন স্যার? আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?

স্কুল-ফাইনাল পাস করেছিলাম স্যার, কিন্তু মামা আর পড়াল না। বললে, এবার নিজের রাস্তা দেখ। কি আর করি, ঢুকে পড়লাম ছাপাখানায়।

মামা কে? কি তার নাম?

আজ্ঞে ওই যে দশ নম্বর পল্লীতে থাকে—রাধেশ্যাম—

রাধেশ্যাম।

কেমন যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্নটা করে সুদর্শন তাকাল জয়ন্তর মুখের দিকে।

হ্যাঁ স্যার। দেখেননি তাকে? ওই যে নরহরি সরকার-দিনরাত মুখে রাধেশ্যাম বুলি—

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় নরহরি সরকারকে সুদর্শনের। বলে, আপনি তাঁরই ভাগ্নে নাকি?

আজ্ঞে সম্পর্কে তাই, তবে রাধেশ্যাম স্বীকার করে না।

স্বীকার করে না!

না।

কেন?

গরিব বিধবা বোনের ছেলে। স্কুল-ফাইনাল পর্যন্ত পড়িয়েছে, খেতে দিয়েছে তাই যথেষ্ট–

কিন্তু ওঁর তো শুনেছি বেশ টাকা-পয়সা আছে?

হ্যাঁ স্যার ঠিক শুনেছেন। অমন ন্যালাখ্যাপার মত থাকলে কি হবে, একটি ঘুঘু। তাই বুঝি?

হ্যাঁ। আর টাকার কুমীর।

অনেক টাকা বুঝি?

অনেক।

ওই তো ছোট্ট একটা সোনা-রুপোর দোকান। সেই দোকান থেকে কত আয় ইনকাম হয়।

তা জানি না স্যার। রাধেশ্যাম যে কোথা থেকে টাকা আনে তা সে-ই জানে—তবে তার অনেক টাকা। সত্যি কথা বলতে কি, সেই কথাটা আমি জানতে পেরেছি জেনেই সে আমায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

নরহরির তো শুনেছি বৌ নেই-এক ছেলে, এক মেয়ে!

মামীমা ছিল লক্ষ্মী স্যার। মামী মারা যাবার পরই তো রাধেশ্যাম আমাকে তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে।

তা নরহরির ছেলে কি করে?

কি আর করবে! রাধেশ্যামের যাত্রার দলে সখী সাজে। লেখাপড়া তো করল না!

আর মেয়ে?

রাধা মেয়েটা বড় ভাল স্যার। লেখাপড়াতেও ভাল ছিল খুব, কিন্তু রাধেশ্যাম তাকে পড়াল না। স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে এনে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছে। বলে বিয়ে দেব। বিয়ে দেবে না ছাই দেবে! বেটা চামার, কেবল টাকাই চেনে। স্যার, অনেক কথা রাধেশ্যাম সম্পর্কে আপনাকে বললাম, ও যেন না জানতে পারে। জানলে আমায় ঠিক একদিন খুন করে ফেলবে।

না না, জানতে পারবে না। আপনার ভয় নেই।

দেখবেন স্যার—লোকটা কিন্তু ডেঞ্জারাস। মুখে কেবলই রাধেশ্যাম বুলি আওড়ালে কি হবে, তলে তলে কেবল শয়তানী মতলব।

আচ্ছা আমি শুনেছিলাম আপনার মামা নাকি মাধবীকে বিয়ে করবার জন্য একময় ক্ষেপে উঠেছিল।

কার কাছে শুনলেন স্যার কথাটা?

শুনেছি। সত্যি নাকি কথাটা?

সত্যি। তেমন খেয়েছিলও মাধবীদির কাছে পটাপট!

কি খেয়েছিল?

কেন, ছাতার বাড়ি!

তাই নাকি? সুদর্শন হেসে ফেলে। যাঃ, আপনি বাড়িয়ে বলছেন!

হ্যাঁ, স্যার। সত্যি বলছি, গড় প্রমিস।

কিন্তু আমি তো শুনেছি, আপনার মামার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল মাধবী দেবীর। যাতায়াত ছিল তার ওই দোকানে।

কার কাছে কথাটা শুনলেন স্যার?

শুনেছি আমি।

না স্যার, যে বলেছে স্রেফ গুল দিয়েছে। এক-আধবার মাধবীদি হয়ত গিয়ে থাকবে রাধেশ্যামের দোকানে গয়না-টয়না গড়াতে। রাধেশ্যামকে তো জানি, ওই সময়েই হয়ত হাতটাত ধরবার চেষ্টা করেছিল মাধবীদির, সঙ্গে সঙ্গে পটাপট ছাতার বাড়ি!

আচ্ছা জয়ন্তবাবু?

বলুন স্যার।

আপনার মামা বন্ধকী কারবারও করেন, তাই না?

রাধেশ্যাম যে কি করে আর কি না করে ভগবানও জানেন না। বললাম তো স্যার, ও একটি বাস্তুঘুঘু। কিন্তু এবারে আমি উঠতে পারি স্যার?

উঠবেন?

হ্যাঁ স্যার, প্রেসে যেতে হবে।

আচ্ছা আপনি আসুন।

জয়ন্ত যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় এবং যাবার আগে আবার বলে, দেখবেন স্যার, রাধেশ্যামের কানে যেন এসব কথা না যায়।

না না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

জয়ন্তকে সুদর্শন বিদায় দিল।

.

২৫.

বাইরে জীপের শব্দ শোনা গেল ঐসময়।

তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সুদর্শন।

লালবাজার থেকে বোধ হয় হোমিসাইডাল স্কোয়াডের কেউ এল।

সুদর্শনের অনুমান মিথ্যা নয়। হোমিসাইডাল স্কোয়াডের রাজেন বোস ইন্সপেক্টার জীপ থেকে নামলেন।

নমস্কার মিস্টার মল্লিক।

আসুন মিস্টার বোস।

চলুন, একবার স্পটটা ঘুরে আসি তাহলে?

চলুন।

রাজেন বোসের জীপেই উঠে বসে সুদর্শন। জীপে যেতে যেতে দুজনের মধ্যে। কথা হয়।

আপনার কি মনে হয় মিস্টার মল্লিক? রাজেন বোস প্রশ্ন করেন।

খুনটা এই তল্লাটেই গতরাত্রে কোথাও কোন এক সময় হয়েছে, তারপর হয়ত ডেড বডিটা ওইখানে নিয়ে গিয়ে ফেলে এসেছে হত্যাকারী ও তার দলবল। সুদর্শন বললে।

আপনার তাহলে মনে হয় এর পিছনে একটা গ্যাং আছে?

আমার তো অন্তত ধারণা তাই। সুদর্শন বলে।

ডি. এস. ও. সব শুনে তাই বলছিলেন। তিন বছরের মধ্যে এই তল্লাটে এতগুলো খুন, অথচ আজ পর্যন্ত খুনগুলোর কোন একটা হদিস পাওয়া গেল না।

আমার মনে হয় মিস্টার বোস, খুনগুলো সব একই সূত্রে গাঁথা–

কি রকম?

ওই ওয়াগন ভেঙে ইয়ার্ড থেকে মাল সরাবার ব্যাপারে সে গ্যাংটা কাজ করছে, এ তাদেরই কীর্তি।

আশ্চর্য নয় কিছু। তাছাড়া দেখুন না, ইয়ার্ডে এত পুলিস-প্রহরা রেখেও আজ পর্যন্ত ওই ওয়াগন থেকে মাল সরাবার ব্যাপারের কোন হদিস পাওয়া গেল না। বেটারা যে কি করে আগে থাকতেই টের পায়! চটপট হাওয়া হয়ে যায়!

সুদর্শন প্রত্যুত্তরে বললে, হয়ত যারা মাল খালাস করে বা মাল লোড করে, তাদেরই কেউ সন্ধান দেয় ওদের কিংবা রেলওয়ের কোন অফিসার বা ক্লার্ক। দলের মধ্যে হয়ত তারাও আছে।

সে সন্দেহ যে আমাদেরও মনে আসেনি মিস্টার মল্লিক, তাও নয়। যথেষ্ট সাবধানতাও নেওয়া হয়েছে সেজন্য।

ইতিমধ্যে জীপ মাঠের মধ্যে এসে গেল।

বটতলায় গাড়িটা রেখে ওরা হেঁটে এগিয়ে গেল স্পটে। যে সেপাইটা প্রহরা দিচ্ছিল সে সেলাম করল।

সুদর্শন আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে বললে, there you are, exactly এইখানেই ছিল ডেড বডি পড়ে।

রাজেন বোস সুদর্শন-প্রদর্শিত জায়গাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ধরে জায়গাটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে কি সব দেখলেন।

তারপর বললেন, আগের বারে সেই মেয়েটির ডেড বডিটা ওই বটগাছতলাতেই পড়েছিল মিস্টার মল্লিক, তাই না?

হ্যাঁ।

আচ্ছা এমনও তো হতে পারে মিস্টার মল্লিক, এখানেই গুলজার সিংহকে হত্যা করা হয়েছিল?

পিস্তলের গুলিতে যখন মারা হয়েছে তখন কি আশেপাশে তাহলে রক্তচিহ্ন থাকত না?

কিন্তু ডেড বডি টেনেহিঁচড়ে এখানে আনার তো কোন চিহ্ন চোখে পড়ছে না আশেপাশের মাটিতে! রাজেন বোস বলেন।

কিন্তু একটা কথা ভুল করছেন কেন মিঃ বোস, ডেড বডি ক্যারি করে এখানে নিয়ে আসা হলে সেরকম কোন চিহ্ন কি থাকত না? আর তাই আমার মনে হয়, ওই হত্যার ব্যাপারে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি নিশ্চয়ই জড়িত ছিল। সুদর্শন বলে।

তা অবিশ্যি হতে পারে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না, ডেড বডিটা রাস্তায় কোথাও না ফেলে এই মাঠের মধ্যেই বা হত্যাকারীরা বয়ে আনতে গেল কেন?

সেটা হয়ত যেখানে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক তার আশেপাশে কোথাও ডেড বডিটা পড়ে থাকলে পুলিসের ওই জায়গাটার ওপর নজর পড়তে পারে বলেই হত্যার পর বেশ কিছুটা দূরে ডেড বডিটা এনে ফেলে দিয়েছে যাতে করে অকুস্থান সম্পর্কে আমরা সচেতন হতে না পারি।

অস্বীকার করছি না, কিন্তু এই মাঠেই বা কেন ফেলা হল? যাকগে, চলুন ফেরা যাক।

ওরা আবার জীপে গিয়ে উঠল।

.

পরের দিন বিকেলের দিকে।

কিরীটী সুদর্শনকে ফোনে ডেকে পাঠিয়েছিল। সুদর্শন হাওড়ায় এসে একটা বালিগঞ্জ অভিমুখী বাসে উঠতেই সাবিত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সাবিত্রী একটা সীটে বসেছিল।

সুদর্শনই প্রথমে সাবিত্রীকে দেখতে পেয়ে বলে, সাবিত্রী, তুমি!

সাবিত্রী সুদর্শনের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসে।

সুদর্শনের বসবার জায়গা ছিল না। কিন্তু সাবিত্রীর পাশের সিটটা তখনও খালিই ছিল।

সাবিত্রী ডাকে, এখানে এসে বসুন না।

সুদর্শন এগিয়ে গিয়ে সাবিত্রীর পাশেই বসে পড়ে।

কোথায় যাচ্ছ? সুদর্শন প্রশ্ন করে।

দিদির এক বন্ধু অরুণাদি মীর্জাপুর স্ট্রীটে থাকে, তার কাছে যাচ্ছি। অরুণাদি একটা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। দেখি তাকে বলে, একটা চাকরি যদি করে দিতে পারে তার স্কুলে।

কেন, সত্যিই কি তুমি পরীক্ষা দেবে না?

ফিস যোগাড় হলে দেব। কিন্তু সে কথা তো পরে ভাবলেও চলবে। আপনি তো সবই জানেন। আপাতত সংসারটা তো চালাতে হবে?

কেন, অবিনাশবাবু আর অমলেন্দুবাবু কি সত্যিই কোন সাহায্য করবেন না?

দাদা তো গতকালই চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে মিলের কোয়ার্টারে—

চলে গেছেন?

হ্যাঁ।

আর অমলেন্দুবাবু?

ছোড়দা অবিশ্যি বাড়ি ছেড়ে যায়নি, তবে—

কি, তবে?

তাকেও তো আর একটা সংসার টানতে হয়।

তার মানে?

প্রশ্নটা করে সুদর্শন সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকাল।

সাবিত্রীও মনে হয় যেন হঠাৎ ঐ কথাটা বলে থমকে গিয়েছে, কেমন যেন একটু বিব্রত।

সুদর্শন আবার প্রশ্ন করল, আর একটা সংসার টানতে হয়—কি বলেছিলে সাবিত্রী! কথাটা তো ঠিক বুঝলাম না!