সমুদ্রতীরে পৌঁছুতে আর কতদিন লাগবে আমাদের?
কোন্ সমুদ্রতীরে? এখন অবশ্য কিছুই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে টিমটু এখনও প্রায় চারশো মাইল পশ্চিমে।
হাওয়া অনুকূলে ছিলো, আর তার গতিও ছিলো প্রবল; তার ফলে রাতের প্রথম ভাগের মধ্যেই পশ্চিম দিকে আরো দুশো মাইল এগিয়ে গেলো ভিক্টরিয়া। পালা মেঘের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে রুপোলি; অদূরে হমবির পর্বতের গগনচুম্বী শিখরদেশ : তার ওপর রুপোর পাতের মতো গলে-গলে পড়ছে জ্যোৎস্না।
সেদিন বিশ তারিখ। অজস্র নদীনালা ঝরনা খালবিল পেরিয়ে গেলো বেলুনআফ্রিকিদের ছোটো-বড়ো বস্তিও দেখা গেলো অনেকগুলো তাদের সবকটিকে একেকটি ছোটো-ছোটো জ্যামিতিক নকশার মতো দেখাচ্ছে, কখনও বাঁকা আর সোজা রেখায় আঁকা, কখনও-বা বহু কালো-কালো ফুটকিতে ঘিরে রয়েছে জনপদের চৌকো সীমানা, কোনোটা আবার গোল বৃত্তের মতো। জায়গাটার নাম কা-বাবা, টিম্বাটুর রাজধানী, নাইজার নদী থেকে পাঁচমাইল দূরে অবস্থিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলো টিম্বাক্টু; এ-দেশী ভাষায় লোকে তাকে বলে মরুভূমির রানী। পাখির মতো শুন্য থেকে মরুভূমি এই রাজ্ঞীকে তাদের চোখে পড়লো : বড়ো অবহেলিত মনে হলো নগরটি। বেলুন থেকে সব খুদে মাপে দেখা যায় বটে, কিন্তু মোটামুটি একটা আন্দাজও পাওয়া যায়। রাস্তাঘাট সব সরু-সরু। দুপাশে রোদে শুকনো ইট, লতা ও পাতা খড়ের ছাউনি দিয়ে বানানো একতলা বাড়ির সারিটুকুও ভারি দুঃস্থ ও গরিব দেখালো তাদের চোখে।
এতদূর এসে পড়ায় ফার্গুসন খুব খুশি হলেন। ঈশ্বর এখন আমাদের যেদিকেই নিয়ে যান না কেন, আমাদের আর-কোনো অভিযোগ নেই!
যেদিকে খুশি-এ-কথাটা কি ঠিক হলো? বরং বলো—সোজা পশ্চিম দিকে যেতে চাই।
কিন্তু ইচ্ছের আর দাম কী? আমাদের নিজেদের শক্তি আর কতটুকু?
কেন বলো তো?
গ্যাস ক্রমশ ফুরিয়ে আছে। হিশেব করে দেখলুম, ভিক্টরিয়ার ভেসে থাকার ক্ষমতা আস্তে-আস্তে কেবল কমেই যাচ্ছে। যদি পশ্চিম উপকূলে পৌঁছুতে চাই, তাহলে খুব সাবধানে চলতে হবে আমাদের, হয়তো বেলুন হালকা করার জন্যে সবগুলি পাথরের বস্তা ফেলে দিতে হবে, চেষ্টা করতে হবে যাতে গ্যাস একটুও বাজে-খরচ না-হয়।
সেই রাতেই ফার্গুসন সব পাথর-ভরা বস্তা ফেলে দিলেন। পুরো দমে গনগনে। করে আগুন দিলেন চুল্লিতে যার গোল ঘুলঘুলি দিয়ে রগরগে এক লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল দোলনার ভেতর। টিম্বাটুর দক্ষিণে প্রায় ষাট মাইল এগিয়ে গেছে বেলুন। হয়তো আগামী কালই নাইজার নদী যেখানে মস্ত চওড়া বাঁক ফিরেছে সেখানে গিয়ে ডেবো নামক হ্রদে পৌঁছুতে পারবেন তাঁরা।
কিন্তু তাদের সব আশাকে ব্যর্থ করার জন্যেই যেন হঠাৎ একখণ্ড প্রচণ্ড বাধা এসে হাজির। কোনো পূর্বাভাস না-দিয়েই হঠাৎ এক পাগলা হাওয়া তা-হো-মের অঞ্চলের দিকে তাড়া করে নিয়ে গেলো ভিক্টরিয়াকে। মারাত্মক হিংস্র ধরনের লোক বাস করে এখানে; নৃমুণ্ডশিকারী হিশেবেই তারা পরিচিত। সাধারণ কোনো উৎসবের দিনেই ডাইনিপুরুৎ আর রাজার নির্দেশে হিংস্র উল্লাসে এখানে হাজার-হাজার মানুষ কোতল করা হয়। সেখানে গিয়ে পৌঁছুনো মানেই নির্বিচারে মৃত্যুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া।
অত্যন্ত ধীরে-ধীরে কোনোক্রমে প্রায় সোয়া-শো মাইল এগিয়ে গেলো বেলুন। এবারে অন্য-একটি বিপদের সম্ভাবনা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে, ক্রমশই চুপসে লম্বা হয়ে গিয়ে তার গোল চেহারা হারিয়ে ফেলছে বেলুন, আর হাওয়ার ধাক্কায় সেই চুপসোতে-থাকা বেলুনের গায়ে নানা স্থানে গর্তের মতো নেমে এসেছে রেশমের আবরণ।
আর থাকতে না-পেরে ভীত গলায় কেনেডি তার আশঙ্কা প্রকাশ করে ফেললেন, বেলুন কি ফুটো হয়ে গেলো নাকি?
না, ফার্গুসন ভালো করে লক্ষ করে জানালেন, যে গাটাপার্চার খোল ছিলো বেলুনের গায়ে, তা গরম হয়ে নানা জায়গায় গলে গেছে—ফলে সে-সব জায়গা দিয়ে একটু-একটু করে গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে।
এই ফুটোগুলোকে তবে বন্ধ করা যায় কী করে?
উঁহু! এখন আর তার কোনো সুযোগ নেই। তবে একমাত্র যা আমরা এখন করতে পারি, তা হলো, ক্রমশ বেলুনক নির্ভার করে ফেলা; যা-কিছু বাড়তি ওজন আছে বেলুনে, সব ফেলে দিয়ে তাকে যদি হালকা করতে পারি, তাহলেই হয়তো একটু উপকার হতে পারে।
আমার কী মনে হয়, জানো, ফার্গুসন? এর চেয়ে বোধহয় নিচে নেমে গিয়ে এটাকে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করে নিলেই ভালো হবে।
এখন আর একে মেরামত করা আমার সাধ্যের অতীত। আমার সাধ আর সাধ্যের মধ্যে এখন ক্রমেই মস্ত ব্যবধান গড়ে উঠছে। তাছাড়া নামা মানেই যে মৃত্যু, তা কি তুমি বুঝতে পারছে না? ঐসব গাছে ঐ যে লতাপাতা দিয়ে বাসা বানানো হয়েছে, দেখছে সেগুলো?
কীসের বাসা ও-সব? পাখির?
পাখির বাসা হলে তো ভালোই হতো—এমনকী ঐ ঈগলদের আস্তানা হলেও তবু একটা কথা ছিলো। আফ্রিকার সবচেয়ে হিংস্র জংলিরা ঐসব গাছে বাসা বেঁধে বাস করে। একবার তাদের পাল্লায় গিয়ে পড়লে স্বয়ং ঈশ্বরও আর রেহাই পাবেন কি না সন্দেহ। নদী থেকে আমরা আর বেশি দূরে নেই, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেটুকু পথও বোধহয় আর আমরা যেতে পারবো না। সেই ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত বেলুনের নেই। এখন।
যেমন করেই হোক নদীর তীরে গিয়ে আমাদের পৌঁছুতেই হবে। ফার্গুসন তাঁর মানসিক উত্তেজনা বহু কষ্টে দমন করে রাখলেন। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে ভাবিয়ে তুলছে আরেকটি বিপদের আশঙ্কা।
পর-পর বেশ কতগুলি পাহাড় পেরুতে হবে আমাদের। কিন্তু সে-পরিমাণ গ্যাস আমাদের নেই, তা ছাড়া উপর্যুক্ত তাপ সৃষ্টি করতে না-পারলে বেলুনও বেশি ওপরে উঠতে পারবে না, অথচ সেইটুকু তাপ তৈরি করারও ক্ষমতা নেই।
পাহাড়গুলোকে তো দেখতেই পাচ্ছি। আচ্ছা, কোনোরকমে এড়িয়ে যাওয়া যায় এদের? কেনেড়ি ভালো করেই জানেন যে তা সম্ভব নয়, তবু কিছু-একটা বলা দরকার মনে করেই কথাটা বললেন। এই কালো গিরিমালা যেভাবে দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িযে আছে তাতে তাদের এড়িয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। কেনেডির মনে হলো, যেন শুধু তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করবার জন্যেই এই পাহাড়গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
তার কোনো উপায় নেই। ফার্গুসন সোজাসুজি বলে দিলেন কথাটা। জো, একদিনের উপযোগী জল রেখে পিপেশুঙ্কু সব জল ফেলে দাও। তাতে হয়তো কিছুটা ওপরে উঠবে বেলুন।
নিমেষের মধ্যে প্রভুর আদেশ পালন করলে জো। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো সুবিধে হলো না, মাত্র পঞ্চাশ ফিট ওপরে উঠলো বেলুন। ক্রমশই ভিক্টরিয়া পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আবো কয়েক শো ফিট ওপরে উঠতে না-পারলে মারাত্মক একটি সংঘর্ষ একেবারে অনিবার্য।
খালি বাক্সগুলি ফেলে দিলেই হয়। কেনেডি মৃদু গলায় বললেন, পাউণ্ড পঞ্চাশেক হালকা হলো বেলুন, আরো কিছু ওপরে উঠলো ভিক্টরিয়া। কিন্তু এখনও পাহাড়ের চুড়ো অতিক্রম করার মতো উচ্চতা লাভ করেনি সে। গোটা পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা ভাবতেই সবাই শিউরে উঠলো। একের পর এক অতবার মরণের হাত থেকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা পেয়েছেন তাঁরা। নিয়তি কি এবারও শেষ মুহূর্তে দয়া করবে না তাদের? পাহাড়ের কঠিন বন্ধুর গায়ে ধাক্কা লাগলে যে-পরিণাম হবে, তার কথা কেউ আর ভাবতেই চাইলেন না। আগে যতবারই মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন কোনোবারই এমন অক্ষম হতাশায় ভরে যাননি কেউ। বেলুন পাহাড় থেকে আর বেশি দূরে নেই। ক্রমেই সেই মন্ত কালো পাহাড় এগিয়ে আসছে তাদের দিকে—এমনভাবে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখে শিরদাঁড়া বেয়ে কেবল একটা ঠাণ্ডা স্রোত কিলবিলিয়ে ওঠা-নামা করতে লাগলো। যদি পার না-হতে পারেন তাহলে আর দশ মিনিটের মধ্যে ফার্গুসনের এত হৈ-চৈ তোলা ভৌগোলিক অভিযান মর্মান্তিকভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে!
সব জিনিশ ফেলে দাও, সব জিনিশ ফেলে দাও! ফার্গুসন আর্তস্বরে প্রবল ভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন।
চরম মুহূর্তটির দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে ভিক্টারিয়া। ফার্গুসন নির্দেশ দিলেন, তোমার বন্দুকগুলো ফেলে দাও, ডিক!
অসীম মমতায় তার বন্দুকগুলিকে সজোরে আঁকড়ে ধরলেন কেনেডি। তার এতদিনের সঙ্গী এরা! বন্দুক ফেলবো? বলছো কী তুমি?
বাঁচতে গেলে এখন ফেলে দিতেই হবে।
জো চেঁচিয়ে উঠল। সর্বনাশ হলো। আর-তত বেশি দূরে নেই!
স্পষ্ট দেখা গেলো, শ্যাওলা-জমা কালো চোখা থ্যাবড়া পাথরগুলো ক্রমশ প্রবল বেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বেলুন থেকে পাহাড়ের চুড়ো এখন প্রায় ষাট ফিট উঁচু। কম্বল, পোশাক-আশাক, গোলা-বারুদও জো দ্রুত হাতে ফেলে দিলে। একঝটকায় বেলুন পাহাড়ের চুড়োর ওপরে চলে এলো—এখন দোলনাটা ঠিক চুড়োবরাবর চলেছে। দোলনাটার সঙ্গে এই বুঝি পাহাড়ের ধাক্কা লাগলে! আরোহী তিনজন মুহূর্তের জন্য কুঁকড়ে গেলেন। তার পরেই উম্মত্তের মতো চীৎকার করে উঠলেন ফার্গুসন ডিক! ডিক! শিগগির তোমার বন্দুকগুলো ফেলে দাও! নয়-তত আমরা সবাই মরবো!
কেনেডির চোখ জলে ভরে গেলো। কোনো দ্বিরুক্তি না-করে তিনি বন্দুকগুলো তুলে ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত তুললেন, কিন্তু হঠাৎ চীৎকার করে জো তাকে বাধা দিলে–থামুন মিস্টার কেনেডি! এক মিনিট! এই বলেই দোলনার দড়ি ধরে, ডিগবাজি খেয়ে, লাফিয়ে, নিচে নেমে গেলো।
জো! জো! এ কী করলে তুমি!
কী সর্বনাশ!
বেলুন আরেকটু ওপরে উঠে এলো। চুড়োর দিকটা প্রায় কুড়ি ফিট চওড়া, অন্য দিকটা কম ঢালু, সেইজন্যে একেবারে চোখা ছুঁচোলো নয়। নিরাপদেই শুধু হালকাভাবে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে সেই ভীষণ পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে গেলো বেলুন।
পেরিয়ে গেছি! পেরিয়ে গেছি।
কেনেডি আর ফার্গুসন চোখ বুজে ফেলেছিলেন, নিচে থেকে জোর গলা কানে আসতেই হতবাক আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তাকিয়ে দেখলেন, পাহাড়ের চুড়োয় হেঁটেহেঁটে চলেছে জো, দু-হাতে গায়ের জোরে দোলনাকে ঠেলে-ঠেলে সে এগুচ্ছে। যেই দোলনা চুড়ো পেরিয়ে এলো, অমনি শরীরের সব শক্তি সংহত করে প্রবলভাবে এক ধাক্কা দিয়ে ফের দড়ি বেয়ে ওস্তাদ খেলোয়াড়ের মতো সে দোলনায় উঠে এলো!
খানিকক্ষণ নির্বাকভাবে তাকে লক্ষ করে ফার্গুসন বললেন, তোমার ঋণ কিছুতেই শোধ করার নয়, জো! বারেবারে তুমি আমাদের নিজের জীবন তুচ্ছ করেও বাঁচিয়ে দিচ্ছো! তারপর তিনি আর-কিছু বলতে পারলেন না, গলা ধরে এলো।