২০-২১. কথাটা আর চাপা রাখা গেল না

কথাটা আর চাপা রাখা গেল না।

দালাল সাহেবই সকলকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, রায়বাহাদুরের হত্যাপরাধেই শকুনি ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামার হত্যাপরাধে শকুনি ধৃত হয়েছে এবং বর্তমানে সে হাজতে বাস করছে।

শীতের বেলায় শেষ আলোর ম্লান রশ্মিটুকু একটু একটু করে ক্রমশঃ ধরিত্রীর বুক থেকে যেন মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার ধূসর ছায়া বাদুড়ের মত ডানা মেলে যেন চারিদিকে ঘনিয়ে আসছে একটা কালো পর্দার মত শ্রীনিলয়ের উপরে। কোথাও এতটুকু সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই।

অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা আশঙ্কা দুঃস্বপ্নের মত সকলেরই মনকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

সন্ধ্যা নাগাদ ডাঃ সেনও এসে শ্রীনিলয়ে উপস্থিত হলেন।

কিরীটীর ঘরের মধ্যে সকলে উপস্থিত হয়। একমাত্র দালাল সাহেব বাদে, কাকাসাহেব অবিনাশ চৌধুরী, দুঃশাসন চৌধুরী, বৃহন্নলা চৌধুরী, তার স্ত্রী পদ্মা দেবী, গান্ধারী দেবী, তাঁর মেয়ে রুচিরা দেবী, সমীর বোস, নার্স সুলতা কর, ডাঃ সানিয়াল, ডাঃ সমর সেন এবং কিরীটী নিজে।

একমাত্র কিরীটী ছাড়া ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলের চোখেমুখেই কেমন একটা যেন আতঙ্কের ভাব। কিরীটী তার পাইপটা হাতে নিয়ে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন আপনাদের সকলকে কেন এ-সময় এ-ঘরে আমি ডেকে এনেছি—একটু থেমে বলে, আপনারা সকলেই দালাল সাহেবের মুখে শুনেছেন রায়বাহাদুরের হত্যা-অপরাধে বোধহয় শকুনিবাবুকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিস অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে কোন কথাই বের করতে পারেনি। অথচ আপনারা জানেন না কিন্তু আমি জানি, শকুনিবাবু যদি মুখ খোলেন হত্যারহস্যটা জলের মত হয়ে যাবে এখনি। কারণ তিনি এই হত্যার ব্যাপারে এমন কতকগুলো মারাত্মক কথা জানেন যা একবার পুলিসের গোচরীভূত হলে হত্যাকারী আর তখন আত্মগোপন করে থাকতে পারবে না।

কিরীটীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই গান্ধারী দেবী প্রশ্ন করে, তবে কি শেকো দাদাকে হত্যা করেনি?

না। বজ্রকঠিন কিরীটীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু আমি জানি হত্যাকারী কে! হত্যাকারী যতই চতুর হোক এবং যত বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়ে থাক না কেন, এমন একটি মারাত্মক চিহ্ন সে রায়বাহাদুরের শয্যার পাশে রেখে গিয়েছে গতরাত্রে হত্যা করতে এসে, যেটি আজ দুপরে সেই ঘরটা পুনরায় গিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার সময়ই আমার নজরে পড়েছে। সেটি কি জানেন?

সকলেই চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে স্থির অপলক দৃষ্টিতে।

কিরীটী বলে, যে ছোরাটা গতরাত্রে রায়বাহাদুরকে হত্যা করবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল তারই শূন্য খাপটা। তাড়াতাড়িতে হত্যাকারী খাপটা ঘরের মধ্যে ভুলে ফেলে এসেছিল। সেই শূন্য চামড়ার খাপটার গায়েই হত্যাকারীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে যা থেকে সহজেই প্রমাণ। করা যাবে হত্যাকারী কে?

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি নরনারীই একেবারে যেন বোবা। সূচ পতনের শব্দও বোধ হয় শোনা যাবে। কারও মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই।

কিরীটী আবার বলতে থাকে, আপনাদের সকলের কাছেই আমার শেষ অনুরোধ এবং সেইটুকু জানবার জন্যই আপনাদের সকলকে আমি এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, এখনও যদি আপনাদের কারও কিছু জানা থাকে যা এখনও আপনারা গোপন করে রেখেছেন আমাকে বলুন। অন্যথায় পুলিস আপনাদের প্রত্যেককেই নাজেহালের একেবারে চূড়ান্ত করবে। অপমান ও লাঞ্ছনারও অবধি হয়ত রাখবে না। দালাল সাহেব সহজে আপনাদের কাউকে নিষ্কৃতি দেবে

জানবেন। কিন্তু তথাপি সব নিশ্চুপ। কারও বাক্যস্ফূর্তিনেই। বোবা ভীত দৃষ্টিতে কেবল পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

একজন পুলিশ অফিসার ঘরের বাইরে দ্বারের নিকট প্রহরায় দাঁড়িয়েছিল, সে এমন সময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কিরীটীর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নস্বরে যেন কি বলল। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে সম্বোধন করে বলে, বেশ, আপনাদের আমি আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, পরস্পর আপনারা আলোচনা করে দেখুন। নীচের থেকে আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই কাজ সেরে আসছি।

চলুন। কিরীটী পুলিস অফিসারটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

নীচের একটি ঘরে নিঃশব্দে পুলিসের প্রহরায় মাথা নীচু করে একটা চেয়ারে শকুনি ঘোষ বসেছিল। কিরীটীর পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল। চোখের ইঙ্গিতে কিরীটী পুলিসের লোকটিকে ঘর ত্যাগ করার নির্দেশ দিতেই সে ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।

ঘরের মধ্যে আর তৃতীয় প্রাণী নেই, কিরীটী আর শকুনি ছাড়া।

কিরীটীকে একা ঘরের মধ্যে পেয়ে এতক্ষণে সহসা শকুনি কান্নায় যেন ভেঙ্গে পড়ে। অরুদ্ধ কণ্ঠে বলে, আমাকে বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি—আমি মামাকে খুন করিনি।

কিন্তু পুলিস যে সে কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না!

কেন—কেন? আমি নিদোষ, আমি জানি না, কিছুই জানি না।

কিন্তু আপনার ঘরের কোণে একটা ধুতি পাওয়া গিয়েছে, তাতে রক্তের দাগ এল কি করে?

শকুনি নিশ্চুপ।

তাছাড়া গতকাল রাত্রে সাড়ে তিনটে থেকে রাত সাড়ে চারটে পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? ঘরে ছিলেন না তো?

আমি—

অস্বীকার করবার চেষ্টা করবেন না। আমি বলছি আপনি ঘরে ছিলেন না—কোথায় ছিলেন? এখনও বলুন? কথার জবাব দিন?

কুণ্ডলেশ্ববাবুর ঘরে গিয়েছিলাম। দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে শকুনি জবাব দিল।

কেন গিয়েছিলেন সেখানে?

আমি—মানে—

মদ খেতে, তাই না?

শকুনি চুপ।

কতদিন ধরে মদ্যপান করছেন?

মদ্যপান!

হ্যাঁ। শমাই বোধ হয় ঐ ব্যাপারে আপনাকে রপ্ত করিয়েছেন। আজ সকালেও আপনার কথা বলবার সময় মুখে অ্যালকোহলের গন্ধ পেয়েছি।

বছরখানেক হবে।

হুঁ। তারপর কখন ফিরে আসেন সেখান থেকে কাল রাত্রে?

রাত সাড়ে চারটে হবে বোধ করি তখন।

সাধারণতঃ কি আপনি ঐ সময়েই শমার ঘরে যেতেন মদ খেতে?

হ্যাঁ। পাছে জানাজানি হয়ে যায় তাই ঐ সময়েই যেতাম তার ঘরে।

পয়সা কে যোগাত, আপনি নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

ঘরে ফিরে এসে কি দেখেন?

রক্তাক্ত আমারই পরনের একটা ধুতি ঘরের কোণে মেঝেতে পড়ে আছে। প্রথমটা আমারই পরিধানের একটা ধুতিতে রক্ত দেখে এমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে কি করি বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর রক্তের দাগগুলো কুঁজোর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলি কাপড় থেকে।

হুঁ। আচ্ছা রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ আপনি গতরাত্রেই পেয়েছিলেন, তাই না?

না। গতরাত্রে পাননি সংবাদটা?

না।

তবে?

আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর জানতে পারি।

.

সেই রাতেই। রাত বোধ করি পৌনে চারটে হবে।

নিঃশব্দ নিঝুম শীতের রাত। কেবল একটুক্ষণ আগে নাইট কিপার হুম সিংয়ের খবরদারীর চিৎকারটা শোনা গিয়েছে।

সেই ঘর। গতকাল রাত্রে এই ঘরের মধ্যেই রায়বাহাদুর ছুরিকাঘাতে আততায়ীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে।

আজ শূন্য সেই শয্যা। কেবল গত রাতের নীল ঘেরাটোপে ঢাকা বাতিটা আজ নেভানোনা।

ঘরের একধারে ক্যাম্পখাটের উপর নিদ্রাভিভূত কিরীটী। আর কেউ ঘরের মধ্যে এই মুহূর্তে নেই। ঘরের দেয়ালে টাঙানো দেয়াল-ঘড়িটার একঘেয়ে টকটক শব্দ কেবল শূন্য ঘরের মধ্যে যেন সজাগ সতর্কবাণী উচ্চারণ করে চলেছে অন্ধকারের মধ্যে। কিরীটী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। সহসা নিঃশব্দে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তারপরই ঘরের মধ্যে অতি-সতর্ক পদসঞ্চারে প্রবেশ করল এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় নিদ্রিত কিরীটীর শয্যার দিকে।

অল্প পরে আর একটি ছায়ামূর্তি প্রবেশ করে সেই একই পথে। প্রথম ছায়ামূর্তি টেরও পেল না দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি যে তাকে অনুসরণ করে ঘরে ঐ মুহূর্তে তার পেছনেই প্রবেশ করল অন্ধকারে।

শায়িত কিরীটীর শয্যার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল প্রথম ছায়ামূর্তি, আর ঠিক সেই মুহর্তে যেন চোখের পলকে ভোজবাজির মত কিরীটী একটা গড়ান দিয়ে একেবারে শয্যা থেকে নীচে পড়ে গেল এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা আর্ত করুণ চিৎকার অন্ধকারকে চিরে দিয়ে গেল।

মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে সুইচটা টিপে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকেই ফিট করা হাজার শক্তির বৈদ্যুতিক বাতিটা জ্বলে ওঠে। মুহূর্তে ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে উজ্জ্বল আলোয় চারদিক ঝলমল করে ওঠে।

দালাল সাহেব কিরীটীর পূর্ব-নির্দেশমত এতক্ষণ তার খাটের তলাতেই ওৎ পেতে ছিলেন। তিনিও ততক্ষণে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন কিরীটীর পাশে।

রক্তাক্ত কলেবরে সামনের মেঝেতেই বসে হাঁপাচ্ছেন দুঃশাসন চৌধুরী। পেছনে রক্তমাখা হাতে তখনও দাঁড়িয়ে বাঈজী মুন্না, তার দুচোখে হিংসার আগুন যেন জ্বলছে। সহসা মুন্না বাঈজী পাগলের ন্যায় খিলখিল করে হেসে ওঠে, হি, হি! পাঁচ বছর ধরে তোকে খুঁজে বেড়িয়েছি। প্রতিশোধ—এতদিনে প্রতিশোধ নিয়েছি। কেমন কেমন হয়েছে!

Whats all this Mr. Roy? এতক্ষণে বিহ্বল হতচকিত দালাল সাহেবের কন্ঠে স্বর ফোটে।

কিরীটী দালাল সাহেবের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ভূপতিত দুঃশাসনের ক্ষতস্থান থেকে বিদ্ধ ছোরাটা টেনে বের করতে করতে বলে, চট করে ডাক্তারকে পাশের ঘর থেকে এখুনি একবার ডেকে আনুন, মিঃ দালাল!

দালাল সাহেব ডাক্তারকে ডাকতে ছুটলেন।

প্রচুর রক্তপাতে দুঃশাসন চৌধুরীর অবস্থা তখন ক্রমশই সঙ্গীন হয়ে আসছে।

মুন্না বাঈজী তখন যেন কেমন হঠাৎ নিঝুম হয়ে গিয়েছে—বিড়বিড় করে বলে চলেছে, কেমন জব্দ! কেমন প্রতিশোধ! পাঁচ-পাঁচ বছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি!

ডাঃ সানিয়াল ছুটে এলেন হন্তদন্ত হয়ে, কি ব্যাপার মিঃ রায়?

দেখুন তো! He has been stabbed!

কিন্তু দেখবার আর তখন কিছুই ছিল না। নিদারুণ ভাবে আহত ও প্রচুর রক্তপাতে চৌধুরীর অবস্থা তখন প্রায় সকল চিকিৎসার বাইরে চলে গিয়েছে। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে ও নাড়ী তার ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে; তথাপি পরীক্ষা করে বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে ডাক্তার মৃদুকণ্ঠে বলে, আশা নেই, কিন্তু কেন এমন করে স্ট্যাব করল দুঃশাসনবাবুকে মিঃ রায়?

জবাব দিল মুন্না বাঈজী, আমি—আমি প্রতিশোধ নিয়েছি নারীহত্যার—vendetta.

কয়েকটা হেঁচকি তুলে চৌধুরীর দেহটা স্থির হয়ে গেল।

মরেছে। এবার আপনারা আমায় ধরতে পারেন। শুনুন পুলিস সাহেব, আমার আসল নাম সাবিত্রী। একদিন ঐ নরপিশাচ দুঃশাসন আমার নারীত্বকে এমনি করেই হত্যা করেছিল, তারই প্রতিশোধ নিতে আমি তাকে হত্যা করেছি। আমি ধরা দিচ্ছি, আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়েছে। এবারে, আমি ফাঁসি যেতেও প্রস্তুত।

ভুল করেছেন সাবিত্রী দেবী। গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে কিরীটী হঠাৎ বলে।

চকিতে মুন্না বাঈজী কিরীটীর কথায় ফিরে কিরীটীর মুখের প্রতি তাকাল, ভুল করেছি!

হ্যাঁ, ভুল করেছেন। উনি তো দুঃশাসন চৌধুরী নন!

কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত যুগপৎ সকলেই একই সময়ে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে কিরীটীর দিকে তাকায়।

হতভম্ব দালাল সাহেবই সর্বপ্রথম কথা বললেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! উনি—উনি দুঃশাসন চৌধুরী নন?

না।

তবে কে? কে উনি?

২১.

রায়বাহাদুরের হত্যাকারী! খোঁজ নিয়ে দেখুন এতক্ষণে হয়ত তীব্র কোন ঘুমের ওষুধের প্রভাবে আসল ও সত্যিকারের দুঃশাসন চৌধুরী তাঁর ঘরে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে আছেন। দুঃশাসন চৌধুরীর ছদ্মবেশ উনি নিয়েছেন মাত্র।

এ কি বিস্ময়! সকলেই বাক্যহারা, নিস্পন্দ।

তবে উনি কে? দুঃশাসন চৌধুরী উনি নন? তবে কাকে—কাকে আমি হত্যা করলাম? বলতে বলতে পাগলের মতই মুন্না বাঈজী মৃতদেহটার উপরে লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হতেই, চকিতে ক্ষিপ্রহস্তে কিরীটী বাঈজীকে ধরে ফেলে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, শুধু আপনারই নয় সাবিত্রী দেবী, ভুল আমারও হয়েছে। ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত এমনি দাঁড়ানে আমিও তা ভাবতে পারিনি–নইলে এই হত্যাকাণ্ডটা হয়ত ঘটত না। উঃ What a mistake—what a mistake!

.

কিরীটী বলছিল : হত্যাকারী যে কেবল অসাধারণ ক্ষিপ্র ও চতুর তাই নয়, সুদক্ষ একজন। অভিনেতাও! আগাগোড়াই সে দুঃশাসন চৌধুরীকে ধ্বংস করবার জন্য এমন চমৎকার ভাবে প্ল্যান করে হত্যার কাজে অবতীর্ণ হয়েছিল, যাতে করে রায়বাহাদুরের হত্যাপরাধের সমস্ত সন্দেহ নিঃসন্দেহে হতভাগ্য দুঃশাসন চৌধুরীর উপরে গিয়ে পড়ে। আর হয়েছিলও তাই। ব্যাপারটা অবশ্য আমি গতকালই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু সবটাই আমার অনুমানের উপরে ভিত্তি বলে গতকাল রাত্রের ঐ ফাঁদটা পেতেছিলাম—ছোরার খাপের চার ফেলে। এবং রায়বাহাদুরেরই ঘরে নিজের শয়নের ব্যবস্থা করেছিলাম শুধু জানবার জন্য, কোন্ পথে হত্যাকারী আগের রাত্রে ঐ ঘরে প্রবেশ করে হত্যা করে গিয়েছিল। অবশ্য এটা স্থির জানতাম আমি, হত্যাকারী যত চতুরই হোক না কেন, রাত্রে সেই মারাত্মক একমাত্র হত্যার নিদর্শন ছোরার খাপটি সংগ্রহ করতে তাকে আসতে হবেই। কেননা হত্যাকারীর নিশ্চয়ই স্থিরবিশ্বাস হবে অত বড় মূল্যবান হত্যার প্রমাণটা আমি অন্য কোথাও না রেখে সবদা নিজের কাছে কাছেই রাখব। এখন আপনারা সকলেই বুঝতে পেরেছেন বোধ হয় যে আমার গণনায় ভুল হয়নি। সে আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে—এসেছে সে, কিন্তু এটা ভাবিনি ঐ সঙ্গে যে সাবিত্রী অর্থাৎ মুন্না বাঈজী, যার নারীত্বের মর্যাদা একদা দুঃশাসন চৌধুরী লুণ্ঠন করেছিল, প্রতিশোধ স্পৃহায় সে গানের মুজরা নিয়ে এ দুঃশাসনেরই খোঁজে দেশদেশান্তরে গত পাঁচ বছর ধরে তীক্ষ্ণ ছোরা কোমরে খুঁজে প্রতীক্ষ্ণয় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং এও বুঝিনি যে দুঃশাসনকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই তাকে হত্যার প্রথম সুযোগেই সাবিত্রী ক্ষুদার্ত বাঘিনীর মত উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একেই বলে নিয়তি। কেউ তা রোধ করতে পারে না। ভবিতব্য অলঙঘনীয়। অনিবার্য। কিন্তু তবুও বলব হত্যাকারীর প্ল্যানটা নিঃসন্দেহে অপূর্ব। অদ্ভুত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে খুনী হত্যার ব্যাপারে। আগে থেকেই সমস্ত আটঘাট বেঁধে মাত্র পনের থেকে বিশ মিনিট সময়ের মধ্যে অন্য একজনের ছদ্মবেশে হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত করে আবার সে তার নিজের জায়গায় ফিরে এসে ছদ্মবেশ ছেড়ে সব হত্যার চিহ্ন নিজের গা থেকে যেন মুছে ফেলেছে। তাহলে গোড়া থেকেই বলি। রায়বাহাদুরের কেন ধারণা কোন এক নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাবেন! হত্যাকারী তাঁকে চিঠি দিয়ে সেকথা জানিয়েছিল।

রায়বাহাদুরের মুখেও আমি শুনি কথাটা এবং পরে একদিন সৌভাগ্যক্রমে লুকিয়ে আড়ি পেতে গান্ধারী দেবী ও কাকা সাহেবের আলোচনাথেকে জানতে পেরেছিলাম আমি, রায়বাহাদুরকে হত্যাকারী একটা চিঠি দিয়েই কোন একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হত্যা করবার ভয় দেখিয়েছিল যদি না তিনি তাঁর উইল পরিবর্তন করেন। কিন্তু কেন? ঐভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে হত্যার ভয় দেখিয়েছিল কেন? খুব সম্ভব যাতে করে রায়বাহাদুর কথাটা সকলকে বলেন, ও হত্যার প্রতিশোধের জন্য ব্যবস্থা করেন। অন্তত আমার ধারণা তাই। তাহলেও এ থেকে দুটো জিনিস ভাববার আছে। প্রথমতঃ অসুস্থ রায়বাহাদুর ঐ ধরনের কথা বললে চট করে সহজে কেউই বিশ্বাস তো করবেই না ব্যাপারটা—অর্থাৎ তাঁর কথার কোন গুরুত্বই দেবে না কেউ। হয়েছিলও তাই।

এ বাড়ির কেউ সেকথা বিশ্বাসই করেননি, এমন কি আমিও করতে পারিনি প্রথমটায়। ডাক্তাররাও বলেছে ওটা hallucination-এর ব্যাপার।

দ্বিতীয়ত:, খুনীর নির্বিঘ্নে হত্যা করবার একটা চমৎকার সুযোগ হাতে আসবে, ঐ ধরনের একটা কথা চাউর করে দিতে পারলে। কিন্তু যা বলছিলাম, ওদিকে তারপর খুনী হত্যার সমস্ত সন্দেহ দুঃশাসন চৌধুরীর উপরে চাপিয়ে দেবার জন্য দুঃশাসনের ছদ্মবেশে একবার গিয়ে রায়বাহাদুরকে threaten পর্যন্ত করে এসেছিল এবং সন্দেহটাকে ঘনীভূত করে তোলবার জন্য ঠিক ঐ সময়টিতেই গান্ধারী দেবীকেও রায়বাহাদুরের ঘরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। জানলা দরজা বন্ধ থাকায় ঘরটা ছিল অন্ধকার তাই হয়ত রায়বাহাদুর ছদ্মবেশে খুনীকে চিনতে পারেননি এবং গান্ধারী দেবীও শেষ পর্যন্ত ঘরে প্রবেশ না করবার দরুন ব্যাপারটা রহস্যাবৃতই থেকে গিয়েছিল। হত্যার রাত্রে খুনী প্রথমতঃ ডাঃ সানিয়ালের ছদ্মবেশে নার্স সুলতা করকে কফির সঙ্গে তীব্র কোন ঘুমের ওষুধ পান করিয়ে তাকে গভীর নিদ্রাভিভূত করে ফেলে। তারপর দুঃশাসনের ছদ্মবেশে রায়বাহাদুরের ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের ভিতর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে রায়বাহাদুরকে হত্যা করে। হত্যার সময় তার পরিধেয় বস্ত্র রক্ত এসে লাগে। সেই রক্তমাখা বস্ত্রটা তড়িৎপদে এসে শকুনির অবর্তমানে তার ঘরের মধ্যে ছেড়ে রেখে নিজেদের জায়গায় আবার ফিরে যায়। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি শকুনির ঘরের বাথরুমের জানলাপথে নেমে কার্নিশ দিয়ে রায়বাহাদুরের কক্ষসংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করা যায় খুব সহজেই। শুধু তাই নয়, হত্যা করবার পর দুঃশাসনেরই ছদ্মবেশে রুচিরা দেবীর ঘরে গিয়েও তাকে হত্যার সংবাদটা দিয়ে আসে হত্যাকারী।

স্তম্ভিত নির্বাক সকলে। কারও মুখে একটি কথা নেই।

দালাল সাহেবই আবার প্রশ্ন করেন, তবে হত্যাকারী কে?

কিরীটী এবারে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, এখনও আপনারা বুঝতে পারছেন না! মহামান্য কাকা সাহেব শ্রী অবিনাশ চৌধুরী।

ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।

কিরীটী বলে, গতকাল সকালে কাকাসাহেবের ঘরে প্রবশ করে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কয়েকখানা ফটো দেখেই প্রথমে তাঁর ওপর আমার সন্দেহ হয়। এককালে অবিনাশ একজন সুদক্ষ অভিনেতা ও রূপসজ্জাকর ছিলেন। ঐটিই প্রথম কারণ ও দ্বিতীয় কারণ তাঁকে সন্দেহ করবার হচ্ছে, তিনটে থেকে রাত চারটে পর্যন্ত ঐ এক ঘণ্টা সময়ে তাঁর movements-এর কোন satisfactory explanation-ই তিনি দিতে পারেননি। তৃতীয়তঃ, তাঁর ঘরের বাথরুমের সংলগ্নই হচ্ছে শকুনিবাবুর ঘরের বাথরুম। বাইরের চওড়া কানিশ দিয়ে ঐ বাথরুমে যাওয়া খুবই সহজ। চতুর্থতঃ, হয়ত উইল। উইলের ব্যাপারটা এখনও আমি জানি না তবে নিশ্চয়ই অবিনাশ চৌধুরীর ভাগে খুব সামান্যই পড়েছে। তাতেই হয়ত তিনি উইলটার অদলবদল চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁর ভয় ছিল দুযযাধন চৌধুরীর মৃত্যুর পর হয়ত অন্যান্য সকলে তাঁর সঙ্গীতপিপাসা ও খেয়ালের খাঁই মেটাতে রাজী থাকবে না তাঁর মত।

দুঃশাসন চৌধুরী এবারে এখানে ফিরে আসা অবধিই ঐ ব্যাপারটা নিয়ে মধ্যে মধ্যে রায়বাহাদুরের সঙ্গে বচসা করতেন। তাঁর আদৌ ইচ্ছা ছিল না ঐভাবে অনর্থক প্রতি মাসে কতকগুলো টাকা নষ্ট হয়। কিন্তু নির্মম নিয়তিই এক্ষেত্রেও প্রবল হয়ে দেখা দিল। কাকা সাহেবকে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই করতে হল প্রাণ দিয়েই। একেই বলে বিধাতার বিচার বোধ হয়। কিন্তু I pity—ঐ সাবিত্রী দেবীকে! কিরীটী চুপ করে।

সাবিত্রী এক রাতের মধ্যে সম্পূর্ণ উন্মাদিনী! কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে।

.

শেষ পর্যন্ত কিরীটীর মধ্যস্থতায় ডাঃ সমর সেনের সঙ্গে রুচিরার বিয়ে হয়ে গেল।

কিন্তু আজও ডাক্তার সেন মধ্যে মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। তাকিয়ে আছে পলকহীন স্থির নিষ্কম্প, বিভীষিকাময় কার দুটি চক্ষু তার দিকে যেন।

হাড়-জাগানো বলিরেখাঙ্কিত মুখ, ফ্যাকাশে রক্তহীন হলদেটে চামড়া বিস্ত, কাঁচাপাকা চুলগুলি কপালের উপরে নেমে এসেছে।

বুকে বিঁধে আছে একখানি কালো বাঁটওয়ালা ছোরা সমূলে। তারপরই যেন কানে আসে কে ডাকছে তাকে।

হুজুর, হুজুর!

ডাক্তার জেগে ওঠে, কে-কে?