২০. ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন

২০.

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার ঠিক এক সপ্তাহ বাদে আরেক শুক্রবার সন্ধ্যের কিছু পরের ঘটনা। সিটাফোর্ড হাউসে মিসেস উইলেটের বসার ঘরে এসে জড়ো হয়েছেন মিঃ রাইক্রফট, মেজর বারনাবি, রণি গারফিল্ড, ব্রায়ান পিয়ার্সন আর এমিলি, এছাড়া মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেটও উপস্থিত আছেন সেখানে।

আজ এই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ, মিসেস উইলেট মন্তব্য করলেন।

তার মানে?

আগে স্থির ছিল যে আমরা পুরো শীতকালটাই এই সিটাফোর্ডে কাটাব, মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু হঠাৎ কিছু পারিবারিক সমস্যা দেখা দিয়েছে যে কারণে শীতকাল শেষ হবার আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে।

আপাততঃ লন্ডনে, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, আশা করছি সেখান থেকে আমরা বিদেশে রিভিয়েরার দিকে রওনা হতে পারব।

সত্যি বলছি, মিঃ রাইক্রফট মন্তব্য করলেন, আপনি চলে গেলে আমাদের খুব লোকসান হবে।

না, না, লোকসান হবে কেন, মিসেস উইলেট বললেন, আসুন আজ শেষবারের মতো একসঙ্গে চা পান করা যাক।

তুমি কি করবে? মেজর বারবি আড়চোখে ব্রায়ান পিয়ার্সনের দিকে তাকালেন, তুমি এখান থেকে কেটে পড়বে ঠিক করেছে?

আপাতত লন্ডনে যাচ্ছি, ব্রায়ান জবাব দিল, তবে আমার ভাই জিম যতক্ষণ খালাস না পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঝামেলার হাত থেকে পুরোপুরি রেহাই মিলছে না।

ব্রায়ানের কথা শেষ হতেই বাইরে থেকে দরজায় করাঘাতের শব্দ হল। ব্রায়ান উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল, সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকল চার্লস এন্ডারবি।

আসুন সাংবাদিক প্রবর, মিসেস উইলেট অভ্যর্থনার সুরে বললেন, আমাদের সঙ্গে এককাপ চা খান।

ধন্যবাদ। একটি কৌচে বসে চার্লস এন্ডারবি বলল, সবাই হাজির আছেন দেখছি, খুব ভাল সময়েই এসেছি।

হ্যাঁ, মিসেস উইলেট বললেন, আসুন, শেষবারের মতো সবাই মিলে এক হাত ব্রীজ খেলা যাক। এক মিনিট, ম্যাডাম, মিঃ রাইক্রফট বাধা দিয়ে বললেন, মিসেস উইলেট, আপনি খুব ভালভাবেই জানেন আমি নিজে অলৌকিক ও পরলোক তত্ত্বে বিশ্বাসী, এ বিষয়ে আমি প্রচুর পড়াশোনা করেছি। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে আপনার এই বসার ঘরে আমরা এক আপাত-ব্যাখ্যাহীন অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।

কথা শেষ করে মিঃ রাইক্রফট একটু তাকালেন আর মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেটের গলা থেকে চাপা গোঙানীর মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল।

সেদিনের ঘটনা আমার মনে করিয়ে দেবার জন্য আপনি যে কষ্ট অনুভব করেছেন তা বুঝতে পারছি, মিস উইলেট, মিঃ রাইক্রফট ভায়োলেটের দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে বললেন, পুলিশ অবশ্য সন্দেহক্রমে একজনকে গ্রেপ্তারও করেছে, অবশ্যই সেই ধৃত ব্যক্তি অর্থাৎ জিম পিয়ার্সন সত্যিই আসল অপরাধী কিনা সে বিষয়েও আমাদের অনেকেরই মনে সন্দেহ আছে। আমার একটি প্রস্তাব আছে তা হল, গত শুক্রবারের মতো আসুন, আজ আবার আমরা প্রেতচর্চার এক অনুষ্ঠান বসাই।

 না, প্রতিবাদের সুরে চেঁচিয়ে ওঠে ভায়োলেট, কখনও নয়।

না, আপনি দেখছি অত্যন্ত নির্মম, রণি গারফিল্ড মন্তব্য করল, মিঃ রাইক্রফট, আপনি সত্যিই মানুষ না প্রেত সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ জাগছে।

মিসেস উইলেট, মিঃ রাইক্রফট বললেন, আমার এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার নিজের কি অভিমত?

আমার এই প্রস্তাব খুব ভাল লাগছে না,মিসেস উইলেট বললেন, গত সপ্তাহের ওই ঘটনা আমার মেয়ের মাথায় যে প্রভাব ফেলেছে তা এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি নি। এরই মধ্যে আবার?

আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন তো? চার্লস এন্ডারবি মিঃ রাইক্রফটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি এটাই বলতে চান যে আজকের প্রেতচক্রের অনুষ্ঠানে যেসব প্রেতাত্মা আসবে তারা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের আসল খুনীর নাম আমাদের দেবে?

চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি, মিঃ রাইক্রফট কৌতূহলী সুরে বললেন, হয়ছে। অপরাধীদের মুখ থেকেই আমরা আসল অপরাধীর নাম জানতে পারব। দোহাই মিস উইলেট, আপনি আর আপত্তি করবেন না।

কিন্তু বিশ্বাস করুন, ভায়োলেট মিনতি করে বলল, মেজর, আপনি তো ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, মিঃ রাইক্রফটের এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার নিজের কি অভিমত?

আমি এর মধ্যে আপত্তির কিছুই দেখছি না, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, মিঃ রাইক্রফট যখন বলছেন তখন একবার না হয় দেখাই যাক।

মেজর বারনাবির কথা শেষ হতেই রণি গারফিল্ড পাশের ঘর থেকে ছোট চৌপায়া টেবলটা নিয়ে এল, যার সাহায্যে এক সপ্তাহ আগেও প্রেত আবাহন করা হয়েছিল।

সেদিন মিঃ ডিউক এখানে ছিলেন,মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু আজ তিনি নেই।

তা নেই ঠিকই, মিঃ রাইক্রফট বললেন, তার জায়গায় মিঃ এন্ডারবি আছেন।

মাপ করবেন, চালর্স এন্ডারবি প্রতিবাদের সুরে বলল, আমি একজন সাংবাদিক, অলৌকিক ব্যাপারে আর ভূতপ্রেত নিয়ে খেলায় আমার আদৌ বিশ্বাস নেই। আমি বড়জোর প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে এখানে উপস্থিত থাকব আর যা কিছু ঘটবে সব লিখে নেব শর্টহ্যান্ডে।

যিনি এক সপ্তাহ আগে শুক্রবার দিন যেখানে বসেছিলেন আজও তিনি সেখানে বসলেন। চালর্স এন্ডারবি কৌচ ছেড়ে উঠে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল, ফায়ারপ্লেসের আগুনের মৃদু আভায় উপস্থিত সবার ছায়া ঠিকরে পড়েছে ঘরের দেয়ালে যার ফলে কাউকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।

তাহলে এবার শুরু করা যাক, মিঃ রাইক্রফট বললেন, এখন ঘড়িতে সময় বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। গত শুক্রবার দিন ঠিক এই সময় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছিলেন।

তার কথা শেষ হবার আগেই ভায়োলেটের চাপা গলার আর্তনাদ শোনা গেল, সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। ব্রায়ান পিয়ার্সন উঠে ঘরের আলো জ্বালাল, তারপর এগিয়ে এসে সদর দরজা খুলে দিল। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল তিনজন লোক, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, এমিলি ট্রেফুসিস, আর মিঃ ডিউক। ওঁদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখে সবাই বেশ বিচলিত হল।

পায়ে পায়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, পকেট থেকে রিভলভার বের করে উপস্থিত এক ব্যক্তির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, মেজর জন বারবি গত শুক্রবার দিন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার অভিযোগে আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করলাম। আপনাকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি যে এখন থেকে আপনি যা কিছু বলবেন তা বিচারের সময় আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে। আপনাকে এবার আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

.

২১.

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের কথায় ঘরের ভেতর যেন ভূমিকম্প হল, এই অভাবিত পরিণামের জন্য উপস্থিত কেউই মানসিক দিক থেকে তৈরি ছিলেন না। সবাই তাই বিস্মিত অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়েই রইল। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আর দাঁড়ালেন না, তিনি গাড়ি নিয়েই এসেছিলেন, আসামী মেজর বারনাবির হাতে হাতকড়া পরিয়ে তখনই গাড়িতে নিয়ে তুললেন তিনি। একটু পরেই তার গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ শুনতে পেলেন সবাই।

কিছুই বুঝতে পারলাম না ছাই, চার্লস এন্ডারবি মন্তব্য করল, আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, সাংবাদিক হিসাবে আমি একটা গাধাকে এখনও ছাপিয়ে উঠতে পারি নি। যাক এমিলি, ব্যাপারটা কি খুলে বলবে কি? দোহাই তোমায়, একটু ঝেড়ে কাশশা। রাতের আগেই খবরটা লিখে সিটি অফিসে টেলিগ্রাফ করতে হবে।

ব্যাপারটা এই যে, মেজর বারনাবিই তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করেছিলেন, এমিলি মন্তব্য করুল।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তো মেজর বারনাবিকে গ্রেপ্তার করলেন দেখলাম, চালর্স বলল, মনে হচ্ছে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ভুল করেন নি। তবু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওঁর বন্ধু মেজর বারনাবির হাতে কিভাবে খুন হলেন সেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। এতবড় একটা ঘটনা সবার চোখের আড়ালে ঘটল কি করে? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যদি সত্যিই বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে খুন হয়ে থাকেন।

ভুল, এমিলি বাধা দিয়ে বলল, উনি ঠিক সন্ধ্যে পৌনে ছটা নাগাদ খুন হয়েছিলেন। সব খুলে না বললে তোমরা বুঝতে পারবে না। জেনে রাখো, এই সমস্যার সমাধানের মূলে আছে স্কি।

স্কি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল সবাই।

হ্যাঁ, ঘাড় নেড়ে এমিলি জবাব দিল, মেজর বারনাবি আগে থাকতেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন আর তার গোটা ব্যাপারটাতে অলৌকিকের ছোঁয়া দেবার উদ্দেশ্যে যেদিনের প্রেতচর্চার অনুষ্ঠানে কৌশলে টেবলের পায়া মেঝেতে ঠুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যেন জনৈক অশরীরী প্রেতাত্মা এসে জানিয়ে গেল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন। মেজর বারনাবির পরিকল্পনা ছিল খুবই নির্ভুল, এখানে বসেই সেদিন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একটু পরেই প্রচণ্ড তুষারপাত আবার নতুন করে শুরু হবে, আর তার ফলে পথের ওপর জুতোর যাবতীয় ছাপ আর অন্যান্য দাগ সবই যাবে মুছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন এমন একটা ধারণা তার আচরণে কথাবার্তায় সেদিন সবার মনে গেঁথে গেল, তার পর তিনিই আবার রওনা হলেন এক্সহাম্পটনের দিকে, যাবার আগে সবাইকে জানিয়ে গেলেন প্রেতাত্মার জবানী শুনে তিনি ভয়ানক বিচলিত হয়েছেন, তাই তার অন্তরঙ্গ বন্ধু সত্যিই কেমন আছেন তা নিজের চোখে যাচাই করে দেখতে যাচ্ছেন তিনি। এরপরে মেজর বারনাবি সোজা তার নিজের বাড়িতে গেলেন, বাগানের ভেতর একটি ছাউনীতে মাঝধরার ছিপ আর জালের সঙ্গে একজোড়া স্কিও রাখা ছিল, সেই স্কি পায়ে গলিয়ে তিনি রওনা হলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির দিকে। মেজর বারনাবি একজন তুখোড় স্কি দৌড়বাজ, তাই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই।

হ্যাজেলমুরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়িতে পৌঁছে মেজর বারনাবি পেছন দিক দিয়ে এসে হাজির হলেন বসার ঘরের জানালার সামনে। সেখানে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বসার ঘরেই আছেন, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জানালার কঁচের শার্সিতে টোকা দিলেন তিনি। মেজর বারনাবি নিশ্চয়ই সেই জানালা দিয়ে এর আগেও ওই বাড়িতে ঢুকেছেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান সেদিনও জানালা খুলে দিলেন আর মেজর বারনাবি সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লেন তার বাড়ির ভেতরে। দুজনের মধ্যে এরপর কি কথাবার্তা হয়েছিল তা এখন বলতে পারব না কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে কথাবার্তার ফাঁকে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান পেছনে ফিরেছিলেন আর সেই সুযোগে হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা ধাতুর হাতল তুলে নিয়ে মেজর বারনাবি পেছন থেকে সাজোরে আঘাত হানেন তার মাথায়। সে আঘাত কতটা প্রচণ্ড ছিল আশাকরি বুঝতে পারছেন সবাই, কারণ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান এক আঘাতেই মারা যান।

আততায়ী মেজর বারনাবির হাতে প্রচুর সময় ছিল, নিজের পা থেকে স্কি দুটো খুলে তিনি এরপর খাবার ঘরের আলমারীর ভেতর রাখা অন্যান্য জিনিসপত্রের ফাঁকে খুঁজে রাখেন। এরপর আমার ধারণা তিনি বসার ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্রের দেরাজ খুলে ভেতরের সবকিছু তছনছ করেন, লণ্ডভণ্ড করেন ঘরের বাকি সবকিছু। এগুলো করার পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল একটিই, তাহল, যাতে পুলিশ এবং বাইরের লোক প্রথম দর্শনে এটাই ধরে নেয় যে কোনও চোরাচোড় কোনমতে জানালা খুলে ভেতরে ঢুকেছে যাকে বাধা দিতে গিয়ে খুন হয়েছেন গৃহস্বামী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান। এসব কাজকর্ম সারতে সারতে মেজর বারনাবির রাত অনেকটা বেজে গিয়েছিল। এরপর বাইরে বেরিয়ে ঘুরপথে চড়াই বেয়ে তিনি ফিরে যান, তাঁকে দেখে তিনি এটাই ধরে নেয় যে অনেকখানি পথ হেঁটে তাকে ফিরতে হয়েছে। স্কি সম্পর্কে কারও মনে সন্দেহ না জাগা পর্যন্ত মেজর বারনাবি ছিলেন সম্পূর্ণ নিরাপদ।

আপনি যা বলছেন তা তো রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার, মিস ট্রেফুসিস, মিঃ রাইক্রফট বললেন, মেজর বারনাবি আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান দুজনেই ছিলেন পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু।

জানি, এমিলি সায় দিয়ে বলল, আমার নিজেরও গোড়ায় সেই ধারণা ছিল। অনেক মাথা খাঁটিয়েও সমস্যার সমাধান খুঁজে পাইনি। শেষকালে তাই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আর মিঃ ডিউকের শরণ নিতে হয়েছিল। কথা শেষ করে এমিলি তাকাল মিঃ ডিউকের দিকে, প্রশ্ন করল মিঃ ডিউক?

বেশ তো, মুখ টিপে হাসলেন মিঃ ডিউক, ইচ্ছে হলে বলুন, মিস ট্রেফুসিস।

চার্লস, মিঃ এন্ডারবির দিকে তাকিয়ে এমিলি বলতে লাগল, তোমার মনে পড়ে ইভানস তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছিল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান প্রায়ই বিভিন্ন ফুটবল বিষয়ক ক্রসওয়ার্ড পাজলের সমাধান তার নামে পাঠিয়ে দিতেন খবরের কাগজের অফিসে। তিনি ওই পাজলের একটি সমাধান পাঠান তার তাতে হ্যাজেলমুরের বদলে সিটাফোর্ড হাউসের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করেন।

শুক্রবার সকালবেলা খবরের কাগজের অফিস থেকে পাঠানো একটি চিঠি পড়ে মেজর বারনাবি জানতে পারেন যে ফুটবল বিষয়ক একটি ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করে পাঁচহাজার পাউন্ড পুরস্কার পেয়েছেন তার বন্ধু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান। অবশ্য জবানবন্দীতে মেজর ওই চিঠি পাবার কথা অস্বীকার করেছেন এবং এও বলেছেন যে আবহাওয়া খারাপ হবার দরুন শুক্রবার দিন সকালবেলা কোনও চিঠিপত্রই আসে নি। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে আমি জেনেছি এটা নির্জলা মিথ্যে, শুক্রবার দিন সকালে অন্যান্য দিনের মতো ডাক ঠিকই বিলি হয়েছিল স্থানীয় ডাকঘর থেকে। মেজর বারনাবির যেকোন কারণেই তোক খুব টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল, ওই চিঠি পড়ে তিনি তখনই স্থির করলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করে পুরো টাকাটা নিজে হাতিয়ে নেবেন।

অভাবনীয়, মিঃ রাইক্রফট প্রশংসার সুরে মন্তব্য করলেন, এত স্বপ্নেও ভাবা যায় না। কিন্তু এইভাবে অনুসন্ধান করতে কে শেখাল আপনাকে। কে আপনাকে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল?

উত্তর দিতে গিয়ে এমিলি মিসেস বেলিং-এর লেখা সেই চিঠির উল্লেখ করল আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ফায়ারপ্লেসের টিমনির ভেতর থেকে কিভাবে তার হারানো বুটজোড়া উদ্ধার করেছিল তাও জানাল।

এক নজর তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওটা স্কি করার বুট, এমিলি আবার বলতে শুরু করল, আর তখনই পরপর কতগুলো সম্ভাবনা ফিল্মের মতো ফুটে উঠল মনের কোণে। দেরী না করে তখনই ছুটে গেলাম নিচে। একটা স্কি আরেকটার চাইতে আকারে ছোট ছিল যা দেখে মনে ধারণা হয়েছিল যে নিশ্চয়ই ওখানে দুজোড়া স্কি আছে। হারানো বুটজোড়া লম্বা স্কি দুটোর সঙ্গে চমৎকারভাবে খাপ খেয়েছিল, ছোট দুটোর সঙ্গে মোটেই খাপ খায়নি।

কিন্তু মেজর বারনাবি বুটজোড়া লুকোতে গেলেন কেন? মিঃ রাইক্রফট জানতে চাইলেন।

আমার মনে হয় পুলিশ সব জানতে পারবে এই ভয় পেয়েই উনি কাজটা করেছিলেন, এমিলি জবাব দিল, হয়তো স্কি দেখলেই ওরা প্রয়োজনীয় সূত্র পেয়ে যাবে এমনটাই উনি ধরে নিয়েছিলেন। তাই ওই বুটজোড়া খবরের কাগজে মুড়ে মেজর বারনাবি ফায়ারপ্লেসের চিমনির ভেতরে গুঁজে রাখেন, আর ওইখানেই উনি সব চাইতে বড় ভুল করে বসলেন। মনিবের বুটজোড়া খোয়া গেছে তা ইভানসের চোখ এড়াল না আর যথাসময়ে সে আমার কানেও পৌঁছে দিল।

মেজর বারবি কি জেনেশুনে ইচ্ছে করে খুনের দায় জিম পিয়ার্সনের ওপর চাপাতে চেয়েছিলেন? ব্রায়ান পিয়ার্সন গম্ভীর গলায় জানতে চাইল।

না, তা নয়, এমিলি জবাব দিল, আসলে জিম একটা বোকা হাঁদা, নিজের নির্বুদ্ধিতার ফলেই ওর এই হাল হয়েছে।

জিমকে নিয়ে তখন আর চিন্তার কোনও কারণ নেই, এমিলি, বলতে বলতে চার্লস এন্ডারবি উঠে দাঁড়াল, ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে কেউ ঠেকাতে পারবে না তা তো বুঝতেই পারছে। যা এবার আমি তাহলে টেলিগ্রাফ অফিসে চললাম, মেজর বারনাবির গ্রেপ্তারের এই খবরটা আজ রাতের মধ্যেই আমার অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। আপনারা আমায় মাফ করবেন, আমায় এক্ষুনি বেরোতে হবে। কথা শেষ করেই ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল চার্লস এন্ডারবি।

আসল অপরাধী ধরা পড়ল বটে কিন্তু সবদিক পুরোপুরি লক্ষ্য হল না, ভায়োলেট এমিলিকে বাইরে নিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, হতভাগা বাপটার কথা ভেবে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

কার কথা বলছ? এমিলি অবাক হয়ে জানতে চাইল, তোমার বাবা?

ঠিক তাই, ভায়োলেটের ঠোঁটে করুণ হাসি ফুটে উঠল, কদিন আগে প্রিন্সটাউন জেলখানা থেকে যে কয়েদিটি পালিয়েছিল সেই হতভাগ্য আমার বাবা। তোমার প্রণয়ী জিমের মেজ ভাই ব্রায়ানের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া থেকে জাহাজে আসার পথে আলাপ হয়েছিল, তখনই আমরা দুজনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। ব্রায়নই পরিকল্পনা করেছিল যে বাবা জেল ভেঙ্গে পালিয়ে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে তারপর সে তার বাবা এখানে আমাদের দুজন পুরুষ ভৃত্য হিসাবে বাস করবে, যাদের দেখে কারও মনে কোনওরকম সন্দেহ জাগবে না। ব্রায়ানের পরিকল্পনা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তারপর ব্রায়নই এই বাড়ির খোঁজ আমাদের দিয়েছিল, ও নিজেই উদ্যোগী হয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ির ওই অংশটা আমরা যাতে ভাড়ায় থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

তা তোমার বাবা এখন কোথায়? এমিলি জানতে চাইল, পুলিশ কি তাকে গ্রেপ্তার করে আবার জেলে পাঠিয়েছে?

না, আবার করুণ হাসি হাসল ভায়োলেট, প্রচণ্ড তুষারপাতে ঠাণ্ডা লেগে বাবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, এখন আর তার বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। জেলে যাবার বছর পনেরো আগে ঘোড়ার পায়ের লাথিতে মাথায় চোট পেয়েছিলেন বাবা, তারপর থেকে মাথার অসুখে ভুগছেন তিনি, ব্রায়ান বলেছিল ভালবাবে চিকিৎসা করলে হয়তো তার এই রোগ সেরে যেতেও পারে আর তাই সে তার জেল ভেঙ্গে পালানো পরিকল্পনা করেছিল।

আমায় দেখতে যতই ভাল হোক না কেন, আসলে আমার বাবা যে একজন কয়েদী, যে জেল ভেঙ্গে পালিয়েছে এই ব্যাপারটা আমার গায়ে চেপে বসেছে তা নিশ্চয়ই জানবে। এমিলি এইসব জানবার পরে কোনও ভদ্রবংশীয় যুবক আমায় গ্রহণ করবে না। সেদিন থেকে ব্রায়ান সত্যিই মহান, তাকে জীবনে কখনও ভুলতে পারব না।

.

২২.

বেচারী ভায়োলেট, এমিলি সহানুভূতির সুরে বলল, তোমার কথা ভেবে সত্যিই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।মন্তব্য করে এমিলি আর দাঁড়াল না, উপস্থিত সবার কাছে তখনকার মত বিদায় নিয়ে সিটাফোর্ড হাউস থেকে বেরিয়ে এল সে, হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছল মিস পার্সিহাউসের বাড়িতে।

কেমন? তখনই বলেছিলাম না যে মেজর বারনাবি অত্যন্ত নীচ, স্বার্থপর আর হিংসুটে লোক? বারনাবির গ্রেপ্তারের বিবরণ এমিলির মুখ থেকে শুনে মিস পার্সিহাউস বলে উঠলেন, এমন একটা জঘন্য স্বভাবের লোকের সঙ্গে গত কুড়ি বছর ধরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কি করে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন সেটাই ভাবার বিষয়। স্কি চড়া, ঘোড়ায় চড়া, পাহাড়ে ওঠা, রাইফেল শুটিং আর ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার সমাধান করা, এ সবের কোনটিতেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাগাল কোনদিন পায়নি বারনাবি। তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছিলেন ধনী লোক, সেই তুলনায় মেজর বারনাবি ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত, এক কথায় গরীব মানুষ। যাক এবার বলো তুমি কি করবে।

আমি এবার লন্ডনে যাব, এমিলি বলল, সেখানে জিম যে বীমা কোম্পানীতে চাকরী করছে সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করব যাতে সামান্য কিছু টাকা না বলে ধার নেবার অপরাধে ওঁরা যেন জিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করেন।

হুম, কোনও মন্তব্য না করে গম্ভীর শব্দটি উচ্চারণ করলেন রণি গারফিল্ডের মাসী মিস পার্সিহাউস।

জিমের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আশাকরি, এমিলি বলল, মনে হয় ভবিষ্যতে এমন ভুল আর কখনও করবে না সে।

তা না হয় হল, মিস পার্সিহাউস বললেন, তারপরেও তোমার করণীয় একটা কাজ আছে তা নিশ্চয়ই মনে আছে?

কোন কাজ বলুন তো,এমিলি অবাক হয়ে বলল, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না?

বটে! রাগত সুরে রণির মাসী বলে উঠলেন, আবার ন্যাকামি হচ্ছে? জিম আর চার্লস এন্ডারবি, এদের দুজনের মধ্যে জীবনসঙ্গী হিসাবে কাকে বেছে নেবে জানতে চাইছি।

কেন এ প্রশ্ন করছ মাসী। এমিলি এবার সত্যিই ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলে উঠল, আমার বর যে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে তা তো তোমার জানা আছে।

মিস পার্সিহাউস কোনও মন্তব্য না করে শুধু মুখ টিপে হাসলেন। এমিলি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল আর সঙ্গে সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চার্লস এন্ডারবির সঙ্গে।

এমিলি! এন্ডারবি এমিলির দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, সত্যিই গো সোনামণি, তোমার তুলনা নেই। আমি এবার তোমায় চুমু না খেয়ে ছাড়ছি না, বলে সে পথের মঝখানে সত্যিই এমিলিকে জড়িয়ে ধরে পরপর কয়েকবার চুমু খেল।

আঃ চার্লস, এমিলি মৃদু গলায় ধমকে উঠল, রাস্তার মধ্যে কি অসভ্যতা করছে।

সে না হয় ছেড়ে দিচ্ছি, এন্ডারবি এমিলির হাত ছেড়ে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল, পিয়ার্সনের নির্দোষিতা প্রমাণ হয়েছে, পুলিশ তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে।

তুমি কি বলতে চাইছো বল তো চার্লস, এমিলি বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

এমিলি, এন্ডারবি গদ গদ গলায় বলে উঠল, বিশ্বাস করো, আমি তোমায় কতটা ভালবাসি তা তুমি কোনদিন টেরও পাবে না। তুমি নিজেও যে আমায় একই রকম ভালবাসো তাও জানতে আমার বাকি নেই। তা এইভাবে আর কতদিন চলবে বলো? সবকিছু যখন ভালোয় ভালোয় মিটে গেল তখন এসো এবার আমরা দুজনে বিয়ে করে ঘর সংসার বাঁধি। তা কিরকম বিয়ে তোমার পছন্দ তা বলো, গীর্জায় নিয়ে নাকি রেজিস্ট্রি করে, কিভাবে তুমি বিয়ে করতে চাও?

ওঃ, তুমি বিয়ের কথা বলছ, এমিলি বলল, তাহলে আর আমার করার মতো কিছু নেই।

সেকি কিন্তু –এমিলি–

না, তুমি যা চাইছো, তা কখনোই হতে পারে না, কঠিন গলায় বলে উঠল এমিলি।

কিন্তু এমিলি–

শোন চার্লস, একইরকম দৃঢ় গলায় বলল এমিলি, আমি জিমকে ভালবেসে এসেছি, এতো কাণ্ডের পরে এখনও মনপ্রাণ দিয়ে শুধু ওকেই ভালোবাসি, ওর জায়গায় আর কাউকে আমি বসাতে পারব না, ওর বদলে আর কাউকে আমি কখনো কোনও মতে বিয়ে করতে পারব না।

 সত্যিই পারবে না? অবাক চোখ এমিলির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল চার্লস এন্ডারবি, তুমি এতো নিষ্ঠুর? এত নির্মম?

তোমার মন যা চায় তাই বলে আশা মিটিয়ে আমায় গাল দিতে পারো চার্লস, এমিলি বলল, কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত থেকে আমায় একচুলও নড়াতে পারবে না। আচ্ছা, তুমিই বা আমাকে পাবার জন্য এত পাগল হয়েছে কেন বলো তো? তুমি একজন তরুণ সাংবাদিক, দ্য ডেইলি অয়্যার কাগজের জন্য এক দারুণ এক্সকুসিভ স্কুপ জোগাড় করেছে। কে জানে এই স্কুপই হয়তো তোমার উন্নতির দুয়ার খুলে দেবে। তুমি হলে সেই জাতের পুরুষ যে নিজের ভাগ্য নিজের হাতে গড়ে। এককথায় খাঁটি শক্তিশালি পুরুষ মানুষ যারা তাদের কাছে আমার মতো এক সাধারণ নারীর কোনও মূল্যই নেই। তুচ্ছ কারণে নাকি কান্না কাদা আর সবসময় তার মতো আঁকড়ে ধরে থাকা, এছাড়া আমি তোমার আর কিই বা করেত পারি? এমনও হতে পারে যে আজ তুচ্ছ আর অলীক চোখের নেশায় তুমি আমায় স্ত্রী হিসাবে পেতে চাইছো তা চিরস্থায়ী হবে না, হয়তো ভবিষ্যতে আমিই হয়ে দাঁড়াব তোমার জীবনের পাপগ্রহ যখন প্রতি মুহূর্তে প্রতি পদে তুমি আমার মৃত্যু কামনা করবে? আমি তো তোমার জীবন বিষিয়েও দিতে পারি? না চার্লস, তুমি শক্তসমর্থ মানুষ, যথার্থ অর্থে পুরুষ, জীবনের চলার পথে তোমার নারী না হলেও চলবে, অন্ততঃ আমার মতো নারীর কোনও প্রয়োজনই তোমার হবে না…..

দোহাই তোমার এমিলি, চার্লস এন্ডারবি করুণ চোখে তার দিকে তাকাল, অনর্থক ওসব নিয়ে শীতকালের এই সুন্দর সন্ধ্যাটা নষ্ট করে দিয়ো না। তোমার মুখে রাজনৈতিক নেতাদের মতো এতো বকবকানি শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগছে না। তুমি যে আঘাত দিলে তাতে আমার বুক ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে গেছে। তবু বিশ্বাস করবে কিনা জানি না তবু বলছি ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আর মিঃ ডিউককে সঙ্গে নিয়ে যখন তুমি মিসেস উইলেটের বসার ঘরে ঢুকলে তখন তোমায় কি সুন্দর দেখাচ্ছিল তা ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। তোমায় ঠিক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না, বিজয়ী সিংহীর মতো মনে হচ্ছিল যে এইমাত্র শিকার সেরে বিজয়ীর মত এসে দাঁড়াল।

চার্লসের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ভারী বুটের আওয়াজ তুলে সেখানে এসে দাঁড়ালেন মিঃ ডিউক।

এই যে মিঃ ডিউক, এমিলি মুচকি হেসে বলল, ভালই হয়েছে আপনি এসেছেন। চার্লস, ইনি হলেন মিঃ ডিউক, একসময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চীফ ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ ছিলেন।

কী আশ্চর্য! অবাক সুরে চার্লস বলে উঠল, আপনি সেই চীফ ইন্সপেক্টর ডিউক? আমি তো নিজের কান আর চোখকে বিশ্বাস করতেই পারছি না।

একসময় আপনি তো আমাদের কাছে স্বপ্নের মানুষ ছিলেন মশাই, গল্পের গোয়েন্দাদের মতো আমরা শ্রদ্ধা করতাম আপনাকে। যাক, আপনার সঙ্গে পরিচয় হতে আমি নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি দ্য ডেইলি অয়্যার পত্রিকার একজন সাংবাদিক, আমার পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে অনুরোধ করছি সাত আটশো শব্দের মধ্যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর খুনের মামলাটা সহজ ভাষায় সত্য কাহিনীর ঢংয়ে লিখে দিন না, আমরা ওটা রবিবারের পাতায় ছাপাব। আমাদের পাঠকেরা এই ধরনের সত্যকাহিনী খুব আগ্রহ সহকারে পড়েন। আপনি লেখাটা অফিসে সরাসরি আমার নামে পাঠিয়ে দেবেন, আমার হাতে এলেই আমি পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকা চেক কেটে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব, তাও এক হাজার পাউন্ডের কম কিছুতেই হবে না জানবেন।

নিশ্চয়ই লিখব, মিঃ ডিউক হেসে বললেন, তবে আমি তো লেখক নই, কাজেই সোজা ভাষায় যা লেখার লিখে দেব, আপনারা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে ছাপিয়ে দেবেন।

মিঃ ডিউককে চার্লস এন্ডারবির সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে এমিলি দৌড়ে গিয়ে ঢুকল মিসেস কার্টিসের বাড়িতে। মিসেস কার্টিস বিছানায় বসেছিলেন, এমিলিকে দেখে তড়াক করে উঠে বসে বললেন, তাহলে মিস ট্রেফুসিস, এখানকার পাট তুলে দিয়ে আপনি তাহলে চললেন?

ঠিক বলেছেন, এমিলি বলল, এখন আমি লন্ডনে যাব, আর আমার সঙ্গে উনিও যাবেন।

এবার তাহলে বলে ফেলুন তো মিস ট্রেফুসিস, মিসেস কার্টিস অন্তরঙ্গ হবার সুরে বললেন, দুজনের মধ্যে কার সঙ্গে ঝুলে পড়বেন বলে ঠিক করলেন?

এ আর মুখ ফুটে বলার কি আছে, এমিলি মুখ টিপে হাসল, ঝুলে তো একজনের সঙ্গেই পড়ব বলে স্থির করে রেখেছি, যাকে বেকসুর খালাস করে আনব বলে আমার এখানে আসা। সে কে তা তো জানেনই ম্যাডাম, তার নাম জিম পিয়ার্সন।

সে কি বাছা! মিসেস কার্টিস বিস্ময়ে দুচোখ কপালে তুলে বললেন, তুমি কথাটা সত্যিই মন থেকে বলছ তো? মিঃ এন্ডারবি এই তদন্তের কাজে তোমায় এত সাহায্য করলেন, অথচ

মিসেস কার্টিস, বাচ্ছা ছেলেমেয়েদের বোঝনোর মতো করে এমিলি বলল, আমি নই, আসলে ভুল করেছেন আপনি নিজে। মিঃ এন্ডারবি একজন প্রতিভাসম্পন্ন সাংবাদিক, তার সামনে বিশাল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। পায়ের নিচে পড়ে আছে গোটা দুনিয়া। বিয়ে করে ঘর বাঁধার জন্য ওঁর জন্ম হয়নি। কিন্তু আমি যাকে এতদিন ভালবেসে এসেছি আর আজ যদি তাকে বিয়ে না করি, তাহলে জানবেন ওঁর অবস্থা সত্যিই খুব অসহায় হয়ে দাঁড়াবে।

জানতাম বাচ্ছা, মিসেস কাটিস বললেন, এর চাইতে কোনও জোরালো অজুহাত তোলা মুখে জোগাবে না। কথা শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মিসেস কার্টিস নেমে এলেন একতলায়, সেখানে তার স্বামী মিঃ কার্টিস একটা কৌচে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন সামনের দিকে।

এই যে আমার উনি, ইশারায় স্বামীকে দেখিয়ে মিসেস কার্টিস মন্তব্য করলেন, আমার বড় জ্যাঠাইমার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। হতচ্ছাড়া জর্জ প্লাংকেটকে বিয়ে করলেন আর ঠিক তারপরেই ওঁর সরাইখানা দেনার দায়ে বাঁধা পড়ল। অবশ্য তার দুবছরের মধ্যেই বড় জ্যাঠাইমা দেনা পুরো মিটিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর তো সেই কারবারের দারুণ রমরমা।

হুম, মিঃ কার্টিস আপন মনেই মন্তব্য করলেন।

 জর্জ প্ল্যাংকেট লোকটি দেখতে ছিল খুবই সুন্দর, মিসেস কার্টিস মন্তব্য করলেন।

যাকে এককথায় বলে রমনীমোহন পুরুষ। কত নারী যে ওঁর জীবনে এসেছে তার লেখাজোখা নেই। অথচ মজার ব্যাপার হল বড় জ্যাঠাইমাকে বিয়ে করার পর বাকি জীবনে উনি অন্য কোনও নারীর দিকে মুখ তুলে তাকান নি।

হুম,! তৃতীয়বার মিঃ কার্টিস আবার সেই একরকম গম্ভীর শব্দ উচ্চারণ করলেন।