২০. পত্রাবলী ৩০৫-৩১৪

৩০৫*

[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]

C/o Miss Muller
Airlie Lodge, Ridgeway
Gardens
উইম্বল‍্‍ডন, ইংলণ্ড
২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
ম্যাক্সমূলারের লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় যে প্রবন্ধটি পাঠিয়েছিলাম, তা তুমি পাওনি বলেই মনে হচ্ছে। তিনি ঐ প্রবন্ধে আমার নাম উল্লেখ না করায় তুমি দুঃখিত হয়ো না; কারণ আমার সঙ্গে পরিচয় হবার ছ-মাস আগে তিনি ঐ প্রবন্ধটি লিখেছেন। তা ছাড়া মূল বিষয়ে যদি তিনি ঠিক থাকেন, তবে কার নাম করলেন বা না করলেন, এ নিয়ে কে মাথা ঘামায়!

জার্মানীতে প্রফেসর ডয়সনের সঙ্গে আমার কিছুদিন খুব সুন্দর কেটেছে। তারপর দুজনে লণ্ডনে আসি। ইতোমধ্যেই আমাদের দুজনের মধ্যে খুব সৌহার্দ্য জন্মেছে। আমি শীঘ্রই তোমাকে তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠাচ্ছি। দয়া করে এইটুকু শুধু মনে রেখো—আমার প্রবন্ধের প্রারম্ভে পুরানো ঢঙের ‘প্রিয় মহাশয়’ যেন ছাপা না হয়। রাজযোগের বইখানি কি তোমার দেখা হয়েছে? আগামী বৎসরের জন্য তোমায় একটি নক‍্‍সা পাঠাব। রাশিয়ার জারের লেখা একটি ভ্রমণ-বিষয়ক পুস্তকের উপর ‘ডেলী নিউজে’ যে প্রবন্ধ বেরিয়েছিল, তা তোমায় পাঠালাম। যে প্যারাগ্রাফে তিনি ভারতবর্ষকে ‘ধর্মভূমি ও জ্ঞানভূমি’ বলেছেন, সেটা তোমার কাগজে উদ্ধৃত করা উচিত; তারপর ওটি ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ পাঠিয়ে দিও।

জ্ঞানযোগের বক্তৃতাগুলি তুমি অনায়াসে ছাপতে পার, আর ডাক্তার নাঞ্জুণ্ড রাও সহজ বক্তৃতাগুলি ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’ ছাপতে পারেন। তবে ওগুলো খুব ভাল করে দেখে নিয়ে ছাপাবে। আমার বিশ্বাস, পরে আমি আরও বেশী লিখবার সময় পাব। উৎসাহ নিয়ে কাজে লেগে যাও। সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—যে অংশটা ছাপতে হবে, তা দাগ দিয়ে দিয়েছি—বাকীটা অবশ্য পত্রিকার পক্ষে উপযুক্ত নয়।

যথেষ্ট প্রবন্ধ দিয়ে কাগজখানিকে বড় করতে পারবে—এমন ভরসা যদি না থাকে, তবে এখনই ওটাকে মাসিক পত্রিকায় রূপান্তরিত করা আমার ভাল মনে হচ্ছে না। এ পর্যন্ত তো পত্রিকার আকার ও প্রবন্ধগুলি আশানুরূপ নয়। এখনও অনেক বিশাল ক্ষেত্র পড়ে আছে, যেখানে আমরা প্রবেশও করিনি; যথা—তুলসীদাস, কবীর, নানক ও দক্ষিণ ভারতীয় সাধুদের জীবন ও বাণী। অসাবধানে ও যা তা ভাবে না লিখে সঠিক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে এ-সব লেখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে এই পত্রিকার আদর্শ বেদান্ত-প্রচার তো হবেই, তা ছাড়া এটি ভারতীয় গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের মুখপত্র হবে—অবশ্য ঐ গবেষণাদি হবে ধর্ম সম্বন্ধে। তোমার উচিত কলিকাতা ও বোম্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সংস্পর্শে আসা ও তাঁদের কাছ থেকে সযত্নে রচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ করা। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লাগ। ইতি

বি

৩০৬*

১৪, গ্রেকোট গার্ডেন‍্‍স্
ওয়েস্টমিনস্টার, লণ্ডন
১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি প্রায় তিন সপ্তাহ হল সুইজরলণ্ড থেকে ফিরেছি; কিন্তু তোমাকে এ পর্যন্ত বিস্তারিত পত্র লিখতে পারিনি। আমি গত mail (ডাকে)-এ কিয়েল-নিবাসী পল ডয়সন সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছি। স্টার্ডির কাগজ বের করবার মতলব এখনও কাজে পরিণত হয়নি। তুমি দেখতেই পাচ্ছ, আমি সেণ্ট জর্জেস‍্‍ রোডের বাসা ছেড়ে এসেছি। আমাদের একটি বক্তৃতা দেবার হল হয়েছে। ৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, C/o E. T. Sturdy—এই ঠিকানায় এক বৎসর পর্যন্ত পত্রাদি এলে আমার কাছে পৌঁছবে। গ্রেকোট গার্ডেনে যে ঘরগুলি আছে, তা আমার ও অপর স্বামীর (সন্ন্যাসীর) থাকবার উদ্দেশ্যে মাত্র তিন মাস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। লণ্ডনের কাজ দিন দিন বেড়ে চলেছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই ক্লাসে বেশী করে লোক সমাগম হচ্ছে। শ্রোতৃ-সংখ্যা যে ঐ হারে ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর ইংরেজ জাতি বড়ই দৃঢ়প্রকৃতি ও নিষ্ঠাবান্। অবশ্য আমি চলে গেলে যতটা গাঁথনি হয়েছে, তার অধিকাংশই পড়ে যাবে। কিন্তু তারপর হয়তো কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে, হয়তো কোন দৃঢ়চেতা ব্যক্তি এসে এই কার্যের ভার গ্রহণ করবে—প্রভুই জানেন, কিসে ভাল হবে।

আমেরিকায় বেদান্ত ও যোগ শিক্ষা দেবার জন্য বিশ জন প্রচারকের স্থান হতে পারে; কিন্তু কোথা থেকেই বা প্রচারক পাওয়া যাবে, আর তাদের আনবার জন্য টাকাই বা কোথায়? যদি কয়েকজন দৃঢ়চেতা খাঁটি লোক পাওয়া যায়, তবে দশ বৎসরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক জয় করে ফেলা যেতে পারে। কোথায় এরূপ লোক? আমরা সবাই যে আহম্মকের দল—স্বার্থপর, কাপুরুষ; মুখে স্বদেশপ্রেমের কতকগুলি বাজে বুলি আওরাই, আর ‘আমরা খুব ধার্মিক’ এই অভিমানে ফুলে আছি! মান্দ্রাজীরা অপেক্ষাকৃত চটপটে ও একনিষ্ঠ; কিন্তু হতভাগাগুলো সকলেই বিবাহিত! বিবাহ, বিবাহ, বিবাহ! পাষণ্ডেরা যেন ঐ একটি কর্মেন্দ্রিয় নিয়েই জন্মেছে! … এ আমি বড় শক্ত কথা বললাম; কিন্তু বৎস, আমি চাই এমন লোক—যাদের পেশীসমূহ লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাত নির্মিত, আর তার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত। বীর্য, মনুষ্যত্ব—ক্ষাত্রবীর্য, ব্র্হ্মতেজ! আমাদের সুন্দর সুন্দর ছেলেগুলি—যাদের উপর সব আশা করা যায়, তাদের সব গুণ, সব শক্তি আছে—কেবল যদি এই রকম লাখ লাখ ছেলেকে বিবাহ নামে কথিত পশুত্বের যূপকাষ্ঠে হত্যা না করা হত! হে প্রভো, আমার কাতর ক্রন্দনে কর্ণপাত কর। মান্দ্রাজ তখনই জাগবে, যখন তার হৃদয়ের শোণিতস্বরূপ অন্ততঃ একশত শিক্ষিত যুবক সংসার থেকে একেবারে স্বতন্ত্র হয়ে কোমর বাঁধবে এবং দেশে সত্যের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হবে। ভারতের বাইরে এক ঘা দিতে পারলে সেই এক ঘা ভারতের ভিতরের লক্ষ আঘাতের তুল্য হয়। যা হোক, যদি প্রভুর ইচ্ছা হয় তবেই হবে।

আমি তোমাদের যে টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলাম, মিস মূলার সেই টাকা দেবেন বলেছিলেন। আমি তাঁকে তোমার নূতন প্রস্তাবের বিষয় বলেছি, তিনি তা ভেবে দেখেছেন। ইতোমধ্যে আমার বিবেচনায় তাঁকে কিছু কাজ দেওয়া ভাল। তিনি ‘ব্রহ্মবাদিন‍্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র এজেণ্ট হতে স্বীকৃত হয়েছেন। তুমি তাঁকে ঐ সম্বন্ধে লিখো যেন। তাঁর ঠিকানা—Airlie Lodge, Ridgeway Gardens, Wimbledon, England. গত কয়েক সপ্তাহ তাঁরই বাড়ীতে ছিলাম। কিন্তু আমি লণ্ডনে না থাকলে লণ্ডনের কাজ চলতে পারে না; সুতরাং বাসা বদলেছি। মিস মূলার এতে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, আমিও দুঃখিত। কিন্তু কি করব! এঁর পুরা নাম—মিস হেনরিয়েটা মূলার। ম্যাক্সমূলার দিন দিন আরও বেশী করে বন্ধুভাবাপন্ন হচ্ছেন। শীঘ্রই আমাকে অক্সফোর্ডে দুটি বক্তৃতা দিতে হবে।

মহীশূরে তামিল লিপিতে সমগ্র ১০৮ উপনিষদ‍্-সমন্বিত একখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অধ্যাপক ডয়সনের পুস্তকাগারে সেটি দেখলাম। ও বইয়ের কি কোন দেবনাগরী সংস্করণ আছে? যদি থাকে তো আমায় একখানি পাঠাবে। যদি না থাকে তো তামিল সংস্করণটিই পাঠাবে এবং একখানা কাগজে তামিল অক্ষরগুলি (সংযুক্ত অক্ষরসহ) পাশে পাশে নাগরীতে লিখে পাঠাবে—যাতে আমি তামিল অক্ষর শিখে নিতে পারি।

সেদিন আমার সঙ্গে সত্যনাথন মহাশয়ের সাক্ষাৎ হল লণ্ডনে। তিনি আমাকে তাঁর বেদান্তের উপর একটি বক্তৃতা এবং তাঁর মৃতা সহধর্মিণীকৃত একখানি উপন্যাস উপহার দিলেন। তিনি বললেন, মান্দ্রাজের প্রধান এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পত্র ‘মান্দ্রাজ মেলে’ রাজযোগ-পুস্তকখানির একটি অনুকূল সমালোচনা বেরিয়েছে। আরও শুনলাম, আমেরিকার প্রধান শারীরতত্ত্ববিৎ উক্ত পুস্তকে প্রকাশিত আমার মত ও ধারণাসমূহ পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছেন। এই সময়ে আবার ইংলণ্ডে কতকগুলি ব্যক্তি আমার মতগুলি নিয়ে উপহাস করেছেন। ভাল কথা! আমার আলোচনা অতি নির্ভীক, আর এগুলির বেশীরভাগই লোকের নিকট চিরকাল অর্থহীন থেকে যাবে। কিন্তু ওতে এমন সব বিষয়ের আভাস দেওয়া হয়েছে, শারীরতত্ত্ববিদ‍্‍রা আরও আগেই গ্রহণ করলে ভাল করতেন। যা হোক, যেটুকু ফল হয়েছে, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার ভাব এই—লোকে আমার বিরুদ্ধে বলুক, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু কিছু বলুক।

অবশ্য ইংলণ্ডের সমালোচকগণ ভদ্র, আমেরিকার সমালোচকদের মত বাজে বকে না। তারপর ইংলণ্ডের যে-সব মিশনরী ওদেশে দেখতে পাও, তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই dissenters (প্রতিষ্ঠিত চার্চের বিরোধী)। … এখানকার ভদ্রলোকগণের মধ্যে যাঁরা ধার্মিক, তাঁরা সকলেই ‘চার্চ অব ইংলণ্ডে’র। ইংলণ্ডে ঐ বিরোধীদের অতি অল্পই প্রতিপত্তি, আর তাদের শিক্ষাও নেই। তুমি আমাকে মধ্যে মধ্যে যাদের বিষয়ে সাবধান করে দাও, তাদের কথা আমি এখানে শুনতেই পাই না। তারা এখানে অজ্ঞাত ও অপরিচিত এবং তারা এখানে বাজে বকতে সাহসও পায় না। আশা করি, রামকৃষ্ণ নাইডু এতদিনে মান্দ্রাজে পৌঁছেছেন এবং তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কুশল।

হে বীরহৃদয় বালকগণ, অধ্যবসায় কর। আমাদের কার্য সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে। কখনও নিরাশ হয়ো না, কখনও বলো না, ‘আর না, যথেষ্ট হয়েছে।’ আমি একটু সময় পেলেই ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য কয়েকটি গল্প লিখব। অভেদানন্দ মারফৎ মাননীয় সুব্রহ্মণ্য আয়ার দয়া করে যে সমাচার পাঠিয়েছেন, সেজন্য তাঁকে আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাবে।

তোমার চিরপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—পাশ্চাত্য দেশে যখনই কেউ আসে এবং বিভিন্ন জাতিদের দেখে, তখনই তার চোখ খুলে যায়। কেবল অনর্থক বকে নয়, পরন্তু ভারতে আমাদের কি আছে আর কি নেই, তা তাদের স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়ে—এভাবেই আমি দৃঢ়চেতা কর্মবীরদের যোগাড় করে থাকি। আমার ইচ্ছা হয়, অন্ততঃ দশ লক্ষ হিন্দু সমগ্র জগতে ভ্রমণ করুক। ইতি

বি

পুনঃ—তোমার ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য লোহার ব্লক সমেত নক‍্‍সা পাঠাব। ইতি

বি

৩০৭*

C/o Miss Muller
উইম্বল‍্ডন, ইংলণ্ড
৭ অক্টোবর, ১৮৯৬

প্রিয় জো,
আবার সেই লণ্ডনে! আর ক্লাসগুলিও যথারীতি শুরু হয়েছে। সংস্কারবশেই আমার মন চারিদিকে সেই চেনা মুখখানি খুঁজে ফিরছিল, যে মুখে কখনও নিরুৎসাহের রেখা পড়ত না, যা কখনও পরিবর্তিত হত না আর যা ছিল সর্বদা সহায়ক, আনন্দময় ও শক্তিপ্রদ। আজ কয়েক সহস্র মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও সেই মুখখানিই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল; অতীন্দ্রিয় রাজ্যে দূরত্ব আবার কি? যাক্, তুমি তো তোমার বিশ্রাম ও শান্তিপূর্ণ ঘরে ফিরে গেছ—আর আমার ভাগ্যে আছে নিত্যবর্ধমান কর্মের তাণ্ডব! তবু তোমার শুভেচ্ছা সর্বদাই আমার সঙ্গে ফিরছে—নয় কি?

কোন নির্জন পর্বতগুহায় গিয়ে চুপ করে থাকাই হচ্ছে আমার স্বাভাবিক প্রবণতা; কিন্তু পেছন থেকে নিয়তি আমাকে সামনে ঠেলে দিচ্ছে, আর আমি এগিয়ে চলেছি! অদৃষ্টের গতি কে রোধ করবে?

যীশুখ্রীষ্ট তাঁর Sermon on the Mount (শৈলোপদেশ)-এ এরূপ কোন উক্তি কেন করেননি—‘যারা সদা আনন্দময় ও সদা আশাবাদী তারাই ধন্য, কারণ স্বর্গরাজ্যলাভ তো তাদের হয়েই আছে?’ আমার বিশ্বাস তিনি নিশ্চয়ই ঐরূপ বলেছিলেন, কিন্তু তা লিপিবদ্ধ হয়নি; তিনি বিশাল বিশ্বের অনন্ত দুঃখ অন্তরে বহন করে বলেছিলেন, সাধুর হৃদয় শিশুর মত। তাঁর সহস্র বাণীর মধ্যে হয়তো একটি বাণী লিপিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ মনে করে রাখা হয়েছে।

বর্তমানে ফল বাদাম প্রভৃতিই আমার প্রধান আহার; এবং ওতেই যেন আমি ভাল আছি। যদি কখনও সেই ‘উঁচু দেশে’র পুরাতন চিকিৎসকটির সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তবে সেই রহস্যটি তাঁকে বলো। আমার চর্বি অনেকটা কমে গেছে; তবে যেদিন বক্তৃতা থাকে, সেদিন কিছু পেট ভরা খাবার খেতে হয়। হলিস্টার কেমন আছে? তার চেয়ে মধুর প্রকৃতির বালক আমি দেখিনি। তার সারাটি জীবন সর্বপ্রকার মঙ্গলে পূর্ণ হোক!

তোমার বন্ধু কোলা নাকি জরথুষ্ট্রীয় দর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতা দিচ্ছেন? অদৃষ্ট নিশ্চয়ই তাঁর খুব অনুকূল নয়। তোমাদের মিস—এবং আমাদের—এর খবর কি? … আর আমাদের মিস (নাম ভুলে গেছি!) কেমন? শুনলাম, সম্প্রতি আধজাহাজ বোঝাই হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান এবং অন্যান্য আরও কত কি সম্প্রদায়ের লোক আমেরিকায় উপস্থিত হয়েছে; আর একদল লোক গিয়ে ভারতবর্ষে জুটেছে, যারা মহাত্মা খুঁজে বেড়ায়, ধর্মপ্রচার করে ইত্যাদি। চমৎকার! ভারতবর্ষ ও আমেরিকা—এই দুটি দেশই যেন ধর্মবিষয়ক উৎসাহ-উদ্দীপনার লীলাভূমি বলে মনে হয়। কিন্তু জো, সাবধান, এই বিধর্মীদের পাপ অতি ভীষণ! আজ পথে মাদাম-এর সহিত সাক্ষাৎ হল। তিনি আর আজকাল আমার বক্তৃতায় আসেন না। সেটা তাঁর পক্ষে ভালই; অত্যধিক দার্শনিক চিন্তা ভাল নয়।

সেই মহিলাটির কথা কি তোমার মনে আছে—যিনি আমার প্রত্যেক বক্তৃতার শেষে এমন সময় এসে উপস্থিত হতেন, যখন কিছুই শুনতে পেতেন না, কিন্তু বক্তৃতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে আমাকে ধরে রাখতেন এবং বকাতেন যে, ক্ষুধার জ্বালায় আমার পাকস্থলীতে ওয়াটারলুর মহাসমর উপস্থিত হত? তিনি এসেছিলেন, অপর সকলেও আসছে এবং আরও আসবে। এ সবই আনন্দের বিষয়। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সকলেই এসেছিলেন এবং গলস‍্‍ওয়ার্দি পরিবারের বিবাহিতা কন্যাদেরও একজন এসেছিলেন। মিসেস গলস্‌ওয়ার্দি আজ আসতে পারেননি, কারণ যথেষ্ট আগে খবর পাননি। এখন আমরা একটি ‘হল’—বেশ বড় ‘হল’ পেয়েছি; তাতে দু-শ বা তার চেয়েও বেশী লোকের স্থান হতে পারে। একটা বড় কোণ আছে, সেখানে লাইব্রেরী বসান যাবে। সম্প্রতি আমাকে সাহায্য করবার জন্য ভারতবর্ষ থেকে আর একজন এসেছেন।

সুইজরলণ্ড এবং জার্মানী দুটি জায়গায়ই আমার খুব ভাল লেগেছিল। অধ্যাপক ডয়সন খুব সদয় ব্যবহার করেছিলেন। আমরা উভয়েই লণ্ডনে এসে খুব আনন্দ করেছি। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। মোটের উপর ইংলণ্ডের কাজ বেশ পাকা হচ্ছে, এবং খ্যাতনামা পণ্ডিতগণের আনুকূল্য দেখে মনে হয় যে, আমাদের কাজ শ্রদ্ধাও অর্জন করেছে। সম্ভবতঃ এই শীতে কয়েকজন ইংরেজ বন্ধু সহ আমি ভারতবর্ষে যাব। আমার নিজের সম্বন্ধে আজ এই পর্যন্ত।

সেই নৈষ্ঠিক পরিবারটির সংবাদ কি? সব বেশ চমৎকার ভাবেই চলছে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। এতদিনে ফক্সের সংবাদ তুমি পেয়ে থাকবে। যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে শুরু না করলে সে ম্যাবেলকে বিয়ে করতে পারে না, এ-কথা তাকে যাত্রার আগের দিনে বলে ফেলে আমি হয়তো তাকে খুব মন-মরা করে দিয়েছি। ম্যাবেল কি এখন তোমার ওখানে আছে? তাকে আমার স্নেহ জানিও; আমাকে তোমার বর্তমান ঠিকানাও দিও। মা কেমন আছেন? ফ্র্যাঙ্কিন্‌সেন্স বরাবরের মত ঠিক সেই খাঁটি অমূল্য সোনাটিই আছে নিশ্চয়! এলবার্টা বোধ হয় ঠিক তার নিয়মমত গান-বাজনা, ভাষাশিক্ষা, হাসিঠাট্টা নিয়ে আছে এবং খুব করে আগের মত আপেল খাচ্ছে?

রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে; সুতরাং জো, আজকের মত বিদায় (নিউ ইয়র্কেও কি আদবকায়দা ঠিক ঠিক পালন করা দরকার?)। প্রভু নিরন্তর তোমার কল্যাণ করুন। … আমার চিরস্নেহ ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—সেভিয়ার-দম্পতি তোমাকে তাঁদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তাঁদের ঘর (ফ্ল্যাট) থেকেই এই চিঠি লিখছি। ইতি

বি

৩০৮*

[মিস ওয়াল্ডোকে লিখিত]

উইম্বল‍্‍ডন, ইংলণ্ড
৮ অক্টোবর, ১৮৯৬

প্রিয় ওয়াল্ডো,
… সুইজরলণ্ডে আমি বেশ বিশ্রাম লাভ করেছি এবং অধ্যাপক পল ডয়সনের সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব হয়েছে। বাস্তবিক, অন্যান্য স্থানের চেয়ে ইওরোপে আমার কাজ বেশী সন্তোষজনক হচ্ছে এবং ভারতবর্ষে এর একটা খুব প্রতিধ্বনি উঠছে। লণ্ডনের ক্লাস আবার আরম্ভ হয়েছে—আজ তার প্রথম বক্তৃতা। এখন আমার নিজের একটা ‘হল’ হয়েছে—তাতে দুইশত বা ততোধিক লোক ধরে। … তুমি অবশ্য জান, ইংরেজরা একটা জিনিষ কেমন কামড়ে ধরে থাকতে পারে, এবং সকল জাতির মধ্যে তারা পরস্পরের প্রতি সবচেয়ে কম ঈর্ষাপরায়ণ—এই কারণেই তারা জগতের উপর প্রভুত্ব করেছে। দাসসুলভ খোশামুদির ভাব একদম না রেখে কিভাবে আজ্ঞানুবর্তী হওয়া যায়—অপরিসীম স্বাধীনতার সঙ্গে কেমন করে কঠোর নিয়ম মেনে চলা যায়—এ রহস্য তারা বুঝেছে।

অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার এখন আমার বন্ধু। আমি লণ্ডনে ছাপমারা হয়ে গেছি। র—নামক যুবকটি সম্বন্ধে আমি খুব কমই জানি। সে বাঙালী এবং অল্পস্বল্প সংস্কৃত পড়াতে পারবে। তুমি আমার দৃঢ় ধারণা তো জান—কামকাঞ্চন যে জয় করতে পারেনি, তাকে আমি বিশ্বাসই করি না। তুমি তাকে তত্ত্বমূলক (theoretical) বিষয় শেখাতে দিয়ে দেখতে পার; কিন্তু সে যেন রাজযোগ শেখাতে না যায়—যারা রীতিমত শিক্ষা না করেছে, তাদের ওটা নিয়ে খেলা করা মহা বিপজ্জনক। সারদানন্দের সম্বন্ধে কোন ভয় নেই—বর্তমান ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী তার উপর আশীর্বাণী বর্ষণ করেছেন। তুমি শিক্ষা দিতে আরম্ভ কর না কেন? … এই র—বালকটির চেয়ে তোমার হাজার গুণ বেশী দর্শনের জ্ঞান আছে। ক্লাসের নোটিস বার কর এবং নিয়মিতভাবে ধর্মবিষয়ক আলোচনা কর ও বক্তৃতা দিতে থাক। এক-শ হিন্দু, এমন কি, আমার একজন গুরুভাই আমেরিকায় খুব সাফল্য লাভ করেছে শুনলে যে আনন্দ হয়, তোমাদের মধ্যে একজন ওতে হাত দিয়েছ দেখলে আমি তার সহস্রগুণ আনন্দলাভ করব। ‘মানুষ দুনিয়া জয় করতে চায়; কিন্তু নিজ সন্তানদের কাছে পরাজয় ইচ্ছা করে।’ জ্বালাও, জ্বালাও—চারিদিকে জ্ঞানাগ্নি জ্বালাও।

আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৩০৯*

[মিসেস বুলকে লিখিত]

উইম্বল‍্ডন, ইংলণ্ড
৮ অক্টোবর, ১৮৯৬

প্রিয়—,
জার্মানীতে অধ্যাপক ডয়সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিয়েল-এ (Kiel) তাঁর অতিথি হয়েছিলাম। দু-জনে একসঙ্গে লণ্ডনে এসেছি এবং এখানেও কয়েকবার দেখাশুনা হয়েছে, খুব আনন্দলাভ করেছি। … ধর্ম ও সমাজ-সম্বন্ধীয় বিভিন্ন কাজের প্রতি যদিও আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে, তবু দেখতে পাচ্ছি যে, প্রত্যেকের কাজের বিশেষ বিশেষ বিভাগ থাকা খুব দরকার। আমাদের বিশেষ কাজ—বেদান্তপ্রচার। অন্যান্য কাজে সাহায্যও এই এক আদর্শের অনুকূল হওয়া চাই। আশা করি, আপনি এটা সারদানন্দের মনে বদ্ধমূল করে দেবেন।

আপনি অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন কি? … এখানে ইংলণ্ডে সবই যেন আমাদের অনুকূল হয়ে উঠেছে। কাজ যে শুধু জনপ্রিয় হচ্ছে তা নয়, পরন্তু তার সমাদরও বাড়ছে।

আপনাদের স্নেহাধীন
বিবেকানন্দ

৩১০*

[‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার জন্য লিখিত]১১০

লণ্ডন
২৮ অক্টোবর, ১৮৯৬

চিকাগো মহামেলার অঙ্গস্বরূপ ধর্মমহাসভার স্বীয় বিরাট কল্পনা সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য মিঃ সি. বনি ডাঃ ব্যারোজকে সহকারী নিযুক্ত করায় দক্ষতম ব্যক্তির হস্তেই কার্যভার অর্পিত হয়েছিল; আর ডাঃ ব্যারোজের নেতৃত্বে ঐ মহাসভাগুলির অন্যতম ধর্মমহাসভা কিরূপ বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছিল, তা আজ ইতিহাসের বিষয়।

ডাঃ ব্যারোজের অদ্ভুত সাহস, অক্লান্ত পরিশ্রম, অবিচল সহনশীলতা ও ঐকান্তিক ভদ্রতাই এই মহাসভাকে অপূর্ব সাফল্যে মণ্ডিত করেছিল।

বিস্ময়কর চিকাগো মহাসভাকে অবলম্বন করেই ভারত, ভারতবাসী ও ভারতীয় চিন্তা জগৎসমক্ষে আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বলভাবে‍ প্রকটিত হয়েছে এবং আমাদের জাতীয় যা কিছু কল্যাণ হয়েছে, তার জন্য সেই সভার অন্যান্য সকলের তুলনায় ডাঃ ব্যারোজের কাছেই আমরা বেশী ঋণী।

তা ছাড়া, তিনি আমাদের কাছে ধর্মের পবিত্র নাম, মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্যের নাম নিয়ে আসছেন এবং আমার বিশ্বাস—ন্যাজারেথের মহাপুরুষের প্রচারিত ধর্মের সম্বন্ধে তাঁর ব্যাখ্যা অতিশয় উদার হবে এবং আমাদের মনকে উন্নত করবে। ঈশার শক্তির যে পরিচয় ইনি ভারতকে দিতে চান, তা পরমত-অসহিষ্ণু প্রভুভাবাপন্ন ও অপরের প্রতি ঘৃণাপূর্ণ মনোবৃত্তিপ্রসূত নয়। পরন্তু ভ্রাতৃরূপে—ভারতে উন্নতিকামী বিভিন্ন দলের সহকর্মী ভ্রাতৃবর্গের অন্যতমরূপে গণ্য হবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি যাচ্ছেন। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কৃতজ্ঞতা ও আতিথেয়তাই ভারতীয় জীবনের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য; তাই আমার দেশবাসীর কাছে এই বিনীত অনুরোধ—পৃথিবীর অপর দিক্ থেকে আগত এই বিদেশী ভদ্রলোকের প্রতি তাঁরা এমন আচরণ করুন, যেন তিনি দেখতে পান যে, এই দুঃখ দারিদ্র্য ও অধঃপতনের ভেতরেও আমাদের হৃদয় সেই অতীতেরই ন্যায় বন্ধুত্বপূর্ণ আছে, যখন ভারত আর্যভূমি বলে পরিচিত ছিল এবং যখন তার ঐশ্বর্যের কথা জগতের সব জাতের মুখে মুখে ফিরত।

৩১১*

C/o E. T. Sturdy
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২৮ অক্টোবর, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি তোমার ‘ভক্তিযোগ’ ও ‘সর্বজনীন ধর্ম’ পেয়েছি। আমেরিকায় ‘ভক্তিযোগে’র নিশ্চয়ই খুব কাটতি হবে। কিন্তু ইংলণ্ডে স্টার্ডির সংস্করণ আগেই বেরিয়ে যাওয়ায় তোমার বিক্রীর রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে বলে ভয় হয়।

আমি ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ সম্বন্ধে তোমায় পূর্বেই সবিশেষ লিখেছি। ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য একটি গল্প আরম্ভ করেছি; শেষ হলেই তোমায় পাঠিয়ে দেব।

কোন‍্ মাসে ভারতে পৌঁছব, তার এখনও ঠিক নেই। পরে এ সম্বন্ধে লিখব। গতকাল এক বন্ধুভাবাপন্ন সমিতির সভায় নূতন স্বামী১১১ তাঁর প্রথম বক্তৃতা দিলেন। বেশ হয়েছিল এবং আমার ভাল লেগেছিল। তাঁর ভেতর ভাল বক্তা হবার শক্তি রয়েছে—এ বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত।

‘ভক্তিযোগ’টা ‘সর্বজনীন ধর্ম’-এর মত তেমন সুন্দরভাবে ছাপান হয়নি। মলাটে বোর্ড দিলে বইখানি দেখতে বেশ মোটা হত; আর ক্রেতাদের খুশী করবার জন্য অক্ষরগুলি মোটা করা যেত।

ভাল কথা, আমার ‘কর্মোযোগ’খানি যে প্রকাশ করনি, এটা একটা লজ্জার কথা—অথচ আমার পরামর্শ না নিয়ে বইখানির এক অধ্যায় ছেপে নিয়ে আমায় বেকায়দায় ফেলেছ। আরও দেখ, ভারতে বেশী কাটতির জন্য বইগুলি সস্তা হওয়া দরকার। ইচ্ছা করলে তুমি ‘রাজযোগ’খানি ছাপতে পার, আমি ইচ্ছা করেই ওখানার কপিরাইট নিইনি। যখনই ইচ্ছা হবে, তখনই ওর একটা সস্তা সংস্করণ বের করতে পার কিন্তু আমরা হিন্দুরা এত ঢিমে-তেতালা যে, আমাদের কাজ শেষ হতে না হতেই সুযোগ চলে যায়, আর তাতে আমাদের লোকসানই হয়। ছাপার কাজ ইত্যাদিতে তোমাকে চটপটে হতে হবে। তোমার ‘ভক্তিযোগ’ বেরুল বছরখানেক কথা চালানর পরে। তুমি কি বলতে চাও যে, পাশ্চাত্যবাসীরা মহাপ্রলয় পর্যন্ত ওটার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে? এই গড়িমসির ফলে তোমার ঐ বই-এর কাটতি আমেরিকা ও ইংলণ্ডে তিন-চতুর্থাংশ কমে গেছে। তাহলে তো তুমি ‘কর্মযোগ’ ছাপছ না দেখছি; অথচ তোমার ঘাড়ে কি ভূত চেপেছিল যে, তুমি একটা বক্তৃতা ছেপে বসে আছ? ঐ হরমোহন একটা মূর্খ; বই-ছাপান বিষয়ে সে তোমাদের— মান্দ্রাজীদের চেয়েও ঢিলে, আর তার ছাপা একেবারে বীভৎস। বইগুলো ঐভাবে প্রকাশ করার মানে কি? দুঃখের বিষয়, সে গরীব। আমার টাকা থাকলে তাকে দিতাম; কিন্তু ওভাবে ছাপান তো লোক ঠকান—এ রকম করা উচিত নয়।

খুব সম্ভব মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার আর মিস মূলার ও মিঃ গুডউইনকে সঙ্গে নিয়ে আমি ভারতে ফিরব। মিস মূলারকে তো তুমি জানই; সম্ভবতঃ ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার অন্ততঃ কিছুদিন আলমোড়ায় বাস করবার জন্য যাচ্ছেন; আর গুডউইন সন্ন্যাসী হবে। সে অবশ্য আমার সঙ্গেই ভ্রমণ করবে। আমাদের সব বই-এর জন্য আমরা তার কাছে ঋণী। আমার বক্তৃতাগুলি সে সাঙ্কেতিক প্রণালীতে লিখে রেখেছিল, তাই থেকে বই হয়েছে। কিছুমাত্র প্রস্তুতি ছাড়াই মু্হূর্তের প্রেরণায় এ-সকল বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল। অপরেরা হোটেলে বাস করতে চলে যাবে; কিন্তু গুডউইন আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার কি মনে হয়, দেশের লোকেরা এ বিষয়ে বড় বেশী আপত্তি করবে? সে খাঁটি নিরামিষাশী।

তুমি ইচ্ছা করলে আমার ‘জ্ঞানযোগে’র বক্তৃতাগুলি ছাপাতে পার। তবে একটু ভাল করে দেখে দিও। ভাল করে দেখে ছাপান উচিত। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—এখানকার সকলে ভালবাসা জানাচ্ছে। ডাক্তার ব্যারোজ সম্বন্ধে ও তাঁকে কি ভাবে অভ্যর্থনা করা উচিত—এই বিষয়ে একটি ছোট লেখা আমি আজ ‘ইণ্ডিয়ান‍ মিররে’ পাঠিয়েছি। তুমিও তাকে স্বাগত জানিয়ে ‘ব‍্রহ্মবাদিনে’ দু-চারটি মিষ্টি কথা লিখো। ইতি

—বি

৩১২*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

১৪, গ্রেকোট গার্ডেন‍্স‍্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
১ নভেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় মেরী,
‘সোনা, রূপা—এ সব কিছু আমার নেই; তবে যা আমার আছে, তা মুক্তহস্তে তোমায় দিচ্ছি’—সেটি এই জ্ঞান যে, স্বর্ণের স্বর্ণত্ব, রৌপ্যের রৌপত্ব, পুরুষের পুরুষত্ব, নারীর নারীত্ব—এক কথায়, প্রত্যেক বস্তুর যথার্থ স্বরূপ—ব্রহ্ম। এই ব্রহ্মকেই আমরা অনাদিকাল থেকে বহির্জগতে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছি; আর এই চেষ্টার ফলে আমাদের মন থেকে এই সকল অদ্ভুত সৃষ্টি বের হয়ে আসছে, যথা—পুরুষ, নারী, শিশু, দেহ, মন, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জগৎ, ভালবাসা, ঘৃণা, ধন, সম্পত্তি, আর ভূত, প্রেত, গন্ধর্ব, কিন্নর, দেবতা, ঈশ্বর ইত্যাদি।

আসল কথা—এই ব্রহ্ম আমাদের ভেতরেই রয়েছেন এবং আমরাই তিনি (সোঽহং), সেই শাশ্বত দ্রষ্টা, সেই যথার্থ ‘অহম্‌’, যিনি কখনই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন এবং যাঁকে অন্যান্য জিনিষের মত ইন্দ্রিয়গোচর করার চেষ্টা—সময় ও ধীশক্তির অপব্যবহার মাত্র।

যখন জীবাত্মা এ-কথা বুঝতে পারে, তখনই সে এই জগৎ-কল্পনা থেকে নিবৃত্ত হয়, এবং ক্রমশই বেশী করে নিজের অন্তরাত্মার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এরই নাম ক্রমবিকাশ—এতে যেমন শারীরবিবর্তন ক্রমশঃ কমে আসতে থাকে, তেমনই অপরদিকে মন উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপানে উঠতে থাকে; মানুষই পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিকাশ। ‘মনুষ্য’ কথাটি সংস্কৃত ‘মন্’ ধাতু থেকে সিদ্ধ—সুতরাং ওর অর্থ মননশীল অর্থাৎ চিন্তাশীল প্রাণী—কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়গ্রহণশীল প্রাণী নয়। ধর্মতত্ত্বে এই ক্রমবিকাশকেই ‘ত্যাগ’ বলা হয়েছে। সমাজ-গঠন, বিবাহ প্রথার প্রবর্তন, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, সৎকার্য, সংযম এবং নীতি—এগুলি ত্যাগেরই বিভিন্ন রূপ। প্রত্যেক সমাজে জীবন বলতে বুঝায় ইচ্ছা তৃষ্ণা বা বাসনাসমূহের সংযম। জগতে যত সমাজ ও সামাজিক প্রথা দেখা যায়, সে-সব একটি ব্যাপারেরই বিভিন্ন ধারা এবং স্তরমাত্র; সেটি এই—ইচ্ছার বা কল্পিত ‘আমি’র বিসর্জন, এই যে নিজের ভিতর থেকে যেন বাইরে লাফিয়ে যাবার ভাব রয়েছে, জ্ঞাতা (Subject)-কে যে জ্ঞেয় (Object)-রূপে পরিণত করবার একটা চেষ্টা রয়েছে, সেটিরও বিসর্জন। প্রেম এই আত্মসমর্পণ বা ইচ্ছাশক্তি রোধের সর্বাপেক্ষা সহজ এবং অনায়াস-সাধ্য পথ; ঘৃণা তার বিপরীত।

জনসাধারণকে নানারূপ স্বর্গ, নরক ও আকাশের ঊর্ধ্বলোক-নিবাসী শাসনকর্তার গল্প বা কুসংস্কার দ্বারা ভুলিয়ে এই একমাত্র লক্ষ্য আত্মসমর্পণের পথে পরিচালিত করা হয়েছে। কিন্তু জ্ঞানীরা কুসংস্কারের বশবর্তী না হয়ে বাসনা-বর্জনের দ্বারা জ্ঞাতসারেই এই পন্থার অনুবর্তন করেন।

অতএব দেখা যাচ্ছে বাস্তব (Objective) স্বর্গ বা ‘সুখের সহস্র বর্ষে’র (millennium) অস্তিত্ব কেবল কল্পনাতেই রয়েছে; কিন্তু অধ্যাত্ম-স্বর্গ আমাদের হৃদয়ে এখনই বিদ্যমান। কস্তুরীমৃগ (নাভিস্থ) কস্তুরীর গন্ধের কারণ অনুসন্ধানের জন্য অনেক বৃথা ছুটাছুটির পর অবশেষে আপন শরীরেই তার অস্তিত্ব জানতে পারবে।

বাস্তব জগৎ—সর্বদাই ভালমন্দের মিশ্রণরূপে বিদ্যমান থাকবে; আর মৃত্যুরূপ ছায়াও চিরদিন এই পার্থিব জীবনের অনুসরণ করবে; আর জীবন যতই দীর্ঘ হবে, এই ছায়াও ততই দীর্ঘ হবে। সূর্য যখন ঠিক আমাদের মাথার উপর থাকে, কেবল তখনই আমাদের ছায়া পড়ে না—তেমনি যখন ঈশ্বর এবং শুভ ও অন্যান্য সবকিছুই আমাতেই রয়েছে—এই বোধ হয়, তখন আর অমঙ্গল থাকে না। বাস্তবজগতে প্রত্যেক ঢিলটির সঙ্গে পাটকেলটি খেতে হয়—প্রত্যেক ভালটির সঙ্গে মন্দটিও ছায়ার মত আছে। প্রত্যেক উন্নতির সঙ্গে ঠিক সমপরিমাণ অবনতিও সংযুক্ত হয়ে রয়েছে। তার কারণ এই যে, ভাল-মন্দ পৃথক্‌ বস্তু নয়, আসলে এক; পরস্পরের মধ্যে প্রকারগত কোন প্রভেদ নেই, প্রভেদ কেবল পরিমাণগত।

আমাদের জীবন নির্ভর করে অপর উদ্ভিদ প্রাণী বা জীবাণুর মৃত্যুর উপর। আর একটি ভুল আমরা প্রতিনিয়তই করে থাকি—তা এই যে, ভাল জিনিষটাকে আমরা ক্রমবর্ধমান বলে মনে করি, কিন্তু মন্দ জিনিষটার পরিমাণ নির্দিষ্ট বলে ভাবি। তা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত করি যে, প্রত্যহ কিছু কিছু মন্দের ক্ষয় হয়ে এমন এক সময় আসবে, যখন কেবল ভালটিই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু এই অপসিদ্ধান্তটি একটি মিথ্যা যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

জগতে যদি ভালটি বেড়েই চলেছে, তাহলে মন্দটিও বাড়ছে। আমার স্বজাতীয় জনসাধারণের বাসনার চেয়ে আমার নিজের বাসনা অনেক বেড়ে গেছে। তাদের চেয়ে আমার আনন্দ অনেক বেশী—কিন্তু আমার দুঃখও লক্ষগুণ তীব্র হয়ে গেছে। যে শরীরের সাহায্যে তুমি ভালর সামান্যমাত্র সংস্পর্শ অনুভব করতে পারছ, তাই আবার তোমাকে মন্দের অতি সামান্য অংশটুকু অনুভব করাচ্ছে। একই স্নায়ুমণ্ডলী সুখদুঃখ দু-রকম অনুভূতিই বহন করে এবং একই মন উভয়কে অনুভব করে। জগতের উন্নতি বলতে যেমন বেশী সুখভোগ বুঝায়, তেমনি বেশী দুঃখভোগও বুঝায়। এই যে জীবন-মৃত্যু, ভাল-মন্দ, জ্ঞান-অজ্ঞানের সংমিশ্রণ, এই-ই মায়া বা প্রকৃতি। অনন্তকাল ধরে তুমি জগজ্জালের ভেতর সুখের অন্বেষণ করে বেড়াতে পার—তাতে সুখ পাবে অনেক, দুঃখও পাবে অনেক। শুধু ভালটি পাব, মন্দটি পাব না—এ আশা বালসুলভ মূঢ়তা মাত্র।

দুটি পথ খোলা রয়েছে। একটি—(জগতের উন্নতির) সমস্ত আশাভরসা ত্যাগ করে এ জগৎ যেমন চলছে সেভাবেই একে গ্রহণ করা, অর্থাৎ মধ্যে মধ্যে একটু আধটু সুখের আশায় জগতের সমস্ত দুঃখকষ্ট সহ্য করে যাওয়া; অপরটি—সুখকে দুঃখেরই অপর মূর্তি জ্ঞানে একেবারে তার অন্বেষণ পরিহার করে সত্যের অনুসন্ধান করা। যারা এভাবে সত্যের অনুসন্ধান করতে সাহসী, তারা সেই সত্যকে সদা বিদ্যমান এবং নিজের ভেতরেই অবস্থিত বলে দেখতে সমর্থ হয়। তখনই আমরা এও বুঝতে পারি যে, সেই একই সত্য কিভাবে আমাদের বিদ্যা ও অবিদ্যারূপ—এই দুই আপেক্ষিক জ্ঞানের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। আমরা এও বুঝি যে, সেই সত্য আনন্দস্বরূপ এবং তা ভালমন্দ দুইরূপে জগতে প্রকাশিত; আর তার সঙ্গে সেই যথার্থ সত্তাকেও জানি, যা জগতে জীবন ও মৃত্যু উভয়রূপেই আত্মপ্রকাশ করছে।

এইভাবে আমরা অনুভব করব যে, জগতের বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা একটি অদ্বিতীয় সৎ-চিৎ-আনন্দ সত্তার দুই বা বহু ভাগে বিভক্ত প্রতিচ্ছায়া মাত্র—সেটি আমার এবং অন্যান্য যাবতীয় পদার্থের যথার্থ স্বরূপ। কেবল তখনই মাত্র মন্দ না করেও ভাল করা সম্ভবপর; কারণ, এইরূপ আত্মা জানতে পেরেছেন, ভালমন্দ—কি উপাদানে গঠিত; সুতরাং ওটি তখন তার আয়ত্তাধীন। এই মুক্ত আত্মা তখন ভালমন্দ যা খুশী তাই বিকাশ করতে পারেন; তবে আমরা জানি যে ইনি তখন কেবল ভালই করেন। এর নাম ‘জীবন্মুক্তি’ অর্থাৎ শরীর রয়েছে, অথচ মুক্ত—এটিই বেদান্ত এবং অপর সমস্ত দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। ইতি

মানবসমাজ ক্রমান্বয়ে চারটি বর্ণ দ্বারা শাসিত হয়—পুরোহিত (ব্রাহ্মণ), সৈনিক (ক্ষত্রিয়), ব্যবসায়ী (বৈশ্য) এবং মজুর (শূদ্র)। প্রত্যেকটির শাসনকালে রাষ্ট্রে (State) দোষগুণ উভয়ই বর্তমান। পুরোহিত-শাসনে বংশজাত ভিত্তিতে ঘোর সংকীর্ণতা রাজত্ব করে—তাঁদের ও তাঁদের বংশধরগণের অধিকার রক্ষার জন্য চারিদিকে বেড়া দেওয়া থাকে—তাঁরা ছাড়া বিদ্যা শিখবার অধিকার কারও নেই, বিদ্যাদানেরও অধিকার কারও নাই। এ যুগের মাহাত্ম্য এই যে, এ সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হয়—কারণ বুদ্ধিবলে অপরকে শাসন করতে হয় বলে পুরোহিতগণ মনের উৎকর্ষ সাধন করে থাকেন।

ক্ষত্রিয়-শাসন বড়ই নিষ্ঠুর ও অত্যাচারপূর্ণ, কিন্তু ক্ষত্রিয়রা এত অনুদার নন। এ যুগে শিল্পের ও সামাজিক কৃষ্টির (culture) চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়ে থাকে।

তারপর বৈশ্যশাসন-যুগ। এর ভেতরে শরীর-নিষ্পেষণ ও রক্ত-শোষণকারী ক্ষমতা, অথচ বাইরে প্রশান্ত ভাব—বড়ই ভয়াবহ! এ যুগের সুবিধা এই যে, বৈশ্যকুলের সর্বত্র গমনাগমনের ফলে পূর্বোক্ত দুই যুগের পুঞ্জীভূত ভাবরাশি চতুর্দিকে বিস্তৃতি লাভ করে। ক্ষত্রিয়যুগ অপেক্ষা বৈশ্যযুগ আরও উদার, কিন্তু এই সময় সভ্যতার অবনতি আরম্ভ হয়।

সর্বশেষে শূদ্রশাসন-যুগের আবির্ভাব হবে—এ যুগের সুবিধা হবে এই যে, এ সময় শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিস্তার হবে, কিন্তু অসুবিধা এই যে, হয়তো সংস্কৃতির অবনতি ঘটবে। সাধারণ শিক্ষার পরিসর খুব বাড়বে বটে, কিন্তু সমাজে অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশই কমে যাবে।

যদি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারা যায়, যাতে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ-শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ—এই সবগুলি ঠিক ঠিক বজায় থাকবে অথচ এদের দোষগুলি থাকবে না, তাহলে তা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। কিন্তু এ কি সম্ভব?

প্রত্যুত প্রথম তিনটির পালা শেষ হয়েছে—এবার শেষটির সময়। শূদ্রযুগ আসবেই আসবে—এ কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না। সোনা অথবা রুপো—কোন‍্‍টির ভিত্তিতে দেশের মূদ্রা প্রচলিত হলে কি কি অসুবিধা ঘটে, তা আমি বিশেষ জানি না—(আর বড় একটা কেউ জানেন বলে মনে হয় না)। কিন্তু এটুকু আমি বেশ বুঝতে পারি যে, সোনার ভিত্তিতে সকল মূল্য ধার্য করার ফলে গরীবরা আরও গরীব এবং ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ব্রায়ান যথার্থই বলেছেন, ‘আমরা এই সোনার ক্রুশে বিদ্ধ হতে নারাজ। রূপার দরে সব দর ধার্য হলে গরীবরা এই অসমান জীবনসংগ্রামে অনেকটা সুবিধা পাবে। আমি যে একজন সমাজতন্ত্রী (socialist),১১২ তার কারণ এ নয় যে, আমি ঐ মত সম্পূর্ণ নির্ভুল বলে মনে করি, কেবল ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’—এই হিসাবে।

অপর কয়টি প্রথাই জগতে চলেছে, পরিশেষে সেগুলির ত্রুটি ধরা পড়েছে। অন্ততঃ আর কিছুর জন্য না হলেও অভিনবত্বের দিক্ থেকে এটিরও একবার পরীক্ষা করা যাক। একই লোক চিরকাল সুখ বা দুঃখ ভোগ করবে, তার চেয়ে সুখদুঃখটা যাতে পর্যায়ক্রমে সকলের মধ্যে বিভক্ত হতে পারে, সেইটাই ভাল। জগতের ভালমন্দের সমষ্টি চিরকালই সমান থাকবে, তবে নূতন নূতন প্রণালীতে এই জোয়ালটি (yoke) এক কাঁধ থেকে তুলে আর এক কাঁধে স্থাপিত হবে, এই পর্যন্ত।

এই দুঃখময় জগতে সব হতভাগ্যকেই এক-একদিন আরাম করে নিতে দাও—তবেই তারা কালে এই তথাকথিত সুখভোগটুকুর পর এই অসার জগৎ-প্রপঞ্চ, শাসনতন্ত্রাদি ও অন্যান্য বিরক্তিকর বিষয়সকল পরিহার করে ব্রহ্মস্বরূপে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমাদের চিরবিশ্বস্ত ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৩১৩*

১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্‌স্ ওয়েষ্টমিনষ্টার
১১ নভেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
খুব সম্ভব আমি ১৬ ডিসেম্বর রওনা হব; দু-এক দিন দেরীও হতে পারে। এখান থেকে ইতালী যাব এবং সেখানে কয়েকটি জায়গা দেখে নেপল‍্‍সে জাহাজ ধরব। মিস মূলার, মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার এবং গুডউইন নামে একজন যুবক আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। সেভিয়ার দম্পতি আলমোড়াতে বসবাস করতে যাচ্ছেন, মিস মূলারও তাই। মিঃ সেভিয়ার ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে পাঁচ বৎসর অফিসার ছিলেন; সুতরাং তিনি ভারত সম্বন্ধে অনেকটা পরিচিত। মিস মূলার থিওসফিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং অক্ষয়কে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন। গুডউইন একজন ইংরেজ যুবক; এরই সাঙ্কেতিক লেখা থেকে আমার পুস্তিকাগুলি বের করা সম্ভব হয়েছে।

কলম্বো থেকে আমি প্রথমে মান্দ্রাজে পৌঁছব। অন্য সকলে স্বতন্ত্রভাবে আলমোড়া চলে যাবেন। মান্দ্রাজ থেকে আমি সোজা কলিকাতা যাব। যাত্রারম্ভে আমি তোমাকে সঠিক সংবাদ দেব। ইতি

তোমাদের স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনশ্চঃ—‘রাজযোগে’র প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। ভারত ও আমেরিকাতেই সব চেয়ে বেশী কাটতি।

৩১৪*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

গ্রেকোট গার্ডেন্‌স্ ওয়েষ্টমিনষ্টার
১৩ নভেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় বুল,
… আমি অতি শীঘ্রই, খুব সম্ভব ১৬ ডিসেম্বর, ভারতবর্ষ যাত্রা করছি। পুনরায় আমেরিকা যাবার পূর্বে আমার একবার ভারতবর্ষ দেখবার বিশেষ ইচ্ছা আছে, এবং আমি কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি; তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।

… আমি অতি শীঘ্রই, খুব সম্ভব ১৬ ডিসেম্বর, ভারতবর্ষ যাত্রা করছি। পুনরায় আমেরিকা যাবার পূর্বে আমার একবার ভারতবর্ষ দেখবার বিশেষ ইচ্ছা আছে, এবং আমি কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি; তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।

ভবদীয়
বিবেকানন্দ