এক্ষণে কথা হইতেছে—গীতা জিনিষটিতে আছে কি? উপনিষদ্ আলোচনা করিলে দেখা যায়, তাহার মধ্যে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা চলিতে চলিতে হঠাৎ এক মহাসত্যের অবতারণা। যেমন জঙ্গলের মধ্যে অপূর্ব সুন্দর গোলাপ—তাহার শিকড় কাঁটা পাতা সব সমেত। আর গীতাটি কি—গীতার মধ্যে এই সত্যগুলি লইয়া অতি সুন্দরভাবে সাজান—যেন ফুলের মালা বা সুন্দর ফুলের তোড়া। উপনিষদে শ্রদ্ধার কথা অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু ভক্তি সম্বন্ধে কোন কথা নাই বলিলেই হয়। গীতায় কিন্তু এই ভক্তির কথা পুনঃপুনঃ উল্লিখিত আছে এবং এই ভক্তির ভাব পরিস্ফুট হইয়াছে।
এক্ষণে গীতা যে কয়েকটি প্রধান প্রধান বিষয় লইয়া আলোচনা করিয়াছেন, দেখা যাউক। পূর্ব পূর্ব ধর্মশাস্ত্র হইতে গীতার নূতনত্ব কি? নূতনত্ব এই যে, পূর্বে যোগ জ্ঞান ভক্তি-আদি প্রচলিত ছিল বটে, কিন্তু সকলের মধ্যেই পরস্পর বিবাদ ছিল, ইহাদের মধ্যে সামঞ্জস্যের চেষ্টা কেহ করেন নাই। গীতাকার এই সামঞ্জস্যের বিশেষ চেষ্টা করিয়াছেন। তিনি তদানীন্তন সমুদয় সম্প্রদায়ের ভিতর যাহা কিছু ভাল ছিল, সব গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু তিনিও যে সমন্বয়ের ভাব দেখাইতে পারেন নাই, এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দ্বারা তাহা সাধিত হইয়াছে।
দ্বিতীয়তঃ নিষ্কাম কর্ম—এই নিষ্কাম কর্ম অর্থে আজকাল অনেকে অনেকরূপ বুঝিয়া থাকেন। কেহ কেহ বলেন, নিষ্কাম হওয়ার অর্থ—উদ্দেশ্যহীন হওয়া। বাস্তবিক তাহাই যদি ইহার অর্থ হয়, তাহা হইলে তো হৃদয়শূন্য পশুরা এবং দেয়ালগুলিও নিষ্কামকর্মী; অনেকে আবার জনকের উদাহরণে নিজেকে নিষ্কাম কর্মিরূপে পরিচিত করিতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু জনক তো পুত্রোৎপাদন করেন নাই, কিন্তু ইঁহারা পুত্রোৎপাদন করিয়াই জনকবৎ পরিচিত হইতে চাহেন। প্রকৃত নিষ্কাম কর্মী পশুবৎ জড়প্রকৃতি বা হৃদয়শূন্য নহেন। তাঁহার অন্তর এতদূর ভালবাসায় ও সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ যে, তিনি সমগ্র জগৎকে প্রেমের সহিত আলিঙ্গন করিতে পারেন। এরূপ প্রেম ও সহানুভূতি লোকে সচরাচর বুঝিতে পারে না। এই সমন্বয়ভাব ও নিষ্কাম কর্ম—এই দুইটি গীতার বিশেষত্ব।
গীতার একটি শ্লোক
এক্ষণে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় হইতে একটু পাঠ করা যাক। ‘তং তথা কৃপয়াবিষ্টম্’ ইত্যাদি শ্লোকে কি সুন্দর কবিত্বের ভাবে অর্জুনের অবস্থাটি বর্ণিত হইয়াছে! তারপর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিতেছেন, ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’—এই স্থানে অর্জুনকে ভগবান্ যুদ্ধে প্রবৃত্তি দিতেছেন কেন? অর্জুনের বাস্তবিক সত্ত্বগুণ উদ্রিক্ত হইয়া যুদ্ধে অপ্রবৃত্তি হয় নাই; তমোগুণ হইতেই যুদ্ধে অনিচ্ছা হইয়াছিল। সত্ত্বগুণী ব্যক্তিদের স্বভাব এই যে, তাঁহারা অন্য সময়ে যেরূপ শান্ত, বিপদের সময়ও সেরূপ ধীর। অর্জুনের (মনে) ভয় আসিয়াছিল। আর তাঁহার ভিতরে যে যুদ্ধপ্রবৃত্তি ছিল, তাহার প্রমাণ এই—তিনি যুদ্ধ করিতেই যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়াছিলেন। সচরাচর আমাদের জীবনেও এইরূপ ব্যাপার দেখা যায়।
অনেকে মনে করেন, ‘আমরা সত্ত্বগুণী’; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা তমোগুণী। অনেকে অতি অশুচিভাবে থাকিয়া মনে করেন, ‘আমরা পরমহংস’। কারণ, শাস্ত্রে আছে—পরমহংসেরা ‘জড়োন্মত্তপিশাচবৎ’ হইয়া থাকেন। পরমহংসদিগের সহিত বালকের তুলনা করা হয়, কিন্তু তথায় বুঝিতে হইবে—ঐ তুলনা একদেশী। পরমহংস ও বালক কখনই অভিন্ন নহে। একজন জ্ঞানের অতীত অবস্থায় পৌঁছিয়াছেন, আর একজনের জ্ঞানোন্মেষ মোটেই হয় নাই। আলোকের পরমাণুর অতি তীব্র স্পন্দন ও অতি মৃদু স্পন্দন উভয়ই দৃষ্টির বহির্ভূত। কিন্তু একটিতে তীব্র উত্তাপ ও অপরটিতে তাহার অত্যন্তাভাব বলিলেই হয়। সত্ত্ব ও তমোগুণ কিয়দংশে একরূপ দেখাইলেও উভয়ে অনেক প্রভেদ। তমোগুণ সত্ত্বগুণের পরিচ্ছদ ধারণা করিয়া আসিতে বড় ভালবাসে; এখানে দয়ারূপ আবরণে উপস্থিত হইয়াছেন।
অর্জুনের এই মোহ অপনয়ন করিবার জন্য ভগবান্ কি বলিলেন? আমি যেমন প্রায়ই বলিয়া থাকি যে, লোককে পাপী না বলিয়া তাহার ভিতর যে মহাশক্তি আছে, সেই দিকে তাহার দৃষ্টি আকৃষ্ট কর, ঠিক সেই ভাবেই ভগবান্ বলিতেছেন, ‘নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে’— তোমাতে ইহা সাজে না। তুমি সেই আত্মা, তুমি স্বরূপ ভুলিয়া আপনাকে পাপী রোগী শোকগ্রস্ত করিয়া তুলিয়াছ—এ তো তোমার সাজে না। তাই ভগবান্ বলিতেছেন, ‘ক্লৈবং মাস্ম গমঃ পার্থ।’ জগতে পাপতাই নাই, রোগশোক নাই; যদি কিছু পাপ জগতে থাকে, তাহা এই ‘ভয়’। যে-কোন কার্য তোমার ভিতরে শক্তির উদ্রেক করিয়া দেয়, তাহাই পুণ্য; আর যাহা তোমার শরীর-মনকে দুর্বল করে, তাহাই পাপ। এই দুর্বলতা পরিত্যাগ কর। ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’, তুমি বীর, তোমার এ (ক্লীবতা) সাজে না।
তোমরা যদি জগৎকে এ-কথা শুনাইতে পার—‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে’, তাহা হইলে তিন দিনের ভিতর এ-সকল রোগ-শোক, পাপ-তাপ কোথায় চলিয়া যাইবে। এখানকার বায়ুতে ভয়ের কম্পন বহিতেছে। এ কম্পন উল্টাইয়া দাও। তুমি সর্বশক্তিমান্—যাও, তোপের মুখে যাও, ভয় করিও না। মহাপাপীকে ঘৃণা করিও না, তাহার বাহির দিক্টিই দেখিও না। ভিতরের দিকে যে পরমাত্মা রহিয়াছেন, সেই দিকে দৃষ্টিপাত কর; সমগ্র জগৎকে বল—তোমাতে পাপ নাই, তাপ নাই, তুমি মহাশক্তির আধার।
এই একটি শ্লোক পড়িলেই সমগ্র গীতাপাঠের ফল পাওয়া যায়, কারণ এই শ্লোকের মধ্যেই গীতার সমগ্র ভাব নিহিত।