ধৃতরাষ্ট্রসমীপে নারদের রাজর্ষি-স্বর্গবর্ণন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর নারদ, পর্ব্বত, দেবল, পরমধাৰ্ম্মিক রাজর্ষি শতযূপ এবং শিষ্যপরিবৃত মহর্ষি দ্বৈপায়ন ও অন্যান্য সিদ্ধগণ ইঁহারা সকলেই অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাঁহার সমীপে সমাগত হইলেন। ভোজনন্দিনী কুন্তী তাঁহাদিগকে দর্শন করিবামাত্র যথানিয়মে তাঁহাদিগের পূজা করিলেন। তখন তাঁহারা তাঁহার পরিচর্য্যায় পরম পরিতুষ্ট হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের চিত্তবিনোদনার্থ বিবিধ বিষয়ক কথোপকথন করিতে লাগিলেন।
ঐ সময় তত্ত্বদর্শী দেবর্ষি নারদ কথাপ্রসঙ্গে অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “রাজন্! শতকূপের পিতামহ নির্ভীকচিত্ত নরপতি সহস্রচিত্ত কেকয়দেশের অধিপতি ছিলেন। তিনি বৃদ্ধাবস্থায় পরমধার্ম্মিক স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া বনপ্রবেশ করেন। তথায় ঘোরতর তপশ্চরণদ্বারা তাঁহার ইন্দ্রলোকলাভ হইয়াছে। আমি ইন্দ্রলোকে গমনাগমন সময়ে অনেকবার তাঁহাকে দেবেন্দ্রসদনে নিরীক্ষণ করিয়াছি। ভগদত্তের পিতামহ রাজা শৈবলেয়ও তপোবলে ইন্দ্রলোক লাভ করিয়াছেন। ইন্দ্রপ্রতিম মহারাজ পৃষধ্র তপঃপ্রভাবে স্বর্গারূঢ় হইয়াছেন। সরিদ্বরা নর্ম্মদা যাঁহার সহধর্ম্মিণী হইয়াছিলেন, সেই মান্ধাতৃতনয় নরপতি পুরুকুৎস এবং পরমধার্ম্মিক রাজা শশলোমা ইঁহারা উভয়ে এই তপোবনে তপানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক স্বর্গে গমন করিয়াছেন। এক্ষণে তুমিও এই তপোবনে তপানুষ্ঠান কর; অচিরাৎ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়নের প্রসাদবলে সিদ্ধিলাভ করিয়া অনায়াসে গান্ধারীর সহিত ঐ সকল মহাত্মার সালোক্য[সমান লোক—একত্র বাস]লাভে সমর্থ হইবে। ইন্দ্রলোকগত নরপতি পাণ্ডু নিয়ত তোমার অনুধ্যান করিতেছেন। তিনি অবশ্যই তোমার মঙ্গলসাধন করিবেন। ভোজনন্দিনী কুন্তী তোমার ও যশস্বিনী গান্ধারীর শুশ্রূষানিবন্ধন নিশ্চয়ই স্বামীর সালোক্যলাভে সমর্থ হইবেন। মহাত্মা বিদুর অচিরাৎ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরে প্রবেশ এবং মহামতি সঞ্জয় ইহলোক হইতে স্বর্গলোকে গমন করিবেন। আমি দিব্যচক্ষুঃপ্রভাবে এই সমুদয় বিষয় অবগত হইয়াছি।”
ধৃতরাষ্ট্রের ভাবী স্বর্গলোলাভানন্দ
দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিলে, কৌরবেন্দ্র ধৃতরাষ্ট্র পত্নীর সহিত যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া পরমসমাদরে তাঁহার পূজা করিলেন। ব্রাহ্মণগণও মহা আহ্লাদিত হইয়া দেবর্ষি নারদকে প্রশংসা করিতে লাগিলেন। এই সময় রাজর্ষি শতযূপ নারদকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “দেবর্ষে! আপনার বাক্য শ্রবণে আপনার প্রতি আমার, কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের ও অত্ৰত্য অন্যান্য ব্যক্তিগণের শ্রদ্ধা পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। আপনি তত্ত্বদর্শী। মানবগণ যে যেরূপ গতিলাভ করিবে, আপনি দিব্যচক্ষুঃপ্রভাবে তৎসমুদয় অবলোকন করিতেছেন। আপনি অনেক নরপতির স্বর্গলোকলাভের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলেন; কিন্তু কৌরবেন্দ্র ধৃতরাষ্ট্র কোন্ সময়ে কোন্ লোকে গমন করিবেন, তাহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইতেছে, অতএব আপনি উহা কীৰ্ত্তন করুন।”
রাজর্ষি শতযূপ এই কথা কহিলে, দিব্যদর্শী দেবর্ষি নারদ, সেই সভামধ্যে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “রাজন্! আমি একদা ইন্দ্রের সভায় সমুপস্থিত হইয়া তথায় পাণ্ডুরাজকে সমাসীন দেখিয়া আসন পরিগ্রহ করিলাম। অনন্তর ঐ সভামধ্যে কথাপ্রসঙ্গে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ঘোরতর তপস্যার কথা উত্থিত হইল। তখন আমি স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের মুখে শুনিলাম যে, ধৃতরাষ্ট্রের আর তিন বৎসর পরমায়ু আছে। তৎপরে তিনি গান্ধারীর সহিত দিব্য-অলঙ্কারে বিভূষিত হইয়া দিব্যবিমানে আরোহণপূর্ব্বক কুবেরভবনে আগমন করিয়া স্বেচ্ছানুসারে দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব ও রাক্ষসদিগের লোকে সঞ্চরণ করিবেন। হে শতযূপ! এই আমি তোমার জিজ্ঞাসানুসারে দেবগুহ্য বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম। তুমি তপঃপ্রভাবে নিষ্পাপ হইয়াছ, এই নিমিত্তই আমি এই গৃঢ় বিষয় তোমার নিকট প্রকাশ করিলাম।”
দেবর্ষি এই কথা কহিলে, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও শতযূপ প্রভৃতি অন্যান্য ব্যক্তিগণ তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া একেবারে আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। এইরূপে নারদ প্রভৃতি মহর্ষিগণ বিবিধ কথাপ্রসঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রকে পরিতুষ্ট করিয়া সকলে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।