এতেক বিচার করে কুরু সৈন্যগণ।
শমী-বৃক্ষতলে যানে ইন্দ্রের নন্দন।।
উত্তরে বলেন, তুমি যুদ্ধে যোগ্য নহ।
এই দীর্ঘ শমীবৃক্ষ উপরে আরোহ।।
ধনুঃশ্রেষ্ঠ গাণ্ডীব যে আছে বৃক্ষোপরে।
দিব্য যুগ্ম তূণ আছে পরিপূর্ণ শরে।।
বিচিত্র কবচ ছত্র শঙ্খ মনোহর।
বৃক্ষ হৈতে নামাইয়া আনহ সত্বর।।
পঞ্চ ধনু মধ্যে যেই ধনু মনোরম।
বল যার এক লক্ষ তালবৃক্ষ সম।।
শুনিয়া বিরাটপুত্র করিল উত্তর।
কিমতে চড়িব এই বৃক্ষের উপর।।
শুনিয়াছি এক গাছে শব বান্ধা আছে।
রাজপুত্র হয়ে কিসে চড়িব এ গাছে।।
পার্থ বলে, শব নহে বৃক্ষ উপরেতে।
পাপকর্ম্ম কেন তোমা কহিব করিতে।।
শব বলি রেখেছিনু কপট-বচন।
শব নহে, আছে ইথে ধনু অস্ত্রগণ।।
এত শুনি রাজসুত চড়ে সেইক্ষণ।
ছাড়াইল যত ছিল বস্ত্র-আচ্ছাদন।।
অর্কচন্দ্র-প্রভা যেন ধনু অস্ত্র যত।
সর্পের মণির প্রায় জ্বলে শতশত।।
ব্যস্ত হয়ে রাজসুত ধনঞ্জয়ে কয়।
ধনু অস্ত্র কোথা, সব দেখি সর্পময়।।
দেখিয়া অদ্ভুত মোর কাঁপিছে হৃদয়।
স্পর্শ করা দূরে থাক, দেখি লাগে ভয়।।
পার্থ বলে, সর্প নহে ধনু-অস্ত্রগণ।
শুনিয়া উত্তর পুনঃ কহিছে বচন।।
অদ্ভূত বিচিত্র দীর্ঘ তালবৃক্ষ সম।
মণিরত্নে বিভূষিত ধনু মনোরম।।
মৃগচিহ্ণ হুলে যার দুরাকর্ষ দেখি।
কোন্ মহাবীর হেন ধনু গেল রাখি।।
বিচিত্র দ্বিতীয় ধনু রিপুকুল-ধ্বংস।
কাহার এ ধনুপৃষ্ঠে শোভে রাজহংস।।
তৃতীয় সুবর্ণ গোধা শোভে ধনুহুলে।
কাহার বিচিত্র ধনু, অগ্নি হেন জ্বলে।।
চতুর্থ অদ্ভূত ধনু, দেখি যে কাহার।
চতুর্দ্দশ ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে শোভিত যাহার।।
কাহার এ ধনু, পৃষ্ঠে হেমশিখি-শোভা।
মণি রত্ন বিভূষিত শত চন্দ্র-আভা।।
বিচিত্র শকুনিপত্র বিভূষিত শর।
পূর্ণ দেখি ছয় গোটা তূণ মনোহর।।
চর্ম্ম মধ্যে পঞ্চ শঙ্খ কাহার সুন্দর।
সেই শঙ্খ বাদ্য করে কোন্ ধনুর্দ্ধর।।
অর্কপ্রভ তীক্ষ্ণ পঞ্চ শঙ্খ মনোহর।
বৃক্ষমধ্যে পঞ্চ শঙ্খ রাখে কোন্ নর।।
নাহি দেখি, নাহি শুনি, লোকের বদনে।
হেন অস্ত্র ধনু, বল রাখে কোন্ জনে।।
পার্থ বলে, যেই ধনু নীলোৎপলনিভ।
ত্রৈলোক্য-বিজয়ী নাম ধরয়ে গাণ্ডীব।।
সুরাসুর সুপূজিত শত্রুর শমন।
শতেক সহস্র বল যাহার গণন।।
ব্রহ্মবৎশে ব্রহ্মা ধরে শতেক বৎসর।
পঞ্চাশী বৎসর ধরিলেন পুরন্দর।।
পঞ্চশত বর্ষ ধরে দেব নিশাকরে।
চৌষট্টি বরষ ছিল প্রজাপতি করে।।
শতেক বরষ ধরিলেক জলপতি।
বরুণে মাগিয়া নিল অগ্নি মহামতি।।
খাণ্ডব দাহন হেতু দিল অর্জ্জুনেরে।
পঞ্চষষ্টি বর্ষ উহা রহে পার্থ-করে।।
দেবের নির্ম্মিত ধনু, দেবমূর্ত্তি ধরে।
দেবকার্য্যে পাইলাম অগ্নি দিল মোরে।।
পূর্ব্বে ব্রহ্মা দেবগণ লয়ে যজ্ঞ কৈল।
পঞ্চবিংশ পর্ব্বে এক বের্ণ-বৃক্ষ হৈল।।
বিষ্ণুর ধনুক নবপর্ব্বে নিরমিত।
শারঙ্গ যাহার নাম, বল অপ্রমিত।।
সপ্তপর্ব্বে জয়ন্তী সে ধনুক নির্ম্মাণ।
সংহার কারণে থাকে মহেশের স্থান।।
পঞ্চপর্ব্বে কোদণ্ডক ধনুক নির্ম্মিল।
দানব দলন হেতু দেবরাজে দিল।।
পঞ্চ লক্ষ বল তার থাকে ইন্দ্র হাতে।
রাবণ বিনাশ হেতু দিল রঘুনাথে।।
তিন পর্ব্বে গাণ্ডীবের হয়েছে নির্ম্মাণ।
খাণ্ডব দহিতে অগ্নি মোরে দিল দান।।
মোহন মূরলী এক পর্ব্বে ধাতা কৈল।
গোপীর মোহন হেতু গোবিন্দেরে দিল।।
গাণ্ডীব ধনুর জন্ম, কৈনু যেই মতে।
ত্রিগুণে নির্ম্মিত গুণ সর্ব্ব ধনুকেতে।।
দ্বিতীয় ধনুক হেম বিদ্যুতে শোভয়।
ছয় হংস-চিত্র ধর্ম্ম-নৃপতি ধরয়।।
সত্তর সহস্র বল ধনুক নির্ম্মাণ।
দ্রোণাচার্য্য গুরু পূর্ব্বে মোরে দিল দান।।
সহস্রেক গোধা যেই ধনু অনুপাম।
বৃকোদর ধনু তার সুপার্শ্বক নাম।।
পঞ্চ শত সত্তর সহস্র বল ধরে।
কাড়ি নিল ধনু বলে জয়দ্রথ বীরে।।
ব্যাঘ্র-বিভূষিত ধনু নকুল বীরের।
পঁষট্টি সহস্র বল শল্যের করের।।
শিখিচিহ্ন ধনু সহদেব বীর ধরে।
চতুঃষষ্টি বল পূর্ব্বে দিল চক্রধরে।।
অতিদীর্ঘ তরুবর পিপ্পলী ভূষিত।
ভীমসেন ঠাকুরের জগতে বিদিত।।
এতেক বলেন যদি বীর ধনঞ্জয়।
তবু না জানিল মূঢ় বিরাটতনয়।।
পুনঃ জিজ্ঞাসিল, সত্য কহ বৃহন্নলে।
ধনু অস্ত্র রাখি তাঁরা, গেল কোন্ স্থলে।।
শুনেছি পাশাতে হারি গেল রাজ্য ধন।
কৃষ্ণা সহ বনে প্রবেশিল ছয় জন।।
হেথায় কিমতে অস্ত্র রাখিল পাণ্ডব।
তুমি জ্ঞাত হৈলে কিসে, বল এই সব।।
হাসিয়া বলেন পার্থ আমি ধনঞ্জয়।
কঙ্ক সভাসদ সেই ধর্ম্মের তনয়।।
বৃকোদর বল্লব, যে পাচক তোমার।
অশ্বপাল নাম গ্রন্থি, নকুল কুমার।।
সহদেব তব গবী করেন পালন।
সৈরন্ধ্রী পাঞ্চালী, হেতু কীচক নিধন।।
উত্তর বলিল, মোর মনে নাহি লয়।
কহ সত্য তুমি যদি পাণ্ডুর তনয়।।
দশ নাম ধরে সেই পার্থ মহাশয়।
শুনিলে আমার মনে হইবে প্রত্যয়।।
অর্জ্জুন বলেন নাম শুনহ আমার।
যেই দশ নাম মম বিখ্যাত সংসার।।
অর্জ্জুন ফাল্গুনি সব্যসাচী ধনঞ্জয়।
কিরীটি বীভৎসু শ্বেতবাহন বিজয়।।
কৃষ্ণ জিষ্ণু, বলি মোর দশ নাম জান।
প্রদান করিল যাহা অমর প্রধান।।
উত্তর বলিল, কহ করিয়া নির্ণয়।
কি হেতু কি নাম হৈল, কুন্তীর তনয়।।
দৈবে তুমি জান নাম তাঁর সঙ্গে ছিলে।
শুনি জ্ঞান হৌক, শীঘ্র কহ বৃহন্নলে।।