২০.
আবার ছোটার পালা। কিন্তু যাবে কোনদিকে?
লবি থেকে বেরিয়ে অন্ধকার ডাইনিং রূমে ঢুকল ওরা। চোখ মিটমিট করে দৃষ্টির সামনে থেকে অন্ধকার দূর করতে চাইল কিশোর। বদ্ধ, ভাপসা, ভারী বাতাসে দম আটকে আসতে চাইছে।
ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল তিনজনে। বড় জানালাটা দিয়ে আকাশ চোখে পড়ছে। রাতের আকাশ, কিন্তু তারা নেই। মেঘে ঢাকা। ঘর আর বাইরে অন্ধকারের কোন তফাৎ নেই।
বাইরে চলে যাবে? বনে ঢুকে পড়বে আবার? বনই হলো তাড়া খাওয়া জানোয়ারের আশ্রয়স্থল।
কোথায় যাব? ফিসফিস করে জানতে চাইল মুসা।
লবির দরজার দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। মিলার বেরোন কিনা। দেখল।
বেরোলেন না।
কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। সুড়ঙ্গটায় ঢুকে পড়লে কেমন হয়?
ঠিক! সমর্থন করল কিশোর। পুলিশ না আসাতক লুকিয়ে থাকতে পারব ওখানে।
পুলিশ! কোথায় ওরা? বিশ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে।
আমারও মনে হচ্ছে ওখানেই নিরাপদ, ভীতকণ্ঠে বলল রবিন।
অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এগোল ওরা। খুঁজে বের করল মঞ্চটা। ফিসফিস করে কিশোর বলল, ধরাধরি করে এমনভাবে সরাতে হবে, যাতে শব্দ না হয়…
ঘরের অন্যপ্রান্তে খসখস শব্দ হলো।
মিলার নাকি?
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মঞ্চটা খুঁজতে শুরু করল কিশোরের চোখ। সয়ে এসেছে। আবছামত দেখতে পাচ্ছে চেয়ার-টেবিলগুলোর অবয়ব।
কেউ নেই।
মঞ্চটা সরাল ওরা। সতর্ক থাকার পরেও শব্দ হয়েই গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কেউ আসে কিনা। এল না। দরজাটা খুলল তখন।
সুড়ঙ্গের মধ্যে আরও বেশি গরম। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। আঠা হয়ে যায় শরীর। ছত্রাকের গন্ধ।
পিঠ চুলকাচ্ছে কিশোরের। দুই কাঁধ ব্যথা করছে। পায়ে তো ব্যথা আছেই। অন্ধকারে আঁকাবাকা সুড়ঙ্গে পাগলের মত দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা। অনেক কষ্টে রোধ করল। তাড়াতাড়ি ছুটে কোন লাভ নেই।
রবিনও বুঝতে পারছে সেটা। মনের ভাবনাটাকেই প্রকাশ করে ফেলল, লুকানো হয়তো যায়, কিন্তু পালাতে পারব না।
ওর কাঁধে হাত রাখল মুসা, ভয় পাচ্ছ?
তুমি পাচ্ছ না?
পাচ্ছি।
হাঁটো, কিশোর বলল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও ঠিক নয়।
বেশি দূরে যাওয়াটাও ঠিক হবে না, রবিন বলল। পুলিশ এলে শুনতে পাব না।…মুসা, টর্চটা জালো তো। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না।
কোমরে হাত দিয়েই বলে উঠল মুসা, যাহ, গেল!
কি?
আনতে মনে নেই। লবির টেবিলেই রয়ে গেছে।
দারুণ! মরণ বোধহয় আজ ঠেকাতে পারলাম না।
দৌড়ে গিয়ে ডাইনিং রূমের আলমারি থেকে খুঁজে নিয়ে আসব নাকি?
না, সময় নেই, বাধা দিল কিশোর। হাঁটতে থাকো।
এগিয়ে চলল ওরা। কান পেতে রেখেছে। মিলার পিছু নিলে যাতে শুনতে পায়। মুখে, মাথায় জড়িয়ে যাচ্ছে মাকড়সার জাল। হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে জ্যান্ত মাকড়সা লাগছে হাতে। কিলবিল করে উঠে যাচ্ছে গায়ের ওপর। থাবা দিয়ে সরাতে গিয়ে একটাকে ভর্তা করে দিল মুসা। ভেজা চটচটে পদার্থ লেগে গেল হাতে। প্যান্টে ডলে মুছল হাতটা।
কতক্ষণ হাঁটল ওরা বলতে পারবে না। অন্ধকারে সময়ের হিসেব রাখা কঠিন। ঢালু হয়ে আসছে সুড়ঙ্গের মেঝে। আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খাইছে!
কি?
কি হয়েছে?
জানতে চাইল রবিন আর কিশোর।
দরজা!
কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এই তো, কাঠ। হাত দিলেই বোঝা যায়…নিশ্চয় ওই ঘরটা, যেটাতে মড়ার খুলি… ভয়ে কথাটা আর শেষ করল না মুসা।
কাছে সরে এল কিশোর। কই, দেখি?
ঠেলা দিতে খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। দরজার পাশে দেয়ালে হাত রাখতে সুইচবোর্ডটা পেয়ে গেল কিশোর। আলো জ্বলল। ছাত থেকে ঝুলে থাকা মৃদু পাওয়ারের একটা বাল্ব।
ছোট ঘর। যে ঘরটাতে খুলি দেখেছিল, সেটা নয়। এটা অন্য ঘর। একটা বড় বিছানা আছে। একটা নাইটস্ট্যান্ড, দুই ড্রয়ারের ড্রেসার এবং একটা টেলিফোনও আছে।
আরেকবার ফোন করে দেখো না পুলিশকে, গলা থেকে মাকড়সার জাল টেনে সরাতে সরাতে বলল রবিন, ওরা লোক পাঠাল কিনা?
কথাটা মন্দ না। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর।
নীরব। ডায়াল টোন নেই।
ডেড, আনমনে বলল সে।
হু, আমাদের মত, বিড়বিড় করল মুসা। পার্থক্য শুধু এটা হয়ে গেছে, আমাদের হতে বাকি আছে…
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, এখানকার সব ফোনই কিন্তু একটা সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে গেছে। মনে নেই সেদিন, গেট থেকে ফোন করার সময়…
ঝট করে রবিনের দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। বড় বড় হয়ে গেছে। চোখ। তাই তো! ইস, কি বোকা আমি! সামনের অফিসে রয়েছে। সুইচবোর্ডটা।
তাতে কি হয়েছে? মুসার প্রশ্ন।
কি হয়েছে এখনও বুঝতে পারছ না? রিসিভারে আঙুলগুলো চেপে বসেছে কিশোরের। সমস্ত কল যায় সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে। পাইরেট আইল্যান্ডে পুলিশকে যে ফোন করেছি সেটাও গেছে। রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে দুর্বল ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়ল সে।
অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল মিলার, রবিন বুঝে ফেলেছে। মুখ কালো হয়ে গেছে তারও। মুসার দিকে তাকাল, ওর মুখের রহস্যময় হাসিটা লক্ষ করোনি?
আমি করেছি, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর, এতক্ষণে বুঝলাম পুলিশ এল না কেন। ওদের সঙ্গে কথাই বলতে পারিনি। বলেছি মিলারের সঙ্গে। কণ্ঠস্বরটা অমন ভোঁতা শোনাচ্ছিল কেন এখন পরিষ্কার। রিসিভারে রুমাল চেপে ধরে কথা বলছিল।
হু, পাগল হলেও বুদ্ধি ঠিক আছে ষোলোআনা, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। ধপ করে কিশোরের পাশে বসে পড়ল সে। তারমানে আমাদের উদ্ধার। করতে আর আসছে না কেউ।
নাহ, দরজার দিকে তাকাল কিশোর। যা করার আমাদের নিজেদেরই করতে হবে এখন। ছাতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, আন্ট জোয়ালিন!
কি?
আন্ট জোয়ালিনের কথা বলছি। কোরি যতবার ফোন করেছে, ততবার সুইচবোর্ডের কাছে বসে বোর্ডটা কন্ট্রোল করেছে মিলার। একটা কলও আন্ট জোয়ালিনের কাছে যেতে দেয়নি। সেজন্যেই মিস ভায়োলার বাড়িতে ফোন করে কোন জবাব পায়নি কোরি। আন্ট জোয়ালিন এখানে আসেন এটা চায়নি মিলার। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে খুশি হয়েছে। তার পার্টির ব্যাপারে নাক গলাতেন তিনি, ঝামেলা তো অবশ্যই করতেন…
চলো এখান থেকে বেরিয়ে যাই, উঠে দরজার কাছে চলে গেল মুসা। ডাইনিং রূমের খুব কাছাকাছি রয়েছি আমরা। যে কোন সময় চলে আসতে পারে পাগলটা।
কোথায় যাব? হাতের তালুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে রইল কিশোর।
সৈকতে। ওখানেই তো পালিয়েছিলাম।
কি হবে তাতে?
হয়তো হবে না কিছু। কিন্তু এখানে যেমন, ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের অবস্থা তো আর হবে না। দৌড়াদৌড়ি করার অন্তত সুযোগ থাকবে।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। ঘরটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আলোটা নিভিয়ে দিল। তাতে আগের চেয়ে অন্ধকার লাগল সুড়ঙ্গটা। গরমও বেশি লাগছে কেন যেন। বদ্ধ বাতাসে বিশ্রী একধরনের ভাপসা গন্ধ।
ওই দেখো, হাত তুলে ফিসফিস করে বলল মুসা।
কিশোরও দেখল। সামনে কয়েক গজ দূরের একটা দরজার ফাঁক দিয়ে হলদে আলো আসছে।
পাতলা আলোর ফালিটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা, এই সময় ঘরের ভেতর পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর কাশি।
খাইছে! ভয়ে কেঁপে উঠল মুসার গলা। ভূত না তো?
.
২১.
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা।
ভূতে কখনও কাশে না, ভয় পাচ্ছে রবিন। ভূতের ভয় নয়।
তবে কি মিলার? মুসার প্রশ্ন।
মেয়েমানুষের কাশি মনে হলো আমার কাছে, কিশোর বলল।
মিলারের ঘরের সেই মহিলা!
চলো তো দেখি। পা বাড়াল কিশোর।
সাবধান, পেছন থেকে বলল মুসা, যা অন্ধকারের অন্ধকার। দেখেশুনে পা ফেলো।
হঠাৎ কিশোরের চিত্তার কানে এল তার।
দরজার কয়েক ফুট সামনে দাঁড়িয়ে গেল সে আর রবিন।
কিশোর? ডাক দিল মুসা।
জবাব নেই।
আশ্চর্য! মুহূর্তে চলে গেল কোথায়? ভূতে গাপ করে দিল নাকি? আতঙ্কিত কণ্ঠে ডাকল আবার, কিশোর?
আলোকিত দরজার অন্যপাশে হুটোপুটি শুরু হলো। ছুটে আসছে যেন। কেউ। আবার কাশি শোনা গেল।
কিশোর, কোথায় তুমি?
এবারও মুসার ডাকের সাড়া দিল না কিশোর।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, ফিসফিস করে রবিন বলল, গেল কোথায়?
মিলার শুনে ফেলবে, এই পরোয়া আর করল না মুসা। গলা চড়িয়ে চিৎকার করে ডাকল, কিশোর! কিশোর!
মুসার হাত আঁকড়ে ধরল রবিন। গেল কোথায় ও? একেবারে গায়েব!
*
বাতাসে মিলিয়ে গেছে যেন কিশোর।
আতঙ্কিত কণ্ঠে রবিন বলল, চুপ করে থাকলে হবে না। কিছু একটা করা দরকার।
কি করব?
অ্যাই কোথায় তোমরা? কিশোরের ডাক শোনা গেল। মুসা?
কিশোর!
তোলো আমাকে এখান থেকে।
মুসার মনে হলো মাটির নিচে কোনখান থেকে আসছে কথা। কোথায় তুমি?
সাবধান, মেঝেতে বিরাট একটা গর্ত আছে। দেয়াল ঘেঁষে।
কোন ধরনের ভেন্টিলেশন হবে, রবিন বলল, বাতাস চলাচলের পথ। মুখটা খুলে রাখল কে?
যে খুশি রাখুক। আমাকে আগে বের করো এখান থেকে।
গর্তটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল মুসা আর রবিন। ওপর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কিশোর। তার হাত দুটো চেপে ধরল দুজনে। ওপরে তুলে আনতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগল না।
বাপরে বাপ, ফোঁস করে বাতাস ছেড়ে বলল রবিন, আজ এত ভারী লাগল কেন তোমাকে? এক টন ওজন!
ক্লান্ত হয়ে পড়েছ আরকি…
একটা কণ্ঠ থামিয়ে দিল কিশোরকে। আলোকিত ঘরটা থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কেউ, বাইরে কে? দরজা বন্ধ থাকায় স্পষ্ট হলো না কণ্ঠটা। চাপা, ভোতা স্বর।
আমরা! জবাব দিল কিশোর।
বাঁচাও আমাদের বের করো এখান থেকে! ককিয়ে উঠল ঘরের ভেতরের কণ্ঠটা।
খোলা ভেন্টের কাছ থেকে সরে এসে দরজাটার দিকে এগোল কিশোর। আবার যাতে অন্য কোন গর্তে পড়ে না যায় সেজন্যে সাবধান রইল। দরজাটা, খোলার চেষ্টা করে বলল, তালা দেয়া।
ওর পাশে এসে দাঁড়াল মুসা। পাল্লায় কাঁধ ঠেকিয়ে ঠেলা দিল। মচমচ করে উঠল পুরানো কাঠ। মনে হচ্ছে ভেঙে ফেলা যাবে। তোমরাও এসো। তিনজনে মিলে ঠেলে দেখি।
হাসল রবিন, ঢুকে যদি দেখো তোমার ভূতটা দাঁড়িয়ে আছে?
দেখব না। কারণ দরজা বন্ধ করে ভূত আটকে রাখা যায় না। ঠিক বেরিয়ে চলে আসত। ভেতরে মানুষই আছে।
পিছিয়ে এসে রেডি ওয়ান টু থ্রী বলে তিনজনেই একসঙ্গে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দরজাটার ওপর। মড়মড় করে ভেঙে গেল পাল্লা। এত সহজে কাজ হয়ে যাবে ভাবেনি ওরা। পুরানো কাঠ আর কজা বলেই সম্ভব হলো।
ঘরের ভেতর চোখ পড়তে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল তিনজনেই।
.
২২.
কোরি! তুমি এখানে? চিৎকার করে উঠল কিশোর। আমরা তো ভাবলাম…
আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। ছোট ঘরটার অন্য প্রান্তে নড়াচড়া চোখে পড়ল। অন্ধকার ছায়া থেকে বেরিয়ে এলেন আন্ট জোয়ালিন।
আন্টি! আপনি!
আমাদের খুঁজে পেলে কি করে? কোরির মুখে হাসি চোখে পানি।
তোমরা এখানে এলে কি করে, সেটাও তো আমাদের প্রশ্ন!
সে এক লম্বা কাহিনী, মাথা নেড়ে বললেন আন্ট জোয়ালিন।
কবে এসেছেন?
তোমাদের পরদিনই, চুলে আঙুল চালিয়ে সোজা করার চেষ্টা করলেন। তিনি। অনেকদিন চিরুনি ব্যবহার করতে পারেননি। পরদিন সকালে উঠেই ব্যথা সেরে গেল। ভাল বোধ করলাম। চলে এলাম সেদিনের লঞ্চেই। গাড়িতে করে রোজার আমাকে হোটেলে নিয়ে এল। কিন্তু তারপর… তারপর…
আন্টিকে জোর করে এনে এই ঘরের মধ্যে আটকে রাখল, আন্টির কথা আটকে যেতে কোরি বলে দিল। জানা গেল ওই লোক রোজার নয়, মিলার।
দেখতে রোজারের মতই, অনিশ্চিত শোনাল আন্ট জোয়ালিনের কণ্ঠ। বিশ বছর হলো ওর সঙ্গে দেখা নেই আমার। কোরিকে বলেছি সেকথা। রোজার আমার দূর সম্পর্কের খালাত ভাই।
তাই নাকি? রবিন বলল। তার সঙ্গে আপনার ছবি দেখে আমরা তো। অবাক…
কোরি বলে উঠল, মেলবয়েসরা আমাদের আত্মীয়।
শোনো, জরুরী গলায় কিশোর বলল, অনেক কিছু ঘটে গেছে। আমাদের খুন করার জন্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে মিলার।
কি? চিৎকার করে উঠল কোরি। আন্টির দিকে তাকাল। চুপ করে রইলেন তিনি।
কিশোর বলল, মিলার একটা উন্মাদ।
এজন্যেই এনে আমাকে এখানে আটকে রাখতে পারল, আনমনে মাথা নাড়তে লাগলেন আবার আন্ট জোয়ালিন।
সব বলার সময় নেই এখন। মস্ত বিপদের মধ্যে রয়েছি আমরা।
আসার পর থেকে এখানেই আটকে আছেন নাকি আপনি? জানতে চাইল রবিন। হান্টিং পার্টি নিয়ে আপনিই মিলারের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন?
পার্টি? আমি তর্ক করেছি? ভুরু কুঁচকে গেল আন্ট জোয়ালিনের। রবিনের কথা যেন বুঝতে পারছেন না।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, কোরি, তুমি এখানে এলে কি করে?
আমি? মিলার আমাকে এই সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখেছিল। ভয় পেয়ে। গিয়েছিল আমি আন্টিকে দেখে ফেলব। রাতে পেন্টাকল বানিয়ে যখন প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম, পা টিপে টিপে আমার ঘরে ঢুকল সে। পেছন থেকে এসে মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরি ঠেকিয়ে নিয়ে চলে এল এখানে। ভয়ে টু শব্দ করিনি।
সুড়ঙ্গে ঢুকেছিলে কেন?
লাল হয়ে গেল কোরির গাল। লজ্জা পাচ্ছে বলতে। মুখ নিচু করে বলল, তোমাদের কাছে মাপ চাওয়া উচিত আমার।
ওর দিকে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। কেন মাপ চাওয়া উচিত, বুঝতে পারছে না।
সুড়ঙ্গটার কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। তোমাদের বলিনি। সৈকতের দিক দিয়ে যে ঢুকতে হয় জানতাম। সামান্য খোঁজাখুঁজি করতেই পেয়ে যাই ঢোকার মুখটা।
কিন্তু আমাদের বলতে অসুবিধেটা কি ছিল? জানতে চাইল কিশোর।
ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম তোমাদের। ভূত দেখানোর কথা বলে নিয়ে এসেছি তোমাদের। কিন্তু দেখাতে পারছিলাম না। সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখটা পেয়ে গিয়ে ঠিক করলাম ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটাব, যাতে তোমরা দ্বিধায় পড়ে যাও ভাবো, ভূত আছে। তোমাদের ভয় দেখানোর জন্যে খুলিতে ক্রীম মাখিয়ে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছিলাম টেবিলে। ওটাও পেয়েছিলাম সুড়ঙ্গে। ঘরের দেয়ালে লাল রঙ মাখিয়ে রেখেছিলাম।
এই ব্যাপার! হতাশ মনে হলো মুসাকে। সে ভেবেছিল সত্যি সত্যি ভূত আছে ঘরটায়।
মাথা ঝাঁকাল কোরি। তোমাদেরকে ভূত বিশ্বাস করানোর জন্যে আরও অনেক কাণ্ড করেছি আমি। সেদিন সন্ধ্যায় গরম কাপড় নিতে হোটেলে গিয়ে অহেতুক চিৎকার করে উঠেছিলাম। তোমাদের বলেছি ভূত দেখেছি। আসলে কোন কিছু দেখিনি। কিশোর যখন রাতে উঠে পানি খেতে রান্নাঘরে যাচ্ছিল, ওর পিছু নিয়েছিলাম। ফিসফিস করে ওর নাম ধরে ডাকা, শেকলের শব্দ, বীণা বাজানো, সব শব্দ রেকর্ড করা। ওর পেছনে লুকিয়ে থেকে আমার মিনি ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়েছি। শুধু এই না, আরও অনেক শয়তানি করেছি। ডাইনিং রূম দিয়ে তোমাদের সঙ্গে সুড়ঙ্গে ঢুকে ভয় পাওয়ার অভিনয় করেছি, কোন দিক দিয়ে বেরোতে হয় জানা থাকা সত্ত্বেও ঘুরিয়ে মেরেছি তবে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে যদি বায়ের সুড়ঙ্গটায় ঢুকে পড়তাম, তাহলেই কাজ হয়ে যেত। এ ঘরের দরজাটা দেখে ফেলতাম। পেয়ে যেতাম আন্টিকে। কাজের কাজ তো কিছু করলামই না, অকারণে…
তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল সে, আমাকে মাপ করে দাও। এসব ছেলেমানুষীর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। গাধামি করেছি।
যাকগে, ভুলে যাও ওসব কথা। আমরা কিছু মনে করিনি, কিশোর বলল। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা চলবে না। তাড়াতাড়ি সরে যেতে হবে। এখান থেকে। দরজা ভাঙতে গিয়ে অনেক শব্দ হয়েছে। উলফ কিংবা মিলারের কানে গিয়ে থাকলে যে কোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে।
চলো, রবিন বলল, সবাই সৈকতে বেরিয়ে যাই।
আমার কোন আপত্তি নেই, আঁন্ট জোয়ালিন বললেন। এখানে আটকে থেকে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আমার। মরেই যেতাম। এই দুর্গন্ধের মধ্যে মানুষ। থাকতে পারে নাকি…
পা বাড়াতে গিয়ে টলে উঠলেন তিনি। পড়ে যাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল কোরি। লাফ দিয়ে গিয়ে আরেকপাশ থেকে ধরল মুসা।
কি হলো? আন্টি? চিৎকার করে উঠল, কোরি।
চোখ মেললেন আন্ট জোয়ালিন। দুর্বল কণ্ঠে বললেন, মাথা ঘুরছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। খোলা বাতাস দরকার।
মনে হয় এসবের জন্যে খিদেও দায়ী, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কোরি। সারাদিনে একবার মাত্র খাবার দিয়ে গেছে মিলার। তাতে কি কিছু হয়।
এত দুর্বল শরীর নিয়ে এতবড় সুড়ঙ্গ পেরোতে পারবেন না আপনি, কিশোর বলল। খাবার দরকার। যাই, দেখি কিছু আনতে পারি কিনা।
রান্নাঘরে গেলেই পাওয়া যাবে, দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল রবিন।
কোনদিক দিয়ে যাবে? জিজ্ঞেস করল মুসা। উলফ আর মিলার:..
যেদিক দিয়েই যাই না কেন, কিশোর বলল, ওদের সামনে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিটা থাকবেই। যা হয় হবে। দৌড়ে গিয়ে আগে কিছু খাবার নিয়ে আসি। আমরা যাচ্ছি। তোমরা আন্টিকে ধরে ধরে আনো।
আগে আগে চলল কিশোর আর রবিন। আন্ট জোয়ালিনকে নিয়ে সাবধানে এগোল মুসা আর কোরি।
মুসা জিজ্ঞেস করল, জালের ছড়াছড়ি। মাকড়সাকে ভয় পান, আন্টি?
না।
তাহলে হাঁটতে থাকুন। আর তেমন কোন অসুবিধে নেই।
ভয় না পেলেও মাকড়সার জাল মুখে, মাথায় জড়িয়ে গেলে বিশ্রী লাগে। অস্বস্তিকর। অন্ধকারে ওগুলোকে দেখাও যায় না। এড়ানোরও উপায় নেই।
আরেকটা ভয় পাচ্ছে মুসা, অন্ধকারে পথ হারানোর। কিন্তু খুব। তাড়াতাড়িই দরজাটা পেয়ে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আস্তে করে পাল্লাটা ঠেলে ডাইনিং রূমে পা রাখল কিশোর। পেছনে ঢুকল রবিন।
কেউ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল কিশোর। নেই দেখে আন্টিকে নিয়ে মুসা আর কোরিকে ঢুকতে বলল।
কি করব? জিজ্ঞেস করল রবিন।
এত অন্ধকারে খাবার বের করা যাবে না। আলো জ্বালতেই হবে, কিশোর বলল।
রান্নাঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল সে। স্টেনলেস স্টীলের ওঅর্ক কাউন্টারটা ঝকঝকে পরিষ্কার। তাকে সাজানো বড় বড় তামার পাত্র।
দরজার দিকে তাকাল কিশোর। উলফ আর মিলার এখন কোথায়? নিশ্চয় বনের ভেতর ওদের খুঁজছে। কিছুক্ষণের জন্যে এখানে ওরা নিরাপদ। কিন্তু বন থেকে ফিরে এলেই রান্নাঘরের আলো চোখে পড়বে ওদের।
তারপর যা হয় হবে। ভাবতে চাইল না আর সে।
রান্নাঘরের একটা টেবিলের সামনে আন্ট জোয়ালিনকে বসিয়ে দেয়া হলো। রক্তশূন্য হয়ে গেছে তার মুখ। রেফ্রিজারেটরে খাবার খুঁজতে লাগল রবিন। বড় এক বাটি টিউনা সালাদ বের করে এনে রাখল আন্ট জোয়ালিনের সামনে। চলবে এতে? আর কিছু পেলাম না।
খুব চলবে, লোভাতুর চোখে খাবারের বাটিটার দিকে তাকানে অন্ট জোয়ালিন।
দুটো প্লেট আর দুটো কাঁটা চামচ এনে দিল রবিন। কোরিও আন্টির মতই ক্ষুধার্ত। কেবল বয়েস অল্প আর আন্টির মত অসুস্থ নয় বলে দুর্বল হয়ে। পড়েনি।
খাবারের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন আন্ট জোয়ালিন। গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলেন। কোরি তার মত গোগ্রাসে না হলেও বেশ দ্রুতই খাচ্ছে।
কয়েক মিনিট পর চামচটা রেখে সোজা হলেন আন্ট জোয়ালিন খানিকটা রক্ত ফিরে এসেছে মুখে। কাগজ দিয়ে মুখ মুছে পানি খেলেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, এবার বলো দেখি কি ঘটছে এখানে?
জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। ঝুলে পড়ছে নিচের চোয়াল।
কি দেখে ভয় পেল সে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল মুসা। চমকে গেল কিশোরের মতই।
ঘুরে ডুকেছে উলফ।
.
২৩.
পালাও! চিৎকার করে উঠল মুসা।
কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল উলফ। এলোমেলো চুল।
কিশোর, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
অনেকটা কোমল হয়ে এল উলফের দৃষ্টি। মুসার চিৎকার দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে তাকে। এতক্ষণে নজর পড়ল আন্ট জোয়ালিনের ওপর। স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। চোখে অবিশ্বাস। মিস জোয়ালিন! আপনি!
উলফ, তুমি! আছ তাহলে এখনও রোজারের সঙ্গেই, আন্ট জোয়ালিন বললেন। হচ্ছে কি এখানে বলো, তো? আমাকে তালা দিয়ে রেখেছিল কেন? এত ভয় পাচ্ছে কেন ছেলেগুলো?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল উলফ। ঝুলে পড়ল কাঁধ। পুরো শরীরটাই কুঁকড়ে ধসে পড়বে যেন। ওর হাতে রাইফেলনেই দেখে স্বস্তি বোধ করছে। কিশোর।
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেন রোজার, উলফের ছোট কাঁধ দুটো সামান্য ওপরে উঠে আবার নেমে গেল।
ডকে আমাকে আনতে গেল যখন, আন্ট জোয়ালিন বললেন, চুল উষ্কখুষ্ক, ময়লা কুঁচকানো কাপড়-চোপড়। একেবারে বুনো। অবাক হয়েছিলাম। ভাবছিলাম এ রকম তো সে ছিল না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেই ভালবাসত। যাই হোক, আমাকে নিয়ে গিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে নোংরা একটা ঘরের মধ্যে ভরে তালা দিয়ে রেখেছিল। এইমাত্র এই ছেলেগুলো আমাকে বের করে এনেছে।
মাথা নেড়ে উলফ বলল, আমি এসবের কিছুই জানি না। এগিয়ে এসে আন্ট জোয়ালিনের দুহাত চেপে ধরল। সত্যি জানি না। বিশ্বাস করুন। তাহলে অনেক আগেই বের করে নিয়ে আসতাম।
তাকিয়ে আছে কিশোর। উলফের আচরণে অবাক হচ্ছে। লোকটাকে বিশ্বাস করার কিছু নেই। তবে হাতে যেহেতু বন্দুক নেই, কিছু করতে পারবে না। আন্ট জোয়ালিনের আচরণেও অবাক হলো সে। মনে হচ্ছে লোকটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন তিনি।
আপনাকে তালা দিয়ে রেখেছিল, বিশ্বাসই করতে পারছি না আমি, উলফ বলছে। তারমানে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। তাকে দিয়ে এখন সবই সম্ভব। আন্ট জোয়ালিনের হাত ছেড়ে দিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে ধপ করে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল সে।
উলফের এটা অভিনয় কিনা বুঝতে পারছে না কিশোর। সাবধানে রান্নাঘরের দরজার দিকে সরে যেতে শুরু করল। আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল। কোরি আর রবিনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। দুই হাত প্যান্টের পকেটে। উলফের দিকে নজর।
কিন্তু এই অবস্থা হলো কি করে উলফ? আন্ট জোয়ালিন বললেন। ও তো এমন ছিল না।
না, ছিল না। তিরিশ বছর ধরে দেখছি মেলবয়েসদের। শুধু রোজারের। চাকরিই করছি পনেরো বছর। ওকে আর এখন মনিব মনে করি না আমি, ভাইয়ের মত দেখি। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল উলফ, ভয়ানক অসুস্থ একজন ভাই।
কোথায় এখন ও?
বনের মধ্যে, চট করে একবার কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিল উলফ, আর কোথায়।
বনে? এ সময়ে? উলফকে জবাব দেয়ার সুযোগ দিলেন না আন্ট জোয়ালিন। মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলো হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে শুরু করল, হোটেলটা বন্ধ কেন? রোজার আমাকে বলল, ছেলেমেয়েগুলোকে কাজ দেবে হোটেলে। গেস্টরাই বা কোথায়? সবাইকে তালা আটকে রেখেছে নাকি?
আন্ট জোয়ালিনের কোন কথারই জবাব দিল না উলফ। কোলের ওপর দুই হাত রেখে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। আমি ভেবেছিলাম রোজারকে সামলাতে পারব। কিন্তু ভুল করেছি।
চিন্তিত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে রইল একটা মুহূর্ত। তারপর বলল, এই নির্জন দ্বীপে ওকে নিয়ে আসার কারণ, প্রথমবার যখন বেড়াতে এলাম, খুব আনন্দ পেয়েছিল সে এখানে এসে। সমস্যা আছে ওর। সাংঘাতিক সমস্যা। ভেবেছিলাম এখানে এলে ঠিক হয়ে যাবে। হোটেলটাকে ঠিকঠাক করে নিয়ে এখানেই থাকার বন্দোবস্ত করলাম। নিয়মিত শোরটাউনে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতাম। ভাবলাম সেরে উঠবে। কিছুই হলো না। রোগটা আরও বাড়ল।
কিন্তু ও তো ভাল ছিল, আন্ট জোয়ালিন বললেন। অবশ্য সেটা বহুকাল আগের কথা। অনেক দিন আর তার সঙ্গে দেখা নেই..যদি বুঝতাম এই অবস্থা, কিছুতেই আসতাম না…
আপনাকে যে আসতে বলেছে, ছেলেমেয়েদের কাজ দেবে বলেছে, আমিও জানি না। চলে আসার পর ওদের বিদেয় করার জন্যে বহু চেষ্টা করেছি আমি, আন্ট জোয়ালিনের দিকে তাকাল উলফ। কোরিকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখেছি। বুঝলাম, সবাই ঢুকবে ওরা। একটা বুদ্ধি করলাম। কিছু সময়ের জন্যে সুড়ঙ্গে আটকে দেব। ভয় পেয়ে পালাবে তখন। নজর রাখলাম। সুযোগ পেয়ে আটকে দিলামও। কিন্তু গেল না ওরা।
আবার জোরে নিঃশ্বাস ফেলল উলফ। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, রলিনের মৃত্যুর পরই রোগটা হয়েছে ওর। মানসিক রোগ। রীতিমত খেপে ওঠে একেক সময়। মানুষ খুন করার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। ও বলে মানুষ শিকার। প্রথম যখন বলল আমাকে, ভাবলাম রসিকতা করছে। কয়েকটা: মোমের মুণ্ডু এনে যখন ট্রফি রূমে দেয়ালে সাজাল, তখনও ভাবলাম রসিকতা। কিন্তু পরে বুঝলাম, রসিকতা নয়। কাউকে খুন করার জন্যে অস্থির হয়ে। উঠল। মাথাটা যখন বিগড়ে যায়, সত্যি সত্যি মানুষ খুন করতে পারবে। ভয়ানক অসুস্থ সে, বললাম না।
উলফের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। তাহলে মুণ্ডগুলো আসল মানুষের নয়। উন্মাদ রোজারের প্রথম আসল শিকার তাহলে ওরাই হতে যাচ্ছে।
পাগল হলো কেন? জানতে চাইলেন আন্ট জোয়ালিন।
আপনি কি জানেন কয়েক বছর আগে শিকারে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যায়। রলিন? তারপর থেকেই খেপা হয়ে যায় রোজার। মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অদ্ভুত এক রোগ। এ রোগ হলে নিজেকে অন্য কেউ কল্পনা করতে থাকে রোগী। রোজারের বেলায়ও তাই ঘটল। নিজেকে অন্য কেউ কল্পনা করে নিজের মানসিক যন্ত্রণার বোঝা তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে বাঁচতে চায়। যন্ত্রণা যখন বেড়ে যায়, নিজেকে ইচ্ছেমত অন্য মানুষ কল্পনা করে নেয়। একা একা কথা বলে।
এতই খারাপ অবস্থা!
মাথা ঝাঁকাল উলফ। আপনার সঙ্গে ডকে দেখা করার সময় নিশ্চয় নিজেকে মিলার কল্পনা করেছে সে। বুনো, খেপাটে মিলার।
তাই হবে!
খোলা রান্নাঘরে নিরাপদ বোধ করছে না কিশোর। ভয়ঙ্কর ওই পাগলকে দিয়ে সব সম্ভব। দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে উলফকে জিজ্ঞেস করল, মিলার কি এখনও বনেই আছেন?
তাই তো মনে হয়।
আমরা কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারি না?
কোনও জায়গা নেই। সব চেনে সে। ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবে।
বের করে কি করবে? বুঝতে পারছেন না আন্ট জোয়ালিন।
কি আর, খুন, বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দিল উলফ, যে কোন অঘটন ঘটাতে পারে সে, বললামই তো। সে এখন নিজেকে মিলার কল্পনা করছে। আর যখন তা করে, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়।
কড়া চোখে উলফের দিকে তাকাল কিশোর। সবই যদি জানেন, পুলিশকে খবর দিচ্ছেন না কেন? কেউ খুন হয়ে যাক চান নাকি?
হতাশ ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল উলফ, কি করে দেব? টেলিফোনের লাইন সব ছিঁড়ে ফেলেছে। নৌকা নিয়ে ডাক্তার কিংবা পুলিশকে খবর দিতে যাব ভেবে নৌকাগুলোও লুকিয়ে ফেলেছে। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে ওগুলোই খুঁজে বেড়াচ্ছি।
তারপর? উলফের চেহারা দেখেই আন্দাজ করতে পারছে কিশোর। জবাবটা কি হবে।
খুঁজে পাইনি। ডুবিয়ে দিল কিনা কে জানে!
কি খুঁজে পাচ্ছ না? কিছু হারিয়েছ নাকি? রান্নাঘরের দরজার কাছে। গমগম করে উঠল একটা ভারী কণ্ঠ।
ভীষণ চমকে গেল কিশোর।
রাইফেল হাতে ঘরে ঢুকলেন রোজার মেলবয়েস।
.
২৪.
মিলার সেজেছেন এখন ব্যারন। চোখে কালো কাপড়। হাতে হান্টিং রাইফেল। চুলগুলো সব এলোমেলো। গায়ে ময়লা কুঁচকানো সাফারি জ্যাকেট আর পরনে ময়লা কাদামাখা প্যান্ট বনে ঘুরে আসার চিহ্ন বহন করছে।
ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে একেবারে ছিটকানি তুলে দিলেন তিনি। যাতে কেউ বেরোতে না পারে। বুনো, উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন সবার দিকে।
রোজার… বলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা বোঁ করে উঠল। আন্ট জোয়ালিনের। দেয়ালে ঠেস দিয়ে সামলে নিলেন।
রোজার চলে গেছে, ষাড়ের মত চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যারন। শিকারের মজা ও বোঝে না।
যাও, রোজারকে নিয়ে এসো, আদেশ দিলেন আন্ট জোয়ালিন। যাও। আমি তোমাকে যেতে বলছি। ওর সঙ্গে কথা আছে আমার।
জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ব্যারন।
যাও, কণ্ঠস্বর চড়িয়ে আদেশ দিলেন আবার আন্ট জোয়ালিন, নিয়ে এসো রোজারকে!
কয়েক সেকেন্ড তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উলফের দিকে ঘুরলেন ব্যারন, এখানে কি তোমাদের?
রোজার… কোমল গলায় বলতে গেল উলফ।
আমি মিলার! গর্জে উঠলেন ব্যারন।
যাও, রোজারকে নিয়ে এসো, আবার বললেন আন্ট জোয়ালিন।
বদলে গেল ব্যারনের দৃষ্টি। দ্বিধান্বিত ভঙ্গিটা নেই আর। বোঝা গেল আন্ট জোয়ালিনের নির্দেশ অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। রাইফেলটা তুলতে শুরু করলেন।
না না, নামান! নামিয়ে রাখুন! চিৎকার করে উঠল উলফ। দৌড় দিল ব্যারনকে ঠেকানোর জন্যে।
রাগে প্রচণ্ড চিৎকার করে রাইফেলের বাট দিয়ে উলফের মাথার একপাশে বাড়ি মারলেন ব্যারন।
চিৎকারের ভঙ্গিতে হাঁ হয়ে গেল উলফের মুখ। কিন্তু স্বর বেরোল না। চোখ উল্টে কাটা কলাগাছের মত ধড়াস করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। তার অনড় দেহটার দিকে তাকিয়ে আছেন ব্যারন। এই সুযোগে রান্নাঘরের দরজার। দিকে দৌড় মারল তিন গোয়েন্দা।
চিৎকার শুরু করল কোরি, ছিটকানি খোলো! ছিটকানি খোলো! দিশেহারার মতো সে-ও দৌড় দিল একদিকে।
কারও দিকে নজর নেই ব্যারনের। ভারী হয়ে গেছে নিঃশ্বাস। উলফের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন, আমার বিরুদ্ধে বানিয়ে কথা বলবে আর? তুমি ভেবেছ আমি কিছুই জানব না। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনেছি আমি। ঝট করে ফিরে তাকালেন দরজার দিকে, চোখ পড়ল কিশোরের ওপর–ছিটকানি খোলার চেষ্টা করছে সে। গর্জে উঠলেন, খবরদার! হাত সরাও!
আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন আন্ট জোয়ালিন। দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, দরজাটা খুলে দাও, রোজার। সবাইকে বেরোতে দাও।
তার কথা কানেই তুললেন না ব্যারন। উলফের দিকে তাকালেন, কেন এতগুলো মিথ্যে কথা বললে উলফ? আমি মনে করেছিলাম তুমি আমার বন্ধু, জুতোর ডগা দিয়ে উলফের পাজরে গুতো মারলেন তিনি। কিন্তু তুমি তো আমার ভয়াবহ শত্রু। নইলে এত মিছে কথা কেউ বলে?
ফিরে তাকালেন আবার দরজার দিকে। তিন গোয়েন্দা আর কোরি সবাই গিয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে।
উলফ আমার কাজ সহজ করে দিয়েছে, ক্রুর হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ব্যারনের মুখে। সবাইকে একজায়গায় করে রেখেছে।
রাইফেলটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। কি যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। শান্ত থাকার চেষ্টা করল সে। বাঁচতে চাইলে এখন আর হুড়াহুড়ি না করে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
অনেক সহজ, চওড়া হচ্ছে ব্যারনের হাসিটা।
তাকিয়ে আছে কিশোর।
রাইফেল তুলে বাট কাঁধে ঠেকালেন ব্যারন।
রাইফেল!
বনের মধ্যে ওই রাইফেল দিয়ে ওদের গুলি করেছেন তিনি।
হোটেলের লবিতে করেছেন।
ঘরের মধ্যেই কাজটা সারতে পারব, শিকারকে কোণঠাসা করতে পেরে শিকারী নেকড়ের মত ঠোঁট চাটলেন ব্যারন। ভয়ানক উন্মাদ, কোন সন্দেহ নেই।
নিশানা করার ভঙ্গিতে রাইফেলটা শক্ত করে চেপে ধরলেন তিনি।
চোখ সরায়নি কিশোর।
না, রোজার না! চিৎকার করে বললেন আন্ট জোয়ালিন। প্লীজ, গুলি কোরো না ওদের! তোমাকে মিলার ডাকলে যদি খুশি হও, তাহলে তাই সই! গুলি কোরো না, মিলার!
রাইফেলের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। মনে পড়ছে না কেন? কি মনে করতে চাইছে সে?
না না, প্লীজ, মিলার, বলেই চলেছেন আন্ট জোয়ালিন, গুলি কোরো!
মুসার দিকে নিশানা করলেন ব্যারন। রবিনের দিকে সরালেন। আবার ফেরালেন মুসার দিকে।
বিদ্যুৎ চমকের মত কথাটা মনে পড়ে গেল কিশোরের। সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠল সে। ব্যারনের দিকে এগোতে এগোতে বলল, ঠিক আছে, গুলি যখন করতেই চান, আমাকে আগে করুন।