২০. আনন্দসংবাদ

কুড়ি – আনন্দসংবাদ

পরদিন সকালে স্বর্ণ তিনপাহাড়ি যাবে! আর সেই রাতের শেষ যামে তার দরজায় কে ঠুকঠুক করে ঘা দিল। স্বর্ণ ঘুমোয়নি। ঘুমোতে পারছিল না। খাটের কোথাও ঘূণপোকাটা আজ বড় জ্বালাচ্ছিল। মাথার ভিতরে যেন ধারাবাহিক তার দাঁতের শব্দ! সেইসময় কয়েকবার বাইরের ঘরের কপাটে ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক। স্বর্ণ ভাবে, জর্জ।

কী সাহস ওর! ভুরু কুঁচকে অপেক্ষা করে। বুক কেঁপে ওঠে এবার। কী চায় জর্জ—এই অসময়ে? নাকি—তাহলে বাঘটা অবশেষে মারা পড়েছে। এবং পুরস্কারের দাবি নিয়ে সে হাজির হয়েছে এখন? স্বর্ণ ভয়ে আরও কাঠ হয়। স্বপ্নের ঘোরে বলতে চায়। না না না! তার ঠোঁট কাঁপে! ফের কপাটে শব্দ ওঠে, ঠুক ঠুক ঠুক!

তখন মরিয়া হয়ে স্বর্ণ বলে, ‘কে?’

চাপা কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘আমি মা, আমি ইয়াকুব।’

ইয়াকুব সাধু! লাফিয়ে উঠে পড়ে স্বর্ণ। লন্ঠনের দম বাড়িয়ে দেয়। এঘরে এসে একটু ইতস্তত করে। ভুল শুনল না তো? সে ফের বলে—’কে?’

‘আমি ইয়াকুব, মা। তিনপাহাড়ি থেকে আসছি।’

দরজা খুলে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ায় সে। ইয়াকুব সাধুর সেই চেনা মূর্তিটি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে। লাল ফতুয়া আর লাল লুঙি, বগলে ঝোলে, পিঠে বোঁচকা জড়ানো, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে কমণ্ডলু, জটাজুট দাড়িগোঁফ, রুদ্রাক্ষ আর পাথরের মালা! ফকির না সাধু—সাধু না ফকির! আর বারান্দায় আরেকটি ক্ষুদে মূর্তি—পেন্টুল কুর্তাশোভিত, একরাশ চুল, রাঙা শান্ত মুখ, দপদপ করে হঠাৎ জ্বলে ওঠে বাতির আলোয়। বাইরে শেষপ্রহরের শেয়ালের ডাকের সঙ্গে গলা মেশায় কয়েকটি পেঁচা। ইয়াকুব ওকে ডাকে—’চলে আয় বাপ, নির্ভয়ে চলে আয়। মা—মা জননী রে, স্বয়ং জগদম্বা। গড় কর ব্যাটা, ধুলো চাট চরণের, অক্ষয় পুণ্যি!’

তবু হেরুর ছেলে আসে না। স্বর্ণের চোখ থেকে চোখ নামায় না সে। স্বর্ণও। তারপর মৃদু হাসে ডাক্তারের বিধবা যুবতী মেয়ে। ….’ভেতরে এসো!’

ছোঁড়াটা ভেতরে ঢোকে। চারিদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। চিনতে চেষ্টা করে হয়তো। ইয়াকুব নিজে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর বলে, ‘হঠাৎ চলে এলাম মা জগদম্বা! নখানে লোকেরা জ্বালাতন শুরু করলে। শেষঅব্দি পুলিশ লাগালে। বলে আমি নাকি চুরিডাকাতির দল ফাঁদছি! শালা মানুষ কি মানুষ মা?’

বলতে বলতে সে ধুপ করে মেঝেয় বসে পড়ে। স্বর্ণ ছোঁড়াটার কাঁধে হাত রেখে বলে—’কী রে, চিনতে পারছিস তো?’

‘শালা নেমকহারাম, মা!’ ইয়াকুব অক্লেশে বলতে থাকে। …’সেই অট্টুকুন থেকে গু—মুত ঘেঁটে মানুষ করলাম। তবু পোষ মানল কই? এদানীং সব সময় বোল ধরেছিল—মায়ের কাছে যাবো, মায়ের কাছে যাবো!’

‘কার কাছে?’

চাপা হাসে সাধু। …’হু, সেটা তো ঠিকই। একবার আপনার ছেনেহ (স্নেহে) পেয়ে শালাব্যাটা ধন্যি হয়ে যেয়েছে, তা আবার পাক। সেই আশায় লিয়ে এলাম। একে গ্রহণ করুন, মা। আমি তীত্থে রওনা হই চিরকালের মতন। এ কেবলই আমার পথের কাঁটা হয়ে ফুটছে গো!’ যেন আফশোসে সাধু মাথা দোলায়। অস্ফুট আক্ষেপ প্রকাশ করতে থাকে।

”কিন্তু ও তো থাকবে না, ফের পালিয়ে যাবে।”

ইয়াকুব লাঠি তুলে শাসায় হেরুর ছেলেকে। ..’খবরদার, খবরদার! এবার পালালে ঠ্যাঙ ভেঙে দেব শালার!’

স্বর্ণ চিন্তিতমুখে বলে, ‘কিন্তু এখানে রাখব কী করে? পাদরি হামলা করবে যে!’

‘কে? পাদরি? ইয়াকুব একটু ভাবে। তারপর তার মুখটা আগুনের মতো জ্বলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলে, ‘পাদরিকে ছেলের ভার তো আমিই দিয়েছিলাম—ন্যায্য কথা বলতে গেলে ছেলের মালিক আমি। আমিই পাদরিকে বলে যাব। আপনি ভাববেন না, মা।’

স্বর্ণ হেরুর ছেলেকে বলে, ‘কী রে?’ থাকবি তো আমার কাছে?’

সে ঘাড় নাড়ে। থাকবে।

বাকি রাতটুকু গল্পে গল্পে কাটিয়ে ও চা খেয়ে ইয়াকুব ওঠে। ভোরবেলা ফাদার সাইমনের কাছে হাজির হবে সে।

সেদিনের মতো তিনপাহাড়ি আর যাওয়া হল না স্বর্ণের। যাই—যাই করে আলস্য চাপে ক্রমাগত। আসলে এই ছেলেটার জন্যেই যেতে চেয়েছিল যেন। বাবা যা ছিলেন, তাই আছেন। গিয়েই কি পাগল ভালো করতে পারবে সে? আরও কটা দিন থাক, বরং।

ফাদার সাইমনকে ইয়াকুব বলে গিয়েছিল—তার প্রমাণ স্বর্ণ পেল। চরণ চৌকিদার এসে জানিয়ে যায়, পাদরিবাবা হেরুর জন্যে মাথা ঘামাতে চান না। তাঁর এখন বড় দুরবস্থা, সর্বমোট দশবারোজন লোক জাত দিয়ে দীক্ষা নিয়েছে। তারা সবাই আবার গোবর খেয়ে জরিমানা দিতে জাতে উঠেছে। পাদরিবাবা টের পাচ্ছেন, এখানে মাটি বড় পুরনো আর শক্ত। খুব একটা সুবিধে হবে না। তাই তল্পি গুটোতে চান।

এখন স্বর্ণ হেরুর ছেলেকে পড়ায়। বাংলা ইংরেজি কতরকম বই এনে দিয়েছে বহরমপুর থেকে। তার নতুন নাম রেখেছে : আনন্দ। সে এখন নির্ভয়ে খেলাধুলো করে সামনের মাঠে। সে গাছে চড়তেও ওস্তাদ। ক্রমশ তার নতুন স্বভাব ঠিকরে বেরোতে থাকে। দুষ্টুমি করতে পিছপা হয় না। স্টেশনে কোনোরকম ফাদার সাইমনকে দূর থেকে দেখলেও ভয় পায় না। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, এই হনুমান কলা খাবি? স্বর্ণ তার কাণ্ড দেখে হাসে।

জর্জ সেই থেকে আর আসেও না রেল ডিঙিয়ে—দেখা হলেও কথা বলে না। স্বর্ণও বলে না—বরং যেন ভয় পায়, বাঘ মারার বাতিক তার গেছে মনে হয়। বন্দুকহাতে আর তাকে রেললাইন ধরে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখা যায় না। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে কখনও এক গম্ভীর শান্ত মূর্তি—তার দৃষ্টি আপে কিংবা ডাউনের দিগন্তে।

স্বর্ণ যখন রুগি দেখতে গাঁওয়ালে যায়, আনন্দ দরজা বন্ধ করে ঘরে জানলার পাশে চুপচাপ বসে থাকে। তখন সে ভারী বাধ্য ছেলে। কেউ ডাকলেও বেরোয় না বা দরজা খোলে না। তার শরীরে হেরুর কোনো ছাপ খুঁজতে চায় কেউ, মেলে না। রাঙী বাউরান ছেলেকে পুরো ধরে রেখেছে শরীরে ও স্বভাবে। শুধু হাসিটা বাদে—হাসলে মনে পড়ে এক বিশালকায় বাউরিডাকাতের মুখের হাসি অবোধ, নির্মল আর স্পষ্ট।

এর কিছুদিন পরেই এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটে।

সেই ধূর্ত কিংবদন্তি হয়ে ওঠা বাঘটা মারা পড়ল—স্বয়ং জুহা মৌলবির হাতেই!!

ঘটেছিল ঠিক এরকম।

শিষ্যরা মৌলবিকে একটি দুধের গোরু দিয়েছিল। তার জন্যে একটি গোয়ালঘর বানানো হয়। এক প্রত্যুষে মৌলবি যথারীতি মসজিদে গেছেন নমাজ পড়তে। বেগম সদ্য নমাজ সেরে বারান্দায় বসে সুর ধরে কোরানপাঠ করছেন। হঠাৎ গোয়াল থেকে হুড়মুড় করে বাছুরটা বেরিয়ে আসে এবং ভিতরে একটা অস্পষ্ট হুটোপুটি শব্দ শোনা যায়। বাছুর দুধ খেয়ে ফেলেছে ভেবে বেগম দৌড়ে গোয়ালে ঢুকে পড়েন। দেখেন গোরুটা খুঁটি থেকে অসম্ভব টানটান হয়ে ফোঁসফোঁস করছে এবং কোণের দিকে একটা মোটাসোটা কুকুর বসে রয়েছে। তিনি তখন কুকুরটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কুকুরটা গ্রাহ্যও করল না। অগত্যা কুকুর নিয়ে আর ব্যস্ত হবার কারণ ছিল না, তাই তিনি বেরিয়ে এলেন। একটু পরেই মৌলবি ফিরলে তাঁকে বললেন ব্যাপারটা।

জুহাসাহেব মুডে ছিলেন। বেয়াদপ কুকুরের জন্যে আজ দুধটি বরবাদ হল! নির্ঘাৎ বাছুর ভয় পেয়ে দড়ি ছিঁড়ে সব দুধ শেষ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নানা ব্যাপারে উত্যক্ত হয়েই ছিলেন। এই মুহূর্তে সব রাগ পড়ল হতভাগ্য প্রাণীটির ওপর। উঠোনের কোণায় একটা কাঠকাটা পুরনো টাঙি পড়েছিল—তাঁর বাঁটটা অদ্ধেক নেই। মৌলবি সেটা তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে গোয়ালে ঢুকলেন। তারপর ‘কই সে শয়তান, কই সে হারামি’ বলে গর্জন করে প্রচণ্ড জোরে টাঙিটা বসিয়ে দিলেন জন্তুটার মাথায়। অমনি একটা আকাশ পাতাল ‘গাঁক গাঁক’ আওয়াজ উঠল। মৌলবি পলকে ডিগবাজি খেয়ে পড়লেন। বেরিয়ে এসে ‘বাঘ, বাঘ—কুকুর না, বাঘ!’ বলে পাড়া মাথায় করলেন; তারপর লোকেরা জড়ো হল। হুলুস্থুল পড়ে গেল। আর কোনো আওয়াজ নেই গোয়ালে—গোরুটার ফোঁসফোঁসানি ছাড়া। একজন পা টিপে টিপে এগোয় আর লাফ দিয়ে পিছিয়ে আসে। কারও সাহস হয় না ভিতর উঁকি মেরে দেখতে। অবশেষে মৌলবি জনতার উদ্দেশ্যে ধিক্কার জানিয়ে বলেন, এই তোমরা ইসলামি রক্তের বড়াই কর! আরে নাদান! তোমাদের পূর্বপুরুষ সারা দুনিয়া জয় করে বাদশাহি পেয়েছিলেন। আর তোমরা একটা কুত্তাকা মাফিক শেরের ভয়ে কাহিল হলে! ইতিহাসে আছে শেরশাহ ঘুমন্ত শের জাগিয়ে মেরেছিলেন। আজ আমিও তাই করেছি! এবার দেখছি শেরের লেজ ধরে আমাকেই টেনে আনতে হবে।’

কেউ কেউ বাধা দিল ‘যাবেন না হুজুর, যাবেন না! ব্যাটার জান এখনও যায়নি হয়তো। ওদের একশোটা জান।’

জুহা মৌলবি গ্রাহ্য করলেন না। সেই রক্তাক্ত টাঙিটা আকাশে নাচাতে নাচাতে এবং ‘আল্লাহু আকবর’ হাঁক ছেড়ে গোয়ালে ঢুকে পড়লেন ফের। জনতা স্তব্ধ ও বাকশূন্য হল। কিন্তু মৌলবির সন্তানসন্ততিরা কী ভেবে হিহি করে হাসতে থাকল। এমনকি বেগমও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পর্দার আড়ালে চুপি চুপি হাসছিলেন।

একটু পরেই দেখা গেল, গোরুটা দড়ি ছিঁড়ে লেজ তুলে ছিটকে বেরিয়ে এল। ভিড় দুদ্দাড় ছত্রভঙ্গ হল। তারপর কিন্তু দেখা গেল, গোরুটা আশ্চর্য শান্ত হয়ে উঠোনের কোণে সবজি—মাচার কাছে বাছুরটার ঘাড় চেটে দিচ্ছে।

এবং সত্যিসত্যি জুহা মৌলবি তুমুল হাসিসহ বাঘের লেজ ধরে বাইরে এলেন। হ্যাঁ, যথার্থ একটি বাঘ। তার মাথাটা প্রায় দুফাঁক হয়ে গেছে। জনমনে শঙ্কাশিহরনসৃষ্টিকারী ধূর্ত পশুচোর দাঁত ছরকুটে পড়ে রয়েছে। এবার সবাই এই প্রচণ্ড বাস্তবতা আঙুলে টিপে এবং মাপজোপ করে দেখতে এগিয়ে এল। কোনো সন্দেহ নেই, এটি রীতিমতো বাঘই বটে। এই অঞ্চলে যে ছোটখাট বেঁটে মোটাসোটা বাঘ দেখা যায়, তাদেরই সাঙাত। এর তিনটে কষ দাঁত ভাঙা! পায়ে ও পিছনের পিঠে কয়েকটা ক্ষতচিহ্ন আছে। গুলি আর বল্লমের দাগ হাতে পায়ে। তবে সবচেয়ে লক্ষ্য করার ব্যাপার বাঘটার রক্তের রঙ। যা দেখে কেউ বলল, ভুঁষির কালি—কেউ বলল, শিমপাতার রসের মতো—আবার কেউ বলল, বাঘটা হিন্দু বিধবার মতো নিরিমিষ খেতে শুরু করেছিল এদানীং তাই এই রক্ত। হুঁ, অনেক সায় দিল, তাই ইদানীং চুপচাপ ছিল ব্যাটা।

বাঘটা ঘিরে এইসব জল্পনা কল্পনা হচ্ছে, এমন সময় স্টেশনের তাঁবু থেকে শিকারিরা এসে হাজির হলেন। তাঁরা তো হাঁ একেবারে। শেষকালে এই হল? তাঁরা হতাশভাবে মুখ তাকাতাকি করলেন! সুগন্ধি সিগ্রেট খেতে খেতে বন্দুক কাঁধে তুলে ‘ফুঃ ফুঃ’ বলতে বলতে চলে গেলেন। অবিশ্বাস, নৈরাশ্য, ক্লান্তি নিয়ে তাঁর গুটিকয় ভিজে সোনালি মোষের মতো রেল লাইনে হাঁটতে থাকলেন। সবাই বাঘের গা থেকে দৃষ্টি তুলে তাঁদের দেখতে লাগল। এই অঞ্চলে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বেচারাদের কস্মিনকালে আর কেউ দেখতে পাবে কিনা ভাবনার কথা বটে!

বেলা বাড়তে বাড়তে কত মানুষ এল। তখন পরদানশিন পরিবারের সম্মান—রক্ষার্থে বাঘের লাশটা বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। সবাই একটা দিন ছুটির খাতায় লিখে গিয়েছিল। কাতারে কাতারে ভিড় আসতে থাকল। এ অঞ্চলের প্রথম উত্তেজনার বিষয় ছিল একদা হেরু বাউরি—দ্বিতীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল বাঘটা। তাই ভিড় স্বাভাবিক। দুপুর নাগাদ লেডি ডাক্তার ও তার পালিত পুত্রটিও এল। মৌলবি তাদের শতমুখে কাহিনীটি শোনালেন। শেষে ঠোঁটের কোণায় হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘ভাবা যায় না! আমি অবশেষে একটা বাঘ মেরেছি!’

এবং মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে সবাই জুহা মৌলবিকে স্বগোতক্তি করতে শুনত—পরবর্তীকালে, ‘আমি একটা বাঘ মেরেছিলাম! ভাবা যায় না!’

তাঁর মুখ যেন দিব্যচ্ছটা ঝলমল করতে দেখেছিল স্বর্ণলতা। যেন তাঁর মধ্যে অলৌকিকের আবির্ভাব ঘটেছিল এক প্রত্যুষকালে এবং সেই অলৌকিকটি প্রস্থানের পরও চিরস্থায়ী এবং সূর্যাস্তরাগের মতো কিছু উজ্জ্বলতা থেকে গেল মৌলবির মুখে, ফুরোল না।

এবং একটি উদাসীন দীর্ঘশ্বাস ক্ষরিত হয়েছিল গোরাং ডাক্তারের মেয়ের। সে কি পরিত্রাণজনিত তৃপ্তি? নাকি অবচেতন অতৃপ্তি জনিত দুঃখ? নিরাপত্তার সুখ, নাকি বঞ্চিতার বিষাদ?

প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান হর্সব্রোকারটি এই বাঘের জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবতে গেলে গা শিরশির করে। স্বর্ণ মনে মনে গোপনে বলে, ‘দুয়ো স্টেশনমাস্টার! হেরে গেল!’ ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসে। আর একপলকের একটি রক্তোচ্ছ্বাস কানের নিচে জ্বলজ্বল করে তক্ষুনি নিভে যায়। …’হালো জর্জ! ইওর গেম ইজ লস্ট! আই উইন! হিপ হিপ হুররে!’…

তো সবাই এল, এল না শুধু একজন। সে হল গোরা স্টেশনমাস্টার। সবার চোখে পড়ল ব্যাপারটা। কেউ বলল, ‘খুব তড়পেছিল দেখ লেঙ্গা—তাই এল না।’ কেউ বলল, ‘সায়েবের জ্বর, শুয়ে আছে।’ আবার কেউ বলল, জংশনে গেছে।

তারপর বেরোলো এক বিশাল মিছিল। বাঁশে ঠ্যাঙচারটে বেঁধে বয়ে নিয়ে চলল জনতা। আর বাঘের গায়ে হাত রেখে হেঁটে চললেন জবরদস্ত মৌলবি জুহা সাহেব। তাঁর পরনে লম্বা সাদা আচকান, পায়ে সাদা পাজামা, মাথায় আরবি টুপি ঘিরে পবিত্র পাগড়ি এবং হাতে কারুকার্যখচিত লাঠি। অকুতোভয়ে সরকারি আদেশ অমান্য করে তাঁকে নিয়ে বেরোল জনতা। ভিড়ের ভিতর থেকে জুহাসাহেবকে ইংরেজ সরকার ছিনিয়ে নেওয়ার হাঙ্গামা ও উৎসাহ কী পাবেন এতটুকু?

সন্ধ্যা নাগাদ সেই বিচিত্র শোভাযাত্রা আরও দীর্ঘকায় হতে হতে সদরে পৌঁছল। কালেকটর বাহাদুরের কুঠির সামনে সে এক লোকসমুদ্র!…

যাই হোক, এই চমৎকার কাজের পুরস্কারস্বরূপ জুহা মৌলবি সরকারের নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেলেন, এটাই বিশেষ ঘটনা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখার কাজে কাঠবেড়ালির সাঁকো বাঁধার মতো ব্যাপার হলেও এই ব্যাঘ্রবধ উড়ো পাখির মতো দেশ—দেশান্তর চক্কর দেবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর জেহাদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। কারণ, ততদিনে পারিবারিক দুর্দশা বেশ ঘোরতর হয়েছিল। এবং তিনি বলতেন, ‘জান বাঁচানো একটি ফরজ (অবশ্যপালনীয়) কাজ। এটা আল্লাতালার আদেশ।’

এর পর লোকে তাঁকে বলত ‘বাঘা মৌলবি’। কেউ কেউ বলত, ‘বাঘমারা মৌলবি।’ তবে উনি নিজে ‘শেরে হিন্দুস্তান’ খেতাবটা পেলেই খুশি হতেন। কারণ, প্রতি ধর্মসভায় তিনি তাঁর বাঘ মারার কাহিনীটি খুঁটিয়ে বর্ণনা করতেন এবং বাঘটিকে একটি প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করতেন। বলতেন, ‘শেরটা ছিল আসলে খোদ শয়তান—যে শয়তানকে আল্লা একদা বেহস্ত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজও ফেরেস্তারা (দেবদূতগণ) যাকে আশমানে জ্বলন্ত পাথর ছুঁড়ে ভাগিয়ে দেয়।’ আকাশে উল্কাপাতের কথাই বলতেন তিনি। বলা বাহুল্য, এসব কারণে তাঁর পসার শিষ্যকুলে বেড়ে গিয়েছিল। সত্যি তো, বাঘা বাঘা বন্দুকবাজ যাকে ঘায়েল করতে পারেনি, তাকে একজন নিরীহ মৌলবি কীভাবে নিকেশ করলেন? ঈশ্বরের দেওয়া ক্ষমতা ছাড়া এ কি সম্ভব? নিঃসন্দেহে জুহাসায়েব এক ‘বুজুর্গ’ (অলৌকিক শক্তিধর পুরুষ), তাঁর কেরামতির মাহাত্ম্য স্বীকার করতেই হয়। এবং যেখানে তিনি যেতেন, বাঘের চামড়াটা বিছিয়ে তাতে বসতেন।

কিন্তু ঠিক সেদিনই সবার অগোচরে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল—যা আরও মারাত্মক।

সন্ধ্যার নিঃঝুম স্টেশনের কোয়ার্টারে গোরাং ডাক্তারের মেয়ে গোরা স্টেশনমাস্টারকে বিদ্রুপ করতে গিয়েছিল। তাছাড়া কেন আর যাওয়া?

স্বর্ণকে যেতে দেখেছিল শুধু একজনই—সে বালক আনন্দ। জানলায় বসে সে সব লক্ষ্য করেছিল স্টেশনে ছোটবাবু বাঙালি প্রৌঢ় মানুষটি ও খালাসি দুজন আসন্ন লক্ষ্য করেছিল স্টেশনে ছোটবাবু বাঙালি প্রৌঢ় মানুষটি ও খালাসি দুজন আসন্ন আপট্রেন নিয়ে ব্যস্ত। প্ল্যাটফর্ম একেবারে খাঁ খাঁ। কোনো যাত্রীই ছিল না। তারপর ট্রেনটা আসে। ট্রেন যায়। জনাতিন যাত্রী নামে। তারাও চলে যায়।

হেরুর ছেলে যখন ঘুমে ঢুলছে, তখন লেডি ডাক্তার ফিরে আসে। বিস্রস্ত চেহারা, হাঁফ সামলাচ্ছে। চাঁদঘড়ির বউ নুন চাইতে এসে নাকি কেমন হতচকিত অবস্থায় দেখে তাকে। অনেক পরে সে কথাটা বলেছিল—কিন্তু কেউ তাতে আমল দেয়নি।

পরদিন খবর রটে যায়, গোরা স্টেশনমাস্টার জর্জ হ্যারিসন বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছে।…

কিন্তু এমন যদি হয় যে স্বর্ণই তাকে বিশেষ এক মুহূর্তে খুন করে বসেছিল? হয়তো স্বর্ণকে ধর্ষণ করতে যাচ্ছিল, কিংবা স্বর্ণ ধর্ষিতা হয়েছিল—তারপর বন্দুকবাজের বন্দুকটি তুলে নিয়ে………..

কারণ, তদন্তকারী অফিসার বলেছিলেন, ‘আশ্চর্য, এভাবে বুকে গুলি করে আত্মহত্যা! সচরাচর এমন করে না কেউ। যেন এটি এক হত্যাকাণ্ড!’

তখন ফোরেনসিক বিজ্ঞান এত উন্নত হয়নি। তাহলে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে বলা যেত হত্যা, না আত্মহত্যা।

এবং এও ঠিক যে চাঁদঘড়ির বউ অনেকরাতে লেডিডাক্তারকে খিড়কির পুকুরে স্নান করতে দেখেছিল।

দেহের অশুচিতা থেকে মুক্তির প্রয়াস?

আমাদের বর্তমান সময়ের যুক্তিজ্ঞান নিয়ে পিছনের দিকে এগোলে কিছুই কাজ হয় না। মানুষের কোনো স্থায়ী শ্বাশ্বত যুক্তি নেই—শুধু যুক্তিবোধ নামে এক বিচ্ছিন্ন বা শূন্য পাত্র আছে মাত্র।

মানুষ নিজের কাছে কী অসহায়, কী নিঃসঙ্গ! অন্ধকার রাতে এই নির্জন টিলায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে আমাদের তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিকের এটাই ক্রমাগত মনে মনে আছড়ে পড়ে।

ক্রমশ এই অন্ধকার কিছু সরে একাংশ মুক্ত হল। এক পরিচ্ছন্ন উজ্জ্বল রোদের দুপুর ফুলে উঠল। প্রত্নতাত্ত্বিক দেখতে থাকলেন। হ্যাঁ, ধীরে ধুলোউড়ির মাঠ দিয়ে হেঁটে চলেছে একটি সাত আট বছরের ছেলে। কোথায় চলেছে সে?

ইয়াকুব সাধুর ভিটেয় সে আনমনে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে পাশের শ্মশানের দিকে চলেছে সে। তার হাতে একটি গাছের ডাল। ছেলেটি চঞ্চল হয়েছে এবার। নাচতে নাচতে এগোচ্ছে। প্রকৃতির এই রাজ্যে সে এখন একটি মুক্ত সত্তা। সে গঙ্গার ধারে ধারে ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। তারপর শ্মশানবটের তলায় এল। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। কী যেন মনে পড়ল। একজায়গায় নরম ধূসর মাটি সরাতে থাকল। ডালটা দিয়ে খুঁড়ল। অনেকটা খোঁড়ার পর কী একটা তুলে নিয়ে দেখেছে সে!

লেডিডাক্তার আসছে ওপার থেকে গাঁওয়াল সেরে। তখন বিকেল হয়েছে। পাড়ে সে থমকে দাঁড়ায়। আনন্দ না? হতভাগার মন পড়ে আছে সাধুর ভিটেয় আবার চলে এসেছে এখানে। ওদিকে বাড়িঘরের দরজা হয়তো হাট করে খোলা। সর্বনেশে ছেলে তো!

রুষ্টা স্বর্ণ এগিয়ে আসে দ্রুত। ….’আনন্দ, আনন্দ! এখানে আয়!’

আনন্দের সামনে নরম মাটির স্তূপ। একপাশে কীসব জড়ো করা। শেকড়—বাকড় তুলছে হয়তো। বুনো স্বভাব আর যাবে কোথায়?

আনন্দ হাতে তুলে নিয়ে দেখায় তাকে এবং দাঁত বের করে হাসে।

‘এসব কী রে?’

সে জানে না। চকিতে দেখে নিয়ে শিউরে উঠে স্বর্ণ। এ যে সোনার গয়না! এখানে পোঁতা কেন? কে পুঁতেছিল? ছেলেটা টেরই বা পেল কী করে? সে ওকে কাঁধ নাড়া দিয়ে বলে—’কেমন করে পেলি? তুই জানতিস?’

ছেলেটা বলে, ‘হুঁ। খেলতে খেলতে দেখেছিলাম—সেই কবে।’

‘হুঁ। সাধুবাবাকে বলিসনি বুঝি?’

‘উঁহু। বলেছিলাম তো। মারতে এসেছিল। খুঁজেই পাইনি।’

‘এখন পেলি যে?’

‘পেয়ে গেলাম!’

‘এগুলো কী জানিস?’

‘কী?’

‘সোনা। সোনার ইংরিজি কী?’

‘গোল্ড।’

‘বাহাদুর ছেলে! এগুলো কে পুঁতেছিল জানিস?’

‘না।’

‘তোর বাবা—ডাকাতবাবা!’

‘সাধু?’ বলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

‘না রে হাঁদারাম, না। তোর আসল বাবা! ডাকাত ছিল সে। নে—ধুলো ঝাড়। ওঠ। আয়, এবার আমরা মজার খেলা খেলব।’

দুজনে গঙ্গার দিকে যায়! তারপর ঠিক একদিন যেমন করে আঁরোয়া জঙ্গলের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেছিল, তেমনি করে গঙ্গার দহে ছুঁড়তে থাকে গয়নাগুলো—কিন্তু আজ একা নয়। ছেলেটিকেও কিছু দেয়। মহাসুখে দুটি প্রাণী দিনাবসানে এই ত্যাগের খেলায় মেতে থাকে কিছুক্ষণ। সব শেষ হলে দুজনেই হাতের ধুলো ঝাড়ে এবং পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে।

তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে ধুলোউড়ির মাঠ পেরিয়ে দুটি মুক্ত মানুষের মতো ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। ….