২০তম অধ্যায় – শাল্বরাজের অভিযান সাত্যকিহস্তে নিহত
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! সৈন্যগণ সমরে প্রবৃত্ত হইলে ম্লেচ্ছাধিপতি শাল্ব কোপাবিষ্ট হইয়া এক ঐরাবতসদৃশ অরাতিমর্দন পৰ্ব্বতাকার মহাগজে আরোহণপূর্ব্বক পাণ্ডবসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। ম্লেচ্ছরাজের সেই মাতঙ্গ সদ্বংশপ্রসূত, গজবিজ্ঞানবিশারদ ব্যক্তিগণকর্ত্তৃক সুশিক্ষিত ও দুৰ্য্যোধনের সতত আদরণীয়। মহারাজ শাল্ব সেই মহাগজে সমারূঢ় হইয়া নিশাবসানে উদাচলস্থিত দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন এবং পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইয়া ইন্দ্রের অশনিসদৃশ ভীষণ নিশিতশরনিকরে যোধগণকে যমালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে কি আত্মপক্ষীয়, কি পরপক্ষীয়, কেহই সেই ঐরাবতস্থিত বাসবসদৃশ বীরবরের কোন ছিদ্র দেখিতে পাইলেন না। পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ সেই একমাত্র মাতঙ্গকে সহস্র সহস্র বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন। বিপক্ষপক্ষীয় সৈন্যগণ সেই মহাগজের প্রভাবে বিদ্রাবিত ও তাঁহার বেগ সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া ভীতচিত্তে সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক সহসা মহাবেগে চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। আপনার পক্ষীয় যোধগণ পাণ্ডবসৈন্যগণকে পলায়নে প্রবৃত্ত দেখিয়া মহারাজ শাল্বকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদানপূর্ব্বক শশাঙ্কসদৃশ শ্বেতবর্ণ শঙ্খ বাদিত করিতে লাগিলেন।
“তখন পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের সেনাপতি মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রমোদিত কৌরবগণের সেই শঙ্খনিনাদ অসহ্য জ্ঞান করিয়া, জম্ভাসুর যেমন ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধ করিবার সময় গজরাজ ঐরাবতের প্রতি ধাবমান হইয়াছিল, তদ্রূপ অতি সত্বর বিজয়লাভার্থ শাল্বরাজের গজের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহারাজ শাল্ব ধৃষ্টদ্যুম্নকে সহসা সমাগত দেখিয়া তাহার বিনাশবাসনায় তাঁহার অভিমুখে স্বীয় মাতঙ্গ সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই মহাগজকে আগমন করিতে দেখিয়া অনলসদৃশ উগ্রবেগ তিন নারাচদ্বারা তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার কুম্ভদেশে পাঁচ নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। শাল্বরাজের মহাগজ এইরূপে দ্রুপদপুত্রের শরে বিদ্ধ হইয়া দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে লাগিল। মহারাজ শাল্ব অঙ্কুশদ্বারা নাগরাজকে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া পুনরায় অতি সত্বর ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিমুথে সঞ্চালন করিলেন। মহাবীর দ্রুপদতনয় মহাগজকে পূনৰ্ব্বার আগমন করিতে দেখি ভীতচিত্তে গদাগ্রহণপূর্ব্বক মহাবেগে স্বীয় রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। গজরাজ তৎক্ষণাৎ দ্রুপদতনয়ের সেই সুবর্ণভূষিত রথ, অশ্ব ও সারথির সহিত উৎক্ষেপণপূর্ব্বক চীৎকার করিয়া ধরাতলে বিপ্রোথিত করিল। তখন ভীমসেন, শিখণ্ডী ও সাত্যকি সেই নাগবরকর্ত্তৃক ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপীড়িত দেখিয়া মহাবেগে আগমনপূর্ব্বক শরনিকরে মাতঙ্গের বেগ নিবারণ করিতে লাগিলেন। গজরাজ রথীগণকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইয়া নিতান্ত বিচলিত হইল। তখন মহারাজ শাল্ব চতুর্দ্দিকে দিবাকরের করজাল সদৃশ শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। রথীগণ তাঁহার শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় যোধশ্রেষ্ঠ পাঞ্চাল, মৎস্য ও সৃঞ্জয়গণ শাল্বরাজের সেই ভীষণ কাৰ্য্যদর্শনে হাহাকার করিয়া মাতঙ্গের চতুর্দ্দিক অবরোধ করিলেন। তখন কৌরবসৈন্যনিসূদন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন অচলশৃঙ্গ সদৃশ গদগ্রহণপূর্ব্বক মহাবেগে ধাবমান হইয়া জলসদৃশ পৰ্ব্বতাকার মদস্রাবী মাতঙ্গকে সমাহত করিতে লাগিলেন। গজরাজ ধৃষ্টদ্যুম্নের গদাঘাতে গভীর গর্জ্জন ও রুধির বমন করিয়া ভূকম্পচালিত ভূধরের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। তদ্দর্শনে কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ হাহাকার করিতে লাগিল। তখন শিনিবংশাবতংস সাত্যকি নিশিতভল্লে শাল্বরাজের শিরচ্ছেদন করিলেন; মহাবীর শাল্বও ছিন্নমস্তক হইয়া বজ্র বিদলিত বিপুল গিরিশৃঙ্গের ন্যায় অচিরাৎ সেই নাগরাজের সহিত ভূতলে নিপতিত হইলেন।”