২০. ঝ
পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত চোখের পলকে ঘটে গেল, যে প্রথমটা কেউ বুঝে উঠতেই পারল না। তারপর, অত্যন্ত হিংস্র একটা অভিব্যক্তি সহকারে পোয়ারো জানালার দিকে ছুটল। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ওকে অনুসরণ করলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই ওরা দুজনে একটা নিথর পুরুষ শরীরকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। আরাম কেদারায় শরীরটাকে শুইয়ে দেবার পর, মুখটা দৃশ্যমান হতেই, আমার মুখ দিয়ে প্রায় একটা আর্ত চিৎকার ঠিকরে বের হয়ে এল, সেই মুখটা, জানালার সেই মুখটা। সাদাটে, দুর্বলতা মাখা, ফ্যাকাশে, প্রায় আধিভৌতিক একটা মুখ, যেন একটা মুখোশ। একবার দেখলেই যা মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। লোকটার মাথার পাশ দিয়ে রক্তের একটা ধারা নেমেছে। ফ্রেডরিকা ধীর পায়ে এগিয়ে চেয়ারে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
আপনি আহত মাদাম। পোয়ারো ওকে বাধা দিয়ে বলে-কিছু না। গুলিটা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। সামান্য ব্যাপার।
নীচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে সে লোকটার মাথায় হাত রাখে। লোকটা এবার চোখ খোলে, ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মানুষটার ঠোঁট দুটো বার কয়েক কেঁপে ওঠে, আশা করি তোমার জন্যে এবার আমি পেরেছি করতে। ফিসফিসিয়ে বলে সে। তারপরই, হঠাৎ তার গলার স্বর বদলে যায়, ওহ্ ফ্রেডি, আমি এরকমভাবে বলতে চাইনি, তুমি সবসময় এত ভাল ব্যবহার করেছ আমার সঙ্গে। প্রায় শিশুর স্বরে সে বলে।
ঠিক আছে, এটা কোন ব্যাপার নয়। লোকটির পাশে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ফ্রেডরিকা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আমি এভাবে……….. কথাটা শেষ হয় না। লোকটার মাথাটা একপাশে হেলে যায়। ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকায়।
হ্যাঁ, ম্যাডাম উনি মারা গেছেন। শান্ত গলায় বলে সে।
ফ্রেডরিকা অনুত্তেজিত, ধীর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। একটা হাত লোকটার কপালে চুঁইয়ে রেখে গভীর দুঃখের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বুক চেরা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাদের দিকে, ঘরের অন্য সবার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আমার স্বামী। শান্ত ভঙ্গিতে বলে।
ঝ’ আমার মুখ দিয়ে প্রায় অজান্তেই বের হয়ে আসে। পোয়ারো দ্রুত আমার মন্তব্যটাকে ধরে নেয় হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ধীর শান্ত গলায় বলে প্রথম থেকেই আমি বলে আসছিলাম, কেউ একজন, ঝ’ নিশ্চয়ই আছে এইসব কিছুর মধ্যে বলিনি?
উনি আমার স্বামী। আবার বলে ফ্রেডরিকা। ভঙ্গিতে ক্লান্তি। লাজারুমের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় হেলান দিয়ে এলিয়ে বসে সে। গভীর একটা শ্বাস ছাড়ে এবার সব কথা খুলে বলবার সময় হয়েছে। এখনি।
আমার স্বামী ছিল এক ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ। মাদকাসক্ত। ও-ই আমাকে ড্রাগ নেওয়া ধরায়। ওকে ছেড়ে আসবার পর থেকেই অভ্যাসটা ছাড়বার জন্যে আমি লড়াই করছি। শেষ পর্যন্ত, আমি প্রায় সেরে উঠছি। কিন্তু ওহ ব্যাপারটা কি কঠিন, প্রাণান্তকর। কেউ বুঝবে না সেটা কি কঠিন ব্যাপার। আমি কখনও, কোনদিন ওকে ছেড়ে আসতে, পালিয়ে সরে আসতে পারতাম না। সবসময় ও আমাকে ভয় দেখাত, টাকার দাবি করত, তারপর আমাকে গুলি করে মারবার, খুন করবার হুমকি দিত। ওর কোন দোষ নেই অবশ্য তাতে ও পুরোপুরিই মানসিক অসুস্থ ছিল। বিকৃত মস্তিষ্ক। একটু থেমে মাথা নীচু করে কি যেন ভেবে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে সে আমার ধারণা ম্যাগি বার্কলিকে ও-ই গুলি করেছিল। নিশ্চিতভাবেই, ওকে মারতে চায়নি। আমাকে ভেবেই গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল। প্রথমে আমি ধরেই নিয়েছিলাম নিককে হত্যার চেষ্টাগুলো আমার স্বামীই করছে। তারপর বুঝি, না, বোধহয় ওগুলো অন্য কারও কাজ। তারপর, হঠাৎ একদিন মঁসিয়ে পোয়ারোর টেবিলে একটা ছেঁড়া, দুমড়ানো কাগজে অতি পরিচিত একটা হাতের লেখা দেখতে পাই। আমাকে লেখা ওর চিঠির অংশ ছিল সেটা। তখনি আমি বুঝে যাই, মঁসিয়ে পোয়ারো সঠিক রাস্তাতে হাঁটতে শুরু করেছেন, এবং এরপর, সবকিছু প্রকাশিত হয়ে পড়াটা শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।
আবার একটু থামে ফ্রেডরিকা। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে কিছুটা প্রশ্ন বা কৌতূহলের ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে কিন্তু চকোলেটের ব্যাপারটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আমি কখনই কোনভাবে নিককে বিষ দেবার চেষ্টা করিনি। দুহাতে এবার নিজের মুখ ঢেকে ফেলে সে। হৃদয়বিদারক গলায় বলে ব্যাস, এইটুকুই। আর কিছু বলার নেই আমার।
.
২১.
এবং সেই ব্যক্তিটি, ‘ত’
লাজারুম সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তার পাশে গিয়ে বসে বলে প্রিয়তমা? আমার প্রিয়তমা। পোয়ারো সেলারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এক গ্লাস ব্র্যান্ডি এনে ফ্রেডির হাতে তুলে দেয়। ফ্রেডি চুমুকে গ্লাস শেষ করে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসে তাহলে এখন? সে এবার জেপের দিকে তাকায়। জেপ এবার মাথা নাড়ে। যা করবার সেন্ট-লু পুলিশই করবে।
নিক আর্তস্বরে বলে মিঃ পোয়ারো ব্যাপারটাকে আমাদের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলা যায় না?
আপনি তাই চাইছেন মাদাম জোয়েল?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আর আমার ওপর নিশ্চয়ই আক্রমণ হবে না। তাই এসবের মধ্যে পুলিশকে না জড়ালেই নয় কি?
না, এটা সত্যি, আপনার ওপর আর আক্রমণ হবার সম্ভাবনা নেই। তবুও……..
আমি জানি। আপনি ম্যাগির কথা ভাবছেন। কিন্তু মিঃ পোয়ারো, আর কোন কিছুই তো ম্যাগিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। শুধু শুধু ফ্রেডরিকাকে বিরাট একটা অপপ্রচারের মধ্যে টেনে এনে লাভ কি? বেচারার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এমনিতেই সারা জীবন প্রচুর কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা। অনেক যন্ত্রণা পেয়েছে। আপনি শুনছেন ওনার এসব প্রাপ্য নয়?
পোয়ারো ঠাণ্ডা গলায় বলে নিশ্চয়ই নয়। স্বামী-হিসাবে লোটা একটা অপদার্থ, জঘন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল। আপনারা আজ নিজের চোখেই তো দেখলেন কেমন চরিত্রের মানুষ ছিল সে। লোকটা মারা গেছে। ব্যাপারটাকে এখানেই শেষ করে দিন। পুলিশ ম্যাগির খুনিকে খুঁজুক। ওরা কোনদিনই তাকে খুঁজে পাবে না।
পোয়ারো এবার এলিনের দিকে ঘুরে তাকায়–তোমার কিছু বলার আছে?
দিব্যি করে বলছি আমার সন্তানের নামে, এ বিষয়ে আমি বা উইলিয়াম আমরা স্বামী-স্ত্রী কোন দিন, কখনো, কারো কাছে একটা শব্দও উচ্চারণ করব না।
পোয়ারো এবার ঘরের অন্য সবার দিকে এক এক করে তাকায় আপনাদের সবারও একই মত তো?
ঘরের সবাই, এমনকি ইন্সপেক্টর জেপ-ও পর্যন্ত নিকের ইচ্ছেতে সায় দেয়। শুধু একজন ছাড়া, চার্লস ভ্যাইস। চার্লস, প্রিয় ভাই। নিক আর্তস্বরে বলে।
দুঃখিত, আমি আইনের বিপরীতে হাঁটতে পারিনা।
পোয়ারো এবার উৎসাহের গলায় বলে ঠিক বলেছেন। আপনি বলিষ্ঠ চরিত্রের মানুষ। আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
মিঃ পোয়ারো, প্লিজ নিক অনুনয়ের গলায় বলে।
দুঃখিত মাদাম জোয়েল। আপনি আমাকে এই কেসে টেনে এনেছিলেন। আপনার ইচ্ছেতেই আমি এসেছিলাম। কিন্তু এখন এই ভাবে আপনি আমাকে চুপ করিয়ে দিতে পারেন না। কিছুতেই না। পোয়ারো ওর মধ্যমা তীক্ষ্ণ শাসনের ভঙ্গিতে উঁচিয়ে তোলে। ওর ওই রুক্ষ্ম ভঙ্গিটা আমি খুব ভাল ভাবে চিনি, জানি। সবাই বসুন। এখন আমি বলব সত্যিটা। আসল সত্যিটা।
পোয়াহোর উদ্ধত শাসনের ভঙ্গিটা সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। সবাই চুপচাপ চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের ভঙ্গিতে পোয়ারোর দিকে তাকায়। Ecountez. আমি একটা দীর্ঘ তালিকা বানিয়েছিলাম। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আমি তাদের অক্ষরমালার ক্রমানুসারে ক’ থেকে জ’ পর্যন্ত চিহ্নিত করেছিলাম। সে তালিকায় অচেনা, রহস্যময় একজনও ছিল। ঝ’। আজ রাতের আগে পর্যন্ত যার পরিচয় আমরা কেউ জানতে পারিনি। যদিও আমি সব সময়ই নিশ্চিত ছিলাম এই অপরাধের সঙ্গে ঝ’ অবশ্যই জড়িত, সেরকম কেউ রয়েছেই। আজ রাতের ঘটনা প্রমাণ করল আমি সঠিক ছিলাম। কিন্তু গতকাল রাতে নতুন করে সব হিসেব করতে, অপরাধের অঙ্কটা নতুন করে সমাধান করতে বসেই প্রথমবার আমি বুঝতে পারি, আমি একটা বিরাট ভুল করে বসেছি। সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ দিয়েছি। ত’ এতদিন যাকে আমি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি।
আরও একজন অচেনা, ব্যক্তি? রহস্যময় চরিত্র? ভ্যাইস কিছুটা প্রচ্ছন্ন কৌতুকের গলায় বলে।
টানা কথা বলে পোয়ারো থামে। আমাদের সবার মুখের ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা, অনুত্তেজিত চোখ বুলিয়ে নেয়, না। ঠিক সেরকম নয়। পোয়ারো মগ্ন গলায় বলে চলে ত’ সম্পূর্ণ এক ভিন্ন তাৎপর্যময় ব্যক্তি কথাটা বলে সে ফ্রেডরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে নিজেকে সামলান মাদাম জোয়েল। আপনার স্বামী খুনী নন। মাদাম জোয়েল ম্যাগিকে গুলি করেছিলেন আমাদের এই ত’ ব্যক্তিটি।
ফ্রেডি তীব্র চোখে তাকায় সে কে?
পোয়ারো জেপের দিকে দিকে তাকায়। সে এগিয়ে আসে এবং ঠিক সেইরকম প্রবল কর্তৃত্বব্যঞ্জক গলায় কথা বলতে শুরু করে দেয়, যে ভঙ্গীতে পুলিশ আদালতে অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় আমি মিঃ পোয়ারোর সাহায্যে সন্ধ্যেবেলার অনেকটা আগে গোপনে এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম। বসবার ঘরের ভারী পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বসেছিলাম। একজন যুবতী মেয়ে সেসময় ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালান। তারপর ফায়ার প্লেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তিনি কিছু একটা চাপ দিয়ে, সম্ভবত কোন স্প্রিং-এর সাহায্যে একটা প্যানেল সরিয়ে ফেলেন। সেখান থেকে তিনি একটা পিস্তল বের করে নেন এবং ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান। আমি ওকে অনুসরণ করি। তিনি একটা রুমাল দিয়ে সযত্নে পিস্তলটাকে মুছে একটা পোশাকের মধ্যে সন্তর্পনে সেটা ঢুকিয়ে দেন। পোষাকটা মিসেস রাইসের।
মুহূর্তের মধ্যে নিক তীক্ষ্ণ গলায় চীৎকার করে ওঠে, মিথ্যে, পুরোটাই এসব মিথ্যে।
VOLTA’ পোয়ারো আঙুল তোলে, এই হচ্ছেন সেই ত। যিনি ম্যাগি বার্কলি, নিজের বোনকে গুলি করে খুন করেছেন।
আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ক্ষিপ্ত গলায় চীৎকার করে ওঠে নিক, আমি কেন ম্যাগিকে খুন করতে যাব?
কারণটা খুব সহজ। মাইকেল সেটনের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দখল করা। মাইকেল সেটন ম্যাগডেলা বার্কলির সঙ্গে বাগদানে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেটা ম্যাগি, আপনি নন মাদাম জোয়েল নিক।
আপনি আপনি………. নিক কথা খুঁজে পায়না। ওকে কেমন খেই হারানো, অথৈ জলে পড়া মানুষ মনে হয়। বাক্যহারা। থরথর করে কাঁপতে থাকে। পোয়ারো ইন্সপেক্টর জেপের দিকে তাকায়। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে? জেপ মাথা হেলিয়ে সায় দেয় হ্যাঁ। ওরা সদলবলে বাইরে অপেক্ষা করছে।
তাহলে? এখন আমরা একটা পুরোপুরি হাস্যকর অবাস্তব নাটকের সাক্ষী হতে চলেছি?
নিক ফেস করে ওঠে তা বলতে পারেন।
পোয়ারো মৃদু হাসে গত কয়েক মাস ধরে আপনি এন্ড হাউসে যে নাটকটা অভিনয় করে চলেছেন। তবে এসবের মধ্যে আমাকে টেনে আনাটা আপনার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল মাদাম জোয়েল। এরকুল পোয়ারো থাকলে আর কেউ নাটকের প্রধান চরিত্র-নায়ক হতে পারে না। কখনো না। আপনার কবর আপনিই নিজের হাতে খুঁড়েছিলেন।
.
২২.
নটে গাছটি মুড়োলো
আপনারা পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা চান? পোয়ারো তৃপ্ত ভঙ্গিতে চারপাশে সবার মুখের দিকে তাকায়। আমি জানি অপরাধীকে হারাবার গর্ব এটা। আমরা সবাই এবার বাইরে বাগানে ঘরের গুমোট ছেড়ে মুক্ত আবহাওয়াতে এসে বসলাম। ইতিমধ্যে আমাদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। নিক-এর সঙ্গে ক্রফট দম্পতিকেও পুলিশ নিয়ে গেছে।
আমি, ফ্রেডরিকা, শ্যালিঙ্গার, লাজারুম, ভ্যাইস পোয়ারোকে ঘিরে বসলাম।
Eh bien, প্রথমেই স্বীকার করে নিই, আমি বেশ বোকা বনতে বাধ্য হয়েছিলাম। পুরোপুরি, সম্পূর্ণভাবে। একটা বাচ্চা মেয়ে যে নাকি নিজেই আমাকে চেয়েছিল। তদন্তের ৯০ শতাংশ অংশ ওনাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি। মাদাম রাইস, আপনি যখন বলেছিলেন আপনার বান্ধবী একজন চতুর মিথ্যেবাদী, আমি আমলই দিইনি। কিন্তু কি সত্যি কথাটাই বলেছিলেন আপনি। ভীষণ সত্যি।
নিক সবসময়ই ভীষণরকম মিথ্যে কথা বলত। ফ্রেডরিকা বলে। সেই কারণেই বারবার অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে ওর রেহাই পেয়ে যাবার কাহিনীগুলো আমি মোটেই বিশ্বাস করিনি।
অথচ আশ্চর্যভাবে, অবিশ্বাস্যভাবে আমি করেছিলাম।
ওগুলো কি তাহলে সত্যি ঘটেনি? আমি প্রশ্ন করি, সত্যি বলতে কি, আমি যে রীতিমত সংশয়গ্রস্থ, স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই।
খুব চালাকির সঙ্গে ব্যাপারগুলো যে ঘটেছে তার ভান করা হয়েছিল। পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে আবার বলতে শুরু করে, আর সেই বানানো সাজানো ঘটনাগুলো সবার মনে ছাপ ফেলতে শুরু করে, মাদাম জোয়েল নিকের জীবন সত্যিই বিপদগ্রস্থ। কিন্তু ঘটনার শুরু তারও অনেক আগে। মূল প্রসঙ্গে ঢুকবার আগে সেগুলো ছুঁয়ে যাওয়া দরকার। আপনাদের জানা প্রয়োজন।
সামান্য থেমে পোয়ারো আবার শেষ করা কথার সূত্র ধরে বলতে থাকে, প্রথম থেকে আমরা জানি, সুন্দরী, প্রাণচঞ্চল নিক বার্কলি বাড়িটাকে আশ্লেষময়, পাগলের মত ভালবাসেন। কিন্তু তার হাতে সেরকম টাকা পয়সা ছিল না। বাড়িটা বন্ধক দেওয়া ছিল। তিনি টাকা খুঁজছিলেন, প্রচণ্ডভাবে মরিয়া হয়ে। টাকার প্রয়োজন ছিল তার, অথচ তিনি সেটা পাচ্ছিলেন না! লে-টকেততে যুবক মাইকেল সেটনের সঙ্গে তার পরিচয় হল। সেটন তার সৌন্দর্যে আকর্ষিত হয়। নিক জানতেন সেটন কোটিপতি কাকার বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। উনি ভাবলেন ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু দেখা গেল সেটন মোটেই সেরকম তীব্রভাবে বা সিরিয়াসভাবে নিকের প্রতি আকর্ষিত হয়নি। ওর সঙ্গ আনন্দদায়ক লাগত সেটনের, ব্যস এইটুকুই ছিল ওর তরফের আকর্ষণ। স্কারবরোঘোতে আবার দেখা হল দুজনের। আর এখানেই পুরো উল্টে পাল্টে গেল ব্যাপারটা। ম্যাগির সঙ্গে আলাপ হল সেটনের, নিকের মাধ্যমেই। আর পাগলের মত, দুর্বারভাবে উনি প্রেমে পড়লেন ম্যাগির সঙ্গে প্রথম দর্শনেই। নিক প্রায় বজ্রাহত হল। ম্যাগিকে কোনদিনই উনি সুন্দরী বলে ভাবেননি। কিন্তু যুবক সেটনের কাছে উনি অন্যরকম। তার জন্যে পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে। গোপনে দুজনে বাগদানে আবদ্ধ হলেন। একজনেই মাত্র জানলেন পুরো ব্যাপারটা। মাদাম জোয়েল নিক। বেচারা ম্যাগি, সে খুশি ছিল যে একজনের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে সে কথা বলতে পারত। প্রেমিক বা বাগদত্তার চিঠিগুলোও বোনকে পড়ে শোনাতেন তিনি। আর ঐ ভাবেই উইলের কথাটা মাদাম জোয়েল নিক জানতে পেরেছিলেন। ব্যাপারটা ওর মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
তারপরই স্যার ম্যাথু সেটনের অপ্রত্যাশিত, আচমকা মৃত্যু ঘটল। তারপরই রইল মাইকেল সেটন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিকের মাথায় চমকপ্রদ একটা পরিকল্পনা এসে গেল। সেটন জানতেন না নিকের নামও ম্যাগডেলা। ওকে নিক বলেই জানতেন তিনি। অথচ পৃথিবীর সবাই জানত সেটনের সাথে নিকেরই বন্ধুত্ব। ম্যাগির সাথে ওর সম্পর্ক তখনও সবার কাছে গোপন। এই সুযোগটাকেই নিখুঁতভাবে কাজে লাগাবেন ঠিক করলেন নিক। সেটনের সঙ্গে নিজের বাগদানের কথা প্রচার করলে কেউই খুবই একটা তাই আশ্চর্য হবে না। কিন্তু সেটা করতে হলে, ম্যাগিকে অবশ্যই মরতে হবে। কারণ, আসল সত্যিটা একমাত্র সে-ই জানে। সময় খুব কম ছিল ওর হাতে। নিজের ওপর প্রাণঘাতী হামলার ভান করে, সুকৌশলে উনি ম্যাগিকে কয়েকদিন নিজের কাছে এনে রাখবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ওর ওপর প্রাণঘাতী হামলার সব কটিই নিখুঁতভাবে সাজানো। ছবির দড়ি উনিই কেটে রেখেছিলেন। নিজেই (গাড়ি নিয়ে ধাক্কা মেরে তারপর) গাড়ির ব্রেকের তার ছিঁড়ে দেন। পাথরটাও বলাবাহুল্য উনি নিজেই ফেলেছিলেন। তখন যে পাথরের তলায়, স্নানের জায়গায় উনি হাজির ছিলেন না সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
তারপর উনি কাগজে আমার নাম দেখলেন। ওনার এত বড় দুঃসাহস, ব্যাপারটাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে আমাকে এরকুল পোয়ারোকে এর মধ্যে টেনে আনলেন, জড়ালেন। আর আমিও সত্যি সত্যি ওর টুপিতে গুলির ফুটোটা দেখে বিশ্বাস করে নিলাম যে অঘটনগুলো ঘটেছে। আর ওনার ফাঁদে পা দিয়ে আমিও বলে ফেললাম, সিদ্ধান্ত নিলাম ওনার সঙ্গে সঙ্গে থাকবার জন্যে কোন আত্মীয়াকে ডেকে আনতে। নিকও ঠিক এই সুযোগটাই খুঁজছিলেন। উনি ম্যাগিকে ডেকে পাঠালেন।
তারপর রেডিওয়ে উনি শুনতে পেলেন, জানতে পারলেন সেটনের মৃত্যুর, নিখোঁজ হয়ে যাবার খবরটা সত্যি। ব্যস, নিশ্চিন্ত হলেন উনি। এখন ওনার হাতে প্রচুর সময়। পরিকল্পিতভাবে এগোবার সুযোগ এসে গেল ওর হাতে। প্রথমেই ম্যাগির থেকে মাইকেল সেটনের লেখা প্রেমপত্রগুলো কৌশলে আদায় করে নিলেন। তারপরের অপরাধক্রম খুব সহজ, অনুমান সম্ভব। বাজি পোড়ানোর পার্টির রাতে ম্যাগিকে নিয়ে শীতপোশাক নেবার অজুহাতে বাড়িতে এলেন। বোনকে নিজের শালটা পরতে দিলেন। তাকে বুঝতে না দিয়ে কোন একটা পথে বাড়ির বাইরে এসে বোনকে গুলি করেই দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। পিস্তলটাকে বাইরের ঘরের ফায়ারপ্লেসের কাঠের গোপন প্যানেলের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন। ওর দৃঢ় ধারণা ছিল সেটার অস্তিত্বের কথা কেউ জানত না (দুর্ভাগ্যবশত এলিন সেটার খোঁজ জানত)। তারপর দোতলায় গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না শোনা গেল লাশ আবিষ্কৃত হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন। তারপরই ছুটে বের হলেন তিনি ফ্রেঞ্চ উইনডোটা দিয়েই সম্ভবত তাড়াতাড়ি পৌঁছবার জন্যে।
কি দুর্দান্তভাবে নিজের চরিত্রতে অভিনয় করে চলেছিলেন উনি। অসাধারণ,হা একটা দারুণ নাটকের মঞ্চ সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি এই বাড়িটাকে। পরিচালিকা এলিন একবার বলেছিল এই বাড়িটাতে শয়তান বাস করে। আমি ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আর সেই শয়তানের অনুপ্রেরণাতেই আমাদের ছোট্ট, মিষ্টি মেয়েটি, মাদাম জোয়েল নিক এতবড় একটা নিষ্ঠুর অপরাধ ঘটিয়ে ফেলেন। তবে এটাও ঠিক উনি যা কিছুই করেছিলেন সবই এই বাড়িটাকে বাঁচাতেই করেছেন। প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল ওনার কাছে এই এন্ড হাউস।
কিন্তু সেই বিষাক্ত চকোলেট? এই ব্যাপারটা এখনও আমার মাথায় ঢোকেনি। ফ্রেডরিকা কৌতূহলী গলায় বলে।
খুবই চতুরভাবে, প্রায় পেশাদারি অপরাধীর মানসিকতায় ব্যাপারটা করা হয়েছিল। ম্যাগির খুন হওয়াটা যে দুর্ঘটনা ছিল, ম্যাগি যে খুনির লক্ষ্য ছিল না, তার লক্ষ্য যে এখনও নিক, সেটা বোঝাবার জন্যেই হাসপাতালের মধ্যেও খুন করার চেষ্টা হল, নাটকটা ঘটান হয়েছিল। মাদাম জোয়েল নিক নিজেই তার গলার স্বর বিকৃত করে মাদাম রাইসকে ফোন করেন।
ওহ ওটা তাহলে নিকের গলা ছিল? ফ্রেডরিকা অবাক গলায় বলে।
অবশ্যই। Nest ce pas? পোয়ারো মাথা দুলিয়ে প্রাজ্ঞের ভঙ্গিতে হাসে আর কে হবে? হতে পারে? তারপর, উনি সেই চকোলেটের বাক্স এসে পৌঁছনোর পর তার মধ্যে থেকে তিনটেতে কোকেন পুরে দেন (নিজের পোশাকের ভেতর গোপন কোকেন নিয়ে এসেছিলেন উনি হাসপাতালে, সম্ভবত এই পরিকল্পনাটার জন্যেই। কারণ মাদাম জোয়েল খুব ভাল করে জানতেন, উনি নিজেই আমাকে কৌশলে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন)। মাদাম রাইসের মাদক নেবার অতীত ইতিহাস আমি জানি। তারই পাঠানো চকোলেটের ভেতর কোকেন থাকাটা তাই খুবই স্বাভাবিক। উনি ভেবে নিয়েছিলেন আমি এবং পুলিশ সেক্ষেত্রে খুব সহজেই দুই আর দুই-এ চার করব। বিষ প্রয়োগের, হত্যার চেষ্টার অভিযোগে মাদাম জোয়েল রাইসকে গ্রেপ্তার করা হবে। সহজ অঙ্ক। আর অন্য বাক্সে আমার কার্ডটা? এটা উনি একটা অসাধারণ চাল দিয়েছিলেন। আমার পাঠান ফুলের তোড়ার সঙ্গে দেওয়া কার্ডটাকেই উনি আবার ব্যবহার করেছিলেন চকোলেটের বাক্সে।
সামান্য নীরবতার পর ফ্রেডরিকা বিষণ্ণ গলায় বলে। কিন্তু কেন? নিক আমায় বারবার কেন খুনি সাজাবার চেষ্টা করছে? আমার কোটের পকেটে কেনই বা পিস্তলটা রেখেছিল? বিষ মেশানো চকোলেট আমি পাঠিয়েছিলাম বোঝাবার, প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিল?
প্রশ্নটা আপনার মনে জাগাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা মাদাম, আপনি একটা কথা বলুন তো আমাকে। আপনার মনে কখনও এই ব্যাপারটা এসেছে যে মাদাম জোয়েল আপনাকে আর ততটা পছন্দ করেন না ইদানীং? পোয়ারোর প্রশ্নটা শুনে ফ্রেডরিকা দৃঢ় গলায় বলে, না, এরকম তো কখনও মনে হয়নি। বরং ও আমাকে পছন্দ করে বলেই মনে হত।
পোয়ারো এবার ঘুরে তাকায় মিঃ লাজারুম, একটা কথা সত্যি সত্যি বলুন। সভাবে বললেন। মাদাম জোয়েল নিকের সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্ক রয়েছে, মানে ছিল?
লাজারুম মাথা নাড়ে, নাহ, অস্বীকার করব না, একটা সময় নিকের প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা ছিল কিন্তু অল্প সময়েই তা কাটিয়ে উঠি। ফ্রেডির প্রতি আমি তারপর থেকেই নিবেদিত।
আহ্, এটাই ওনার ট্রাজেডি। উনি মানুষ (পুরুষ) কে আকর্ষণ করতেন। আর তারপর তারা ওকে ছেড়ে অন্য কোন নারীতে সরে যেতেন, যাইহোক, মাদাম রাইস, আপনার প্রশ্নের উত্তরটা আশা করি পেয়ে গেলেন? হ্যাঁ, উনি মিঃ লাজারুমকে ভালবাসতেন, এখনও ভালবাসেন। আপনাক সরিয়ে দিয়ে উনি মিঃ লাজারুমকে পেতে চেয়েছিলেন। লাজারুমকে কেড়ে নেবার সময়টা, তারপর থেকেই উনি আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। অসম্ভব ঘৃণা। অবশ্য, তার প্রকাশ উনি ঘটতে দেননি কোনদিনও।
কিন্তু মিঃ পোয়ারো, নিক যে অপরাধী সেটা কখন, কিভাবে আপনার মনে হল? এবার শ্যালিঙ্গার প্রশ্ন করেন।
পোয়ারো বিনীতভঙ্গিতে হাসে প্রশ্নটা শুনে, খুব লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করব, ব্যাপারটা আমার মাথায় আরও আগে আসা উচিত ছিল। অনেক আগে। কিন্তু মাদাম জোয়েল নিককে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। উনি যা বলতেন অন্ধের মত বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তারপর আচমকা আমার চোখে একটা ব্যাপার ধরা পড়ে। উনি অত্যন্ত চতুর মহিলা ঠিকই। কিন্তু উনি একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছিলেন। সৌভাগ্যবশত শেষ পর্যন্ত যা আমার নজর এড়ায়নি। আমি যখন ওনাকে বললাম কোন বন্ধু বা আত্মীয়াকে ওনার কাছে এনে সঙ্গী হিসাবে রাখতে, উনি নিমরাজি হবার ভান করলেন। অথচ ততদিনে উনি ম্যাগিকে এখানে আসবার জন্যে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলেন। এই ছোট্ট ভুলটা যখন ধরতে পারলাম ওনার, আমার প্রথম টনক নড়ল। ম্যাগি এখানে পৌঁছে ওর বাবা মাকে পৌঁছানোর খবর জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। প্রথমে না ধরতে পারলেও, শেষ পর্যন্ত চিঠির একটা নিরীহ অংশই আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। ম্যাগি লিখেছিলেন আমি সত্যি বুঝতে পারছি না নিক আমাকে এভাবে তড়িঘড়ি চলে আসবার জন্যে কেন তার করল। মঙ্গলবারের পরে আসলেও তো ক্ষতি ছিল না। এই মঙ্গলবার শব্দটা আমার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। নিক এভাবে কেন আগেভাগেই তার করেছিলেন? মঙ্গলবার কথাটা কেন উল্লেখ করেছিলেন? তড়িঘড়ি তার আগে কেন ম্যাগিকে ডেকে আনলেন?
পোয়ারো থামে। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে। তার একটাই কারণ, মাদাম জোয়েল চেয়েছিলেন মঙ্গলবার রাতটা মাদাম ম্যাগি এন্ড হাউসে হাজির থাকুন। কিন্তু কেন তার সেই তীব্র আকুতি? আমার চোখ খুলে গেল। এবার মাদাম জোয়েল নিককে আমি ভিন্ন আলোয় দেখা শুরু করলাম। ওর বক্তব্যগুলোকে অন্ধের মত বিশ্বাস না করে কাটাছেঁড়া করা শুরু করলাম। যার ফলে উঠে এল এক একটা নির্মম সত্য। মাদাম ম্যাগিকে সাত তাড়াতাড়ি মঙ্গলবারের বাজি পোড়ানোর রাতে এন্ড হাউসে ডেকে আনা হয়েছিল খুন করার জন্যেই। কিন্তু কেন? এই রহস্য সমাধানে আমার অবশ্য ভীষণরকম সাহায্য করেছে। বন্ধুবর হেস্টিংস। এক সন্ধ্যায় ও ম্যাগি নামটা নিয়ে বিশ্লেষণে বসেছিল হঠাৎ করেই। ম্যাগি নামটা কি কি হতে পারে পুরো আকারে ম্যাগগি। মার্গারেট। ঝলসে উঠেছিল। মাদাম ম্যাগি-র পুরো নামটা ম্যাগডেলা নয়তো? এবং ……… খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার অনুমানই ঠিক। রহস্যের ঘোর জটের মাঝে দুই ম্যাগডেলা বার্কলির উপস্থিতি জানতে পারার পরই ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বাকিটা এরকুল পোয়ারোর সেই বিখ্যাত ধূসর মস্তিষ্কের কামাল।
আমার প্রথম খটকাটা অবশ্য লেগেছিল মাত্র কয়টি প্রেমপত্র দেখে। একজন প্রেমিকা তো তার প্রেমিকের সবগুলো প্রেমপত্রই রেখে দেবে। মাদাম জোয়েল বার্কলির কাছে মাত্র ওই কয়টি চিঠি কেন? তার উত্তর মাদাম জোয়েল ম্যাগির কাছ থেকে তার কাজে লাগবে এরকম কয়েকটা চিঠি বেছে নিয়েছিলেন। আর সেই চিঠিগুলোরই একটা কিন্তু আমার কাছে, সমস্ত জট খুলে দিল। পোয়ারো এবার একটু থামে। ও সেই ট্রিপিক্যাল ভঙ্গিতে গোঁফে মোচড় দেয়। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার উৎসুক গলায় প্রশ্ন করেন সেটা কি?
পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে হাসে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ মাদাম জোয়েল নিকের অ্যাপেনডিক্স অপারেশান হয়। অথচ, মাইকেল সেটনের মার্চ-২ তারিখের চিঠিতে সে বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। কোন উদ্বেগ বা দুশিন্তা নেই। কুশল প্রশ্ন নেই। ওই চিঠিটাই নিশ্চিত করে দেয়, আমাকে প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় চিঠিগুলো মাদাম জোয়েল নিক-কে লেখা হতেই পারে না। অন্য কাউকে লেখা। অন্য কারো জন্যে লেখা। কে? সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিমান হবার দরকার হয় না। এরপর পুরো মামলাটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়।
ফ্রেডরিকা সজল চোখে তাকায় একটা মিষ্টি, ছোট্ট মেয়ে………..
পোয়ারো এবার হঠাৎ লাজারুমের দিকে ফিরে তাকায় একটা ব্যাপার আমার কাছে এখনও পরিষ্কার হয়নি। আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?
লাজারুম অবাক চোখে তাকায়। কিছুটা শঙ্কিতও।
পোয়ারো হাসে যে ছবিটার ৫০ পাউন্ড দাম হবার কথা নয়, আপনি তার জন্যে মাদাম জোয়েলকে ১০০ পাউন্ডের দর দিয়েছিলেন কেন?
লাজারুম কয়েক মুহূর্ত পোয়ারোর মুখের দিকে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাসে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, দেখুন মিঃ পোয়ারো, আমি একজন ব্যবসায়ী। আপনি ঠিকই বলেছেন। স্যার নিকোলাসের ওই ছবিটা সম্ভব ২০-২৫ পাউন্ডের বেশি দাম হবে না। তবু আমি ১০০ পাউন্ড দর দিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম নিক ছবিটার বাজার দর যাচাই করে দেখবে। এবং জানবে আমি প্রকৃত বাজার দরের অনেক বেশি দর দিয়েছি। তারপর থেকে আমি কোন ছবি বা জিনিস কিনতে চেয়ে দর দিলে ও আর বাজার দর যাচাই করতে যেত না। অনেক কম দর দিয়ে এ বাড়িতে দশ বারো পনেরো হাজার পাউন্ড দামের পুরনো জিনিসপত্র কিনে নিতে পারতাম আমি একবার ৫০-৭৫ পাউন্ড ক্ষতি করে।
পোয়ারো হাসে, থাক, এই মামলায় আর কোনো উত্তর না-জানা প্রশ্ন রইল না।