জ্ঞানদ্বারা ব্ৰহ্মপ্রাপ্তি
কৃষ্ণ কহিলেন, “হে অর্জ্জুন! এক্ষণে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী সংবাদনামক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে এক জ্ঞানবিজ্ঞানপারদর্শী ব্রাহ্মণ সৰ্ব্বদা বিজনপ্রদেশে সমাসীন হইয়া যোগসাধন করিতেন। একদা তাঁহার পত্নী তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘নাথ! শুনিয়াছি, কামিনীগণ পতির কৰ্ম্মানুরূপ লোক লাভ করিয়া থাকে, কিন্তু আপনি ধৰ্ম্মপরিত্যাগপূৰ্ব্বক নিতান্ত অনভিজ্ঞের ন্যায় কালহরণ করিতেছেন; অতএব জানি না, আপনার এই কর্ম্ম পরিত্যাগনিবন্ধন চরমে আমার কিরূপ দুর্গতি লাভ হইবে।
“প্রশান্তমূৰ্ত্তি ব্রাহ্মণ পত্নীকর্ত্তৃক, এইরূপ অভিহিত হইয়া সহাস্যমুখে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘প্রিয়ে! ইহলোকে যেসমুদয় কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হয়, কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিরা তন্মধ্যে কতকগুলিকে অসৎকৰ্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। ঐ সমুদয় গুণহীন ব্যক্তি কাৰ্য্যদ্বারা লোকের মোহ উৎপাদন করে। উহারা মুহূর্ত্তকালও কৰ্ম্মবিহীন হইয়া কালহরণ করিতে সমর্থ হয় না। প্রাণীগণ যতকাল মোক্ষলাভ করিতে না পারে, ততকাল বিবিধ যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়া কায়মনোবাক্যে শুভ বা অশুভ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। বিশেষতঃ ধার্ম্মিক ব্যক্তিরা যজ্ঞাদি কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে দুরাত্মারা প্রায়ই উহার বিঘ্ন উৎপাদন করে। এই নিমিত্তই আমি নিতান্ত বিরক্ত হইয়া যজ্ঞাদি কার্য্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জ্ঞানচক্ষু দ্বারা হৃদ্গত স্থান দর্শন করিতেছি। ঐ স্থানে নির্দ্বন্দ্ব পরব্রহ্ম চন্দ্র ও হুতাশন বিদ্যমান রহিয়াছেন। জীবাত্মা ঐ স্থানে অবস্থিত হইয়া পঞ্চভূতকে ধারণপূৰ্ব্বক সংহারকাৰ্য্য সম্পাদন করিতেছেন। ব্রহ্মাদি দেবগণ এবং ব্রতপরায়ণ প্রশান্তমূৰ্ত্তি জিতেন্দ্রিয় মহাত্মারা সেই রূপরসাদি বিষয়াতীত, চক্ষু, কর্ণ ও মনের অগোচর, হৃদ্গত, অক্ষর ব্রহ্মের উপাসনা করিয়া থাকেন। সেই পরব্রহ্ম হইতে সমুদয় পদার্থ সৃষ্ট হইয়া তাঁহাকেই আশ্রয় করিয়া থাকে।
যোগিগণের অন্তর-প্রাণায়াম
“প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান এই পঞ্চবিধ বায়ু পরব্রহ্ম হইতে সমুৎপন্ন ও তাঁহাতেই বিলীন হয়। সমান ও ব্যান-বায়ুর মধ্যে প্রাণ ও অপান-বায়ু বিচরণ করে; সুতরাং প্রাণ ও অপান বায়ু রুদ্ধ হইলে সমান ও ব্যান-বায়ুও রুদ্ধ হইয়া যায়; কিন্তু উদান-বায়ু কোন বায়ুর আয়ত্ত নহে। ঐ বায়ু আপনিই প্রাণ-বায়ুকে আবৃত করিয়া অবস্থান করে। এই নিমিত্ত প্রাণ ও অপান-বায়ু নিদ্রিত পুরুষকে পরিত্যাগ করে না। ফলতঃ উদান-বায়ু প্রাণাদি সমুদয় বায়ুকেই আয়ত্ত করিয়া রাখে, এই নিমিত্ত ব্ৰহ্মবাদী মহাত্মারাই ঐ বায়ুকে সংযত করিয়া প্রাণায়াম করিয়া থাকেন। শরীরস্থ সমুদয় বায়ুর অন্তর্গত সমান-বায়ুমধ্যে জঠরানল সপ্তধা প্রদীপ্ত রহিয়াছে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্, মন ও বুদ্ধি এই সাতটি উহার শিখাস্বরূপ। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ, সংশয় ও নিশ্চয় এই সাতটি সমিধ এবং ঘ্রাতা, ভক্ষয়িতা, দ্রষ্টা, স্রষ্টা, শ্রোতা, মন্তা ও বোদ্ধা এই সাতটি ঋত্বিক শরীরস্থ অগ্নিতে রূপরসাদি সপ্ত বিষয়কে আহুতি প্রদানপূর্ব্বক ব্রহ্মের স্বরূপত্ব লাভ করেন। সুষুপ্তিকালে গন্ধাদি গুণসমুদয় ইতর ব্যক্তির চিত্তে বাসনারূপে অবস্থান করিয়া জাগ্ৰদ্দশায় নাসিকাদি ইন্দ্রিয়ে আবির্ভূত হয়, কিন্তু যোগিগণের সেরূপ হয় না। স্বভাবতঃ তাঁহাদিগের অন্তরেই ঐ সমুদয় গুণ সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। তাঁহারা পূর্ণব্রহ্মের আবির্ভাবনিবন্ধন সতত আত্মজ্যোতিতে পরিপূর্ণ হইয়া থাকেন। পূৰ্ব্বে মহর্ষিগণ যোগশীল মহাত্মাদিগের এইরূপ নিয়ম নিরূপণ করিয়া গিয়াছেন।’ ”