২০. রাজা ও মন্ত্রী
মন্ত্রী মহাসত্ত্ব বললেন, মহারাজ! যদি অনুমতি দেন, তবে কয়েকটা প্রশ্ন করি।
দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটি ক্ষুর হাতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মহারাজ রুদ্রদমন স্বহস্তে মুণ্ডিত মুখমণ্ডল পরিদর্শন করছিলেন, মহাসত্ত্বের কথার উত্তরে বললেন, মন্ত্রীবর! আমি বোধহয় একবারও নিজেকে অসুস্থ বলে ঘোষণা করিনি, অথবা আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অনিচ্ছা বা অক্ষমতাও প্রকাশ করিনি।
মহাসত্ত্বের ভ্রু কুঞ্চিত হল, মহারাজ! আপনি গভীর রাত্রে প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আপনাকে শ্রান্ত ক্লান্ত মনে করেছিলাম। অতএব আজ রাত্রে আপনাকে উপযুক্ত বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে কাল প্রভাতেই প্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা করব মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, মুহূর্ত মাত্র বিশ্রাম না করেই শ্মশ্রুরাশিকে মুখমণ্ডল থেকে বিলুপ্ত করতে আপনি বদ্ধপরিকর। তখন ভাবলাম, সম্ভবত আপনি বিশেষ ক্লান্ত নন, ক্ষৌরকর্ম শেষ হলে হয়তো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি বিরক্তিবোধ করবেন না।
মহারাজ নিবিষ্টচিত্তে মুখগুল পরিদর্শন করছিলেন, দর্পণের মধ্যে প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললেন, মন্ত্রীবর! আমি বিরক্তিবোধ করলেই যে আপনি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপে বিরত হবেন এমন তো মনে হয় না।
—সে-কি মহারাজ! আপনি বিরক্তিবোধ করলে আমি কি আপনাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারি?
–পারেন। অন্তত কিছুদিন আগেও পেরেছিলেন। কিন্তু অতীতের উদাহরণ দিয়ে বর্তমানকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। অনুগ্রহপূর্বক আপনার বক্তব্য প্রকাশ করুন।
আপনার অবর্তমানে রাজ্যে কিছু কিছু বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে রাজ্যত্যাগ করে দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ হওয়া রাজ্যের পক্ষে নিরাপদ নয়।
-মন্ত্রী মহাসত্ত্ব থাকতে রাজ্য সম্পর্কে আমার কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। আপনার পরবর্তী বক্তব্যের প্রসঙ্গ ধরে বলছি, প্রজার সম্পর্কে রাজার কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব আছে মনে করি বলেই মাঝে মাঝে আমাকে নিরুদ্দেশ হতে হয়।
-আপনার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, তবে দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ আছে। ছদ্মবেশে রাজ্য মধ্যে বিচরণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা আদৌ নিরাপদ নয়।… ভালো কথা, পরন্তপের কোনো সংবাদ পেয়েছেন?
মন্ত্রী মহাসত্ত্বের কথার উত্তর না দিয়ে মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, মন্ত্রীবর! আপনার কাছে কর্ণদেব নামে জনৈক কিশোরের একটি লিপি নিয়ে আসার কথা ছিল। সে এসেছে কি?
হ্যাঁ, এসেছিল, মহাসত্ত্ব বললেন, উক্ত লিপির নির্দেশ অনুসারে পূর্ব সীমান্তের রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক বিষাণ বর্মার নিকট তাকে প্রেরণ করেছি। কিন্তু মহারাজ
-বলুন।
ওই সুকুমার-দর্শন কিশোরের পক্ষে সীমান্তের রক্ষীবাহিনীতে যোগ দেওয়া আত্মহত্যারই নামান্তর মনে হয়। অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপে নিযুক্ত গুপ্তশত্রু, অথবা শত্রুভাবাপন্ন ভয়ংকর অনার্য বাহিনীর চকিত আক্রমণের সম্মুখীন হলে ওই কিশোরের মৃত্যু অনিবার্য। সীমান্তবাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে যেভাবে কঠিন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়, এই ক্ষেত্রে সেইভাবে পরীক্ষাও করা হল না– কারণ, পত্রে লিখিত ছিল কোনো পরীক্ষা না করেই অবিলম্বে যেন তাকে সীমান্তের রক্ষিবাহিনীতে নিযুক্ত করা হয়। আপনার নির্দেশ অনুসারে তাকে বিষান বর্মার নিকট
বাধা দিয়ে মহারাজ রুদ্ৰদমন বলে উঠলেন, আমার নির্দেশ? অপনি কি বলছেন মন্ত্রিবর?
বিমূঢ় দৃষ্টিতে মহারাজের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন মহাসত্ত্ব, তারপরই তার অধর-ওষ্ঠে ক্ষীণ হাসিররেখা দেখা দিল, না, আপনার নির্দেশ নয়- শশক নামে এক ভ্রাম্যমাণ পেশাদার যোদ্ধার নির্দেশ অনুসারে তাকে বিষান বর্মার নিকট প্রেরণ করেছি। তিনদিন পুর্বে সংবাদ পেয়েছি তাকে পূর্বদিকের সীমান্তবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সন্তুষ্ট হয়ে মহারাজ হৃষ্টস্বরে বললেন, ভালোই হয়েছে; তবে শশক নামে কোনো পেশাদার ভ্রাম্যমাণ যোদ্ধা মন্ত্রীবরকে তার অনুরোধ জানাতে পারে। কিন্তু শ্রাবস্তী রাজ্যের মন্ত্রীকে উক্ত ব্যক্তি নির্দেশ দেবে এমন ধৃষ্টতার প্রকাশ আমি কল্পনা করতে পারি না। মন্ত্রী মহাসত্ত্বের ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসি প্রশস্ত হল। মহারাজ আবার বললেন, মন্ত্রীবর! কর্ণদেব নামে ওই কিশোরের যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকুন। সীমান্তবাহিনীতে রক্ষীদলের মধ্যে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারে এমন ক্ষমতা কোনো রক্ষীর আছে কিনা সন্দেহ।
মহাসত্ত্বের ললাটে জাগল মৃদু কুঞ্চনরেখা, মহারাজের কথার প্রতিবাদ করা উচিত নয়। তবু বলছি, এটা যেন অতিশয়োক্তি মনে হচ্ছে।
রুদ্রদমন হাসলেন, মন্ত্রীবর!জল্লাদ নামে এক কুখ্যাত দস্যু তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে কর্ণদেবকে আক্রমণ করেছিল। যুদ্ধের ফলে জল্লাদ ও তার দুই সঙ্গী প্রাণ হারিয়েছে কর্ণদেব নামক ওই কিশোরের অসির আঘাতে। আরও একটা কথা মনে রাখবেন– কিশোর কর্ণদেব ছিল দস্যু পরন্তপের সর্বপেক্ষা বিশ্বস্ত অনুচর।
মহামন্ত্রী সচমকে বলে উঠলেন, ওই কিশোর দস্যু পরন্তপের বিশ্বস্ত অনুচর! কি আশ্চর্য মহারাজ, আপনি সকল তথ্য অবগত হয়েও তাকে সীমান্ত বাহিনীতে নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন? ওই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত রক্ষী ইচ্ছা করলে গুপ্তশত্রুর নিকট হতে উৎকোচ গ্রহণ করতে পারে অথবা অর্থলোভে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যে ব্যাপৃত হয়
বাধা দিয়ে মহারাজ বললেন, আবার আপনি ভুল করলেন। মন্ত্রীবর। কর্ণদেবকে সীমান্তবাহিনীতে নিযুক্ত করার অনুরোধ এসেছে শশকের কাছ থেকে এবং সেই অনুরোধ রক্ষা করেছেন আপনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত নই। তবে এটুকু বলতে পারি-~শশকের পরামর্শে কাজ করলে রাজ্যের অমঙ্গল হবে না।
গম্ভীর কণ্ঠে মহাসত্ত বললেন, শশকের অনরোধ আমার কাছে মহারাজ রুদ্রদমনের আদেশের সমতুল্য।… হ্যাঁ, একটি প্রশ্নের উত্তর আমি আপনার কাছে পাইনি। মনে হয়, ওই প্রশ্নটি মহারাজকে বিব্রত করেছে। তবু এই রাজ্যের গুরুদায়িত্ব আমার স্কন্ধে রয়েছে বলেই শ্রাবন্তীর মঙ্গলের জন্য উক্ত প্রশ্নটি আবার আপনার সম্মুখে উপস্থিত করছি। আশা করি আপনি বিব্রত বা ক্রুদ্ধ হবেন না।
–আমার ক্রোধের ভয়ে মহামন্ত্রীকে কোনোদিন বিচলিত দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। মন্ত্রীবর! অনর্থক কালক্ষেপ না করে আপনার বক্তব্য উপস্থিত করুন।
দস্যু পরন্তপের কি সংবাদ? আপনার পরম সুহৃদ শশক আশা করি নিরুদ্দিষ্ট পরন্তপের সন্ধান পেয়েছে?
-হ্যাঁ।
–সে কোথায়?
–বলতে পারি না।
–মহারাজ! আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। শশক নাকি পলাতক পরন্তপের সন্ধান পেয়েছে, অথচ আপনি জানেন না ওই দস্যু এখন কোথায়! এ কি হেঁয়ালি!
মন্ত্রীবর! মহারাজ বললেন, সম্প্রতি ভূমিকম্পের ফলে রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত একটি পর্বত ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ব্যাদিতবদন কঙ্কালমুণ্ডের ন্যায় ওই পর্বতের সানুদেশে যে প্রকাণ্ড গুহাগহ্বর আছে, সেই গুহামুখ ভীষণ ভূমিকম্পের ফলে রাশি রাশি প্রস্তরে আবৃত হয়েছে। ওই গিরিগুহার ভিতর
বাধা দিয়ে মহাসত্ত্ব অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, মহারাজ! আপনার কথায় বাধা দিয়ে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা প্রকাশ করলাম, তবু নিজগুণে ক্ষমা করবেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি আলোচনা করতে চাই নি, আমি চেয়েছিলাম
–আপনি যে দস্যু পরন্তপের সন্ধান জানতে চাইছেন সে বিষয়ে আমি অবগত। অনুগ্রহ করে আমার বক্তব্য শেষ করতে দিন। যা বলছিলাম- ওই গিরিগুহার ভিতর গুপ্তধন আবিষ্কার করার পর দস্যু পরন্তপ ও আমার বন্ধু শশকের মধ্যে মহারাজ রুদ্রদমন সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়। আলোচনার ফলে উত্তেজিত হয়ে দুজনেই যখন গুহার বাইরে আসে, তখন হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড তাড়নায় চারদিকে রাশি রাশি প্রস্তর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং পর্বতশিখরের কিয়দংশ চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়। ওই প্রাকৃতিক বিপ্লবের মধ্যে শশক আর পরন্তপ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেইসময় নিকটেই দণ্ডায়মান কর্ণদেব নামে কিশোরটি হঠাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে মস্তকে আহত হয়ে জ্ঞান হারায় এবং শশক তাকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে এনে শুশ্রূষা করতে সচেষ্ট হয়। ভূমিকম্পের পরে পরন্তপের কোনো সন্ধান পায় নি শশক। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, ওই দস্যু এখন কোথায় অবস্থান করছে আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। পর্বতের তলদেশে রাশি রাশি প্রস্তর ও ভূমিকম্পে বিদীর্ণ গিরিপথের ফাটলে ফাটলে পরন্তপের মৃতদেহ সন্ধান করেছিল শশক ও কর্ণদেব কিন্তু দস্যর কোনো সন্ধান পাওয়া। যায়নি। তবে পর্বতের পাদমূলে রাশি রাশি প্রস্তরের স্তূপে সমাহিত একটি মানবদেহের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। হয়তো প্রস্তরস্তূপের মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে দস্যর মৃতদেহ, আর না হয়তো সে ভুমিকম্পের সময়ে সকলের অজ্ঞাতসারে স্থানত্যাগ করেছে। তবে এই মুহূর্তে পরন্তপকে নিয়ে আমি বিশেষ বিব্রত বোধ করছি না। যদি সে বেঁচেও থাকে, বেশ কিছুদিনের মধ্যে সে আর দস্যুবৃত্তি করতে ইচ্ছুক হবে না।
মহারাজ! মহাসত্ত্ব বললেন, আপনি যে গুপ্তধনের কথা বলেছিলেন, তার সন্ধান নিশ্চয়ই শশক আপনাকে জানিয়েছে?
–হ্যাঁ। আমি দুই-এক দিনের মধ্যেই এক সেনাদল নিয়ে ওই গুপ্তধন উদ্ধার করব।
–সেনাদল। কেন? ওই স্থান তো আপনার পরম সুহৃদ অনার্যরাজ মুলকের অধিকারভুক্ত।
যুদ্ধের জন্য নয়; গুহামুখ থেকে প্রস্তররাশিকে অপসারিত করার জন্যই সৈন্যদলের প্রয়োজন। ওই অর্থ দিয়ে রাজ্যের উন্নতিসাধন করা যাবে।
হু, তাহলে রাজ্যের সংবাদ একরকম ভালই, মহাসত্ত্ব বললেন, তবে দস্যু পরন্তপের মৃত্যুসংবাদ পেলে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
পরন্তপের মৃত্যুতে আপনি খুশি হতে পারেন, রুদ্রদমন বললেন, কিন্তু শশক আশা করে বন্ধুবর পরন্তপ ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে।
–বন্ধুবর পরন্তপ! মহারাজ, আপনি রসিকতা করেও দস্যু পরন্তপকে বন্ধু বলে অভিহিত করবেন না।
–শশকের বন্ধু বলেই বন্ধুবর বিশেষণে ভূষিত করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরন্তপকে বন্ধু বলে স্বীকার করিনি।
দস্যু পরন্তপ শশকের বন্ধু! মহারাজ! এ আপনি কি বলছেন!
ঠিকই বলছি, রুদ্রদমন বললেন, শশকের সঙ্গে পরন্তপের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। রাজা রুদ্রদমনের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে মতান্তর উপস্থিত না হলে গুহামধ্যে আবিষ্কৃত গুপ্তধনের কিয়দংশ গ্রহণ করে পরন্তপ স্বচ্ছন্দে সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গমন করতে পারত। অবশ্য ভূমিকম্পের ব্যাপারটা স্বতন্ত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিণাম নিয়ে কোনো কথা বলা চলে না।
মহাসত্ত্ব বললেন, আপনি বলছেন ভূমিকম্পের কবল থেকে পরন্তপ যদি আত্মরক্ষা করতে পারত এবং মহারাজের প্রসঙ্গ নিয়ে যদি শশকের সঙ্গে তার মতভেদ না ঘটত, তাহলে সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গমন করতে তার অসুবিধা ছিল না? শশক তাকে গুপ্তধনের কিছু অংশ আত্মসাৎ করে প্রস্থান করতে বাধা দিত না?
রুদ্রদমন বললেন, কেন বাধা দেবে? গুপ্তধনের সন্ধান তো পরন্তপই দিয়েছিল। শশকের ধারণা, দস্য হলেও পরন্তপ খুব খারাপ লোক নয়। সুতরাং শ্রাবস্তী রাজ্যে উৎপাত না করে সে যদি গুপ্তধন থেকে তার ন্যায্য অংশ নিয়ে দেশান্তরী হত, তাহলে শশক নিশ্চয়ই আনন্দলাভ করত। শশক মনে করে পরন্তপের মতো মানুষকে সত্তাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
মহাসত্ত্ব এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। মহারাজ রুদ্রদমন পুনরায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে নিজের মুখমণ্ডল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। ক্ষপণকের সাহায্যে না নিয়ে নিবিড় শ্মশ্রুরাশিকে স্বহস্তে নির্মূল করে সম্ভবত আত্মপ্রসাদ উপভোগ করছিলেন তিনি।
মন্ত্রী মহাসত্ত্ব হঠাৎ কণ্ঠ মধ্যে একটি অস্ফুট শব্দ করলেন, তারপর বললেন, মহারাজ!
দর্পণ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মহাসত্ত্বের দিকে জিজ্ঞাসু চক্ষে তাকালেন রুদ্রদমন।
–মহারাজ! আম্রপালী থেকে রাজদূত এসেছিলেন।
দূতের আগমন সংবাদ জানিয়েই আবার নীরব হলেন মহাসত্ত্ব।
রুদ্রদমন একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, আম্রপালীর রাজদূত! হঠাৎ!… কি সংবাদ?
মহাসত্ত্ব বললেন, আম্রপালী রাজ্যে রাজকন্যার স্বয়ংবর সভা বসছে আগামী ফাল্গুন মাসের সাত তারিখে। সেই সংবাদ দিতে এসেছিলেন রাজদূত।
রুদ্রদমন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তাঁর ক্ষুর এবং দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটি অবাঞ্ছিত কেশ মুখের একপাশে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। তাড়াতাড়ি ক্ষুর উদ্যত করে তিনি মুখের সংস্কার-সাধনে তৎপর হলেন।
মহাসত্ত্ব বললেন, মহারাজ রাজ্যে অনুপস্থিত শুনে দূত মহাশয় বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু নিমন্ত্রণলিপি দিয়ে বলে গেছেন, মহারাজ রুদ্রদমন যদি স্বয়ংবর শুরু হওয়ার আগে রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন, তবে তিনি যেন অনুগ্রহপূর্বক স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত থেকে আম্রপালী রাজ্যকে কৃতার্থ করেন।
রুদ্রদমন সম্পূর্ণ নীরব। মুখমণ্ডলে শারাশিকে নির্মূল করার পরেও যে দুই একটি অবাঞ্ছিত কেশ মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, পুনর্বার ক্ষুরের স্পর্শে এখন তারাও বিলুপ্ত; এখন, গুম্ফটিকে আরও সূক্ষ্ম করলে ফলাফল সন্তোষজনক হতে পারে কিনা সেই চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে গেছেন রুদ্রদমন।
কণ্ঠ মধ্যে ঘুৎকারধ্বনির ন্যায় একটি শব্দ করে মহাসত্ত্ব বললেন, স্বয়ংবর সভা শুরু হতে এখনো প্রায় দশ দিন বিলম্ব আছে। আম্রপালীর রাজকন্যার রূপের খ্যাতি
বাধা দিয়ে রুদ্রদমন বলে উঠলেন, মন্ত্রীবর! পথশ্রমে আমার শরীর এত ক্লান্ত যে, একাদিক্রমে অন্তত একমাস সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এখনই নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি, আর দাঁড়াতে পারছি না। এখন শয্যাগ্রহণ করতে চললাম।
মহাসত্ত্বের দিকে একবারও দৃষ্টিপাত না করে প্রাসাদের মধ্যে অন্তর্ধান করলেন রুদ্রদমন। তার গমনপথের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মন্ত্রী মহাসত্ত্ব।