বাড়িতে ফিরে সারাটা দিন কিরীটী পেসেন্স খেলেই কাটিয়ে দিল একা একা আপন মনে—কেবল মধ্যে দুচার জায়গায় ফোন করেছিল।
সুব্রত আর বাড়িতে ফিরে যায়নি, সে ঐখানেই ছিল। আহারাদির পর কিরীটী যখন তাসের প্যাকেট নিয়ে বসলো, সে একটা উপন্যাস নিয়ে বসেছিল।
বেলাশেষের আলো ইতিমধ্যে একটু একটু করে মুছে এসেছে যেন কখন–বাইরে বোধ হয় মেঘ করেছে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে।
কৃষ্ণা জংলীর হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
চা—কৃষ্ণা প্রথম সুব্রতকে একটা কাপ দিয়ে দ্বিতীয় কাপটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিল। কিরীটী হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, আচ্ছা কৃষ্ণা, তোমার কি মনে হয়–মিত্রানী জানতে পারেনি কখনো যে কাজল বোসও সুহাসকে ভালবাসত?
আমার মনে হয়-কৃষ্ণা বললে, কাজল বোস যেমন জানত মিত্রানী সুহাসবাবুকে ভালবাসে, তেমনি মিত্রানীও বুঝতে পেরেছিল তারই মত কাজলও সুহাসবাবুকে ভালবাসত–
তাই যদি হতো–তার ডাইরীর মধ্যে কোথাও সেই সম্পর্কে এতটুকু ইঙ্গিতমাত্রও নেই কেন?
তার কারণ হয়ত–
কি?
মিত্রানীর নিজের ভালবাসার উপর এতখানি স্থির বিশ্বাস ছিল যে, সে ওটা চিন্তা করবারও প্রয়োজনবোধ করেনি—অথবা সুহাসবাবুর দিক থেকে তার কোন উদ্বেগের কারণ আছে বলেই মনে করেনি
কিরীটী কি যেন বলতে উদ্যত হয়েছিল জবাবে—কিন্তু বলা হলো না, ঠিক ঐ সময় ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো—কিরীটী রায়—
রায়সাহেব, আমি নাইড়ু, ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস্-এর–
নমস্কার। যা জানতে চেয়েছিলাম জানতে পেরেছেন?
হ্যাঁ—ঐ নামে কোন প্যাসেঞ্জার সেদিনের মর্নিং ফ্লাইটে বা নুন ফ্লাইটে ছিল না। রিজার্ভেশন লিস্টে।
কিছুক্ষণ অতঃপর দুজনের মধ্যে মিনিট পনেরো ধরে টেলিফোনে কথা হলো। সুব্রত লক্ষ্য করে, কিরীটীর চোখে-মুখে যেন একটা আনন্দের আভাস।
থ্যাংকু মিঃ নাইড়ু-থ্যাংকু—বলে কিরীটী টেলিফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
কিরীটী ফিরে এসে সোফায় বসতেই জংলী এসে ঘরে ঢুকল।
বাবু, সেদিন যে ভদ্রমহিলা এসেছিলেন, তিনি এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান—
সুব্রত বললে, নাম বলেনি?
জবাব দিল কিরীটী, যা, এ-ঘরে পাঠিয়ে দে। তারপর সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, কাজল বোস।
সত্যিই কাজল বোস। কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়। কাজল বোস এসে ঘরে ঢুকল।
আসুন মিস বোস—
সেদিন একটা কথা আপনাকে আমি গোপন করে গিয়েছি কিরীটীবাবু কাজল বোস বললে।
বসুন। দাঁড়িয়ে কেন। কিরীটী বললে।
কাজল বোস বললে, আপনি সেদিন আমার চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলে কোনদিনই হয়ত আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুলটা ভাঙতো না। তারপরই একটু থেমে কাজল বললে, আশ্চর্য! আমি এত বছর ধরে বুঝতেই পারিনি যে, ওর সমস্ত মন জুড়ে রয়েছে আর একজন—ছিঃ ছিঃ, আর আমি কিনা হ্যাংলার মত ওর পিছনে পিছনে এতদিন ছুটে বেড়িয়েছি–
কিরীটী শান্ত গলায় বললে, ঐ আঘাতটা আপনার প্রয়োজন ছিল বলেই কালকে ইঙ্গিতটা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম মিস বোস। হ্যাঁ—সত্য যে সুহাসবাবু মিত্রানীকে ভালবাসতেন, কিন্তু সে ভালবাসা জানবেন কোনদিনই তার প্রকাশ পেতো না—
না, না—আপনি জানেন না। ও, এত ছোট–এত নীচ।
না মিস বোস—মানুষ হিসেবে অন্তত আমি তাকে ঐ বিশেষণগুলো দিতে পারছি, না—আপনি জানেন না একটা কথা—ওর দুটো চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। এবং একদিন তার দুচোখে চির অন্ধকার নেমে আসবে–
কি বলছেন আপনি—
তার চশমার পুরো লেন্স দেখেও কি কখনো আপনার কথাটা মনে হয়নি—
না—
হওয়া কিন্তু উচিত ছিল। আমি জানি, কোন্ কথাটা আমাকে আজ বলবার জন্য আপনি ছুটে এসেছেন–
জানেন! বিস্ময়ে তাকাল কাজল বোস কিরীটীর মুখের দিকে।
যার সঙ্গে আপনার ধাক্কা লেগেছিল—সেদিন ধুলো-ঘূর্ণির ঝড়ের মধ্যে—কে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল–
সে সুহাস—এখন আমি বুঝতে পেরেছি সে সুহাস—
না। মিস বোস—তিনি সুহাসবাবু নন। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় কিরীটী প্রতিবাদ জানাল।
হ্যাঁ আমি বলছি—সে সুহাস ছাড়া আর কেউ হতে পারে না—আর কেউ হতেই পারে —তবু বলে কাজল বোস।
না। আমি বলছি শুনুন, তিনি সুহাসবাবু নন মিস বোস।
তবে—তবে সে কে?
আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয়—সে-ই হত্যা করেছিল সেদিন মিত্রানীকে।
কে! কে হত্যা করেছিল সেদিন মিত্রানীকে?
যার সঙ্গে আপনার ধাক্কা লাগবার পর তাকে আপনি দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং যে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল—
কে সে?
পূর্ববং শান্ত গলায় কিরীটী বললে, এইমাত্র বললাম আপনাকে সে-ই মিত্রানীর হত্যাকারী—
তাহলে সে সুহাস নয়?
না। তবে আপনাদের মধ্যেই একজন।
কাজল বোস অতঃপর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো মাথা নীচু করে। তারপর যখন। মুখ তুললো, কাজলের দুচোখে জল টলটল করছে। কাজল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তারপর বললে, আমি তাহলে যাই কিরীটীবাবু—
আসুন—
মাথাটা নীচু করে উপচীয়মান অশ্রুকে যেন রোধ করতে করতে কাজল বোস ক্লান্ত পা দুটো টেনে টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, পুওর গার্ল!
সুব্রত এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, সে এবার বললে, কিরীটী, তাহলে সুহাস মিত্র নয়?
না।
যুক্তি দিয়ে আমি যেটা খাড়া করেছিলাম, তাহলে সেটা দেখছি ভুল। তাহলে কি সেই চোখে চশমা—দাড়িওয়ালা ব্যক্তিটিই–
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে সুব্রতর কথার কোন জবাব না দিয়ে।
কিন্তু একজন ছাড়া সেই ব্যক্তি আর কে হতে পারে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের মিঃ নাইড়ু কার কথা বলছিলেন তোকে ফোনে—প্যাসেঞ্জার লিস্টে কার নাম ছিল না?
সজল চক্রবর্তী।
মানে।
দুর্ঘটনার দিন সকালের ফ্লাইটে তো নয়ইনুন ফ্লাইটেও সজল চক্রবর্তীর নাম কোথাও পাওয়া যায়নি—কাজেই এটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার যে, তিনি আদৌ সেদিন কলকাতা ছেড়ে তার কর্মস্থলে ফিরে যাননি–
তবে ভদ্রলোক পিকনিক পার্টিতে সেদিন ওদের সঙ্গে যোগ দিল না কেন?
সে প্রশ্নের জবাব একমাত্র সজল চক্রবর্তীই দিতে পারে। আসলে তুই সেই বেতের টুপি আর বায়নাকুলার নিয়েই বেশী মাথা ঘামিয়েছিস সুব্রত–
কিন্তু–
ওই বস্তু দুটির কোন মূল্যই যে একেবারে মিত্রানীর হত্যা রহস্যের মধ্যে নেই তা আমি বলছি না–কিন্তু তার চাইতেও মূল্যবান সূত্র দুটি হয়ত তোর মনের মধ্যে ততটা রেখাপাত করেনি—
কোন্ দুটি সূত্রের কথা বলছিস?
এক নম্বর হচ্ছে মিত্রানীর ডাইরীর মধ্যে যে ফোনের সংবাদটি আছে, যেটা সে মনে করেছিল সুহাসের ফোন-সেটা এবং দুনম্বর—যেটা হচ্ছে বর্তমান হত্যা-মামলার প্রধানতম সূত্র—
কি সেটা?
একটা চশমা।
চশমা!
হ্যাঁ চশমা—হ্যাঁ সুহাসবাবুর চশমা—যে চশমাটা তার চোখ থেকে ছিটকে আশেপাশেই অকুস্থানের কোথাও পড়েছিল, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেটা আর পাওয়া যায়নি। এবং ঐ চশমার পিছনের ইতিহাসটা হচ্ছে সুহাসবাবুর ক্ষীণদৃষ্টি—যার অ্যাডভানটেজ বা সুবিধা ব্যাপারটা জানা থাকায় হত্যাকারী পুরোপুরিই নিতে পেরেছিল।
কি রকম?
সুহাসবাবুর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ না থাকলে হত্যাকারী তার রুমালটা অনায়াসেই সরিয়ে পকেটস্থ করতে পারত না ও হত্যার সন্দেহটা পুরোপুরি তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে এ সহজে বোধ হয় পারত না। যাক—কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী সহসা দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, রাত নটা প্রায় বাজে–
মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষা করছিস?
হ্যাঁ–
কার, সুশীলবাবুর?
না। সজল চক্রবর্তীর।