২০. ভিক্টরের সঙ্গে গল্প

২০.

একদিন আমি বাড়ি ফিরে দেখি মার্গারেট ড্রয়িংরুমে বসে ভিক্টরের সঙ্গে গল্প করছে। ওর পরনে খানিকটা নীলচে ধরনের রঙীন স্কার্ট, ওকে অনেক কমবয়েসী লাগে ও যখন এটা পরে। চেয়ারের উপর বসে যথারীতি মার্গারেট পা তুলে দিয়েছে টেবিলের উপর এবং তার ফলে ওর প্যান্টিটার খানিকটা দেখা যাচ্ছে স্কার্টের কিছুটা অংশ নেমে গিয়ে। যেকোনো পুরুষের কাছে পরম লোভনীয় ওর এই ফর্সা মাখনের মত নিটোল উরু দুটো। ভিক্টর পরেছে একটি সাদা শার্ট এবং প্যান্ট। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ছেলেটি স্মার্ট এবং সুন্দর। ভিক্টর কিছুটা কুণ্ঠিত ভাবে উঠে দাঁড়াল আমাকে দেখামাত্রই। অপরাধী ভাব নিয়ে হেসে কোনো রকমে বলল আমাকে, আপনি কেমন আছেন আংকল?

আমাকে আংকল বলতে ওকে শিখিয়ে দিয়েছে ডরোথি। এই চলছে মোটামুটি, আমি জবাব দিলাম।

এরপর চোখ দুটো বড়ো করে ঝাঁঝিয়ে আমি মার্গারেটকে বললাম, একি অসভ্যতা হচ্ছে মার্গারেট, একজন লোক বসে রয়েছে তোমার সামনে, ছিঃ আর তুমি কিনা পা তুলে দিয়েছ টেবিলের উপর, শিগগির নামাও।

তেমন আমল দিল না মার্গারেট আমার কথাটায়। খিল খিল করে হেসে উঠে পা নামালো অনেক অনিচ্ছা নিয়ে। কিন্তু ওকে আর বললাম না আমি। তাকালাম ভিক্টরের দিকে এবং ওকে, বললাম, কেমন চলছে তোমার পড়াশুনা ভিক্টর?

ভিক্টর নীচু গলায় জবাব দিল, এই একরকম।

ড্রয়িং রুমে রাখা একটি ছোটো আকারের খাটের উপর গিয়ে আমি বসলাম।

মার্গারেট হঠাৎ আমাকে আংকল সম্বোধন করে বলে উঠল, ভিক্টরের কাছে বাংলা শিখব আমি।

আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম মার্গারেট আমাকে আংকল বলে সম্বোধন করায়, তবে এটা বুঝতে পারলাম যে ও আমার সঙ্গে রসিকতা করছে। মার্গারেটের দিকে আমি তাকালাম। ওর রসিকতা আমার পছন্দ হচ্ছে না এটা আমি ওকে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম আমার চোখের ভাষা দিয়ে।

আমি বাংলা শিখবো, মার্গারেট আবার বলল। এবার আর ও আমাকে আংকল বললো না যে, সেটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম। আমি ভিক্টরকে বললাম ওর দিকে নিস্পৃহ ভাবে তাকিয়ে, তুমি বাংলা ভাল জানো বুঝি।

আমি এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, এমনকি আমার মোটামুটি অনেক বাঙালীবন্ধুবান্ধব আছে। সেই কারণেই আমি কিছু কিছু জানি।

আমি বললাম, মানুষ হিসাবে বাঙালীরা খুব অতিথিপরায়ন হয়।

ভিক্টর বলল, ওদের মধ্যে কিন্তু সংগ্রামী মনোভাবটা অনেক কম থাকে। ওদের মধ্যে পুরনো সংস্কার অনেক থাকে কিন্তু কোনোরকম উচ্চাশা থাকে না। একটু থেমে ও আবার বলল, তবে কি খুব বুদ্ধিমান হয় ওরা, বেশ কিছু পরিচিত বাঙালী আমার আছে।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম বেশ খানিকটা সময় গল্প করে কাটিয়ে দিয়ে।

 ভিক্টরের সঙ্গে গল্প করতে লাগলো মার্গারেট। ঠিক ভাবে নিতে পারলাম না আমি ব্যাপারটাকে। আমি মার্গারেটকে ভালবাসি এটা ঠিক কথা কিন্তু আমি ওকে বিশ্বাস করতে পারি না। ওর ঐ জেদী এবং ছটফটে স্বভাব নিয়ে ও কখন যে কি করে বসে তার কোনো ঠিক নেই আমি এখনো ভুলিনি ফ্রেডির সঙ্গে ওর মাখামাখির ব্যাপারটা। সেই রাতে বিশেষ করে মার্গারেটের আচরণ আমি ভুলতে পারব না। কোনো রকম তেজ ওর ছিলনা, ও প্রতিবাদ করেনি কোনে উত্তেজিত আচরণের এবং ওর মধ্যে ছিল কিরকম একটা অপরাধী ভাব। স্বাভাবিক ব্যবহার ফ্রেডি ওর সঙ্গে করেনি এটাই আমার ধারণা ছিল। আমি ব্যাপারটা মার্গারেটের কাছে বারবার জানবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই জানতে পারছি না। মার্গারেট যেন ওর প্রসঙ্গ ভুলতে পারলেই বাঁ বলে বারবার মনে হয়েছে আমার। আমাকে বারবার এখন জ্বালাতন করে তোলে সেই ব্যাপারটা ভিক্টরের সঙ্গে এখন ও আবার বেশী মেলামেশা করছে। ওদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক এখ রয়েছে ঠিকই কিন্তু এটা যে চলে যাবে না তারই বা গ্যারান্টি কোথায় রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি না মিমিকে। মিমির তুলনা হয় না পুরুষকে উত্তেজিত করার ব্যাপারে। ওকে কোনদিনই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না ও যদি একবার অভ্যস্ত হয়ে যায় এই ধরনের জীবনে। ওকে হারিয়ে যেতে হবে চিরদিনের মত এখানকার এই কুৎসিত ভিড়ের মধ্যে। বেশ্যার জীবন বেছে নিতে হবে যেখানে কিছু নেই নরক ছাড়া। বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে বিছানায় শোওয়া এবং আকণ্ঠ মদ। আমি দেখেছি এদের এখানকারই বিভিন্ন অলিগলিতে এবং শিউরে উঠেছি, ভয়ানক এদের জীবন দেখে মৃত্যুর পর যে জায়গাকে ভারতীয়রা নরকের সঙ্গে তুলনা করে এটা ঠিক সেই ধরনের ভয়ানক বেশ্যাদের জীবনকে এরকম নরক বলে আমার মনে হয় বলেই আমি ঠেলে দিতে পারি না এই জীবনে আমার প্রিয়তমাকে।

আমি ভালবেসেছি মার্গারেটকে। হয়তো অসমবয়সী আমরা কিন্তু এতে ফাঁক নেই। আমি ওকে আন্তরিক ভাবেই ভালবাসি। আমার ভালবাসায় কোনো প্রতারণা নেই। আমার কাছে সেট প্রচণ্ড আঘাত হবে ও যদি আমার কাছ থেকে সরে যায়। আমি হয়তো সহ্য করতে পারবো ন এই আঘাত। আমি জীবনে শান্তি পাইনি কোনদিন নারীর সান্নিধ্যে। আমার জীবনে এমনকি মার্গারেটকে নিয়েও কোনো শাস্তি নেই।

মার্গারেট দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিল, আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর। দরজার সামনে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, আমি কিন্তু চলে গেলাম না। একটু শোনা দরকার কি ধরনের কথাবার্ত ওরা বলে। আমার কানে এল মার্গারেটের খিলখিল হাসির শব্দ। মার্গারেট বলছে শুনতে পেলাম তুমি ভিক্টর আমার কান ধরবে না, খুব বেড়ে গেছে তোমার সাহস।

ভিক্টর বললো, তোমার আংকল তোমাকে বারণ করে গেল টেবিলের ওপর পা তুলে বসতে অথচ তুমি।

রাখোতো, বেশ করেছি, টেবিলের ওপর পা রেখেছি, যদি তুমি বেশী কর তো তাহলে আি আমার পোকই খুলে ফেলব।

ভিক্টর বলল, তোমার লজ্জা করবে না, সেকি কথা।

পুরুষরা তোমরা সব কিছু পারো, আর আমরা করতে পারি না। মার্গারেট আবার বলল এক থেমে, শেখাবে তো তুমি আমাকে?

ভিক্টর বললো, আমি তোমায় শেখাবো যদি তোমার আংকল, অনুমতি দেয়।

আরে দুর, আমি খোঁড়াই কেয়ার করি ওসব আংকল টাংকলকে, অনুমতি কিসের। আ কারো আপত্তি শুনবো না, আমি যখন শিখতে ইচ্ছা করেছি তখন আমি শিখবই।

আমি কথাবার্তাগুলো শুনছিলাম কান লাগিয়ে কপাটে। এসব কথা শুনে শিউরে উঠলাম ম মনে, মার্গারেট এসব কথা কি বলছে। কান রাখলাম কপাটে খুব সাবধানে। কানে এলে ভিক্টরে কণ্ঠস্বর, খুব ভালবাসে তোমার আংকল, তোমাকে তাই না!

মার্গারেট বলল, আংকল আংকল করো নাতো বারবার। আমাকে যথেষ্ট ভালবাসেন মি পিটার ব্রাউন এবং কোনো ফাঁক নেই সেই ভালবাসায়, তবে তিনি একটু ঈর্ষান্বিত যৌন ব্যাপারে উনি রীতিমতো ক্ষেপে যান আমাকে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে মিশতে দেখলে। আমি এই ৫ কথা বলছি তোমার সঙ্গে তো গিয়ে দেখবো যে উনি গম্ভীর মুখে শুয়ে রয়েছেন বা বসে রয়েছে তেমন ভাবেই কথা বলবেন না উনি আমার সঙ্গে।

ভিক্টর বললো, আমিতো ওটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, তুমি যে কি যৌন ব্যাপারের কথা বললে?

মার্গারেট খিল খিল করে হেসে বলল, তুমি বুঝতে পারবে না ওসব ব্যাপার, আই লাভ ইউ, আচ্ছা ভিক্টর এর বাংলাটা কি হবে।

মোটামুটি থেমে থেমে যে বাংলা উচ্চারণ আমার ওর কানে এল তা হল, আমি তোমাকে। ভালবাসি।

মার্গারেট থেমে থেমে কোনোরকমে উচ্চারণ করল কথাটা এবং সেটাও আমার ঠিক বোধগম্য হল না, এবং তারপর হেসে উঠল সজোরে।

খানিকটা সময় কেটে যাবার পর আমি বুঝলাম যে এখানে থাকাটা আমার পক্ষে আর নিরাপদ নয় যখন তখনই ওরা বেরিয়ে পড়তে পারে, তাই শোবার ঘরে চলে এলাম আমি চুপি চুপি সিঁড়ি বেয়ে। বিছানায় পোষাক ছেড়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ভাবলাম এবার চোখে চোখে রাখতে হবে মার্গারেটকে। অতো মেলামেশা বন্ধ করতে হবে ওর ভিক্টরের সঙ্গে। এটা মোটেই ভাল নয় যে ওরা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আমাকে একদিন নিশ্চয় মাশুল গুনতে হবে এরকমভাবে চলতে থাকলে। তুলকালাম করে ছাড়বে যদি মার্গারেট এটা আঁচ করতে পারে। এবং তাতে হবে হিতে বিপরীত। এখন এখানে একটু আসা যাওয়া বাড়িয়েও দিয়েছে ভিক্টর। ওদের আলাপটা যে এর মধ্যেই বেশ পুরনো হয়ে গেছে তা মনে হল ওদের কথাবার্তা শুনেই। আমার আয়ত্তের বাইরে পুরো পরিস্থিতি চলে যাবে যদি এখন থেকে রশি টেনে না ধরা হয়। আর কোনো উপায় থাকবে না তখন।

আমার ঘরে এলো একবার ডরোথি। লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, খেয়ে নিন এবার সে বলল।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বলেছে মিমিকে।

ডরোথি এগিয়ে গেল দরজার দিকে এবং বলল, না এখনো ওকে বলা হয়নি, আগে আপনাকে বলে তবে নীচে গিয়ে ওকে বলবো। আমি আবার ডাকতে ও ঘুরে দাঁড়ালো এবং বললো মৃদু হেসে, আমাকে কিছু বলবেন।

চুপ করে রইলাম আমি কিছুক্ষণ। তারপর বললাম, ঠিক আছে, আমি এখনি খেতে যাচ্ছি তুমি যাও।

প্রথমে ভেবেছিলাম ওকে কিছু বলব ভিক্টরের ব্যাপারে কিন্তু পরে ভাবলাম যে সেটা এখন না বলাই ভাল, মার্গারেটের কানে যদি ব্যাপারটা চলে যায় তাহলে সেটা খুবই খারাপ হবে। খুবই সুচতুর ভাবে বন্ধ করতে হবে ওদের এখনকার মেলামেশা। কোন উপায় নেই এছাড়া। এখন কোনো কাজে জোর করে লাভ নেই তার চেয়ে যদি বুদ্ধিবলে করা যায় তো তাহলে সেটাই খুব ভাল কাজ হবে।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ডরোথি।

আমি বাইরে তাকালাম জানালা দিয়ে। গাড়ি চলছে দুরে। মোটামুটি রাস্তার ওপরে এই বাড়ি। কিছুক্ষণ কাটার পরে কানে এলো মার্গারেটের চীৎকার, লাঞ্চ রেডি।

বারান্দায় গেলাম আমি। আমাদের খাবার জায়গা রান্নাঘরের ঠিক সামনের বারান্দাতে। জায়গাটা খুবই চওড়া এবং টেবিলটা ডিম্বাকৃতি। চেয়ার রয়েছে তার চারপাশে, ওর পাশে আমি বসলাম। ডরোথি খায় আমাদের খাবার পরেই। ভিক্টরনীচে ড্রয়িংরুমে বসে আছে, সেটা জানলাম আমি ওকে জিজ্ঞেস করে। ও খাবে ওর মায়ের সঙ্গে বসে। এরপর আরম্ভ করলাম আমরা খেতে এবং আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডরোথি। কারণ ওই আমাদের খাবার পরিবেশন করে।

আমি আবার দোতলায় চলে এলাম নিজের ঘরে খাওয়া শেষ করে। ঘরে এসে ঢুকলো। মার্গারেট মিনিট পাঁচেক পরে। আমি খবরের কাগজ পড়ছিলাম। জোর হাওয়া উঠেছে বৃটেনে, শ্রমিকদল ক্ষমতায় আসছে নির্বাচনে রক্ষণশীলদের হারিয়ে দিয়ে। আমি যুক্ত নই ব্যক্তিগত ভাবে রাজনীতির সঙ্গে। তেমন একটা বুঝি না এসব ব্যাপারে। আমি রুশ বিপ্লবের বছর উনিশশো সতেরো সালে জন্মেছি। আমার মোটেই তেমন কোনো উৎসাহ নেই সামন্ত্রতন্ত্র সম্পর্কে। আমি কোনো তফাৎ খুঁজে পাই না হিটলার এবং স্তালিনের মধ্যে। আমি যে রাজনীতি বুঝি না সেটা আমি অবশ্য আগেই বলেছি। মার্গারেট এগিয়ে এল আমার কাছে। ওর পরনে নীল রঙের গাউন স্বচ্ছ প্রকৃতির। যদিও ভেতরে অন্তর্বাস রয়েছে তথাপি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বুকের উপরের অংশটা। আমি আধ শোওয়া হয়েছিলাম বিছানায় একটা বালিশে হেলান দিয়ে। ঠিক আমার কোলের কাছটায় এসে মার্গারেট বললো, আমার শরীরটা আজকাল ভাল যাচ্ছে না, কি ব্যাপার বলতো?

আমি বললাম, কি সমস্যা তোমার?

মার্গারেট জবাব দিল, একটুতেই হাঁফিয়ে যাচ্ছি আজকাল, একটুও রুচি নেই খাওয়া–দাওয়ার ব্যাপারে।

ওর দিকে তাকিয়ে আমি দেখলাম যে একটি মৃদু ক্লান্তির রেখা ওর মুখের মধ্যে। আমার চিন্তা হলো, আমি এখানে এসেছি মাস দুয়েক হলো। আমি এখানকার একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ওকে দেখাব বলে ঠিক করলাম যদিও আমি নিজে ডাক্তার।

কাছে টেনে নিয়ে মার্গারেটের ঠোঁটে চুমু খেলাম একটা, আলতো করে।

.

২১.

 একটা চিন্তা আমার মাথায় সবসময় ঘুরছে যে এখানে একটা চেম্বার করব। যদিও ঠিক করেছি এখানেই প্র্যাকটিশকরবো তবে এখনো ঠিকমতো জায়গা পছন্দ হয়নি। দু-একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে এখানকার এবং তাদেরকেও বলেছি একটি ঘরের সন্ধান দিতে পছন্দমত। ভাবছি এখানে নিয়মিত প্র্যাকটিশ করবো। এখানে আসার পর মার্গারেট বেশ কিছুদিন মনমরা হয়েছিল। আগেকার মত ছটফটে উচ্ছল হয়েছে আবার ও এখন। আলাদা একটা জৌলুস এসেছে ওর চেহারায় এখন, যা দেখলে মাথা ঘুরে যাবে যেকোনো পুরুষের। ভিক্টরের সঙ্গে ও একটু বেশী মেলামেশা করছে বলে আমি ইদানীং লক্ষ্য করছি। অনেকবারই লক্ষ্য করেছি দুজনে বসে চুপচাপ গল্প করছে। হয়ত আমাকে দেখে হাসল কিন্তু আবার গল্পে মেতে গেল ভিক্টরের সঙ্গে। ওদের এই মেলামেশায় বাধা দেকনা বলেই আপাতত আমি ঠিক করেছি। যদি আমি বাধা দিতে যাই তো মার্গারেট আবার যে স্বভাবের মেয়ে তাতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা বেশী। তীক্ষ্ণ নজর রেখেছি তবে আমি ওদের ওপর। ওর সঙ্গে অবশ্য এখনও পর্যন্ত মার্গারেটকে আমি কোনো আপত্তিকর অবস্থায় দেখিনি। ভিক্টর খুবই নরম প্রকৃতির এবং ভীতু স্বভাবের যুবক। যেহেতু ওর মা এখানকার পরিচারিককা সেহেতু ও সাহস পাবেনা বেশীদূর এগোতে। একটু সাবধানতা অবশ্য দরকার যেহেতু বিশ্বাস করা যায় না মানুষের মনকে। মার্গারেট যেখানে শর্টহ্যারল্ড শিখছে সেখানে গেলে একবার কেমন হয় বলে আমার মনে হল। যেই মাত্র ভাবলাম, তৎক্ষণাৎ আর দেরী না করে সেখানে গেলাম। বেশ ছিমছাম বাড়ি, পলেস্তারা খসে পড়েছে এখানে ওখানে। চারদিক ভাল করে দেখলাম বাড়িতে ঢোকবার আগে। উল্লেখযোগ্য জিনিষ কিছুই চোখে পড়ল না। আমাদের ওখানকার বাড়িগুলোর সঙ্গে এই বাড়িগুলোর অনেক মিল রয়েছে। দরজায় শব্দ করতে একটি বছর বারো তেরা বয়সের মেয়ে মিনিট পাঁচেক পরে দরজা খুলে দিল। কাকে চাই? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল আমাকে দেখেই।

মিসেস উইলসন আছেন? বললাম আমি।

 মেয়েটা বলল, ওনার আসার সময় হয়ে গেছে তবে উনি এখনও ফেরেননি।

পাঁচটা বেজেছে আমার রিষ্টওয়াচটায় দেখলাম। মেয়েটা বলল, এক্ষুনি ফিরবেন উনি, আসুন ভিতরে আসুন।

বেশ সাজানো গোছানো ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলাম। যীশু খ্রীষ্টের ছবি রয়েছে দেওয়ালে। একটি পুরনো ক্যালেন্ডার টাঙানো চলতি বছরের। একটি মেয়েলী পত্রিকা টেবিলে রয়েছে। সাজানো রয়েছে কিছু বইও। মিসেস উইলসন এলেন প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর। উনি হাসলেন আমাকে দেখে। তারপর বললেন, আমার জন্যে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন আপনি নিশ্চয়।

কিছুক্ষণ আগে এসেছি আমি।

ক্ষমা করবেন আমি আসছি এক মিনিট, এই বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন এবং পোষাক পরিবর্তন করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে হাসি মুখে বললেন, কি খবর বলুন?

ওকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম শিখেছে মার্গারেট?

ইতিমধ্যে চা দিয়ে গেছে মেয়েটি? মিসেস উইলসন চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠলেন, খুব ভালই শিখেছে মার্গারেট, বেশ ভাল মাথাটা, তবে…। এই বলে সামান্য থামলেন তিনি এবং ওর কৌতূহলী চোখ নিয়ে আবার বললেন, আপনার ভাইঝিটি খুব চাপা প্রকৃতির।

মনে মনে অবাক হলাম কারণ এই ব্যাপারটা তার উল্টো, এবং খুব কমই আছে ওর মতো হৈ-চৈ এবং খোলামেলা স্বভাবের মেয়ে। জিজ্ঞেস করলাম কারোর সঙ্গে কথা বলে না ও কি এখানে।

হ্যাঁ কথা সবার সঙ্গেই বলে, তবে কেউ যদি ওর বাবার বা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে তখন কিন্তু ও কিছু বলে না। শুধু বলে যে মারা গেছে এবং কেউ যদি আপনার প্রসঙ্গ তোলে তাহলে এড়িয়ে যায় ও একেবারে। আবার বললেন একটু থেমে, ওর কি কোনো পরিচিত ব্যক্তি আছে ফ্রেডি উইলসন বলে।

চমকে উঠলাম আমি। হেসে বললেন মিসেস উইলসন, মার্গারেট আমার পদবী শুনে বলল ওরও একজন এই পদবির ফ্রেডি নামে বন্ধু আছে। ভদ্রলোক নাকি খুব ভাল সাহিত্যিক এবং ভদ্রলোকের খুব প্রশংসাও করল ও।

 টিনটিন করলো আমার ভেতরটা। এখনো তাহলে ফ্রেডিকে ভোলেনি মার্গারেট। আমি নিস্পৃহভাবে বললাম, কিছু বলেছে নাকি সে আর ফ্রেডির ব্যাপারে।

তেমন কিছু আর বলেনি, তবে একটা বই ও পড়তে দেবে বলেছে, একটা ফোটোও আমাকে দেখিয়েছে ফ্রেডির এবং এখানে আসারও নাকি কথা আছে ফ্রেডির।

আমি ঘাড় নাড়লাম এবং আমার বুকের ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

মিসেস উইলসন বললেন, ওর একটা বিয়ের প্রয়োজন এবং এমন একটা পুরুষের সঙ্গ দরকার যাকে ও ভালবাসে বলে এই মুহূর্তে আমার মনে হয়।

আমি ম্লান হেসে বললাম, আমি ওকে খুব ভালবাসি ছেলেবেলা থেকে এবং এই মুহূর্তে আমি ওর বিয়ের কথা ভাবছি না কারণ আমি ভাবতেই পারছি না যে ও আমার কাছে থাকবে না।

আমার কাঁধে একটা হাত রাখলেন মিসেস উইলসন। তারপর বললেন সহানুভূতির সুরে, আমি বুঝতে পারছি সেটা মিস্টার ব্রাউন, ছেলেবেলা থেকে আপনি মানুষ করেছেন বাপ-মা মরা মেয়েটাকে। ছাড়তে কষ্ট হলেও আপনাকে তো একদিন না একদিন ছাড়তেই হবে এবং চিরকাল তো আপনি আপনার কাছে ওকে ধরে রাখতে পারবেন না।

আমি জবাব দিলাম ম্লান কণ্ঠে, আমার কাছে ওকে রেখে দেবো বলেই তো শিখতে পাঠিয়েছি আপনার কাছে, একটু নজর দেবেন যাতে ও ভালভাবে শেখে। আমি আমার ডাক্তারখানাতেই ভাবছি যে ওকে চাকরীতে লাগিয়ে দেবো। ওকে দিয়েই করাবো আমি আমার সমস্ত কাজকর্ম।

সজোরে হেসে উঠলেন মিসেস উইলসন আমার কথা শুনে, বললেন, অবাক করলেন আপনি আমাকে, যতই আপনি ওকে আপনার নিজের কাছে রাখুন আপনি কি পারকেন ওর মনের ইচ্ছাকে দমন করতে, চাকরী করতেও কী রাজী আছে মার্গারেট? ,

আমি ঘাড় নাড়লাম, হ্যাঁ।

আমি উঠলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলার পর। আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন মিসেস উইলসন। আমি নিজের মনেই বেশ ভারী মন নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। ব্যাপারটা এমনিতে স্বাভাবিক যে মার্গারেট ঐ ভদ্রমহিলার কাছে প্রশংসা করেছে ফ্রেডির। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না এই ব্যাপারটা। কোথায় যেন খোঁচার মতো বিধছে একটা কাটা। আমাকে কি তাহলে একেবারেই ভালবাসে না মার্গারেট? কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ও আমাকে ভালবাসে এবং এটা আমার মনে হয় ওর আচার আচরণ দেখে। কেন রয়েছে তাহলে ওর কাছে ফ্রেডির ফটো। আমি এটাকে সাজাতে পারছিলাম না কোনোরকম যুক্তি দিয়েই। একেবারেই বাড়ি যাবার ইচ্ছা আমার নেই বলে আমি খুব মনোরম জায়গা গার্ডেনে চলে গেলাম। যার চারদিকে শুধুই সবুজের সমারোহ এবং মাঝখানে একটা ঝিল। দৃশ্যটা খুবই অপূর্ব একটি বেঞ্চিতে বসলাম গিয়ে, কিছুনারী পুরুষ রয়েছে আশেপাশের বেঞ্চিতে। হঠাৎ একটা গাছের তলাতে চোখ পড়তে আমার শরীর পাথর হয়ে গেল এবং আমি একটু আড়ালে বসলাম সঙ্গে সঙ্গে। আমাকে যাতে ওরা দেখতে না পায়। ওরা গল্পে এতই মশগুল যে আমাকে একেবারে লক্ষ্যই করেনি। আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম আড়াল থেকে। হাসির শব্দ শুনলাম।

কিছু কিছু শব্দ কানে এলেও আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না প্রায় ওদের কথাবার্তা। একটি হিমেল অনুভূতি যেন বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমার মনে হল যেন ঘামছি যখন আমি কপালে হাত রাখলাম। অসুস্থ হয়ে পড়েছি বলে একবার আমার মনে হল। আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না কি করব। কি করা উচিত এই মুহূর্তে আমার। ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত, কি হবে কান টেনে। তাহলে কি ও আরো জেদী এবং অবাধ্য হয়ে উঠবে। সেই মানুষ মরীয়া হয়ে উঠে যখন কারো কোনো গোপন ব্যাপার প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তখন তাকে আর সামলানো যায় না, সে এমন কিছু ভয়ঙ্কর করে বসে। এতো সাহস আর স্পর্ধা ওর। আমি খুব সাবধানে দৃষ্টি রেখেছি ওদের দিকে। বিকেল চলে যাচ্ছে এবং বেশ খানিকটা সময় এইভাবে কেটে গেল। পুরো জায়গাটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দু একজন কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে এ পাশে ও পাশে দেখলাম। ওরা ভেবেছে আমি পাগল বা বিকৃত মানসিকতা যুক্ত। আসলে ব্যাপারটা কী ওরাতো কেউ বুঝতে পারছে না। ওদের অবশ্য সেরকম কোনো অশালীন দৃশ্য দেখতে পেলাম না খানিকটা সময় কেটে যাবার পরও। ওরা পরস্পরের হাত ধরে রেখেছিল অবশ্য কিন্তু আমার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিল সেটাও। সহ্য করতে পারছিলাম না আমি একেবারে এবং একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে ইচ্ছা করছিল। নিজেকে সংযত করে বসে রইলাম আমি কোনোক্ৰমে। ওরা হাত ধরাধরি করে চলে গেল একসময়। আমি অনেকক্ষণ বসে রইলাম ওরা চলে যাবার পরও। বাইরে যদিও অন্ধকার অবশ্য বাগানের ভেতর আলো রয়েছে। একটি অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ তৈরী হয়েছে আলো আঁধারি মিলে।

একটা গোপন রহস্য দানা পাকিয়ে উঠছে যেন কোথায়। এর আগেও আসা যাওয়া করেছে এরা, এটা নিশ্চয় প্রথম নয়। ও অনেক কিছুই তাহলে গোপনে করে। আমি যখন এর হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছি এখন এর একটা ব্যবস্থা করবো।

হাঁটতে লাগলাম বাগান পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তা ধরে। এক দম্পতি আমার পাশ দিয়ে দুজনে দুজনের কোমর জড়িয়ে চলে গেল। মেয়েটি ভদ্র নয় সেটা ওর মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে মনে হল। ওদের বাগানের ভেতর ঢুকতে দেখলাম আমি পিছন ফিরে।

আমি খানিকটা স্বস্তি বোধ করলাম লোকালয়ে পৌঁছে। নানা ধরনের মানুষ যাতায়াত করছে চৌরঙ্গীতে। একমনে হাঁটতে হাঁটতে গাড়িঘোড়ার শব্দ শুনছি। কিছু ভালো লাগছে না। একটি বারে বসে মদ খেলাম। বেশ রাত করে বাড়ি পৌঁছলাম। খাবার চাপা দিয়ে গেছে ডরোথি। শোবার ঘরে গিয়ে দেখি ঘুমোচ্ছ মার্গারেট। মনে হল ওকে শেষ করে দিই। ওর ঘুমন্ত মুখ দেখে একটি সরল বালিকা মনে হল ওকে। ওর কাছে দাঁড়ালাম পোক ছেড়ে। গাউন উঠে গিয়ে পায়ের ডিম দেখা যাচ্ছে। মিমি ঘুমোচ্ছে কাত হয়ে। আমি হাত রাখলাম ওর মাথায় কিন্তু তাতেও ওর ঘুম ভাঙলো না। আমি ওর পাশে শুয়ে পড়াতে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগল আমার। আমার প্রতিশোধ নেওয়া হল না যদিও নেবো ভেবেছিলাম।

বেশ বেলা করে আমার ঘুম ভাঙলো। রিষ্টওয়াচে দেখলাম আটটা বেজেছে। মার্গারেট নেই পাশে ঘুরে দেখলাম, তাই উঠে বসলাম ধড়ফড় করে। মনে করার চেষ্টা করলাম গতরাতের কথা আমি। এখনো সামান্য ধরে আছে মাথাটা। বাথরুমে চলে গিয়ে স্নান সেরে নিলাম। চেহারায় যে বয়সের ছাপ পড়েছে তা বাথরুমে গিয়ে নগ্ন হয়ে দেখলাম। মাথার চুল পাকা। আমি রোজই দাড়ি গোঁফ কামাই এবং কামিয়েছিলাম গতকাল সকালেই। গতকাল বিকালবেলার কথা এখন কামাতে গিয়ে মনে পড়ল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল গার্ডেনের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার কথা। আবার রাগ জমতে আরম্ভ করলে শরীরে। আমি বারান্দায় গেলাম এরপর সমস্ত কিছু সেরে। একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পরছিল মার্গারেট বারান্দায়। একবার আমার দিকে তাকিয়ে যথারীতি আবার মন দিলো খবরের কাগজে। ও আমাকে অবজ্ঞা করছে বলে যেন আমার মনে হল। ওকে সত্যিই অপূর্ব লাগছিল পাশ থেকে। সরল বালিকার মত এখন ওকে আর মনে হচ্ছে না। আমাকে নিয়ে খেলা করছে যেন এক রহস্যময়ীনারী। একটা চেয়ারে সামনাসামনি বসলাম আমি গম্ভীর মুখে। একমনে কাগজ পড়ছে মার্গারেট।

এর মধ্যে আমাদের চা দিয়ে গেল পরিচারিককা ডরোথি। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, মিঃ ব্রাউন, আপনি কাল রাতে খাননি কেন?

আমি হেসে বললাম, একটু দেরী হয়ে গেছিল কাল আমার ফিরতে।

আমার সামনে থেকে চলে গেল ডরোথি আচ্ছা বলে। চুমুক দিলাম আমি চায়ের কাপে।

এক হাতে কাপ তুলে নিল মার্গারেট কাগজ পড়তে পড়তে।

.

২২.

 ও আমার সঙ্গে আগে থেকে কিছু বলতে চাইছেনা এটা আমি বুঝতে পারছি। ওর ভেতর। একটা যেন কোথায় পরিবর্তন ঘটে গেছে। ওর মুখের মধ্যে কোমলতার বদলে কঠিনতা। শেষ করলাম দুজনে চুপচাপ চা খাওয়া। রাগে ফুলছিল আমার শরীরটা এবং আমি মার্গারেটকেবললাম, একটু ঘরে চলল।

খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলে ও এর কারণ জিজ্ঞেস করল।

আমি আবার বললাম, আমার দরকার আছে।

 নিস্পৃহভাবে ও খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলে বলল, যা বলার তা এখানেই বলো।

আমি এবার বললাম একটু জোরে, ঘরে যেতে বলেছি না তোমাকে।

 ভাল লাগছে না এখন ঘরে যেতে।

ওর ইচ্ছা নেই তা সত্ত্বেও ও হেসে উঠল এবং তখন আমি উঠে পড়লাম। আমাকে ভেতর ভেতর আরো জ্বালিয়ে দিল ওর সেই হাসির ন্যাকামি। আমি বললাম, যেতেই হবে তোমাকে।

মার্গারেট বলে উঠল, একটু পরে যাচ্ছি।

পরে নয় এক্ষুনি, এই বলে আমি ওর হাতটা ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এলাম ঘরের ভেতর এবং ওকে ছুঁড়ে দিলাম বিছানার উপর। ও ছিটকে পড়লো বিছানার উপর। ও চোখদুটো বড়ো বড়ো করে ঢোক গিলে আবার বলল, হয়েছেটা কি?

আমি তাকালাম ওর দিকে স্থির চোখে এবং বললাম, কোথায় গিয়েছিলে কাল বিকালে তুমি?

সঙ্গে সঙ্গে ও জবাব দিল, আমি যেখানেই যাই না কেন সেখানে নিজের ইচ্ছায় গেছিলাম।

ছুটে আমি আমার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলাম। ডরোথি কিংবা অন্য কেউ এসে পড়ুককথার মাঝখানে সেটা আমি চাইনা। এবার আমি দাঁড়ালাম গিয়ে মার্গারেটের সামনে। আমি বললাম, আমি এখন তোমার অভিভাবক, এটা তোমার ব্যাপার নয়, তুমি যখন যা করবে তা আমার অনুমতি নিয়ে করবে।

মার্গারেট ঝাঁঝিয়ে বলল, আমি এসেছি তোমার সঙ্গে আমার নিজের ইচ্ছায়, তাই বলে তুমি আমার অভিভাবক হতে পারো না। আমাকে নিয়ে আসার এতটুকুও ক্ষমতা তোমার ছিল না যদি আমি না নিজে আসতে চাইতাম। আমার এই দেহের উপরেই যতো লোভ তোমার, কারণ তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ।

আমি আবার বললাম, তোমার কাছে কেন রেখেছ ফ্রেডির ফটো?

ও আমার একমাত্র বন্ধু সেই কারণেই নিজের ইচ্ছায় রেখেছি আমি।

আমি ওর গালে একটা সজোরে থাপ্পড় মেরে বললাম, ও তোমার বন্ধু, বাঃ আর আমি তোমার কেউ নই?

মার্গারেটের দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল এবং ও গালে হাত দিল। জ্বলন্ত চোখে ও সেই অবস্থাতেই বলল, তোমার কাছে আমি থাকবো না।

ক্রমশঃ আমার এত রাগ বেড়ে যাচ্ছিল, যে ওকে আমি ভীষণ ভাবে মারলাম একটা বেল্ট দিয়ে। একবারের জন্যেও চীৎকার করে কাঁদলো না মার্গারেট, কি আশ্চর্য! আমি শান্ত হলাম বেশ খানিকক্ষণ পরে। উপুড় হয়ে শুয়েছিল মার্গারেট, আমি চুপচাপ হাত দিয়ে বসে রইলাম মাথায়, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেল্টটাকে। আমার কিছুই ভাল লাগছেনা এবং এইভাবে কাটলো ঘণ্টাখানেক। আমি বাইরে বেরিয়ে গেলাম এবং উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো মার্গারেট। ডরোথির কাছে আমি প্রথমেই গেলাম।

বেশ ঘাবড়ে গেল ডরোথি আমার উদভ্রান্তের মত চেহারা দেখে।

কি হয়েছে আপনার, সে জিজ্ঞেস করল। আমি একরকম জোর করেই মৃদু হাসলাম, বললাম, ভিক্টর কোথায়, আমার কিছু হয়নি।

ডরোথি জবাব দিল, বেরিয়ে গেছে তো ভিক্টর।

আমি বললাম, ও এলে বলবে, খুব জরুরী দরকার আমার, আমি বেরোচ্ছি, ও এলে নিশ্চয় আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।

একটু অবাক হয়ে ডরোথি বলল, এলেই বলব, আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

 আমি বললাম, বল।

কোনো খারাপ খবর আছে কি? ও জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম হেসে, তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারে যে, কোনো খারাপ খবর নেই। আমি সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম এই কথা বলে। এলোমেলোভাবে বেশ খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম রাস্তায়। আমার রীতিমতো অনুশোচনা হচ্ছে কারণ আমি এই প্রথম গায়ে হাত তুলেছি আমার প্রিয়তমার। মার্গারেটের একটা স্বাধীনতা নিশ্চয় আছে যদিও সে আমার প্রিয়তমা হোক না কেন। আবার এটাও ঠিক যে আমি ওকে ভালবাসি, তাই এটাই বা কেমন করে হয় যে ও আমাকে অবজ্ঞা করে অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘুরবে এবং ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশবে। ওর কাছে থাকবেই বা কেন আমার বন্ধুর ছবি। ক্ষতিই বা কি, যদি আমার বন্ধুর ছবি ওর কাছে থেকেই থাকে। এটাই বা কেমন করে হয় যে আমি ছাড়া ওর আর অন্য কোনো পুরুষ বন্ধু থাকবে না। এই সব ব্যাপারটাই ওর নিজস্ব। আমার বোকামি। বাড়ি ফিরলাম, ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ আর তুলো কিনে নিয়ে। আমি ওর গায়ে হাত দিলাম। দেখলাম ও এই ভাবে শুয়েই রয়েছে এবং ঘুমিয়ে পড়েছে। অসহায় লাগছে ওর মুখটা রীতিমতো। ও নিশ্চয়ই ভালবাসে আমাকে। আমার সঙ্গে নাহলে এখানে ও চলে আসতে পারে না। ওকে ডাকলাম আমি আলতো করে, ওর দেহে দু এক জায়গায় কালসিটে পড়েছে। বললাম, মিমি মিমি, আমি এসেছি উঠে পড়ো।

মার্গারেট ঘুমোচ্ছিল গভীর ভাবে এবং সেই কারণেই আমি ডাকতে ও উঠে বসলো ধড়ফড় করে। আমি বললাম, শুয়ে থাকো, একদম উঠবে না।

আমার নির্দেশ পালন করলো মার্গারেট একেবারে বাধ্য মেয়ের মত। ওর আঘাত লাগা জায়গাগুলোতে আমি ওষুধ লাগিয়ে দিলাম তুলে দিয়ে। পিঠে, মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আমি বললাম, আমায় তুমি ক্ষমা কর মিমি, হিতাহিত জ্ঞান ছিল না তখন আমার। লক্ষীটি কিছু মনে করো না, এরকম হবে না আর কোনো দিন।

মার্গারেট কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইল। পরম আবেগে একটা চুমু খেয়ে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম এবং ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ওকে নিয়ে সেদিন খাওয়া দাওয়া শেষ করে কলকাতার বিভিন্ন দিকে বিশেষ করে উত্তরের দিকটায় ঘুরলাম। লোকজনের ভিড় কেশ এখানটায়। দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার সেদিনই সেই বিখ্যাত বাংলা ছবিটা। ছবিটা হচ্ছিল একটি মাঝারী ধরণের বাংলা সিনেমা হলে। তেমন একটা ভিড় নেই অবশ্য হলে ঢুকে দেখলাম। আমাদের দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল আমাদের আশে পাশে যারা বসেছিল। আমরা যেহেতু বিদেশী সেহেতু অনেকেরই ধারণা হল যে আমরা ছবিটা বুঝবো তো! আমরা প্রায় আড়াই ঘণ্টা ছবিটা দেখলাম তন্ময় হয়ে। আমি এর আগে এত গভীর এবং মানবিক ছবি দেখেছি বলে আমার মনে হল না। ছবিটি বিশ্ব জয় করার মত। ধন্যবাদ জানালাম হল থেকে বেরিয়ে ছবিটির যুবক পরিচালককে। যুবকটির বাবা নাকি সাহিত্যিক ছিলেন। এটাই নাকি তার প্রথম ছবি। একটি বিজ্ঞাপন কোম্পানির কর্মাশিয়াল আর্টিস্ট ছিল যুবকটি। তার আঁকা নাকি এখানকার অনেক বইয়ের কভারও। তার নিজের আঁকা যে কাহিনী নিয়ে তিনি ছবি করছেন তার কভার এবং ভিতরের ছবিটিও। ক্যালিওয়ার্ক ভালই জানেন।

 অনেকটা ছবি দেখার পর মার্গারেটের মন ভালো হল। ও হলের মধ্যে মাঝে মঝে আমার হাত চেপে ধরছিল। খুব ভাল লেগেছে ওর ছবিটা। একটা রেস্তোরাঁয় নানারকম খাবার খেলাম আমরা। ও উজ্জ্বল আবার আগের মতোই। হেসে কথা বলল ও আমার সঙ্গে। ছবিটা নিয়ে অনেক কথা বললাম। রাত আটটায় পোশাক পাল্টে চেয়ারে বসে আমি আমার একটা হাত মার্গারেটের কাঁধে রাখলাম।

ভিক্টরের সঙ্গে আমি গার্ডেনে গিয়েছিলাম কাল বিকালবেলা, তুমি ছিলে না। এই সময় ও বললো যে চলো একটু গার্ডেনে ঘুরে আসি, তাই গার্ডেনে পৌঁছলাম ঘুরতে ঘুরতে, তোমাকে বলা হয়নি, কারণ তুমি ছিলে না। ও একটু থেমে আবার বলল, ও আমার গুণমুগ্ধ শ্রোতা এবং বন্ধু।

আমি হেসে বললাম, ভিক্টর খুব ভালো ছেলে, তা তুমি নিশ্চয় ওর সঙ্গে যাবে।

আমি আর তুললাম না ফ্রেডি ছবিটার কথা।

আমরা ঘরে এলাম রাতের ডিনার শেষ করে। আমার প্রিয়তমা মিমি, আমার মার্গারেটকে গোলাপী রঙের গাউনে চমৎকার লাগছিল। মার্গারেট বিছানায় শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা অর্থেই হাসলো। আমার রক্ত গরম করে তুলেছে ওর কটাক্ষ। ঘরে তখন মান আলো জ্বলছিল এবং ওর কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম একটার পর একটা। মার্গারেট, আমি ক্লান্ত দেহে শুয়েছিলাম এবং নিজেরাই ভাল করে জানিনা কখন যে দুজনের চোখে ঘুম নেমে এসেছে। দীর্ঘকাল পরে আমি এতখানি আনন্দ পেলাম মার্গারেটের সঙ্গ পেয়ে।

.

২৩.

 সকাল থেকে আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ এবং ঘন হয়ে গেছে কালো মেঘে। কলকাতার বুকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমাদের টেবিলে অনেকক্ষণ চা দিয়ে গেছে ডরোথি। নিজের মনে আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম এবং সামনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। বৃষ্টি নামল কিছুক্ষণের মধ্যে। মার্গারেট তখনো ঘুমোচ্ছিল বলে ওকে আমার আর জাগাতে ইচ্ছা করল না। আমরা অনেক রাতে ঘুমিয়েছি গতকাল। অনেকদিন পর শান্তিতে ঘুমোচ্ছ মার্গারেট বলে মন চাইছে না ওকে বিরক্ত করতে। আমার সঙ্গে ওর রোজই প্রায় ঝগড়াঝাটি হচ্ছে এবং বর্তমানে কাটিয়ে দেওয়া গেছে। সেই অবস্থাটা। বৃষ্টি দেখছিলাম আমি চুপচাপ এবং সেই বৃষ্টির মধ্যে ঝড় কাকের মত হঠাৎ ছাতা নিয়ে হাজির হল ভিক্টর। ওর দেহের অনেকটাই ভিজে গেছে ছাতা থাকা সত্ত্বেও। আমার কাছে এসে ও হাজির হয়ে বোকার মত হাসলো ছাতাটা বাইরে রেখে। ওর হাসিটা খুবই সরল এবং ওর মধ্যে এখনও ছেলেমানুষি ভাব যায়নি তাই বেশ ভাল লাগছে ওকে দেখে। অবাক হয়ে বললাম, এতো ঝড় জল মাথায় করে, কি ব্যাপার ভিক্টর?

ভিক্টর হেসে বলল, মা বলল, খুব জরুরী প্রয়োজনে আপনি আমাকে ডেকেছেন আংকল, তাই আমি চলে এলাম।

ডরোথিকে বলেছিলাম একবার ভিক্টরকে পাঠিয়ে দেবার কথা এবং সেই কারণেই হয়তো ও পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি ব্যাপারটা একেবারে ভুলেই গেছিলাম কিন্তু তা মনে পড়লো এবারে। বোসো, হেসে বললাম। চা দিয়ে গেছে ডরোথি ইতিমধ্যে। ভিক্টর অপেক্ষা করতে লাগল চায়ে চুমুক দিতে দিতে। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে কথাটা বলব, কারণ আমার মনে কোনো বল নেই এই মুহূর্তে। ভিক্টরই বলে ফেলল অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে, একটু গার্ডেনে গিয়েছিলাম আমি কালকে মার্গরেটকে নিয়ে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম কারণ আমার ভালই লাগলো ওর কাছ থেকে কথাটা শুনে। তাই বললাম, আমি শুনেছি কারণ মিমি আমাকে বলেছে।

ভিক্টর আবার বলল, যেতে চাইছিল না মার্গারেট প্রথমে আমার সঙ্গে, আপনি এসে রাগ করবেন বারবার বলছিল, তাই ওকে অনেক কষ্ট করে নিয়ে গেছি আমি।

সিগারেট ধরালাম আমি। আমি সাধারণত মনের ভেতর উত্তেজনা না হলে সিগারেট খাই না। সিগারেটে টান মেরে বললাম, খুব ভাল করেছে, মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে একটু এদিক ওদিক যেও, আমার অনুমতির দরকার নেই সব সময়, তুমি থাকলে আমি নিশ্চিন্ত, তুমি ইচ্ছা করলে ওর প্রিয় বন্ধু হতে পার।

ও কিছুটা অবাক হয়ে আমার কথায় বলল, ও খুব সরল মেয়ে, তবে ও বকে খুব বেশী।

ওর কথা শুনে আমি হেসে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছো, বড় বেশীবকা ওর অভ্যাস, আবোল তাবোল কথা বলে, ওকে শর্টহ্যারল্ড, টাইপ শিখতে দিয়েছি কিন্তু ও আজ অবধি তা ঠিকমতো শিখতে পারলো না। এতো বুদ্ধি কম হলে, ওর যে কি হবে!

ওর যথেষ্ট বুদ্ধি আছে এবং শর্টহ্যারল্ড টাইপেও যথেষ্ট স্পীড আছে।

আমি সজোরে হেসে উঠলাম, তুমি তো ওর এত বেশী গুণগ্রাহী হয়ে পড়ছ এর মধ্যে যে এতটা বেশী পরিমাণ ভক্ত হয়ে যাওয়া–এটা একদমই ভাল লক্ষণ নয়।

এই বলে আমি হেসে উঠলাম এবং লক্ষ্য করলাম ভিক্টর তাকিয়ে রয়েছে ফ্যালফ্যাল করে এবং ওর মধ্যে মার্গারেটের উপর প্রেমের চেয়ে বেশী একটা গুণমুগ্ধ ভাব গড়ে উঠেছে। ওকে নিয়ে মার্গারেট যা ইচ্ছা করতে পারে এখন। আমি বললাম, মার্গারেটকে তুমি বাংলা শেখাবে বলেছিলে, তা শিখাবে কবে থেকে?

ভিক্টর চুপ করে রইল। কালো হয়ে আসছে আকাশ। বৃষ্টিও হচ্ছে প্রচণ্ড। সঙ্গে বইছে ঝড়ো হাওয়া। ভিক্টর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলল, আমি শেখাতে আরম্ভ করব সেদিন থেকেই যেদিন থেকে আপনি বলবেন।

তুমি আরম্ভ কর আগামী সপ্তাহ থেকে।

 ভিক্টর আমার কথায় ঘাড় নাড়াতে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। প্রচণ্ড দুর্যোগ চলছে বাইরে। আমার হাতের মুঠোর মধ্যে যেমন করে হোক রাখতে হবে এই সাদামাঠা ছেলেটিকে। এতে কোন অসুবিধা হবে না। আমি ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কি কোনো অসুবিধা আছে আমার কাছে কাজ শিখতে ভিক্টর।

আমি থেমে যেতে ভিক্টর উৎফুল্ল হয়ে বলল, আমিতো কিছুই জানি না এবং এতে কিন্তু কোনো অসুবিধা হবে না আমার।

আমি তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে নেব এবং এতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।

আমি ঘড়িতে দেখলাম বেশ বেলা হয়েছে এবং বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণ দেখছিনা তাতে। তবে আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে। আমি বললাম, আমি একটু আসছি, বসো ভিক্টর।

মার্গারেট ঘুমোচ্ছ এখনও পর্যন্ত, ওকে জাগাতে হবে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম ও বিছানায় নেই, বাথরুমে। দরজা বন্ধ, তাই মৃদুভাবে টোকা দিতে ও বলল মিষ্টি গলায়, চান করছি, জলের শব্দ আসছিল বাথরুম থেকে।

দরজায় আবার টোকা দিতে ভিতর দিকে সাড়া এল, খোলা আছে দরজা।

আমি দরজাটা খুললাম মৃদু ভাবে টোকা দিয়ে। মার্গারেটের দেহ ভেজা কারণ ও স্নান করছিল। ওর ভিজে ঠোঁটে চুমু খেলাম এই অবস্থায় ওকে জড়িয়ে ধরে। আমার সারা দেহ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল একটা আশ্চর্য সুখের অনুভূতি। আমাকে জড়িয়ে মার্গারেট আদুরে ভঙ্গীমায় বলল, এখনতো বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, কেমন হয় বৃষ্টিতে ভিনজলে?

শরীর খারাপ হবে এতে, বললাম আমি কপট ধমক দিয়ে।

খিলখিল করে হেসে বলল মার্গারেট, হোক শরীর খারাপ, ভিনজবো আমি তবু। আমি মুছিয়ে। দিতে লাগলাম ওর দেহটা পরম মমতায় হ্যাঁঙার থেকে একটা তোয়ালে পেড়ে নিয়ে। ও খিলখিল করে হেসে উঠছিল এবং মাঝে মাঝে ছটফট করছিল। আমি পাঁজাকোলা করে ওকে তুলে নিলাম ভাল করে মুছিয়ে দিয়ে। ও পা দুটো ছুঁড়ে বলে উঠল, তুমি আমাকে এই ভাবে নিয়ে চলো বৃষ্টিতে।

আমি চাই না এতে তোমার শরীর খারাপ হোক।

উঠে এলো মার্গারেট এবং হেসে বলল, তোমার শুধু শরীর খারাপের অজুহাত কারণ তুমি সেকেলে ভীষণ। আমার ভাবতেই খুব খারাপ লাগছে যে আমাকে সারাজীবন কাটাতে হবে তোমার সঙ্গে।

কোনো জবাব দিলাম না এবং বললাম, আমি বাইরে বসে আছি। তুমি পোষাক পরে নাও তাড়াতাড়ি।

বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে দেখি ভিক্টর বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। একবার আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ও মৃদু হাসলো। আমি ওর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টি কমে এসেছে, আমার টাকার দরকার, তাই একবার লন্ডনে খবর দিতে হবে। যদিও আমার টাকার দরকার কোন  অভাববোধে আমি ভুগছি। মার্গারেট এসে মুখোমুখি চেয়ারে বসল মিনিট পাঁচেক পরে এবং ভিক্টরকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠল এবং বলল, তুমি কখন এসেছে ভিক্টর?

মৃদু হেসে ভিক্টর জবাব দিল, অনেকক্ষণ এসেছি, তুমি এই বৃষ্টিতে খুব ঘুমোচ্ছিলে, ও সামান্য বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল।

মার্গারেট হেসে বলল তবে বেলা তেমন একটা হয়নি। চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছিল ও এবং ঘাড় অবধি ওর চুল নেমে এসেছে। ওকে বেশ বেপরোয়া মনে হচ্ছে কারণ ওর পরনে একটি প্যান্ট এবং রঙীন শার্ট।

আমি তাকালাম মার্গারেটের দিকে, আগামী সপ্তাহ থেকে ভিক্টর তোমায় বাংলা শেখাবে মিমি।

মার্গারেট আমার এবং ভিক্টরের পরস্পরের দিকে তাকাল। কিছু না বলে খবরের কাগজটা টেনে নিল। কাগজ পড়তে লাগলো ও চিরুনীটা পাশে রেখে। আমি তাকালাম মার্গারেটের দিকে এবং দেখলাম যে ভিক্টরও মার্গারেটকে দেখছিল। ওর চাহনিতে কৃতজ্ঞতার ছাপ কিন্তু তাতে কোনো পাপবোধ নেই। আমরা যে ওকে আমল দিয়েছি এতেই ও খুশী। ভিক্টরের দিকে ছুঁড়ে দিল মার্গারেট খানিকটা কাগজ পড়ার পর। এরই মধ্যে কাগজ পড়া শেষ হয়ে গেল তোমার, ভিক্টর হেসে বলল।

আমি শুধু সিনেমা আর খেলার পাতাটাই দেখি, আমার কাগজের অন্য কোনো খবর পড়তে ভাল লাগে না।

ভিক্টর সজোরে হেসে বলল, তোমার তো পৃথিবীর আর কোনো জিনিষ ভালো লাগে না ঐ দুটো ছাড়া। তাকিয়ে দেখলো মার্গারেট ভিক্টরের দিকে একবার। আমি ব্যস্ত ছিলাম তখন অন্য একটা কাগজ পড়ায়। আমি জরীপ করছিলাম ওদের দুজনকে তারই ফাঁকে ফাঁকে। এছাড়া আমার উপন্যাস, বিশেষ করে প্রেমের, পড়তে খুব ভালো লাগে।

হোঁচট খেলাম আমি কিন্তু তবু মার্গারেটের দিকে তাকালাম না এবং কাগজ পড়তে লাগলাম।

ভিক্টর হেসে বলল, তোমার তো উপন্যাস পড়তে ভাল লাগে, আমারও লাগে, আমি প্রায় সব লেখাই পড়েছি শেক্সপিয়ারের, আমার খুব ভালো লাগে শেক্সপিয়ারকে।

মার্গারেট হেসে বলল, তোমাকে আমার একজন পরিচিত লোকের উপন্যাস পড়তে দেব, এই বলে মার্গারেট আমার দিকে তাকাতে আমি ভাবলাম সে হয়তো আমাকে পরীক্ষা করতে চাইছে। তাই আমি কাগজ পড়তে লাগলাম নিস্পৃহ ভাবে। এবার জিজ্ঞেস করলো ভিক্টর, কি নাম ভদ্রলোকের?

লন্ডনের একটা কাগজের সাংবাদিক এবং লেখক ফ্রেডি উইলসন। থেমে থেমে বলতে লাগলো যে, ভদ্রলোক খুবই সুপুরুষ এবং ভালো লেখে, একটা ছবি ভদ্রলোকের আমার কাছে আছে, নাম আছে ভদ্রলোকের সাংবাদিক হিসাবেও।

মার্গারেট আমাকে পরখ করতে চাইছে নিশ্চয় আমার সামনে আমার বন্ধু ফ্রেডির প্রশংসা করে। এটা ঠিক নয় যে আমার ভেতরে একটা চিনচিনে যন্ত্রণা হচ্ছিল না কিন্তু নিস্পৃহ ভাবে তবু আমি কাগজ পড়তে লাগলাম। বাইরে রোদের আভাস তখন, কারণ বৃষ্টি থেমে গেছে। তাকিয়ে, দেখলাম ভিক্টরের দিকে যে ওর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে।

মার্গারেটকে জিজ্ঞেস করলো, কি নাম উপন্যাসের?

নামটা বললো মার্গারেট উপন্যাসের। আমি তাকিয়ে বললাম ভিক্টরকে, আমাদের কফি দিয়ে যেতে বলতে একবার তোমার মাকে ভিক্টর।

ভিক্টর রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে আমি মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে হাসলাম এবং বললাম, তুমি আজকাল নিজেকে খুব চালাক ভাবছো মার্গারেট।

তোমার এসব ভুল ধারণা, কে বলেছে এসব? ও হেসে উঠতে আমি বললাম, আমার ঈর্ষা নেই ফ্রেডির উপরে কারণ ফ্রেডি আমার বন্ধু।

আমি বলতে ও ওর সেই রহস্যমাখা হাসিটি মৃদু হাসলো। ভাবা যায় না ওর মাঝে রহস্যময়ী হয়ে ওঠাটা। তখন আমার কাছে ও সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে যায় এবং ওকে তখন আর চিনতে পারিনা আমি। আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে তখন ওর মনের তল পাওয়া। তোমার কি ফ্রেডিকে খুব ভালো লাগে, আমি জিজ্ঞেস করলাম মার্গারেটকে।

ভনিতা না করেই মার্গারেট বললো, আমি খুব কমই দেখেছি ফ্রেডির মত লোক।

আমি কি উত্তেজিত হচ্ছি ভেতর ভেতর, তাই আমি চুপ করে রইলাম। আমি ঠিক বলতে পারছি না যে আমি উত্তেজিত হচ্ছি কিনা। আমি তাই না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ফ্রেডির কোন দিকটা তোমার বেশী ভালো লাগে মিমি?

ফ্রেডি খুবই সমানুষ, ওর সবকিছু, বিশেষ করে ওর আচরণ আমার খুবই ভালো লাগে।

আমার আর জবাব দেওয়া হল না যেহেতু ভিক্টর এবং ডরোথি এসে পড়ল। ডরোথি ট্রে টেবিলের উপর রেখে মৃদু হাসলো, কফি দিলো তারপর আমাদের। আমি আকাশের দিকে তাকালাম কফিতে চুমুক দিতে দিতে। রোদ অদৃশ্য হয়ে গেছে, আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে, সম্ভবতঃ ঝড় উঠবে বলে।

.

২৪.

 মার্গারেটের গর্ভে সন্তান এসেছে তা ধরা পড়ল মাস তিনেকের মাথায়। মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল এবং একদিন খাবার পরে বমি করলো এবং কোনো রুচি ছিলনা ওর খাবারে। আমাকে কিছু জানায়নি ও, চেপে গিয়েছিল, ডরোথি একমাত্র জানতে পেরেছিল। বাড়ির পরিচারিককার থেকে মিমির সন্তান হবার লক্ষণ জেনে নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে, আপনার আত্মীয়ার পেটে বাচ্চা আছে, ডাক্তার হাসি মুখে জানাল আমাকে।

সন্তান এসেছে মাস তিনেক হল, মাস তিনেক আগে আমরা দিল্লী থেকে এসেছি। আমি রীতিমতো গম্ভীর হয়ে গেলাম ডাক্তারের কথায়। রক্ত উঠে গেল আমার মাথায়। এ সন্তান আমার নয় এ বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চিত। আমি খুবই সাবধানে প্রত্যেকবার মিলিত হয়েছি। মার্গারেটও ভোলে না প্রতিদিন সাবধান হতে। আমার সন্দেহ সেই কারণেই বাড়তে লাগলো ক্রমশঃ। মাস তিনেক আগের সেই রাতের কথা মনে পড়ল। দিল্লীতে তখন আমরা এবং অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। মার্গারেট ফিরছিল না কিছুতেই। তারপর আমি দেখলাম ও ফ্রেডির সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল। আমি ওকে রীতিমতো মেরেছিলাম ফেরার পর। কোনো রকম প্রতিবাদ করেনি ওর মতো জেদী মেয়ে, আমার পরিষ্কার মনে আছে সেটা। মার খেয়েছিল চুপচাপ। কোথায় যেন একটা অপরাধে কষ্ট পাচ্ছিল ও এই বলে আমার মনে হচ্ছিল। ফ্রেডিই কি তবে সবকিছুর মূলে?

 বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি কিছুতেই, এবং ওর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম আমি সেই রাতেও। আমি সাবধান ছিলাম। আমি ভুলিনি সাবধান থাকতে হয় প্রচণ্ড উত্তেজনার মধ্যে। কিছুদিন নার্সিংহোমে রাখতে হবে এখন মার্গারেটকে। ওর শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেছে এবং ওকে রাখাটা ঠিক করলাম আমি ডাক্তারের পরামর্শেই।

কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি কি করব। অস্থির লাগছে নিজেকে ভীষণ এবং বারবার মাথাটা গরম হয়ে গেছে। মার্গারেটের গর্ভে আমার সন্তান যে আসেনি এটা আমার স্থির বিশ্বাস। এই সন্তানটি তাহলে কার?

ঘড়িতে ঢং ঢং করে সকাল নটা বাজল। আমি তখন বসে আছি বারান্দায়। হাওয়ার বেগ আজ একটু বেশী। চা দিয়ে ডরোথি জিজ্ঞেস করল আমাকে, কেমন আছে আজ মিমি?

ও ওখানে কিছুদিন থাক, কারণ ওর শরীর খুব দুর্বল।

ডরোথি বলল আমার কথার জবাবে, মিঃ ব্রাউন, থাকাই ভাল; কিন্তু আপনি কি একেবারেই বুঝতে পারেননি যে ঐ ঘটনা কি ভাবে ঘটল?

বাড়ির পরিচারিককার সঙ্গে আমি এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছিলাম না তাই বললাম, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের তো একটা স্বাধীনতা থাকে, আমিতো ওকে সবসময় নজরে রাখতে পারি না।

এ সমস্ত কথাবার্তা যে আমি পছন্দ করছিনা ডরোথি সেই কারণে সে তত ঠিক, এই কথা বলে চলে গেল। বসে রইলাম আমি নিঃসঙ্গ ভাবে কারণ এই মুহূর্তে নার্সিংহোমে শুয়ে আছে মার্গারেট ওর শরীর খুব দুর্বল এবং ওকে আমি নিয়ে আসব দিন কয়েক বাদেই। হঠাৎ চা খেতে খেতে বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম, আমার মাথা ঘুরছে এবং আমার মনে হল যে আমার শরীরটা খারাপ। বেশ চনচনে রোদ বাইরে। পাখাটা ফুলস্পীডে চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম এবং ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম একটা ছেলে হয়েছে মার্গারেটের। মার্গারেটের এবং ছেলেটির উভয়েরই দুটো পাখা। মার্গারেট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে দুরের আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে একসময় দেখলাম। আমার কপালে ঘাম জমেছে এবং একসময় আমি চীৎকার করে উঠলাম। হাত উঠলো না যদিও হাত বাড়িয়ে চীৎকার করতে গেলাম এবং ঠিক উঠে বসতে যাব, ডরোথি ভাকল সেই সময়।

ওরকম চীৎকার করছেন কেন মিঃ ব্রাউন, উঠে পড়ুন বেলা হয়েছে।

আমি ধড়ফড় করে উঠে বসাতে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ডরোথি বলে উঠল, বেলা হয়েছে মিঃ ব্রাউন, উঠে পড়ুন, ওরকম চীৎকার করছেন কেন? কোন, অসুস্থবোধ করছেন কি আপনি?

খানিকটা ধাতস্থ হয়ে আমি বললাম, আসলে একটা বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম, কিছু হয়নি কিন্তু আমার।

স্নান করে নিন, লাঞ্চ রেডি, ডরোথি বললো।

কোনোক্ৰমে উঠে বাথরুমে ঢুকে গিয়ে স্নান করাতে নিজেকে বেশ ঝরঝরে লাগল। শেষ করে ফেললাম খাওয়া দাওয়া মিনিট পনেরোর মধ্যেই। সিগারেট ধরালাম বারান্দায় এসে। আমি যখন মানসিকভাবে অস্থির থাকি তখন আমার একটু সিগারেট খাওয়াটা বেড়ে যায়। ধোঁয়াটা ছাড়তে সেটি কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল।

গর্ভে সন্তান এসেছে মার্গারেটের। আমি যে মার্গারেটকে ভালবাসি, তার এখন অন্ধকার জঠরের ভিতর কার ভ্রূণ বড় হচ্ছে!

মার্গারেটের ওখানে বিকালবেলা গিয়ে আমি দেখলাম যে ওর গায়ের উত্তাপ দেখছিল নার্স। খানিকটা সরে দাঁড়ালো আমাকে দেখে মৃদু হেসে। এখন টেম্পারেচার কত, আমিও মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম।

নার্স জবাব দিল থার্মোমিটার দেখতে দেখতে, জ্বর এখন সামান্য আছে।

মার্গারেটের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে, আমি তাকালাম মার্গারেটের মুখের দিকে। আমাকে দেখে তবু ও মৃদু হাসলো। জিজ্ঞেস করলাম ওর কপালে হাত রেখে, কেমন আছো এখন?

ভালো বোধ করছি এখন একটু।

মার্গারেট বালিশ হেলান দিয়ে বসল। ওর পেটে যে বাচ্চা এসেছে, তা ওকে জানান হয়নি এখনো। বলতে নিষেধ করেছি ডাক্তার বা নার্স সবাইকেই। ওর পেটে যে ও কার ভালবাসার ফসলকে বয়ে নিয়ে চলেছে তা এখনও জানে না মার্গারেট। ওকে বাড়িতে গিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা জানাব বলে আমি ঠিক করেছি। ওকে জানানো হয়ত ঠিক হবে না কারণ এখন ও খুবই দুর্বল। ও সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি নষ্ট করে ফেলতে চাই ওর এই অবাঞ্ছিত বাচ্চাটি। পরম স্নেহে মার্গারেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম আমি। ঘুণাক্ষরে যেন ডরোথি ওকে না জানায় যে ওর পেটে বাচ্চা আছে, সে কথা ডরোথিকে বলে দেওয়া হয়েছে। একবারে কিশোরী বালিকার মতো মার্গারেট, যদিও ওর বয়স হয়েছে। ও হয়তো ভাবেইনি যে ও গর্ভবতী হয়েছে। ওর মাথায় আমি হাত বুলাতে লাগলাম অনেকক্ষণ ধরে। ও কাঁধের উপর রেখেছে ওর একটা হাত। বেরিয়ে গেছে নার্স এবং একা রয়েছে মার্গারেট ঘরে। ছিমছাম ঘরটি যদিও খুব বড়ো নয়। একটা ফোটো রয়েছে দেখলাম দেওয়ালে, তাতে বাচ্চা যীশু রয়েছে মাতা মেরীর কোলে। ফোটোটার দিকে তাকিয়ে দেখতে বেরিয়ে এল একটা কথা হঠাৎই কুমারী মাতা মেরী।

মেরীর কি বিয়ে হয়নি? সরলভাবে জিজ্ঞেস করলো মার্গারেট।

আমি বললাম, না।

ওর বাচ্চা হলো কি করে তাহলে?

 আমি বললাম, মার্গারেটের প্রশ্নের জবাবে, যোশেফ ছিল তো মেরীর প্রেমিক হিসাবে।

মার্গারেটকে আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, তোমার তো এখনও বিয়ে হয়নি মিমি, তবু তোমার যদি এখন বাচ্চা হয় তবে তোমার কেমন লাগবে?

মার্গারেট খিল খিল করে হেসে বলল, আমার খুব ভালো লাগবে, আমি ওকে মানুষ করতাম, যদি আমার একটা বাচ্চা হত।

চমকে উঠলাম আমি। সরলভাবে ও কথাগুলি বলল নাকি ও মূর্তিমতী শয়তান। ও জানে কি যে ওর পেটে বাচ্ছা আছে। বুঝতে পারছি না আমি কিছুই। মার্গারেট যদি জেনে শুনে এই সমস্ত কথা বলে তো ওর মতো পাকা অভিনেত্রী তাহলে খুব কমই আছে এটা মনে করব। আমার হাতের উপর হাত রেখে মার্গারেট বললো, কবে নিয়ে যাবে তুমি আমাকে এখান থেকে?

তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই, দু এক দিন অপেক্ষা করো, ভালো হোক তোমার শরীরটা একটু, তারপর তোমাকে নিয়ে যাব।

আমার ভেতরটা রীতিমতো অস্থির তাই আমি বলে উঠলাম স্বাভাবিকভাবেই। নিজেকে সংযত রাখতে আমি চেষ্টা করছি তবুও প্রাণপনে। এটা মার্গারেটের অপরাধ না ভুল সেটাই আমি ভাবছিলাম। আমি কি ওকে ক্ষমা করতে পারব যদি এটা অন্য কারো সন্তান হয় কে জানে। এটা বলা একেবারেই সম্ভব নয় তবে আমার প্রেমিকা যেহেতু মিমি, তাই অনেকদূর এর জন্য এগোতে পারি আমি। আমি ক্ষমা করতে রাজী ওর হাজার অপরাধ হলেও। যদিও এটা সামান্য ভুল। নিশ্চয় পারবো আমি ওকে এর জন্য ক্ষমা করতে। চুমু খেলাম মার্গারেটকে আমি নীচু হয়ে। দু চোখ বুজে রইল ও। হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম ওর চুলে মাথায়। চুপচাপ বেশ খানিকটা সময় কাটাবার পর মনে হল, কোনো এক অচেনা পরিবেশে ঢুকেছি আমি, যেহেতু একটা নিজস্ব গন্ধ আছে নার্সিংহোমের, তাই এটি একটি অদ্ভুত পরিবেশ। আমি কোনোক্রমেই যদিও এই অস্বস্তিকর আবহাওয়া চাই না, তবু সহ্য করতে হয় আমাকে।

ভিক্টর আসবেনা? মার্গারেট বলে উঠল। আমি বললাম, ডরোথি আসার সময় আমাকে বলল যে একটু পরেই ও আসবে। মার্গারেট হেসে বলল, বড় মজার ছেলে এই ভিক্টর, ওর সব কথাবার্তা শুনলে আমার ভীষণ হাসি পায়।

যেমন বল ওর একটা কথা, আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 মার্গারেট জবাব দিল, ফ্রেডির বইটা পড়ে ওর খুব ভালো লেগেছে, তাই ও বলছে যে ও বড় হয়ে ফ্রেডির মত লেখক হবে। মার্গারেট একটু থেমে বলল, ওর সঙ্গে আলাপ হবে কি করে, আমি অবশ্য এ কথা বলেছি, যদি ও এখানে আসে তাহলে আলাপ হয়তো হতে পারে। মার্গারেট আমার চোখের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমাকে ও পরখ করতে চাইছে বলে মনে হলো। আমার কি রকম অবস্থা হয় ফ্রেডির কথা বললে সেটা জানাই যেন ওর উদ্দেশ্য। ফ্রেডির কথা একেবারেই আমি সহ্য করতে পারছি না। একদম যেন আগুন জ্বলছে আমার মাথায়। আমার হাত আস্তে আস্তে উঠে এল মার্গারেটের মাথার উপর থেকে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেও পারলাম না রাখতে। ভেতর থেকে উঠে আসছিল আমার এক ধরণের রফা।

মৃদু হেসে বললাম, তোমার খুব ভাল লাগে না ফ্রেডিকে?

হেসে বলল মার্গারেট, আমার ভালগার কথা আমি বলি নি, ভিক্টরের ভালো লাগে ওকে এই কথাই আমি বলেছি।

আমি চেষ্টা করলাম ওর কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে। যাকে আমি প্রাণপণে ভালবাসি, সে কিনা অন্য পুরুষের চিন্তায় বিভোর হয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে শুধু এক অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব গর্ভে নিয়ে। ওর প্রতিশোধ আমি নেবোই, ছেড়ে আমি দেবো না ওকে। ও অসুস্থ তাই এই মুহূর্তে কিছু বলবনা, ওর সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া আমি করব ও বাড়িতে ফিরে আসলে। ও বললো, আমি খেতে পারছি না, কেন যে আমার শরীর বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এরপর উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, আমি মাকে কাল স্বপ্ন দেখেছি জানো।

হ্যারিয়টকে দেখেছো!

মা, এখনতো উনিই আমার মা, মার্গারেট বললো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্বপ্নে কিরকম দেখলে ওকে?

মার্গারেট বলল, পাগলের মতো হয়ে গেছে মা, পাহাড়ের দিকে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল ধাক্কা মেরে। মা পাগলের মতো হাসছিল আমি পড়তে পড়তে যত চীৎকার করছিলাম। ঘুমটা ভেঙে গেল তারপরই।

আমি বললাম, স্বপ্নটা খুব মজার না, তারপর কি হল?

মার্গারেট জবাব দিল, একটি চিল এসে আমাকে ছোঁ মেরে কোথা থেকে নিয়ে তারপর মিলিয়ে গেল, সেই চিলের মুখটা মানুষের। যখন আমি ওকে তুলে নিয়ে গেলাম তখনই বুঝতে পারলাম, সেই মানুষটা কে।

তখনই আমি বললাম, ফ্রেডি উইলসন কি?

মার্গারেট খিলখিল করে হেসে বললো, না, সেই মানুষটা তুমি।

ওর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ভিক্টর তার মা ডরোথির সঙ্গে ঘরের পর্দা সরিয়ে ঢুকল এবং আমার দিকে তাকিয়ে ডরোথি হেসে তারপর মার্গারেটকে জিজ্ঞেস করলো, মিমি, এখন কেমন লাগছে তোমার?

মার্গারেট মৃদু হেসে বলল, আমার খুব ভাল লাগছে।

আমাকে জিজ্ঞেস করলো ডরোথি, মিঃ ব্রাউন আপনি কখন এসেছেন?

 আমি মৃদু হেসে বললাম, এই কিছুক্ষণ আগে।

মার্গারেটের কাছে এগিয়ে একটি চেয়ারে বসে ভিক্টর বলল, তোমাকে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখব ভাবছি।

ভিক্টর আবার পাগলামি করছো, মার্গারেট একটা ধমক দিয়ে বলল।

ভিক্টর হাসতেই তার মনে পড়ল যে আমি আছি, তাই সে চুপ করে গেল।

আমি বললাম, তোমরা গল্প করো, মার্গারেট আমি যাচ্ছি, সময় হয়ে আসছে, ঘড়িতে দেখলাম। ভিক্টরকে বেরিয়ে আসার আগে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে একবার দেখা করো ভিক্টর।

ভিক্টর জবাব দিল, ঠিক আছে। বেরিয়ে এলাম আমি নার্সিংহোম ছেড়ে। ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার মনের মধ্যে। বাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হল কারণ একটা বারে আকণ্ঠ মদ গিলে ফিরলাম। ফ্রেডির মুখটা মনে পড়তে একটা অশ্রাব্য খিস্তি দিলাম। বিছানার উপর এলিয়ে দিলাম এরপর ক্লান্ত দেহটাকে।

.

২৫.

মার্গারেটের চলাফেরা মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে কারণ এখন ও মোটামুটি সুস্থ। দিন কয়েক বিছানায় শোয়ার পর এখন ও আবার চলাফেরা করছে। ওর পেটটা সামান্য স্ফীত হয়েছে। বারান্দায় বসেছিলাম এবং আমি ভাবলাম যে মার্গারেটকে এবার সবকিছু বলা দরকার। কিছুক্ষণ আগে চা দিয়ে গেছে ডরোথি এবং রীতিমতো আগুন জ্বলছে এখন আমার মাথার মধ্যে। আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না যতক্ষণ না এর ফয়সলা হচ্ছে। আমার মুখোমুখি এসে মার্গারেট বসলো স্নান সেরে। বাদামী রঙের ড্রেসিং গাউন পরনে এবং দারুণ ফর্সা শরীরে সুন্দরী লাগছে ওকে। চোখদুটো ফোলাফোলা, ভালো ঘুমিয়েছে রাতে। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে মুখটা ওর গম্ভীর। টেবিল থেকে টেনে নিয়ে কাগজ পড়তে লাগলাম আমি। আমি চুপচাপ চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ কেটে গেল। কালেই গরমের আভাস এবং রোদ ঝলমল করছে সারা জায়গায়। অনেক দুরে মেঘ জমেছে এবং অদ্ভুত পরিবেশ। শেষ বোঝাপড়া করা আমার দরকার মিমির সঙ্গে। আমি বললাম, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরী কথা আছে মিমি।

খবরের কাগজ থেকে ও চোখ দুটো তুলে তাকাল আমার দিকে। ভুরু দুটো কুঁচকে তাকাল, আমি ওর দিকে তাকাতে ও আমার গম্ভীর চোখ দেখে সম্ভবতঃ একটু ভয় পেয়ে গেলো। কি কথা, মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো ও।

কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে তারপর বললাম, তোমার পেটে বাচ্চা এসেছে মার্গারেট।

মার্গারেট চমকে উঠল, কি বললে!

আমি আবার বললাম, এখন তুমি সন্তানসম্ভবা।

মার্গারেট বলল, আমার পেটে বাচ্চা, টেবিলের ওপর কান্নায় ভেঙে পড়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল ও। আমার ওর গায়ে হাত দিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছিল না। তাই আমি চুপ করে রইলাম, মার্গারেট বিশ্বাসঘাতিনী, আমার প্রেমের মর্যাদা ও রাখেনি। ও বিলিয়ে দিয়েছে ওর নিজের দেহটাকে অন্য এক পুরুষকে। ক্ষমা আমি কেমন করে করবো ওকে। ও মিশে আছে আমার দেহের প্রতিটি অনুপরমানুতে। আমি ওকে ছাড়তে পারব না। ওর সত্তা জড়িয়ে গেছে আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে। ও আমারই প্রেমিকা ও শত অপরাধ করুক না কেন। মার্গারেট মুখে একটা কাঠিন্য নিয়ে শান্ত হলো বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর।

তিনমাস আগে তোমার পেটে বাচ্চা এসেছে, মার্গারেট এবং আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর, নিস্তব্ধতা ভাঙলাম আমি। এবার আমাকে বলল, এ বাচ্চা কার, আমি আরো গভীর এবং কঠিন স্বরে বললাম।

কোনোরকম জবাব না দিয়ে চুপ করে মাথা নীচু করে রইল মার্গারেট। ভেসে আসছিল ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সুর পাশের বাড়ি থেকে। মিমি এ বাচ্চা কার, বলল আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।

মার্গারেট মুখটা কঠিন করে নীচু করে থাকাতে আমি আবার বললাম, এ বাচ্চা কার বলো?

মার্গারেট চমকে বলল, আমি জানি না।

তুমি একটা পাকা অভিনেত্রী, তুমি জানো নিশ্চয়, তুমি আঘাত করেছ আমার বিশ্বাসে, তুমি আমার ভালবাসার মর্যাদা দাওনি বিশ্বাসঘাতিনী, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম পাগলের মত এবাচ্চা কার বলল।

মার্গারেট জবাব দিল একই ভাবে, জানিনা বললাম তো। একটা থাপ্পড় কলাম সজোরে ওর গালে। ওর চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে জলে ভরে গেছে এবং ও সঙ্গে সঙ্গে একটা গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকালো। ঘরের ভিতর ও দৌড়ে চলে যেতে ওর পেছন পেছন আমি ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। ফুলে ফুলে কাঁদছে দেখলাম মার্গারেট, বিছানায় উপুড় হয়ে। আমার মাথা আরো গরম হয়ে উঠল ওর এই কান্নার আওয়াজ শুনে। আমি ওকে বসিয়ে দিলাম চুলের মুঠি ধরে। বললাম দাঁতে দাঁত চেপে, এ বাচ্চা কার তোমাকে বলতে হবে।

মার্গারেট একইভাবে কঠিন স্বরে বলল, আমি জানি না।

 চীৎকার করে বললাম আমি চুলের মুঠিটা শক্ত করে ধরে, বাঃ চমৎকার। তুমি নিজে পেটে তিনমাসের বাচ্চা ধরে আছ আর তুমি জানো না। তোমাকে বলতেই হবে এ বাচ্চা কার। আমি তোমাকে শেষ করে দেব তা না হলে।

মার্গারেট এখন আর কাঁদছে না, এখন ওর জেদী ভাবটা ক্রমশঃ বাড়ছে। রীতিমতো কঠিন হয়ে উঠছে এখন ওর চোখ মুখ। মার্গারেট জোর দিয়ে বলে উঠল, তুমি তো আমাকে মেরে ফেলতে পারবে না।

কার বাচ্চা, এই বলে আমি আবার ওর চুল ধরে ঝাঁকুনি দিলাম।

জানি না, মার্গারেট বলল।

মার্গারেট মুখ নীচু করে বসে রইল এবং ওর চুল ছেড়ে দিলাম আমি। আমি বললাম চেয়ারে বসে, আমি জানি, আমি যদি বলি।

আমার দিকে মার্গারেট তাকালো খানিকটা অবাক হয়ে। তারপরই গম্ভীর হয়ে গেল ও। মার্গারেটের দিকে আমি তাকালাম এবং আমি কেননা ব্যাপারটা ভাবতে পারছি না ওকে শেষ করে দিই বা আমি নিজে আত্মঘাতী হই এটাই আমার মনে হল কারণ আমার মাথায় এখন আগুন জ্বলছিল। আমি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলাম যতটা পারা যায়, চুপচাপ একই ভাবে বসে রইল মার্গারেট। তারপর বেশ খানিকটা সময় কেটে যাবার পর আমি বললাম, আমি জানি এ বাচ্চা কার মার্গারেট, আমি বোঝাপড়া করব তার সঙ্গে পড়ে। আমি তোমাকে ভালবাসি মিমি। আমি ভাবিনি যে শেষপর্যন্ত তোমার কাছ থেকে আমি এতটা আঘাত পাব।

মার্গারেট চুপচাপ একইভাবে বসে রইলো এবং আমিও থেমে গেলাম। মার্গারেট আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছিল বলে আমার মনে হচ্ছিল। ওর চোখে একটা প্রচণ্ড জেদী ভাব দেখলাম আমি। আমি এর আগে দেখিনি ওর মুখে এই ধরনের কাঠিন্য। আমার সেই ছোট্ট সরল প্রিয়তমা মিমি আমার কাছ থেকে ক্রমশঃ অপরিচিত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। চুপচাপ মার্গারেট খানিকক্ষণ বসে রইল এবং তারপর আমি বললাম, শোনো মিমি, তুমি না বললেও আমি জানি এ বাচ্চা কার, পরে তার সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করব। আমি তোমাকে ভালবাসি মিমি, তোমার কাছ থেকে যে এরকম আঘাত আসবে তা আমি ভাবিনি মিমি।

মার্গারেট চুপচাপ একইভাবে বসে রইলো এবং আমিও থেমে গেলাম। মার্গারেট আমার কাছ থেকে অনেকদূরে সরে যাচ্ছিল বলে আমার মনে হচ্ছিল। ওর চোখে একটা প্রচণ্ড জেদী ভাব দেখলাম আমি। আমি এর আগে ওর মুখে এই ধরনের কাঠিন্য দেখিনি। আমার সেই ছোট্ট সরল প্রিয়তমা মিমি আমার কাছ থেকে ক্রমশঃ অপরিচিত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। একবারেই আমি জানিনা এই মার্গারেটকে। আমার নেই ওর সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয়। পোষাক এলোমেলো ভাবে মার্গারেট বসে আছে গম্ভীর হয়ে এবং দেখা যাচ্ছে ওর বুকের অনেকটাই। আমার চোখের সামনে সে বসে আছে নিরেট পাথরের মূর্তির মত। আমি বারান্দায় চলে এলাম ঘর থেকে বেরিয়ে। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া চলছে যে আমার সেসব কোনোদিকেই নজর নেই। আমি আবার ঘরে ঢুকলাম কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়ে। এবং তখন ও একভাবে বসে আছে দেখলাম। আমি পড়তে পারলাম না ওর দুচোখের ভাষা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভেতর ভেতর ও তীব্রভাবে অনমনীয় হয়ে উঠেছে। আমার মনে হল যে এই মুহূর্তে আমার একটু বাইরে যাওয়া দরকার এবং সেই কারণেই আমি পোষাক পরলাম। আমার এখন মুক্তির দরকার, আমি বেরিয়ে এলাম দ্রুত পায়ে ঘর থেকে এবং হাঁটতে লাগলাম রাস্তার উপর দিয়ে। ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার এই মুহূর্তে। ভেতর ভেতর একটি অস্থিরতা বোধ করছি বলে ভালো লাগছে না কিছুই। এমনকি নিজেকেও না।

এর আগে কখনো আসেনি আমার নিজের ওপর এত বিতৃষ্ণা। বারের একটি কোণের টেবিলে সোজা এসে বসলাম। এর আগেও আমি এখানে এসেছি বেয়ারা আমাকে চিনতে পেরেছে। বেয়ারা আমার কাছে মৃদু হেসে দাঁড়াতেই আমি হুইস্কির অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে টেবিলের ওপর এক গ্লাস হুইস্কি বেয়ারা রেখে গেল। এলোমেলো দেখাচ্ছিল বলে আমাকে বারের ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলে আপনার শরীর কি খারাপ স্যার?

আমার কিছুই হয়নি, আমি ঠিক আছি। মৃদু হেসে জবাব দিলাম আমি হাত নেড়ে।

আমার সামনে থেকে কিছু না বলে চলে গেল ম্যানেজার ভদ্রলোক। আমি জানি না ঘণ্টা দুয়েক কোথা দিয়ে চলে গেল। ঘোড়ার গাড়ি করলাম শেষ পর্যন্ত বার থেকে বেরিয়ে। এখন কোথায় যাওয়া যেতে পারে কারণ একেবারেই যেতে ইচ্ছা করছে না বাড়ি। হাল্কা লাগছে পা দুটো তাই জড়ানো গলায় কোচোয়ানকে বললাম, পার্কে যেতে চাই আমি। সে, দু–একবার বোঝাতে শেষ পর্যন্ত বুঝল। পার্কে গিয়ে দেখলাম জোড়ায় জোড়ায় সব নারী পুরুষ বসে আছে। একটি জলাশয়ের সামনে বসে আছি, যাতে ঢেউ উঠছে মৃদু। জলাশয়ের পাশের বেঞ্চিতে একভাবে খানিকক্ষণ বসার পর আমার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ল। ও কিরকম উচ্ছল স্বভাবের ছিল যখন আমার সঙ্গে মার্গারেটের প্রথম দেখা হয়েছিল। এখন সে রুক্ষ এবং জেদী, ওর মধ্যে উচ্ছলতার কোনো অবশিষ্ট নেই তাই রীতিমতো কঠিন ওর মনের তল পাওয়া। একটু একটু করে মার্গারেট দূরে সরে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে। আমি একভাবে বসে রইলাম সেই জলের মৃদু ঢেউ-এর দিকে তাকিয়ে। ক্রমশঃ শেষ হয়ে আসছে দুপুর। এখানে প্রেম প্রত্যাশী নারী। পুরুষের ভিড় বেড়ে যাবে যতই রোদ কমে আসবে। একসময় ফাঁকা পরিবেশে এক মহিলা যা পরনে উগ্র ধরনের পোষাক সে এসে বসলো। ও বসলো দূরত্ব বজায় রেখেই। ওকে বোঝা যাচ্ছি। বেশ্যা হিসাবে; কারণ আমার ভালো লাগছিল না ওর চাউনিটা। একটু গম্ভীর হয়ে আমি ও দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি যাও, এখন কোনো আগ্রহ নেই আমার।

মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো বসে মহিলাটি। এই দুপুরে খদ্দের ধরতে বেরিয়েছ, তোমার বি টাকার দরকার খুব? আমি বলে উঠলাম অসহিষ্ণুভাবে।

 মহিলাটি রুক্ষ স্বরে বলল, আমি কি এমনি বেরোই টাকার দরকার না হলে। উগ্র পেন্ট কর মুখ, তাকিয়ে দেখলাম। তাতেও বয়সের প চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। একরাশ কালো অন্ধকা চোখের নীচে। বাদামী রঙের স্কার্ট পরনে এবং লালচে চুল। দুটি বুক বাঁধা আঁটোসাটো করে এব ভীষণ উঁচু হয়ে আছে স্কার্টের উপর দিয়ে। রঙ বাদামী, ফর্সা বা কালো নয়।

তোমার কত টাকার দরকার, আমি বললাম জড়ানো কণ্ঠে।

মহিলাটি ঠোঁট উল্টে ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, এমনি কি দেবে নাকি তুমি।

পকেট থেকে পার্স নিয়ে আমি পঞ্চাশটা টাকা বের করলাম এবং এগিয়ে ধরে বললাম, তুটি এখান থেকে চলে যাও এটা নিয়ে।

তীব্রভাবে রেগে মহিলাটি উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখের সামনে খানিকটা এগিয়ে এসে তী শ্লেষের সঙ্গে মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল, আমায় টাকার লোভ দেখাচ্ছ বদমাইশ, আমি ভিখারী আমার ফ্ল্যাটে ফাইফরমাশ খাটছে তোমার মতো লোক। দুহাতে স্কার্টটা উঁচু করে তুলে বলল শুয়োর কোথাকার, আমি আমার দেহকে খাটিয়ে রোজগার করি।

মহিলাটি এই কথা বলে দ্রুত পায়ে গট গটিয়ে চলে গেল। আমার কানে ভেসে এল এরপর শিসের শব্দ এবং মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বসে রইলাম হতভম্ব হয়ে। 

বাড়িতে ফিরে এলাম সন্ধ্যে নামার আগে এবং উঁকি মারলাম এসেই ড্রয়িং রুমে। দেখলাম

ড্রয়িংরুমের দরজা ভেজানো এবং সেখানে মার্গারেট এবং ভিক্টর অতি ঘনিষ্ঠ ভাবে নীচু স্বরে কথাবার্তা বলছে। দুজনেই সামান্য চমকে উঠল আমাকে দেখে এবং মার্গারেটকে গম্ভীর স্বরে আমি বললাম, এক্ষুনি আমার ঘরে এস।

আমি যে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ এবং এলোমেলো সেটা ভিক্টরের নজর এড়ায়নি এবং সেই কারণেই সে আমার দিকে তাকিয়েছিল। ভিক্টরের দিকে আমি তাকিয়ে বললাম, আমার এখন একটু দরকার আছে ভিক্টর, তুমি বাড়ি যাও।

ভিক্টর আগে এরকম অবস্থায় আমাকে দেখেনি কখনও তাই ওর পক্ষে ঘাবড়ে যাওয়াটা বিচিত্র নয়। দরজার দিকে ও উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো আমার কথা শোনামাত্রই। আমি ওকে বললাম দরজার সামনে আসতেই, আমার সঙ্গে কাল একবার তুমি দেখা করবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঘাড় নাড়িয়ে ভিক্টর এবং আমি ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ কিছুক্ষণ। আমি ওপরে আছি, এসো তাড়াতাড়ি, আমি মার্গারেটকে বললাম।

মার্গারেট মুখ নীচু অবস্থাতেই বলল, যাচ্ছি।

আমার. নেশা অনেকটা কেটে গেলেও একেবারে যায়নি, সেই কারণে আমার পা টলটল করছিল এবং তাই আমি ওপরে চলে এলাম। চোখ দুটো বুজে ঘরে গিয়ে দেহটাকে এলিয়ে দিলাম বিছানার উপরে। চোখ খুলে হঠাৎ দেখলাম ডরোথি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আমি তাকে আসতে বললাম ভেতরে এক ডরোথি ঢুকে একটা চেয়ারে বসলো। আপনার কি শরীর খারাপ সে বলল।

আমি বললাম মৃদু হেসে, আমি লাঞ্চ খাইনি যদিও অবশ্য ডিনারও করবো না। কিন্তু আমার শরীর খারাপ নয়।

ডরোথি কি বলবে ভেবে না পেয়ে একটু অবাক হলো। আমি চোখ দুটো বুজে টান টান হয়ে শুয়ে রইলাম এবং ঘাড় নাড়িয়ে খানিকক্ষণ বসে বেরিয়ে গেল ও। পায়ের আওয়াজে চোখ খুলে দেখলাম যে মার্গারেট দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর চেহারা একেবারে অন্য রকম হয়ে গেছে, কোনোরকম উজ্জ্বলতা অবশিষ্ট নেই এবং দু–চোখের কোণে কালি এবং পেটটা সামান্য উঁচু। চোখ দুটো রুক্ষ

কি ব্যাপার, আমার সামনে চেয়ারে বসে ভুরু কুঁচকে ও বলল।

ওর অনেক বয়েস হয়েছে বলে এই মুহূর্তে আমার মনে হল। ওর যেন কোনো প্রেম ভালবাসার অবশিষ্ট নেই আমার উপরে। ওকে পেয়ে বসেছে কাঠিন্য। তাই আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি খুবই দুঃখিত মিমি তোমার গায়ে হাত তোলার জন্য। একটু থামলাম কিন্তু কোনো জবাব দিল না মার্গারেট। তুমি ভিক্টরকে কি বলছিলে, আমি বললাম।

তোমার কোনো অধিকার নেই তা জানার, মার্গারেট চোখ দুটো কঠিন করে বলল।

আমি যদিও আহত হলাম কিন্তু বললাম স্বাভাবিক ভাবে, আমার কোনো অধিকার নেই তা জানার এই কথা বলছ কেন?

আমি তোমার বিবাহিতা স্ত্রী নই এবং তুমি আমার মাকে মিথ্যা কথা বলে আমাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছ।

আমি বললাম, তুমি প্রতিবাদ করনি তো?

 মার্গারেট বলল, আমি তোমাকে তখন বিশ্বাস করতাম তাই।

মার্গারেটকে আমি আর্তস্বরে বললাম, কেন ভালবাসতে না?

মার্গারেট আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নীচু করে বলল, আমি তা বলতে পারবো না তবে এখন আর বাসি না।

আমি ঢোক গিললাম এবং একটা গরম রক্তের স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। আমার মাথা গরম হয়ে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, আমি তোমাকে ভালবাসি মার্গারেট, তাই আমি তোমাকে ছেড়ে একমুহূর্তও থাকতে পারবো না, আমি অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছি তোমার জন্য। একটানা কথাগুলো বলে আমি থামলাম কিছুক্ষণের জন্য। তোমার বাচ্চাকে নষ্ট করতে হবে মার্গারেট।

মার্গারেট আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল, না।

আমি বললাম, কেন তুমি করবে না, কেন?

না, বাচ্চা আমি নষ্ট করবো না।

এই অবৈধ সন্তান তুমি পেটে ধরবে। আমি অবাক হয়ে বললাম।

সন্তান অবৈধ বলে আমি মনে করি না।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, এতোদূর এগিয়ে গেছ তুমি। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে ওর মাথাটা তুলে ধরে বললাম, কি বলছো ভেবে দেখ তুমি মার্গারেট।

স্থির ভাবে বলল মার্গারেট, এ সন্তান আমার, আমি তো বারবার বলছি।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওকে ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় গেলাম ঘর ছেড়ে। আমার নিজেকে কোনোদিন এতোখানি নিঃস্ব মনে হয়নি। দেখলাম অন্ধকার ক্রমশঃ ঘন হয়ে আসছে বাইরে।

.

২৬.

সকাল থেকে মার্গারেটকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিছানায় ঘুম থেকে উঠে ওকে দেখতে না পেয়ে ভেবেছিলাম বাথরুমে। তাই সেখানে গেলাম কিন্তু সেখানেও না পেয়ে আমি তোলপাড় করে ফেললাম সারা জায়গা। ডরোথিকে জিজ্ঞেস করলেও ও কিছুই বলতে পারলো না। ডরোথিকে ভিক্টর-এর কথা জিজ্ঞেস করতে ও জানালো যে, ভিক্টরের ফিরতে দেরী হবে কারণ ও কলেজে গেছে। কোথায় যেতে পারে মার্গারেট। আমি ভাবতে পারিনি ঘুণাক্ষরেও যে শেষ পর্যন্ত ও পালিয়ে যাবে। আমার মাথায় কিছুই আসছিল না, তাই মার্গারেটকে কোথায় পাওয়া যাবে এই ভেবে বিভিন্ন পার্ক এবং রাস্তাঘাট এলোমলোভাবে তল্লাশি করলাম। কিন্তু পেলাম না কোথাও। সব কিছু খুঁজলাম ঘরের মধ্যে তোলপাড় করে, যেমনকার পোষাক তেমনই আছে তার। মানে সেটা পরেই ও বেরিয়ে গেছে যেটা পরে ছিল। মেঝেতে হঠাৎ একটা ফোটো ছিটকে পড়তে দেখি ফ্রেডির ফোটো। ফ্রেডি হাসছে চশমার ভিতর দিয়ে এবং অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে ওকে। কুচি কুচি করে ছবিটা ছিঁড়ে আমি সেটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বললাম, বিশ্বাসঘাতক, শুয়োরের বাচ্চা। রাস্তায় উড়ে পড়তে লাগলো টুকরো টুকরো কাগজগুলো। দুহাত দিয়ে নিজের চুলগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে অসহায় আক্রোশে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলাম। সজোরে একটা লাথি মারলাম মার্গারেটের বাক্সটা পায়ে লাগতে। শেষ পর্যন্ত চেয়ারে বসে ক্লান্ত হয়ে ভাবতে লাগলাম, আমার প্রিয়তমা কোথায় গেল? আমার নিজেকে অস্থির লাগছে প্রচণ্ড কারণ প্রতিটি অণুপরমাণুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে মার্গারেট। ডরোথি আমাকে দেখে কিরকম যেন ভয় পেয়ে গেল আমার জন্য চা নিয়ে এসে। ও চলে যাচ্ছিল চায়ের কাপটা রেখে। আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম, তোমরা নিশ্চয় জানো ডরোথি মিমি কোথায়, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তোমরা।

ও কাতরকণ্ঠে বললো, আমি কিছুই জানি না মিঃ ব্রাউন, আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন।

সব জানো আলবাৎ জানো বেইমান।

ডরোথিকে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে এসে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, ও ভয়ে আঁতকে বলল, ছেড়ে দিন আমাকে, ছেড়ে দিন।

আমি সজোরে থাপ্পড় মারলাম কারণ আমার মাথা দিয়ে তখন আগুন ছুটছিল, বলল মার্গারেট কোথায়, আমি বললাম।

আমি জানি না বিশ্বাস করুন।

ডরোথি কেঁদে উঠল এবং আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটানে ডরেথির স্কার্টটা খুলে দিলাম। তারপর একটু একটু করে নিংড়ে নিতে লাগলাম ওর অসুন্দর এবং শিথিল শরীরটাকে। ও মাঝে মাঝে আর্তনাদ করছিল, আমি ওকে বললাম, সব যখন শেষ হয়ে গেল, এখন যাও। তোমার পরিণাম খুব খারাপ হবে বাইরে যদি প্রকাশ কর। খুন করে ফেলব তোমাকে এবং ভিক্টরকে আমি ছাড়বো না।

আমি খিল দিয়ে দিলাম ও টলমল করতে করতে বাইরে চলে যেতেই।

একইভাবে কেটেছে আমার দিন সাতেক। ডরোথি এবং ভিক্টরকে সেই থেকে আর দেখিনি। খুঁজে বেড়িয়েছি বিভিন্ন জায়গা তোলপাড় করে ওকে পথে–ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, পার্কে খুঁজে বেরিয়েছি। মার্গারেট হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তাই ওকে কোথাও পাওয়া যায়নি।

একেবারেই চেনে না মার্গারেট কলকাতার রাস্তাঘাট। মায়ের কাছে ও বোম্বেতে ফিরে যায়নি তো, হঠাৎ একবার আমার মনে হল। ও অবশ্য টাকাপয়সা পাবে কোথায়, তাই আমার মাথায় কোনো ব্যাপারটাই ঢুকছে না ঠিক মতো।

 ডরোথির ওখানে আমার আর যেতে ইচ্ছে করছে না বলে এখন আমাকে হোটেলে খেতে হচ্ছে কারণ খাওয়াটা আমার ঠিক হবে না।

আমার ক্ষমতা নেই মার্গারেটের নিরুদ্দেশের ব্যাপারটা থানায় জানানোর। অগত্যা উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেসে চলে যেতে লাগলাম হালভাঙা নৌকার মতো। সারাদিন ঘুরি কেবলমাত্র রাতে ফিরি। সকালে সেই যে স্নান সেরে বেরোই, গভীর রাতে ঢুকি পা দুটো টলমল করে নেশায়। আমাকে তলার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যায় কোচোয়ান যার গাড়ি চড়ে আমি ফিরি। ভয়ে আঁতকে উঠি মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে। আমার নিষিদ্ধ পল্লীতে আসা যাওয়া বেড়ে গেছে। একদিন রাতে একটি বিশ্রী স্বপ্নে দেখলাম যে খাদের কিনারায় আমাকে চুলের মুঠি ধরে বসিয়েছে মিসেস হ্যারিয়েট মুর। আমার তলপেটে একটা ছুরি বসানো এবং পা দুটো ছটফট করছে। দুটো কিম্ভুত কিমাকার লোক হারিয়েটের পাশে। প্রথমে দোলাতে আরম্ভ করল চুলের মুঠি ধরে হ্যারিয়েট এবং তারপরে অতল খাদের নীচে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল কিম্ভুত কিমাকার লোকদুটো।

আমার সারা কপাল ঘামে ভিজে গেছে। আমি চীৎকার করে উঠেছি। পাখা ফুল স্পীডে বাড়ালাম এবং আলো জ্বালোম। আমি ঘামছি। হাঁফাতে লাগলাম উঠে বসে খানিকক্ষণ। কয়েক গ্লাস জল খেলাম ঢক ঢক করে। দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেলেও আরেকটা খেলাম। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম আলো নিভিয়ে এবং তারপর জানিনা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি। একবার মনে হল যেন ভোর হয়ে গেছে।

ঘড়ি দেখলাম বেশ বেলা হয়েছে। ঘুম ভেঙেছে দরজার ঠক্ঠক্ শব্দে। দরজা খুলে যাকে দেখলাম আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম তাকে দেখে। হাতে ব্যটন নিয়ে বিরাট চেহারার একজন পুলিশ অফিসার। আমার পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে একটি ঠাণ্ডা রক্তের স্রোত বয়ে গেল ওর গোঁফজোড়ার দিকে তাকিয়ে। দুজন ভয়ঙ্কর চেহারার কনস্টেবল পাশে। একটা অদ্ভুত ধরনের হাসি হেসে অফিসার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ পিটার ব্রাউন আপনি না?

আমি ঘাড় নাড়লাম, মৃদু হেসে অফিসার বললেন, আমি খুবই দুঃখিত আপনাকে বিব্রত করার জন্য, একবার থানায় যেতে হবে আপনাকে আমার সঙ্গে।

গম্ভীর মুখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার অপরাধ কি? আমার কণ্ঠস্বরে কোনরকম তীব্রতা ছিল না যেহেতু আমি জানি যে আমি কতবড়ো অপরাধী।

পুলিশ অফিসার বললেন, আমি কিছু জানি না, আপনি সেই সব জানবেন থানায় গেলেই।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি ধীরে ধীরে এখানকার রোদ গায়ে মেখে। বাড়ির দরজায় তালা দিলাম, দেখলাম এক প্রতিবেশী দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন বাড়ির মালিককে চাবিটা দিয়ে দেয়, এই কথা তাকে বলে আমার মনে হল যেন এই যাওয়াই শেষ যাওয়া আমার। পুলিশ ভ্যানের ভিতর আমি ঢুকে বসতে থানার দিকে তা এগিয়ে চলল নিঃশব্দে।

.

২৭.

শেষ পর্যন্ত জেল হয়ে গেছে পিটার ব্রাউনের। সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত ওকে দশ বছরের জন্য। পিটার হেরে গেল প্রতিবারই জীবনের বাস্তব খেলায় ভুল চাল দিয়ে। পিটারের ঘুমন্ত যৌবনকে জাগিয়ে দিয়েছিল জীবনের প্রারম্ভে যে কিশোরী এসেছিল। কিন্তু তার আশ মেটেনি এবং শেষ পর্যন্ত আশ মিটেছিল অনেকদিন পর স্ত্রীর সান্নিধ্যে। সে স্ত্রীকেও বেঁধে রাখতে পারেনি কারণ দেহ সর্বস্ব নারী পালিয়েছিল অন্য পুরুষের সঙ্গে। প্রেমের সন্ধানে তারপর দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছে পিটার। এমন কথা সত্যি নয় যে তার জীবনে বিভিন্ন নারীর সান্নিধ্য আসেনি। দেহের চাহিদা তার ক্রমশঃ বেড়েছে এবং কিছুতেই তার তৃপ্তি মেটেনি। অষ্টাদশী মানসপ্রিয়াকে সে খুঁজে পেয়েছে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। সেই কিশোরী প্রেমিকার কথা তাকে দেখামাত্রই মনে পড়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত এক অনুভূতিমাখা স্বাদের সন্ধান দিয়েছিল সে তাকে প্রথম। প্রেমের ক্ষেত্রে কিন্তু আবার ভুল চাল দিল হার্টস্পেশালিস্টপিটার। মার্গারেটের দিকে তাকে টেনে নিয়ে গেল তার আকণ্ঠ দেহ পিপাসা। মার্গারেট তন্বী যৌবনা একটি স্বভাব চঞ্চল বালিকা। পবিত্রতা চোখের চাহনিতে এবং কুসুমের মত দেহ তার পাগল করে তুলেছিল পিটারকে। সে সবকিছু ভুলে মেতে উঠেছিল দৈহিক খেলায়। দৈহিক উন্মাদনার বীজ লুকিয়েছিল পিটারের পূর্বপুরুষের রক্তে। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন পিটারের দাদু একের পর এক নারী সম্ভোগে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে। প্রচুর সম্পত্তি ছিল তার। সেই উন্মাদনা সংক্রামিত হয়েছিল পিটারের বাবার দেহেও। শুধু বোনকে পাবার আশাতেই ভদ্রলোক প্রথম স্ত্রীকে খুনই করেছিলেন একরকম। বোনকে পাননি তিনি। পিটার তো তারই সন্তান। ভারতীয় ছিলেন পিটারের মা। এবং উজ্জ্বল স্বভাবের ছিলেন পিটারের বাবা। তার ছিল একটিমাত্র হোটেল লন্ডনে, সবকিছু খুইয়ে এইটিই ছিল তার সম্বল। ভারতে এসে বোম্বেতে একটি ছোটোখাটো হোটেল খুলেছিলেন ভাগ্য ফেরাবার আশায়।

ততদিনে পিটার শেষ করেছে ডাক্তারী পড়াশুনো। পিটার ভদ্রলোক হয়েছে ইতিমধ্যে রীতিমত। খুবই বিরল এমন অমায়িক স্বভাবের মানুষ। মারাত্মক খেলায় শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ল পিটার। অস্বীকার করা যায় না রক্তের প্রভাব। ক্রমশঃ মারাত্মক ফাঁদের দিকে পিটারকে নিয়ে চলল পিটারের ভাগ্য। সুদূর বোম্বেতে এক কারাগারে পিটার তারই চরম পরিণতিতে জনৈক মিসেস হ্যারিয়েট মুরের হত্যার জন্য দায়ী সে–এটাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ।

একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল মার্গারেটের একমাত্র অভিভাবক হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করার আগে। হ্যারিয়েট এবং মার্গারেট এই দুজনকে ও প্রতারণা করেছে একই সঙ্গে। ওদের বাড়িতে ভাড়া থাকতো পিটার এবং মেলামেশার সূত্রে হ্যারিয়েটর খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। ও ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে পিটার ওর মৃতা বোনের মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। ওর চোখে ধরা পড়েছিল অবশ্য মার্গারেটের পরিবর্তন।

ব্যাপারটাকে তা সত্ত্বেও ও গুরুত্ব দেয়নি। তার ফলে এই ব্যাপারটা ওর পক্ষে কাল হয়েছিল। ও মার্গারেটকে নিয়ে পালিয়েছিল এক পরিচালক বন্ধুর ফিল্মে নামিয়ে দেবার নাম করে। এই মিথ্যাচার মার্গারেটও বুঝতে পারেনি প্রথমটা। হ্যারিয়েটের সন্দেহ হয়েছিল যখন মাসখানেক পরেও ওরা ফিরলো না এবং ভীষণ আঘাত পেয়েছিল তখন ও। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজিও করলো। ওকে বেশ কয়েকমাস হাসপাতালে কাটাতে হলো তারপরই। নিজের মেয়ে যদিও নয় তবু মার্গারেটকে ও ভালবাসতো নিজের মেয়ের মত। হ্যারিয়েট সেরে ওঠার পর একদিন বাড়িতে ফিরে খুঁজে পেল হঠাৎই মার্গারেটের সেই ডায়েরী। হুবহু লেখা ছিল এতে মার্গারেটের প্রতিটি ঘটনা। সহবাসের কথাও বাদ যায়নি এতে পিটারের সঙ্গে। সেই সন্দেহ এবার সত্যি প্রমাণিত হল যা এতদিন নিছক সন্দেহ ছিল। এরপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল হ্যারিয়েট। চরম পথ বেছে নিল শেষ পর্যন্ত। ঘুমের ট্যাবলেট একটার পর একটা খেয়েছিল রাতে চিঠি লেখার পর। ওর সেই ঘুম আর ভাঙেনি চিরদিনের মত।

 প্রথমটা অস্বস্তি হত কয়েদির পোষাকে পিটারের। ব্যাপারটা অনেকটা সহ্য হয়েছে মাস তিনেক কাটার পর। পিটার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ভাবে যে হ্যারিয়েট নতুনভাবে বাঁচতে চেয়েছিল ওকে ভালবেসে এবং ওকে অবলম্বন করে, ওর মন বেদনায় ভরে ওঠে এই কথা ভাবতে গিয়ে।

বোম্বে হাইকোর্টে বিচার হয়েছিল পিটারের। মন রীতিমতো বেদনায় ভরে উঠে যখন মনে পড়ে বিচারের দিনগুলোর কথা। ফ্রেডির সঙ্গে মার্গারেটকে কোর্টে দেখেছিল দীর্ঘকাল পরে। দারুণ সুন্দরী লাগছিল মার্গারেটকে। মার্গারেট পরেছিল নীল রঙের নক্সা করা সাদা গাউন, ওকে লাগছিল দারুণ সুন্দরী। ওদের বিয়ে হয়ে গেছে, কারণ এনগেজমেন্ট রিং ও দেখতে পেয়েছে মার্গারেটের হাতে। চেহারা আরো ভাল হয়েছে। পেট ফুলে উঠেছে কারণ আর বেশী দেরী নেই সন্তানের জন্মের। ফ্রেডিই এই সমস্ত ব্যাপারের মূলে দায়ী যে তা বুঝতে পেরেছিল পিটার। আসামীর কাঠগড়া থেকে দেখেছিল ফ্রেডিকে। চোখে চশমা পরা ছিল ওর। বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য শান্ত ধীর স্থির চোখে। পিটারের কোনো ঈর্ষা হয়নি বরং দুঃখবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল ওর মন। পিটার ওর দিকে একবারই তাকিয়েছিল যখন কাঠগড়ায় ডাকা হয়েছিল মার্গারেটকে সাক্ষী হিসাবে। মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ভাব এবং লাবণ্য আরো বেড়েছে। তবুও কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতা। মার্গারেট চোখ নামিয়ে নিয়েছিল একবার পিটারের দিকে তাকিয়ে। পিটার এই প্রথম দেখলো মার্গারেটকে, ওর চলে যাবার পর। যে প্রিয়তমাকে ও একান্ত আপন করে পেতে চেয়েছিল সেই আজ তার বন্ধু অন্য পুরুষের সঙ্গে। জেল থেকে বেরিয়ে ওর সঙ্গে ও শেষ বোঝাপড়া করবে কারণ ফ্রেডি ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

পিটারের এখন কিছুই করার নেই। অনন্ত সময় ওর জেলের ভিতর। নিয়মিত খবরের কাগজ এবং কিছু বই ও একটি বাইবেল পেয়েছে ও জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। পিটার মনে মনে প্রায়শ্চিত্ত করে, বাইরের খোলা আকাশ যখন রোদে ঝলমল করে। কাশ্মীর থেকে লেখা একটি চিঠি পিটার পেলো কারাবাসের ঠিক মাসখানেকের মাথায় একদিন বিকালে। মার্গারেট লিখেছে জেলের ঠিকানাতেই। পিটার ভাবতেই পারেনি যে মার্গারেট ওকে চিঠি লিখতে পারে। পিটার পড়ল চিঠিখানা খুলে।

প্রিয় পিটার,

তুমি ভালো আছো আশা করি, তোমার মঙ্গল করবেন ঈশ্বর। ফ্রেডিকে আমি ভালবাসি তাই আমি ফ্রেডির সঙ্গে পালিয়ে এসেছি। এই ভালবাসা সত্যিকারের ভালবাসা। আমি তোমার খারাপ ব্যবহারের পরও সহ্য করেছি সবকিছু কারণ আমার গর্ভের সন্তান ওর। সন্তান নষ্ট করিনি আমি কারণ ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল বরাবরই। চিঠি লিখতাম আমরা দুজনে দুজনকে,  তাই কিছু গোপন করিনি ওর কাছে। ওর সামনেই তাই চিঠি লিখছি। ভিক্টরের ঠিকানায় চিঠি দিত ফ্রেডি। দুজনে দেখাও করেছি আমরা কলকাতায় মাঝে মাঝে। এসব তোমাকে লুকিয়ে করতে হয়েছে কারণ তুমি এর কিছুই মেনে নিতে পারতে না। কোনোদিনই তুমি আমার মনকে বোঝনি, বরাবর দেহ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছ। ফ্রেডি আমাকে বিয়ে করেছে ও স্বীকৃতি দিয়েছে আমার সন্তানকে। ওরই সন্তান। ও প্রথমে চায়নি আমিই চেয়েছিলাম, ও ওর বিবেকের অনুশোচনার কথা জানিয়েছে এই ঘটনার পর যতবারই ও চিঠি লিখেছে।

ভারতে আমি জন্মেছি যেহেতু তাই তুমি আমায় অনায়াসে ভারতীয় বলতে পারো। আমি বিশ্বাসী এখানকার দর্শনে। এখানকার মেয়েরা সারাজীবন স্বামী আর ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে কাটিয়ে দিতে চায়। এদের একমাত্র কাম্য নয় বিভিন্ন পুরুষের কাছে দেহসুখ পাওয়া। আমি যেহেতু নিজেকে ভারতীয় নারী বলেই ভাবি তাই আমিও এর ব্যতিক্রম নই। ফ্রেডিকে আমি তা বলাতে ও মেনে নিয়েছে। ভারতীয় দর্শনে ও ভীষণ অনুরাগী এবং অনেক কিছু শিখিয়েছে ও আমাকে। এখন আমি একেবারেই তা নই আগে যা ছিলাম। আমি ভাবিনি যে আমি এত ধীর স্থির হয়ে যাব, যে আগে এত চঞ্চল স্বভাবের ছিল।

কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি আমরা দুজন। এ জায়গাটাকে যে পৃথিবীর মধ্যে স্বর্গ বলা যায় তা যে কতটা সত্যি তা আমি বুঝতে পারছি। ভাবতে পারিনি যে আমাদের হানিমুন এত সুন্দর আর রমনীয় জায়গায় হবে। যত দেখছি নতুন করে বাঁচার সুখ খুঁজে পাচ্ছি। সন্তান হবে আমার আর কয়েক মাস পর, ও যেন ফ্রেডির মত হয় তুমি সেই আশীর্বাদ ওকে কর।

ফ্রেডির কোনো অভিযোগ নেই তোমার উপরে। ও পড়াশোনা করেছে মনোবিজ্ঞান নিয়ে। মানুষ যে রক্তের প্রভাবকে এড়িয়ে যেতে পারে না সেটাই ওর বিশ্বাস। ও ভাগ্যে বিশ্বাসী। বিজ্ঞান শেষ কথা নয় তার বাইরে আরো কিছু আছে। কে জানে আমরা সেখানে আদৌ পৌঁছব কি পৌঁছব না। বিজ্ঞানকে অবশ্য এ সব কথার জন্য অস্বীকার করা যায় না। আমি কিভাবে শিখলাম এসব জবর কথা সেটা হয়তো তুমি ভাবছো। আমি বলতে পারি এই সব শিখেছি ফ্রেডির উৎসাহে। আমি ধন্য যে ফ্রেডি আমাকে গ্রহণ করেছে। আমি এখন খুব সুখী, তোমার মঙ্গল কামনা করি ঈশ্বরের কাছে।
–তোমার মিমি।

 পিটারের দুচোখ ঝাপসা যখন চিঠি শেষ করল। ওর নিজেকে প্রচণ্ড মুক্ত মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে। কোনো বন্ধন নেই। কোনো দুঃখ নেই এই মুহূর্তে পিটারের। সে বাইরের নীল আকাশের দিকে তাকাল গরাদের ফাঁক দিয়ে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, মিমি, আমার মার্গারেট, সুখে থাকো তুমি, সুখী হোক তোমাদের বিবাহিত জীবন।

পাখিদের ঘরে ফেরার পালা তখন বাইরের নীল দিগন্ত জুড়ে।