গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

২০. নরকের দ্বার

বিংশ পরিচ্ছেদ – নরকের দ্বার

দিনটা আলস্য ও কর্মহীনতার মধ্য দিয়া কাটিয়া গেল।

কোদণ্ড মিশ্র প্রভাতেই স্নানাদি সমাপন করিয়া কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছিলেন। বৃদ্ধের জীর্ণ শরীরে কর্মপ্রেরণা শতগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছিল। বজ্র শূন্য কুটিরে কিয়ৎকাল বসিয়া রহিল, তারপর আলস্য ভঞ্জন করিয়া বাহির হইল। তাহার মনের অবস্থা এখন স্তিমিত; সে যেন বিবাহের বর; তাহাকে ঘিরিয়া সকল তৎপরতা, অথচ সে নিজে নিষ্ক্রিয়।

বজ্র বাহিরে আসিয়া কাল রাত্রে যেদিক হইতে আসিয়াছিল সেইদিকে চলিল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট কুটির, তাহার চারিপাশে শাক কন্দ ফল ফুলের উদ্যান। কুটিরগুলিতে মানুষ নাই, বোধহয় সকলেই কর্ণসুবর্ণে হাটে গিয়াছে। ইহাদের গৃহে চুরি করিবার মত তৈজস কিছু নাই, তাই তাহাদের মনেও কোনও দুশ্চিন্তা নাই।

এইরূপ কয়েকটি গৃহের পরে একটি কুটিরের সম্মুখীন হইয়া বজ্র গঙ্গাকে দেখিতে পাইল। গঙ্গা দাওয়ায় বসিয়া পায়ের উপর সলিতা পাকাইতেছিল, হাসিমুখে বজ্রকে অভ্যর্থনা করিল। বলিল— ‘এস। আয়ি এক কাঁদি কলা আর ইঁচড় নিয়ে কানসোনায় বেচতে গেছে। এখুনি আসবে।’

গঙ্গা দাওয়ায় পাটি বিছাইয়া দিল; ধামিতে করিয়া এক ধামি মুড়ি ও গুড় আনিয়া বজ্রকে খাইতে দিল, উঠানের লতা হইতে ক্ষীরিকা পাড়িয়া দিল। বজ্র পরম তৃপ্তির সহিত মুড়ি চিবাইতে লাগিল।

গঙ্গার আজ আর শঙ্কা সঙ্কোচ নাই, সে সলিতা পাকাইতে পাকাইতে গল্ গল্ করিয়া কথা বলিতে লাগিল; আর থাকিয়া থাকিয়া বজ্রের অঙ্গদের পানে বিমুগ্ধ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। বজ্র তাহা দেখিয়া বলিল— ‘দেখবে?’ বলিয়া অঙ্গদটি খুলিয়া তাহার হাতে দিল।

গঙ্গা যেন স্বর্গ হাতে পাইল। দুই চক্ষে আনন্দ এবং সম্ভ্রম ভরিয়া সে অঙ্গদটি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে লাগিল। অনেকক্ষণ দেখিবার পর গভীর পরিতৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিয়া অঙ্গদ বজ্রকে ফিরাইয়া দিল। বজ্র লক্ষ্য করিল, গঙ্গার মুখে ক্ষণেকের জন্যও লোভ বা গৃধ্নুতা প্রকাশ পাইল না। যাহাদের কিছুই নাই তাহারাই বোধকরি নির্লোভ হইতে পারে।

আয়ি বুড়ি ফিরিয়া আসিল। কলা ও ইঁচড় বিক্রি করিয়া সে কাঁকড়া কিনিয়াছে; ঘটা করিয়া অতিথির জন্য পঞ্চ ব্যঞ্জন রাঁধিতে বসিল। কাঁকড়া কুটিতে বসিয়া গঙ্গার আহ্লাদের সীমা নাই।

দ্বিপ্রহরে বজ্র ভাগীরথীতে স্নান করিয়া আসিল। তারপর উদর পূর্ণ করিয়া বুড়ির রান্না অতি মুখরোচক অন্নব্যঞ্জন গ্রহণ করিল।

আহারের পর হরীতকী চর্বণ করিতে করিতে বজ্র কোদণ্ড মিশ্রের কুটিরে ফিরিয়া গেল, দেখিল তিনি এখনও আসেন নাই। সে নল-পাটি পাড়িয়া শয়ন করিল। কাল রাত্রে জাগরণ গিয়াছে, তাহার চক্ষু মুদিয়া আসিল। ক্রমে সে অশান্ত অর্ধনিদ্রায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।

যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল তখন দিন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। বজ্র দেহের জড়িমা দূর করিয়া বাহিরে আসিল। কোদণ্ড মিশ্রের দেখা নাই। তিনি এখনও ফিরিয়া আসেন নাই, কিম্বা হয়তো ফিরিয়াছিলেন, আবার বাহির হইয়াছেন; বজ্র ঘুমাইয়াছিল তাই জানিতে পারে নাই।

বজ্র অনিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণ ইতস্তত করিল, তারপর ভাগীরথীর তীর ধরিয়া ভ্রমণে বাহির হইল। নিশ্চেষ্টভাবে কুটিরে বসিয়া থাকিয়া লাভ নাই।

সে উত্তরমুখে চলিল। এখানে জনবসতি অধিক নাই, স্থানে স্থানে দুই চারিটি বিচ্ছিন্ন কুটির। শূন্য তীর ধরিয়া চলিতে চলিতে সে ক্রমে ময়ূরাক্ষী ও ভাগীরথীর সঙ্গমস্থলে উপস্থিত হইল। ময়ূরাক্ষীর ধারা ভাগীরথীর তুলনায় সঙ্কীর্ণ, কিন্তু যেস্থানে দুই স্রোত মিলিত হইয়াছে সে স্থান তরঙ্গ সমাকুল। গত রাত্রে বজ্র এই স্রোত অন্ধকারে পার হইয়াছিল।

এই সঙ্গমস্থলের অপর পারে কোণের উপর বহু শিখরযুক্ত তুঙ্গ রাজপ্রাসাদ। এদিকটা প্রাসাদের পশ্চাদভাগ। দুই দিক হইতে উচ্চ প্রাকার আসিয়া নদীর কিনারায় দুইটি বিপুল স্তম্ভে পরিণত হইয়াছে, মাঝের অবকাশ স্থলে অবরোধের স্নান-ঘাট। সারি সারি দীর্ঘ সমান্তরাল সোপান উচ্চ সৌধতল হইতে নামিয়া নদীগর্ভে নিমজ্জিত হইয়াছে।

বজ্র দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল। দুই তীরের মাঝখানে অনুমান তিন চারি রজ্জুর ব্যবধান। অস্তমান সূর্যের তির্যক আলোকে প্রাসাদ ও ঘাট স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। প্রাসাদ যেন সুপ্ত, কোথাও কর্মচঞ্চলতা নাই; ঘাটে কয়েকটি পুরনারী জলে নামিয়া গা ধুইতেছে। আসন্ন দু্র্যোগের কোনও পূর্বাভাস সেখানে নাই।

বজ্র ময়ূরাক্ষীর তীর ধরিয়া আবার চলিতে লাগিল। কিন্তু তাহার দৃষ্টি পরপারে প্রাসাদের উপর ন্যস্ত হইয়া রহিল। তাহার অন্তরে কোনও বিপুল হৃদয়াবেগ উত্থিত হইল না, কেবল নির্লিপ্ত শ্লথ চিন্তার ক্রিয়া চলিতে লাগিল; তাহার পিতামহের রচিত ঐ রাজপুরী…কোদণ্ড মিশ্রের চেষ্টা সার্থক হইবে কি?…কপর্দকহীন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একটা রাজ্য ওলট-পালট করিয়া দিবে…ইহা কি সম্ভব? না ইহা স্বপ্ন?—

রাজপুরী পিছনে পড়িয়া রহিল, বজ্র খেয়াঘাটের নিকট উপস্থিত হইল। এখানে খেয়াঘাটের আশেপাশে জনবসতি অধিক। খেয়াতরী যাত্রীদের পারাপার করিতেছে; ওপারেও ক্ষুদ্র একটি খেয়াঘাট। বজ্র অদূরে উচ্চ পাড়ের উপর এক বৃক্ষতলে বসিয়া দেখিতে লাগিল। দর্শনীয় কিছু নয়; তবু তৃপ্ত মনে বসিয়া দেখা যায়।

অল্পকাল পরে সূর্যাস্ত হইল। খেয়ার মাঝি নৌকা বাঁধিয়া প্রস্থান করিল। ঘাট শূন্য হইয়া গেল।

বজ্র উঠিয়া আবার নদীতীর ধরিয়া ফিরিয়া চলিল। রাজপ্রাসাদের সমান্তরালে আসিয়া দেখিল যেখানে প্রাসাদ ছিল সেখানে পিণ্ডীভূত অন্ধকার। সেই অন্ধকারের জঠর হইতে দুই চারিটি বর্তিকার ক্ষীণ রশ্মি নদীবক্ষে প্রতিবিম্ব ফেলিয়া কাঁপিতেছে।

বজ্র যখন কোদণ্ড মিশ্রের কুটির সম্মুখে ফিরিয়া আসিল তখন দিবালোক সম্পূর্ণ লুপ্ত হইয়াছে। কোদণ্ড মিশ্র ফিরিয়াছেন, কুটির কক্ষেই আছেন; বদ্ধ দ্বারের ফাঁকে আলো দেখা যাইতেছে।

বজ্র দাওয়ায় উঠিয়া ঘরের মধ্যে মৃদু জল্পনার শব্দ শুনিতে পাইল। সে দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া পড়িল— হয়তো কোনও গূঢ়-পুরুষ আসিয়াছে। বজ্র একটু দ্বিধা করিল, তারপর দ্বারের ফাঁক দিয়া তাহার দৃষ্টি ভিতরে প্রবেশ করিল। সেখানে কোদণ্ড মিশ্রের সম্মুখে যাহাকে বসিয়া থাকিতে দেখিল তাহাতে সে বিস্ময়ে পিছাইয়া আসিল।

কুহু! কোদণ্ড মিশ্রের সহিত মুখোমুখি বসিয়া কুহু কথা কহিতেছে! তাহার অঙ্গ ঘিরিয়া নীল রঙের ঊর্ণা, কিন্তু চিনিতে কষ্ট হয় না— সেই মিষ্ট-দুষ্ট হাসিভরা মুখ! কুহু কোথা হইতে আসিল? কোদণ্ড মিশ্রের সহিত তাহার কী সম্বন্ধ?

দ্বারের বাহিরে নির্বাক দাঁড়াইয়া বজ্র শুনিতে পাইল, কোদণ্ড মিশ্র বলিতেছেন— ‘এই লিপি নাও, অর্জুনসেনকে আজ রাত্রেই দিও। আর মুখে বোলো, সমস্ত প্রস্তুত; অমাবস্যার তিথি যেন ভ্রষ্ট না হয়।’

কুহু বলিল— ‘বলব। — অমাবস্যা কবে?’

‘পরশু। সেই রাত্রির মধ্যযামে—’

‘যে আজ্ঞা। আজ তাহলে উঠি। ফিরতে দেরি করলে রানী সন্দেহ করবে।’

‘স্বস্তি।’

কুহু সন্তর্পণে দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিল। তারপর বজ্রকে দেখিয়া সেও বজ্রাহতবৎ চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দুইজনেই হতবাক্।

এই সময় ঘরের ভিতর হইতে কোদণ্ড মিশ্রের কণ্ঠস্বর আসিল— ‘কে? বাহিরে কে?’

বজ্র চমকিয়া বলিল— ‘আমি বজ্র।’

‘এস বৎস, ভিতরে এস।’

বজ্র দ্বিধাভরে দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলে কুহু চকিতে হাত তুলিয়া কি যেন ইশারা করিল, তারপর বাহিরের অন্ধকারে মিলাইয়া গেল।

ঘরে প্রবেশ করিয়া বজ্র কোদণ্ড মিশ্রের সম্মুখে উপবিষ্ট হইল। বৃদ্ধের মুখে চোখে তীব্র উত্তেজনা, শুষ্ক দেহে তিলমাত্র অবসাদ নাই। তিনি নিম্নকণ্ঠে আজিকার সমস্ত দিনের কর্মতৎপরতা বজ্রকে শুনাইতে লাগিলেন। কর্ণসুবর্ণে এখনও অনেক ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আছে যাহারা বর্তমান রাজারানীর কুক্রিয়া ও জঘন্য জীবনযাত্রায় উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে। শশাঙ্কদেবের বংশধর সিংহাসনে বসিলে তাহারা আনন্দিত হইবে, সহায়তাও করিবে। ব্যবস্থা সমস্তই প্রস্তুত। অমাবস্যার রাত্রে অগ্নিবর্মার নারকীয় জীবন শেষ হইবে। পরদিন প্রাতে কোকবর্মার সৈন্যগণের সাহায্যে বজ্র রাজপুরী অধিকার করিবে। নগরে শাসন-ডিণ্ডিম প্রচারিত হইবে; অগ্নিবর্মার মৃত্যু এবং বজ্রদেবের অভিষেক ঘোষিত হইবে। কোকবর্মা যাহা চায় তাহা লইয়া নিজের দেশে চলিয়া যাইবে। দুই শত বাছাই করা খস্ যোদ্ধা সংগ্রহ হইয়াছে, তাহারা রাজপুরী রক্ষা করিবে। কোদণ্ড মিশ্র তখন নিশ্চিন্ত হইয়া নূতন শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত করিবেন। দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিবে।

বজ্র মনোযোগ দিয়া শুনিল, কিন্তু মনের মধ্যে কোনও প্রকার তীব্র আগ্রহ অনুভব করিল না। তাহাকে সিংহাসনে বসাইবার জন্য এত উদ্যোগ আয়োজন, অথচ তাহার অন্তর যেন এই জটিলতা-কুটিলতায় সায় দিতেছে না। পিতা-পিতামহের সিংহাসন তাহার প্রাপ্য, সে তাহা চায়। কিন্তু রাষ্ট্রনীতির কূটচক্রান্ত, বিষপ্রয়োগে নরহত্যা, সে স্বচ্ছন্দ মনে গ্রহণ করিতে পারিতেছে না। ইহা অপেক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তস্রোত প্রবাহিত করিয়া এ প্রশ্নের মীমাংসা হইলে সে অধিক সুখী হইত।

কিন্তু মনের সূক্ষ্ম ভাবনা মুখে প্রকাশ করিতে সে অভ্যস্ত নয়। প্রকাশ করিয়াই বা লাভ কি। সে শুধু জিজ্ঞাসা করিল— ‘আমার কর্তব্য কিছু আছে কি?’

কোদণ্ড মিশ্র বলিলেন— ‘উপস্থিত কিছু না। তুমি কেবল অমাবস্যার রাত্রি পর্যন্ত নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখবে, আর কোনও কর্তব্য নেই। আমার ঘরে এখন অনেক লোকের যাতায়াত হবে, তোমার এখানে না থাকাই ভাল। তুমি আয়ি বুড়ির ঘরে থাকবে।’

আরও দুই চারি কথার পর বজ্র বাহিরে আসিল। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র ফুটিয়াছে, নিম্নে কুটিরগুলিতে মৃৎ-প্রদীপের ক্ষুদ্র শিখা। বজ্র অন্যমনে আয়ি বুড়ির কুটিরের দিকে পা বাড়াইয়াছে এমন সময় একজন আসিয়া তাহার হাত ধরিল।

‘মধুমথন!’

‘কুহু!’

কুহু এতক্ষণ বাহিরের অন্ধকারে লুকাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। বজ্র তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল— ‘তুমি এখানে?’

কুহু প্রতিধ্বনি করিল— ‘তুমি এখানে?’

বজ্র সংক্ষেপে নিজের নদীসন্তরণ কাহিনী বলিল, তারপর প্রশ্ন করিল— ‘কিন্তু কোদণ্ড মিশ্রের কাছে তুমি এলে কি করে? তাঁর সঙ্গে তোমার কী সম্বন্ধ?’

কুহু বলিল— ‘আছে, পরে বলব। কাল আমি মদিরাগৃহে গিয়েছিলাম। দেখলাম, দোর বন্ধ, কেউ নেই। কী দুঃখ যে হয়েছিল!’

বজ্র লক্ষ্য করিল কুহু হাত ধরিয়া তাহাকে একদিকে লইয়া যাইতেছে। সে বলিল— ‘কোথায় যাচ্ছ?’

কুহু বলিল— ‘চল, আমাকে রাজপুরীতে পৌঁছে দেবে।’

‘কিন্তু— খেয়া তো বন্ধ। নদী পার হতে কি করে?’

‘আমার উপায় আছে। এস।’

কুহু তাহার বাহুর সহিত বাহু জড়াইয়া লইল। দুইজনে নক্ষত্রবিদ্ধ অন্ধকারের ভিতর দিয়া চলিল।

খেয়াঘাটে খেয়াতরীর পাশে একটি মোচার খোলার মত ছোট্ট ডিঙি বাঁধা আছে। এটি অবরোধের নারীদের ব্যবহার্য ডিঙি, ঘাটের এক কোণে স্তম্ভের গায়ে অর্ধনিমজ্জিত হইয়া বাঁধা থাকে; পুরীর দাসীরা প্রয়োজন হইলে ব্যবহার করে। কুহু ও বজ্র সেখানে উপস্থিত হইলে কুহু বলিল— ‘তুমি আগে ওঠ। বৈঠা ধর।’

বজ্র উঠিয়া বসিয়া বৈঠা করিল। কুহু পিছনের গলুইয়ে উঠিয়া বাঁধন খুলিয়া দিল। বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘রাজপুরী কোন দিকে? কিছুই যে দেখা যাচ্ছে না।’

কুহু বলিল— ‘ভাবনা নেই, দু’বার দাঁড় টেনে স্রোতের মুখে ডিঙি ছেড়ে দাও, আপনি রাজপুরীর ঘাটে গিয়ে লাগবে।’

বজ্র তাহাই করিল। আঁধারে ডিঙি ভাসিয়া চলিল।

এতক্ষণে বজ্র অন্তরের মধ্যে একটা সহর্ষ উত্তেজনা অনুভব করিতে লাগিল। অসংখ্য অপরিচিত ব্যক্তির ভিড়ের মধ্যে ঘুরিতে ঘুরিতে সে যেন হঠাৎ একান্ত আপনার জনকে খুঁজিয়া পাইয়াছে। মনের আনন্দে হাসিয়া উঠিয়া সে বলিল— ‘কুহু, তোমার সঙ্গে যে আবার দেখা হবে তা একবারও ভাবিনি।’

কুহু বলিল— ‘আমিও না। — কিন্তু ঘাট এসে পড়েছে।’

ঘাটের পাষাণে ডিঙি ঠেকিল। দুইজনে অবতরণ করিল। কুহু স্তম্ভের গায়ে লোহার আংটায় ডিঙি বাঁধিল, তারপর আসিয়া বজ্রের হাত ধরিল।

বজ্র বলিল— ‘এবার আমি ফিরে যাই?’

কুহু বজ্রের কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল— ‘মহারাজ বজ্রদেব, আজ আপনাকে ছাড়ব না। দাসীর ঘরে পায়ের ধুলো দিতে হবে।’

মহারাজ বজ্রদেব! এই সম্বোধন শুনিয়া বজ্র যেন ক্ষণেকের জন্য মন্ত্রমূঢ় হইয়া গেল। কুহু হাত ধরিয়া তাহাকে রাজপুরীর মধ্যে লইয়া চলিল।