২০. বাক ও জন থর্নটন
জন থর্নটন ছিল স্লেজচালক। স্লেজ চালনাই ছিল তার পেশা। সাধারণত পেশাদার স্লেজচালকদের তাঁবুতে থাকে অনেক কুকুর এবং তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চালনা করার জন্য দুই কি তিনজন অভিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু থর্নটনের তাঁবুতে সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। নিদারুণ শীত তার পা দুটিকে সাময়িকভাবে অসাড় করে দিয়েছিল বলেই কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে ওই অঙ্গ দুটিকে আবার সচল করে নিতে মনস্থ করেছিল সে। তার দুই অংশীদার ডসন থেকে খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে, তাদের জন্যই পূর্বে উল্লিখিত হোয়াইট রিভার নামক নদীর ধারে সে অপেক্ষা করছিল ইতিমধ্যে অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল আমাদের কাহিনির নায়ক বাক!
বাক যখন থর্নটনের জীবনে এল, তখনও একটু খুঁড়িয়ে চলে থর্নটন। তার পায়ের মাংসপেশিতে সাড় এসেছে বটে, কিন্তু এখনও সে আগের শক্তি ফিরে পায়নি। বাক এতদিন যথেষ্ট অনাচার অত্যাচার সহ্য করেছে, তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে থর্নটনের সান্নিধ্যে এসে সর্বপ্রথম বিশ্রামলাভের সুযোগ পেল সে। নদীর ধারে চুপচাপ বসে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল চতুষ্পদ বাক ও দ্বিপদ থর্নটন।
ধীরে ধীরে আবার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পেল বাক। ফ্যাকাশে চামড়া আবার উজ্জ্বল হল, যেখানে হাড় দেখা যাচ্ছিল সেখানে দেখা দিল সাবলীল পেশীর তরঙ্গ।
জন থর্নটনের তাঁবুতে এসে আরও দুটি কুকুরের সঙ্গে পরিচিত হল বাক স্কীট ও নিগ। নিগ হচ্ছে ছোটোখাটো চেহারার আইরিশ সেটার, আর নিগ নামক কুকুরটি ব্লাড হাউন্ড ও ডিয়ার হাউন্ড নামক দুই বিভিন্ন জাতীয় কুকুরের সংমিশ্রণে তৈরি এক অতিকায় জীব। বিপুল দেহ এবং প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হলেও নিগ ছিল খুব শান্তশিষ্ট, বাককে সে সহজেই বন্ধু হিসাবে মেনে নিল। স্কীট ছিল মেয়ে কুকুর, জননীর স্নেহে সে গ্রহণ করল বাককে, তার আহত ক্ষতস্থানগুলিকে সে চেটে চেটে পরিচর্যা করতে লাগল। কয়েকদিনের মধ্যে স্কীট-এর জান্তব চিকিৎসার ফল পাওয়া গেল, সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করল বাক।
বাক অবাক হয়ে দেখল থর্নটন তার কুকুরদের সঙ্গে ছেলেমানুষের মতো ছুটোছুটি করে এবং নিত্য-নতুন খেলা আবিষ্কার করে চমকে দেয় সবাইকে। বিচারক মিলারকেও বাক পছন্দ করত বটে, কিন্তু থর্নটনের স্নেহ-ভালোবাসা তাকে অভিভূত করে ফেলল, এমন তীব্র আবেগ ও আকর্ষণ ইতিপূর্বে কারও জন্যেই অনুভব করেনি বাক, বোধহয় এমন একজন প্রভুর জন্যই এতদিন অপেক্ষা করছিল সে।
অবশেষে থর্নটন যাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তারা এসে উপস্থিত হল- হানস ও পিট, জন থর্নটনের দুই অংশীদার। স্কীট আর নিগ যেভাবে থর্নটনের হাতের তলায় মাথা গলিয়ে আদর পেতে চাইত, ঠিক সেইভাবেইনবাগতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল তারা। তাদের আশা অবশ্য অপূর্ণ থাকেনি। থর্নটনের মতোই কুকুর দুটিকে আদর করত হানস আর পিট। কিন্তু বাক নতুন মানুষদের কাছে ভিড়ল না। সে বুঝেছিল এই মানুষ দুটি তার মনিবের বন্ধু, তাই তাদের সান্নিধ্য সে সহ্য করত– কিন্তু তার সমস্ত অনুরাগ ও ভালোবাসা ছিল থর্নটনের জন্য। সে প্রভর কাছে আদর পেতে চাইত না, থর্নটনের পাশে চুপচাপ বসে তার মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রভুর মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করত। সেই নিমেষহীন দৃষ্টি আকর্ষণে থর্নটন মুখ ফিরিয়ে চাইত, কয়েক মুহূর্তের জন্য তাদের দৃষ্টি বিনিময় ঘটত এবং চোখে চোখে ফুটত পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা…
হ্যাঁ, সুখী হয়েছিল, খুব সুখী হয়েছিল বাক থর্নটনের কাছে এসে, তবু রক্ত-জমানো ঠান্ডায় অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে অগ্নিশিখার চঞ্চল নৃত্যের মধ্যে বাক যেন প্রত্যক্ষ করত তার পূর্বপুরুষদের তাকে যেন আহ্বান করে আদিম অরণ্য। যেখানে ঘুরে বেড়ায় নেকড়ের মতো হিংস্র বুনো কুকুরের দল… বহু যুগের ওপার হতে সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের আদিম অরণ্য যেন তাকে টানতে থাকে অমোঘ আকর্ষণে…
.
২১. বিখ্যাত হল বাক
যে-সময়ের কথা বলছি, সেইসময় উত্তর আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসছিল সোনার সন্ধানে। পার্বত্য নদীর তীরভূমিতে বালির উপর প্রবাহিত জলস্রোত ছড়িয়ে দেয় স্বর্ণরেণু, বালুকামিশ্রিত ওই স্বর্ণরেণু পাত্র বোঝাই করে পরীক্ষার পর খাঁটি নির্ভেজাল সোনার গুঁড়ো অন্বেষণকারীর হস্তগত হয়। যথেষ্ট অর্থ ছিল না বলে তারা ডসন শহরে ফিরে গেল– যদি কোনোরকমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা যায়, তাহলে আবার সোনার সন্ধানে তারা অভিযান শুরু করতে পারে, না হলে অর্থাভাবে সমস্ত পরিকল্পনা হবে নষ্ট…
ডসন শহরে পৌঁছে একটি পানাগারে ঢুকল থর্নটন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে উদ্দেশ্য, তৃষ্ণা নিবারণ। বাক সর্বদাই থর্নটনকে অনুসরণ করত, পানাগারের মধ্যেই এক জায়গায় শুয়ে সে প্রভুর উপর নজর রাখছিল।
ব্ল্যাক বার্টন নামে একটা লোক ওই সময় পানাগারের ভিতর মদ্যপান করছিল। বার্টনের দেহে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। স্বভাবেও সে ছিল অত্যন্ত কলহপ্রিয় সর্বদাই সে মারামারির সুযোগ খুঁজত। পানাগারের মধ্যে সে একটি নিরীহ ছোকরার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিল। ছোকরা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল, কোনো অপরাধ না করেও সে ক্ষমা চাইতে লাগল কাচুমাচু হয়ে। বার্টন ছাড়ার পাত্র নয়, সে ছেলেটিকে রূঢ়ভাবে এক ধাক্কা মারল।
ঠিক সেইসময়ে অকুস্থলে প্রবেশ করেছিল জন থর্নটন। সে অন্যায় সহ্য করতে পারত না, বিনাদোষে ছেলেটিকে নিগৃহীত হতে দেখে দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে বার্টনকে নিবৃত্ত করতে চাইল। খুব শান্তভাবে কয়েকটা কথা বলেছিল থর্নটন, তাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল বার্টন, বিনা বাক্যব্যয়ে সে ঘুসি বসিয়ে দিল থর্নটনের মুখে। ঘুসিটা এমন জোরে পড়েছিল যে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে পড়তে কোনোরকমে একটা টেবিল আঁকড়ে ধরে পতন থেকে আত্মরক্ষা করল থটন।
বার্টন আর থর্নটনের কাছাকাছি যে মানুষগুলো ছিল তাদের কানে এল একটা ভয়ংকর জান্তব শব্দ- আওয়াজটা কুকুরের গলার আওয়াজের মতো হলেও উপস্থিত জনমণ্ডলী কোনো কুকুরের গলা থেকে অমন ভয়ংকর শব্দ বেরিয়ে আসতে শোনেনি। পরবর্তীকালে দর্শকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ওই চিৎকারের শব্দকে গর্জনধ্বনি বলেই বর্ণনা দিয়েছিল।
লোকগুলো দেখল একটা প্রকাণ্ড কুকুর মাটি থেকে সগর্জনে লাফিয়ে উঠে যেন শূন্যপথে উড়ে এল বার্টনের গলা লক্ষ্য করে। হাত দিয়ে গলা আড়াল করে কোনোমতে প্রাণ বাঁচাল বার্টন, কিন্তু বাক-এর গুরুভার দেহের আঘাতে সে ছিটকে ধরাশায়ী হল। শত্রুর হাতটাকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে তার গলায় কামড় বসাতে উদ্যত হল বাক। সেদিন বার্টনের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত কেবল আশেপাশে অবস্থিত লোকজনের হস্তক্ষেপে বার্টন প্রাণে বেঁচে গেল। প্রথমে সকলেই হকচকিয়ে গিয়েছিল, তারপরেই তাদের সংবিৎ ফিরে এল। সবাই মিলে বাককে বার্টনের দেহের উপর থাকে তাড়িয়ে দিল নিরাপদ দূরত্বে। একজন চিকিৎসককে ডেকে আনা হল। চিকিৎসক যখন বার্টনের ক্ষতগুলো পরীক্ষা করছিলেন, সেইসময় দণ্ডায়মান জনতার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আবার বার্টনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছিল বাক।
তৎক্ষণাৎ শুরু হল বিচার জনতার আদালতে। কুকুরের পক্ষে মানুষকে আক্রমণ করা গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হয়। আদালতের বিচারে বাক নিরপরাধ সাব্যস্ত হল- সে যা করেছে, ঠিক করেছে! এক মুহূর্তের মধ্যে নগণ্য অবস্থা থেকে বাক হয়ে গেল হিরো!
উত্তরাঞ্চলের মানুষ কুকুর ভালোবাসে। কুকুর তাদের প্রিয় আলোচ্য বিষয়। প্রভুর পক্ষ নিয়ে বার্টনের উপর বাক-এর আক্রমণজনিত ঘটনা তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিয়েছিল। অনেক সময় জন থর্নটন বাককে সমর্থন করতে বাধ্য হত তার নিজস্ব সম্মানরক্ষার তাগিদে।
একদিন কুকুর নিয়ে আলোচনা করতে করতে এক ব্যক্তি জানাল তার কুকুর পাঁচশো পাউন্ড ওজনের জিনিসপত্র-বোঝাই স্লেজ টানতে পারে। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানাল তার কুকুর টানতে পারে ছয়-শো পাউন্ড। তৃতীয় ব্যক্তি সগর্বে ঘোষণা করল তার কুকুরটি অনায়াসে সাত-শো পাউন্ড টানতে সমর্থ। তারপর তিনজনই ফিরে তাকাল থর্নটনের দিকে, অর্থাৎ তারা জানতে চায় থর্নটনের কুকুরের ক্ষমতার বহর কতটা।
লোক তিনটির কথা আর তাকানোর ভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জ ছিল স্পষ্ট। দারুণ উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত করে থর্নটন বলে উঠল, ওইসব ওজন ধার্তব্যই নয়। আমার বাক হাজার পাউন্ড নিয়ে চলতে পারে।
শ্রোতাদের দৃষ্টিতে ফুটল অবিশ্বাস, একজন বলল, কী বলছ তুমি? বরফে জমে থাকা স্লেজের রানার টেনে হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে চলতে পারবে তোমার কুকুর?
থর্নটন দৃঢ়ভাবে জানাল তার কুকুর ওই কাজ করতে সমর্থ।
ঠিক আছে, ম্যাথসন নামে যে লোকটি জানিয়েছিল তার কুকুর সাতশো পাউন্ড টানতে পারে, সে বলল, আমার কাছে হাজার ডলার আছে। এই হাজার ডলার বাজি রেখে আমি বলছি তোমার কুকুর হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে চলতে পারবে না।
সোনার গুঁড়োতে ভর্তি একটা চামড়ার থলি সশব্দে টেবিলের উপর রাখল ম্যাথসন।
বিপদে পড়ল থর্নটন। মাল বহন করতে সে বাককে দেখেনি কখনো, তাই বাক-এর বহন ক্ষমতা সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। থর্নটন আর তার দুই অংশীদারের সম্বল মাত্র দু-শো ডলার। হাজার ডলারের বাজিতে টক্কর দিতে হলে তাদের কাছেও হাজার ডলার থাকা দরকার এখন উপায়? একেবারে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হওয়ার উপক্রম হল যে!
উপায় হয়ে গেল। কাছেই দাঁড়িয়েছিল থর্নটনের বন্ধু জিম ওব্রায়েন। সে অতিশয় সদাশয় ধনী ব্যক্তি, থর্নটনকে হাজার ডলার ঋণ দিতে সে রাজি হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।
মৃদু হেসে ম্যাথসন বলল, বাইরে আমার কিছু ময়দা আছে। বিশ থলে ভরতি ময়দা। প্রতি থলের ওজন পঞ্চাশ পাউন্ড। এবার বাইরে গিয়ে দেখব তোমার আশ্চর্য কুকুর হাজার পাউন্ডের থলেগুলো কেমন টানতে পারে।
সমবেত জনতার কৌতূহল এখন তুঙ্গে। একটা কুকুর হাজার পাউন্ড টেনে ছুটতে পারে এমন কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
বহু মানুষের চোখের সামনে এবার বাককে নিয়ে আসা হল। ময়দা-ভরতি থলেগুলো টানার জন্য যে দশটি কুকুরকে স্লেজের সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়েছিল, তাদের বাঁধন খুলে দিয়ে সেখানে দশের পরিবর্তে একটিমাত্র কুকুরকে যুক্ত করা হল– বাক!
তার উজ্জ্বল রোমশ দেহের পেশীপুষ্ট সৌষ্ঠব দর্শকদের বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটি লোক জানাল এখনই আটশো ডলার দিয়ে সে বাককে কিনে নিতে ইচ্ছুক প্রতিযোগিতায় বাক হারল কি জিতল তা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না।
থর্নটন লোকটির কথার জবাব দিল না। হাত নেড়ে তাকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে সে হাঁটু পেতে বসল বাক-এর পাশে, দুই হাতে তার মাথাটা ধরে মুখের উপর নিজের গাল চেপে ধরে থটন বলল, টানো বাক। যদি আমায় ভালোবাসো, তাহলে সমস্ত শক্তি দিয়ে টানো।
উত্তরে থর্নটনের হাত কামড়ে ধরল বাক। তার ভীষণ ধারাল দাঁতগুলো রেশমের মতো হালকাভাবে স্পর্শ করল রক্ত বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা, হাতের উপর একটা আঁচড় পর্যন্ত পড়ল না। নিজস্ব ভাষায় নীরব থেকেই বাক জানিয়ে দিল সে প্রভুকে ভালোবাসে, তার আদেশ পালন করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পিছিয়ে এসে এবার থর্নটন আদেশ দিল, চালাও!
বাক সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ডানদিকে ফিরল, স্লেজের উপর ময়দা থলেগুলো কেঁপে উঠল ঝাঁকুনির বেগে এবং স্লেজের তলেদেশে অবস্থিত রানারের তলা থেকে বরফ ভেঙে পড়ার শব্দ ভেসে এল।
হা! আবার হুকুম দিল থর্নটন। আগের মতোই শরীরটাকে চালনা করল বাক- এইবার বাঁদিকে। বরফ ভাঙার মৃদু শব্দ এবার আরও জোরে বেজে উঠল। রানার দুটিও হড়কে সরে এল বাক-এর প্রবল আকর্ষণে স্লেজের রানার এখন বরফের কঠিন আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়েছে!
এইবার এল শেষ নির্দেশ মাশ!
সামনে ঝুঁকে পড়ল বাক লাগামে টান পড়ে সেটা শক্ত হয়ে এঁটে বসল বাক-এর শরীরে। তার প্রকাণ্ড বুক নেমে এল মাটির দিকে, মাথা উঠল উর্ধ্বে এবং নখের আঁচড়ে জমাট তুষার উড়তে লাগল চারদিকে।
অচল স্লেজ সচল হল! হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে সেটা খুব ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আধা ইঞ্চি… এক ইঞ্চি… দুই ইঞ্চি… প্রতি ঝাঁকুনির সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে চলল স্লেজ… গতি আরও বাড়ল… এখন আর ঝাঁকুনি দিচ্ছে না বাক, স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলেছে সে, তার পিছনে লাগামে বদ্ধ স্লেজও এগিয়ে চলেছে সহজভাবে স্বচ্ছন্দ গতিতে।
অনেকগুলো কাটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে একশো গজ দুরের সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছিল, অনায়াসে সেই সীমা পার হয়ে গেল বাক! দণ্ডায়মান জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে বাককে অভিনন্দন জানাল, শুন্যে উড়তে লাগল টুপি আর দস্তানা! থর্নটন নিচু হয়ে বাক-এর গলা জড়িয়ে আদর জানাতে লাগল, আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর, ওরে বাক, ওরে হতভাগা, ওরে শয়তান জানোয়ার!
হঠাৎ বাধা পড়ল। যে লোকটি প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে আটশো ডলারের বিনিময়ে বাককে কিনে নিতে চেয়েছিল, সে এগিয়ে এসে থর্নটনকে বলল, আমি বারোশো ডলার দিতে প্রস্তুত, কুকুরটা আমাকে দাও।
মাথা নেড়ে থর্নটন বলল, আমি বরং দাসব্যবসায়ীর কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেব। কিন্তু এই কুকুরটা আমি বিক্রি করব না। দয়া করে আমাকের বারবার বিরক্ত করো না।
পূর্বোক্ত ঘটনার পরেই সমগ্র উত্তরাঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে গেল থর্নটনের কুকুর- বাক!
.
২২. বনবাসী বন্ধু
আশেপাশে দাঁড়ানো আরও অনেক দর্শক বাক-এর বিরুদ্ধে বাজি ফেলেছিল– প্রথমেই হাজার ডলার বাজি ফেলেছিল ম্যাথসন পরে তার পক্ষে ও থর্নটনের বিপক্ষে বাজি পড়েছিল আরও ছয়শো ডলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওই ষোলোশো ডলার জিতে নিল বাক! নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে হঠাৎ ধনী হয়ে গেল জন থর্নটন!
থর্নটন, পিট ও হানস স্থির করল আর মালবহন নয়। এবার সোনার সন্ধানে যাত্রা করবে তারা। টাকার অভাব ছিল না, চটপট কিনে ফেলা হল ছয়টি নতুন কুকুর আর প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম– তারপর মহা-উৎসাহে তারা স্লেজ চার্লিয়ে যাত্রা করল সোনার সন্ধানে।
তাড়াহুড়ো করে নয়। খুব ধীরে ধীরে তারা অগ্রসর হল। তারা স্লেজটাকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করেনি, স্লেজে ছিল সোনা খোঁজার জন্য নিতান্ত দরকারি কিছু যন্ত্র ও অস্ত্রশস্ত্র। খাদ্যের জন্য তারা শিকার করত অথবা নদীর জল থেকে মাছ ধরতে সচেষ্ট হত। সবসময় যে তাদের চেষ্টা সফল হত তা নয়; বনের পশু বা নদীর মাছ যখন বন্দুক অথবা ছিপের মুখে আত্মসমর্পণ করত না, তখন কুকুরের দল ও তাদের প্রভুদের উপবাসী থাকতে হত- ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে প্রচুর মৎস্য ও মাংসে ক্ষুধা নিবারণ করত তারা। এই জীবন ছিল বাক-এর কাছে দারুণ আনন্দের মাঝে মাঝে উপবাসী থাকলেও একঘেয়ে স্লেজবাহকের জীবনযাত্রার চাইতে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ছিল তার কাছে অনেক বেশি আকর্ষক, অনেক বেশি আনন্দদায়ক।
অবশেষে একসময়ে একটি পার্বত্য নদীর জলধারার মধ্যে তারা সোনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করল। ছোটো ছেটো পাত্র নিয়ে নদী থেকে প্রতিদিন তারা সে জল তুলে আনত, সেই জল থেকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিদিনই তারা সংগ্রহ করত হাজার হাজার ডলারের সোনা। চামড়ার থলেগুলো সোনা-ভর্তি করে জ্বালানি কাঠের মতোই একজায়গায় ফেলে রাখা হত। ক্রমে ক্রমে ওই সোনা-ভরতি থলের স্তূপ একদিন উচ্চতায় বাক-কে ছাড়িয়ে গেল।
দু-এক সময়ে খাদ্যসংগ্রহের তাগিদে থর্নটন যখন শিকারে যেত, তখন বাক হত তার সঙ্গী। কিন্তু শিকার অভিযানের ওই সময়টুকু ছাড়া বাক-এর কিছু করার ছিল না। অধিকাংশ সময়েই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে সুদূর অতীতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত বাক– একটি রোমশ মানুষ গাছের উপর বিশ্রামরত, আর সেই গাছের তলায় অতন্দ্র প্রহরায় জাগছে একটি জন্তু ওই জন্তুটি কি বাক? বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে-আসা পূর্বজন্মের স্মৃতি কি তাকে চঞ্চল করে তোলে মাঝে মাঝে?… হঠাৎ ভেসে আসত দূর-দূরান্ত থেকে জান্তব কণ্ঠের বিষণ্ণ সংগীত– নেকড়ের চিৎকার! সেই বিষঃ জান্তব কণ্ঠস্বর যেন তাকেই আহ্বান করছে! শব্দ লক্ষ্য করে বাক ছুটত, কিন্তু কোনোদিনই শব্দের উৎস যার কণ্ঠে, তাকে খুঁজে পেত না…।
এক রাতে গভীর নিদ্রার মধ্যেই সেই তীব্র করুণ শব্দ শুনতে পেল বাক, সঙ্গেসঙ্গে ঘুম ভেঙে উঠে বসল সে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে অরণ্যের বুকে, তারই ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাক- ঝোপের আড়াল থেকে সে দেখতে পেল একটি কৃশকায় নেকড়ে, পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে, তার মুখ উঁচু হয়ে আছে আকাশের দিকে!
ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল বাক। তাকে দেখেই ছুটে পালাল নেকড়ে। পিছনে ছুটল বাক। একসময়ে নেকড়ে ঘুরে দাঁড়াল, হিংস্র দন্ত বিকাশ করে জানিয়ে দিল যুদ্ধের জন্য সে প্রস্তুত। বাক আক্রমণ করল না। সে নেকড়ের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বন্ধুত্ব জানানোর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করল। নেকড়ে কিন্তু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বাককে লক্ষ করছিল, সহজে সে বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি। অবশেষে বাক-এর ভাবভঙ্গিতে আশ্বস্ত হল নেকড়ে, সে বাককে কাছে এগিয়ে আসতে দিল– গৃহপালিত কুকুর ও বনবাসী নেকড়ে পরস্পরের নাকে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ গ্রহণ করল অর্থাৎ পশুজগতের নিয়ম অনুসারে তারা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল।
নেকড়ে আর বাক কিছুক্ষণ খেলা করার পর হঠাৎ খেলা ফেলে নেকড়ে ছুটতে শুরু করল। তার আচরণে সে বুঝিয়ে দিল বাক তার সঙ্গী হলে সে খুশি হবে। নেকড়ের সঙ্গ নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাক-এর মনে হল এইভাবে সে আগেও ছুটেছে। নেকড়ের ছোটার ভঙ্গিতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে সে যাচ্ছে। বাক ভাবল ওই নির্দিষ্ট স্থান থেকেই বোধহয় দূরাগত আহ্বান তার কানে এসেছে বারংবার ওই আহ্বান বন্য প্রকৃতির আহ্বান, অরণ্যের আহ্বান!
একটি ছোটো জলাধারের পাশে এসে থামল তারা, সেইখানে তৃষ্ণা নিবারণ করল আর হঠাৎ তখনই বাক-এর মনে পড়ল তার প্রভু থর্নটনের কথা সে বসে পড়ল। নেকড়ে আবার ছুটতে শুরু করল, কিন্তু এইবার বাক তাকে অনুসরণ করতে রাজি হল না। নতুন বন্ধুর এই হঠাৎ পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে গেল নেকড়ে, সে বারবার বাক-এর কাছে এসে মৃদু শব্দে তার সঙ্গ নিতে অনুরোধ জানাল– তবু বাক ফিরল না। অবশেষে পিছনের দুই পায়ের উপর বসে পড়ল নেকড়ে, আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে উঠল তীব্র তীক্ষ্ণ করুণ স্বরে। বাক তার আস্তানার দিকে ছুটতে ছুটতে শুনতে পেল সেই বিষঃ শব্দের ঝংকার ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে এবং একসময়ে সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে গেল সম্পূর্ণভাবে…
.
২৩. আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ
দুই দিন দুই রাত তাবু ছেড়ে বাইরে গেল না বাক। ওই সময়ের মধ্যে একবারও থর্নটনকে সে চোখের আড়াল করেনি। কিন্তু তারপর আবার অস্থির হয়ে পড়ল সে, প্রতিমুহূর্তে অনুভব করতে লাগল অরণ্যের অদম্য আকর্ষণ। তবুর আশ্রয় ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যেই সে ঘুমাত প্রতি রাত্রে। পর পর কয়েকটা দিন সে কাটিয়ে দিল অরণ্যের অন্তঃপুরে। ওই সময়ে শিকার করে সে পেট ভরাত আর খুঁজে ফিরত তার নতুন-পাওয়া নেকড়ে বন্ধুকে।
বনের মধ্যে বন্য পশুর মতোই চলাফেরা করত বাক। এমন নিঃশব্দে ছায়ার মতো সে বিচরণ করত যে, জলের ভিতর থেকে সে মাছ তুলে আনতে পারত অতর্কিতে। এর মধ্যে একটা বৃদ্ধ মুগ্ধ হরিণকে সে শিকার করল। কাজটা খুব সহজ হয়নি, দলের ভিতর থেকে তাড়িয়ে ওই হরিণটিকে আলাদা করে সে একসময়ে কোণঠাসা করে ফেলল– তারপর বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করার পর সে হরিণটাকে হত্যা করতে সমর্থ হল। হরিণটাকে মারার পরে আবার নিজস্ব আস্তানার প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করল এবং ঘরের দিকে ফিরল।
তাঁবু থেকে তিন মাইল দূরে বাক যখন এসে পড়েছে, সেই সময়ে একটা গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে তাকে বিচলিত করে তুলল। গন্ধ অনুসরণ করে সে সতর্কচরণে অগ্রসর হল। কিছুক্ষণ পরেই সে উপস্থিত হল একটা ঝোপের মধ্যে, যেখান থেকে ভেসে আসছে ওই গন্ধ। সেইখানেই সে নিগ নামে কুকুরটার তিরবিদ্ধ মৃতদেহ দেখতে পেল।
তাঁবুর ভিতর থেকে বহুকণ্ঠের মিলিত ঐকতান-সংগীত ভেসে এল বাক-এর কর্ণকুহরে। বাক গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়াবহ দৃশ্য
সোনা-ভরতি থলেগুলোর সামনে পড়ে আছে হানস, তার শরীরে বিঁধে রয়েছে অনেকগুলো তির! বলাবাহুল্য, হানসের দেহে প্রাণ নেই। কাছেই অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বিজয়নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠেছে ঈহাট নাম রেড-ইন্ডিয়ান জাতির একটা দল, মিলিত ঐকতান-সংগীতের রেশ ভেসে এসেছে তাদেরই কণ্ঠ থেকে!
বাক-এর সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে জেগে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধ ঝোপের ভিতর থেকে নর্তকদের লক্ষ্য করে সে ঝাঁপ দিলে সগর্জনে! একটা ভয়ংকর শব্দ ভেসে এল ঈহাটদের কানে, পরক্ষণেই বাক-এর ধারাল দাঁতের একটি মাত্র কামড়েই ছিঁড়ে গেল ঈহাট-সর্দারের কণ্ঠনালী! ব্যাপারটা কি ঘটছে ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই আরও পাঁচজন ঈহাট তীক্ষ্ণ দস্তাঘাতে মৃত্যুবরণ করল। ঈহাটরা তাড়াতাড়ি তাদের ধনুক তুলে তির ছুড়ল। কিন্তু বাক এত তাড়াতাড়ি স্থান পরিবর্তন করছিল এবং ঈহাটরা এমন ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, নিক্ষিপ্ত তিরগুলো বাক-এর পরিবর্তে ঈহাটদের শরীরেই বিদ্ধ হল। বাক আক্রমণ করেছিল নির্ভুল লক্ষ্যে পর পর আরও কয়েকজন ঈহাট মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল বাক-এর ধারাল দাঁতের মারাত্মক আঘাতে। এইবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ঈহাটদের দলে, তারা পালাতে পালাতে চিৎকার করে বলতে লাগল একটা দুষ্ট আত্মা হানা দিয়েছে তাদের উপর… জঙ্গলের মধ্যে তাড়া করে আরও কয়েকজন ঈহাটকে হত্যা করল বাক…
বাক-এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে যারা জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, এক সপ্তাহ পরে একটি উপত্যকার ভিতর তারা নিখোঁজ সঙ্গীদের খুঁজে পেল আর সেখানে দাঁড়িয়েই তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজ করতে পারল।
তাঁবুতে ফিরে কম্বলের মধ্যে প্রাণহীন দেহে পিটকে শুয়ে থাকতে দেখল বাক। কিন্তু তার প্রিয় প্রভু কোথায়?..থর্নটনের গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে একটা ছোটো নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল বাক। একটা ভয়ংকর লড়াই-এর চিহ্ন ছিল নদীতীরে। থর্নটনের পদচিহ্ন নেমে গেছে নদীগর্ভে কিন্তু নদীর তীরে মাটির উপর তার ফিরে আসার চিহ্ন নেই।
বাক বুঝল, থর্নটন আর ফিরে আসবে না, তার মৃত্যু হয়েছে। সারাদিন বাক নদীর পারে বসে রইল, অথবা ঘুরে বেড়াল তাঁবুর আশেপাশে অশান্ত পদে। দুঃসহ ক্ষুধার মতো একটা যাতনাদায়ক অনুভূতি জেগে উঠেছে তার মধ্যে, কিন্তু খাদ্য দিয়ে সেই ক্ষুধার্ত অন্তরের শূন্যতাকে পূর্ণ করা সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি থামিয়ে সে ঈহাটদের মৃতদেহগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রিয় প্রভুকে হারানোর দুঃখ মুছে গিয়ে তার অন্তরে জেগে উঠছিল দৃপ্ত অহঙ্কার- পশুজগতে মানুষ শিকার নিষিদ্ধ, কিন্তু সেই নিষিদ্ধ জীব মানুষকেই হত্যা করেছে বাক!
.
২৪.অরণ্যের আহ্বান
এল রাত্রি। আকাশে দেখা দিল চাঁদ। অর্ধচন্দ্র নয়– সুবর্তুল আলোকপিণ্ডের মতো পূর্ণচন্দ্র। যে নদীর স্রোতের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে থর্নটনের দেহ, সেই নদীর পারে বসেছিল শোকে দুঃখে মুহ্যমান বাক।
হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। বহুদূর থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ জান্তব ধ্বনি। সেই শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জাগল আরও বহুকণ্ঠের মিলিত ঐকতান। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এসে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বেজে উঠল। বাক অনুভব করল অগ্নিকুণ্ডের নৃত্যচঞ্চল অগ্নিশিখার ভিতর দিয়ে যে বন্য দুনিয়ার আভাস তার মানসপটে ভেসে উঠেছে বারংবার সেই দুনিয়া তাকে ডাকছে, ডাকছে আর ডাকছে! আদিম অরণ্যের বন্য আহ্বান তাকে টানতে লাগল দুর্নিবার আকর্ষণে…
এমন প্রচণ্ড আকর্ষণ এর আগে কখনো অনুভব করেনি বাক, সে প্রস্তুত হল অরণ্যের আহ্বানে সাড়া দিতে– জন থর্নটনের মৃত্যু নিঃশেষে মুছে দিয়েছে বাক-এর সঙ্গে মানুষের সমস্ত সম্পর্ক..
কিছুক্ষণের মধ্যেই নদী আর বৃক্ষ-সমাকীর্ণ বনভূমি পেরিয়ে বাক-এর অধিকৃত উপত্যকায় প্রবেশ করল নেকড়ের দল। চন্দ্রালোকে আলোকিত নিরেট রূপার ধাবমান স্রোতের মতো একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নেকড়ে বাহিনী
পূর্বোক্ত ফাঁকা জায়গার ঠিক মাঝখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বাক- মৌন, গম্ভীর, নিশ্চল!
সেই মৌন গাম্ভীর্যে স্থির চতুষ্পদ প্রাণীটির অস্তিত্ব নেকড়ের দলে আতঙ্কের সঞ্চার করল। একটি মুহূর্ত, শুধু একটি মুহূর্তই স্থায়ী ছিল আতঙ্কের ছায়া, পরক্ষণেই দলের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী নেকড়েটা লাফিয়ে পড়ল দণ্ডায়মান জন্তুটার উপর। বিদ্যুঝলকের মতে আঘাত হানল বাক, ঘাড় ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দুঃসাহসী নেকড়ে, তার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। বাক তখনও নীরব, নিশ্চল– কিন্তু প্রতীক্ষায় ভয়ংকর। আরও তিনটি নেকড়ে পরপর আক্রমণ করল তাকে, তিনজনই গলায় অথবা ঘাড়ে রক্তাক্ত ক্ষত নিয়ে পিছিয়ে এল। এবার আর একে একে নয়– সমস্ত দলটা মিলিত আক্রমণে ঝাঁপিয়ে এল বাক-এর দিকে।
কিন্তু কার সাধ্য তার সামনে এগোয়? সামনে, পিছনে, ডাইনে, বায়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো ঘুরতে ঘুরতে দলবদ্ধ আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল বাক- তার দুই চোয়ালের দুর্ভেদ্য প্রহরা এড়িয়ে কোনো নেকড়ে বাক-এর দেহ স্পর্শ করতে পারল না। খনি-মজুরদের খননকার্যের ফলে শুকনো নদীর খাঁড়িতে যেখানে খাড়া পাঁচিল তৈরি হয়েছিল, সেই পাঁচিলের তলায় পিঠ দিয়ে রুখে দাঁড়াল বাক- নেকড়ের দলের কোনো জন্তুকে সে তার পিছনে যেতে দিল না।
শুকনো খাড়ির খাড়া পার আর পাঁচিলের দেয়াল বাক-এর বাম, দক্ষিণ ও পশ্চাৎভাগ আড়াল করে রেখেছিল, শুধুমাত্র সামনের দিক ছাড়া অন্য কোনো দিক থেকে তাকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। প্রায় আধ ঘণ্টা কাটল। বাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে বিজয়ী বীরের মতো। নেকড়ের দল তাকে অর্ধবৃত্তের আকারে ঘিরে রক্তাক্ত ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করছে, কেউ আর ওই ভয়ংকর জীবটির সামনে এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ একটি কৃশকায় দীর্ঘদেহী ধূসর বর্ণের নেকড়ে ধীরে ধীরে সতর্ক পদে এগিয়ে গেল বাক-এর দিকে, তার আচরণ বন্ধুর মতো। বাক-এর দুই চোখে পরিচয়ের আলো জ্বলে উঠল সে চিনতে পেরেছে ওই নেকড়েটাকে এরই সঙ্গে কিছুদিন আগে সে মিলিত হয়েছিল অরণ্যের গর্ভে, এরই সঙ্গে সে পাশাপাশি ছুটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নেকড়ে এগিয়ে এল, তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল মৃদু কোমল স্বরের লহরী- একই রকম ভাবে কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্ব প্রকাশ করল বাক- তারপর পরস্পরের নাকে নাক লাগিয়ে দাঁড়াল তারা।
এবার এগিয়ে এল একটা বয়স্ক নেকড়ে। তার ক্ষতবিক্ষত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বহন করছে বহু যুদ্ধের চিহ্ন। বাক তার নাকে নাক ঠেকাল। বয়স্ক নেকড়ে তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল। তার সঙ্গে যোগ দিল দলের অন্যান্য নেকড়ে। সাগ্রহে তাদের ঐকতানে যোগ দিল বাক।
বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে দেরি হল না নেকড়ে-বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটতে শুরু করল সে…
.
২৫. ভুতুড়ে কুকুর
জন থর্নটন ও তার সঙ্গীদের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যেই ঈহাট জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ানরা লক্ষ করল বনবাসী নেকড়ের দলে একটা পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটি নেকড়ের মাথায় ও মুখে বাদামি রং-এর ছাপ দেখা যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো জন্তুর বুকের মাঝখানে শ্বেতবর্ণের প্রলেপ।
নেকড়ের দলে এই অস্বাভাবিক বর্ণবৈচিত্র্য ঈহাটদের বিস্মিত করেছিল বটে, কিন্তু তাদের বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল আর একটা ঘটনা নেকড়ের দলকে পরিচার্লিত করে সর্বাগ্রে ধাবমান একটি প্রকাণ্ড কুকুর~ মাঝে মাঝেই আত্মপ্রকাশ করে অরণ্য-প্রান্তরে। ঈহাটরা ওই কুকুরটাকে আখ্যা দিয়েছে প্রেতগ্রস্ত বা ভুতুড়ে কুকুর। উক্ত ভুতুড়ে কুকুর এখন ঈহাটদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। বহু চেষ্টাতেও তারা ওই কুকুরটার হামলা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। তাদের ফাঁদে-আটকানো জন্তুগুলোকে ওই কুকুরটা মেরে খায়- নিজে ফাঁদে পড়ে না, কিন্তু ফাঁদগুলোকে ভেঙে শেষ করে দেয়। তাঁবু থেকে খাবার চুরি করে কুকুরটা, ঈহাটদের পোষা কুকুরগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করে। ঈহাটদের মধ্যে যারা শিকার করতে যায়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিকারি আর ঘরে ফেরে না– জঙ্গলের মধ্যে অনুসন্ধান চার্লিয়ে দেখা যায় মাটিতে পড়ে আছে শিকারির মৃতদেহ, তার কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন এবং মাটিতে বরফের উপর যে শ্বাপদের পদচিহ্নগুলো দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে নেকড়ের পদচিহ্নের সাদৃশ্য থাকলেও কোনো নেকড়ের পায়ের ছাপই অত বড়ো হয় না।
ঈহাটরা একটি উপত্যকায় কখনো প্রবেশ করে না। জনশ্রুতি আছে, উক্ত উপত্যকায় বাস করে একটি দুষ্ট আত্মা! ওই উপত্যকায় শিকার করতে গেলে শিকারি যে জীবিত অবস্থায় ফিরবে না এ বিষয়ে ঈহাটরা নিঃসন্দেহ।
যাই হোক, দ্বিপদ মনুষ্য পূর্বোক্ত উপত্যকায় পদক্ষেপ না করলেও একটি চতুম্পদ জীব প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে সেখানে উপস্থিত হয়। জন্তুটি নেকড়ের মতো দেখতে হলেও নেকড়ে নয়। একটি ছোটো নদীর ধারে সে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে, তারপর একবার মুখ তুলে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে- সেই তীব্র করুণ আর্তনাদের রেশ দীর্ঘসময় ধরে বাজতে থাকে বনভূমির বুকে… তারপর জন্তুটা স্থানত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র…
দীর্ঘ শীতের রাত্রে মাঝে মাঝে নেকড়ের দলের পুরোভাগে ধাবমান কুকুরটিকে দেখা যায়। নেকড়ের দলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সে চিৎকার করে সেই জান্তব কণ্ঠ যেন অরণ্যের আহ্বান জানিয়ে ছুটে যায় দিক হতে দিগন্তরে…