২০৭তম অধ্যায়
বিষ্ণু হইতে সৃষ্টি—তদীয় নাভিপদ্মে ব্ৰহ্মার জন্ম
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যিনি সকলের স্রষ্টা, যাঁহার স্রষ্টা কেহই নাই এবং যিনি পুণ্ডরীকাক্ষ, অচ্যুত, বিষ্ণু, হৃষীকেশ, গোবিন্দ ও কেশব প্রভৃতি নামে বিখ্যাত হইয়াছেন, আমি সেই ভূতভাবন [সৰ্ব্বজীবের উৎপাদক] নারায়ণের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে বাসনা করিতেছি, আপনি বিশেষরূপে তাঁহার বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! আমি জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম, দেবর্ষি নারদ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়নের নিকট ঐ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছি। ভগবান অসিত, দেবল, মহাতপাঃ বাল্মীকি ও মহর্ষি মার্কণ্ডেয় ইহারা নারায়ণের বিষয় অতি অদ্ভুতরূপে কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। আমি অনেক মহাত্মার মুখে শ্রবণ করিয়াছি যে, ভগবান নারায়ণ পুরুষপ্রধান ঈশ্বর ও সর্ব্বব্যাপী। যাহা হউক, এক্ষণে মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং পুরাণবেত্তা সাধুগণ ঐ মহাত্মার যেসকল গুণ কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন, আমি তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“ভগবান পুরুষোত্তম আকাশ, বায়ু, পৃথিবী, তেজ ও জল এই পাঁচ মহাভুতের সৃষ্টি করিয়া পরে স্বয়ং সলিলোপরি শয়ন করিলেন। অনন্তর তিনি প্রথমে মনের সহিত অহঙ্কারের সৃষ্টি করিলেন। সেই অহঙ্কারবলে জীবগণের সংসারকার্য্য নির্বাহ হইতেছে। অহঙ্কারের সৃষ্টির পর সলিলশায়ী ভগবান নারায়ণের নাভিদেশে ভাস্করপ্রতিম এই দিব্যপদ্ম সম্ভূত হইল। লোকপিতামহ ব্রহ্মা নারায়ণের সেই নাভিপদ্ম হইতে প্রাদুর্ভূত হইলেন। পদ্মযোনি প্রাদুর্ভূত হইবামাত্র তাঁহার প্রভায় দিঙ্মণ্ডল উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। ভগবান্ ব্রহ্মার উৎপত্তির পর তমোগুণসম্পন্ন মধুনামে এক মহাসুর জন্মপরিগ্রহ করিয়া তাঁহার উপর অত্যাচার করিতে লাগিল।
ব্রহ্মার প্রতিকূলকারী মধুদানববধ
“তখন পুরুষোত্তম নারায়ণ লোকপিতামহ ব্রহ্মার উপকারার্থ ঐ বিকটবেশধারী রুদ্ৰকর্ম্মা [উগ্ৰকৰ্ম্মা—ভয়ঙ্কর কর্ম্মাচরণকারী] মহাসুরকে নিপাতিত করিলেন। মহাত্মা হৃষীকেশ তৎকালে সেই দুরাত্মা অসুরকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন বলিয়া দেব, দানব ও মানব প্রভৃতি সকলে উহাকে মধুসূদননামে নির্দ্দেশ করেন।
“মধুদৈত্য নিহত হইলে পর মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য পুলহ ও ক্রতুনামে ব্রহ্মার মানসপুত্রগণের উৎপত্তি হইল। তন্মধ্যে মরীচি হইতে কশ্যপ সম্ভূত হন। বেদবিদ্যাবিশারদ মরীচিমুনির জন্মপরিগ্রহের পুৰ্ব্বে ব্রহ্মার অঙ্গুষ্ঠ হইতে আর একটি পুত্র উৎপত্তি হইয়াছিল। তাঁহার নাম দক্ষ প্রজাপতি। দক্ষ হইতে প্রথমে ত্রয়োদশ কন্যার উৎপত্তি হয়। ঐ কন্যাগণের মধ্যে দিতিই সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠা। সৰ্ব্বধর্ম্মজ্ঞ মহাযশস্বী মরীচিপুত্র কশ্যপ ঐ কন্যাগণের পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।
“অনন্তর প্রজাপতি দক্ষ আর দশটি কন্যা উৎপাদন করিয়া ধৰ্ম্মকে সমর্পণ করিলেন। ধর্ম্মের ঔরসে তাঁহাদিগের গর্ভে বসু, রুদ্র, বিশ্বদেব, সাধ্য ও বায়ু প্রভৃতি পুত্ৰসমুদয় সমুৎপন্ন হইল। ঐ দশ কন্যার জন্মের পর দক্ষের আর একটি সপ্তবিংশতি কন্যা জন্মিয়াছিল। ভগবান চন্দ্রমা তাঁহাদিগের পাণিগ্রহণ করেন। কশ্যপের পত্নীগণের মধ্যে অদিতি হইতে মহাবলপরাক্রান্ত দেবশ্রেষ্ঠ আদিত্যগণ উৎপন্ন হইলেন। ঐ আদিত্যগণের মধ্যে বামনরূপী বিষ্ণু অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। সেই বামনদেবের বিক্রমপ্রভাবে দেবগণের শ্রীবৃদ্ধি এবং দানব ও অসুরগণের অবনতি হইতে লাগিল। দনু বিপ্রচিত্তি প্রভৃতি দানবকে ও দিতি মহাবলপরাক্রান্ত অসুরগণকে এবং কশ্যপের অন্যান্য পত্নীগণ গন্ধৰ্ব্ব, তুরঙ্গ, পক্ষী, গো, কিম্পুরুষ, মৎস্য ও উদ্ভিজ্জ সমুদয় উৎপাদন করিলেন।
কালব্যবস্থা—সত্যাদি যুগধর্ম্ম
“অনন্তর ভগবান্ মধুসুদন বিবেচনা করিয়া দিবা, রাত্রি, কাল, ঋতু, পূৰ্ব্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ, মেঘ ও পৃথিবীস্থ যাবতীয় স্থাবরজঙ্গমের সৃষ্টি করিলেন। অনন্তর মুখ হইতে একশত ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে একশত ক্ষত্রিয়, ঊরুদেশ হইতে একশত বৈশ্য এবং পাদদেশ হইতে একশত শূদ্র সমুৎপন্ন হইল। হে মহারাজ! ভগবান্ নারায়ণ এইরূপে চারিবর্ণের সৃষ্টিবিধান করিয়া পরিশেষে বেদবিধাতা ব্রহ্মাকে সৰ্ব্বভূতের অধ্যক্ষ, ভগবান্ বিরূপাক্ষকে ভূত ও মাতৃগণের অধ্যক্ষ, যমরাজকে পাপাত্মাদিগের নিয়ন্তা, কুবেরকে ধনরক্ষিতা, জলেশ্বর বরুণদেবকে জলজন্তুগণের অধিপতি এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদয় দেবগণের অধীশ্বর করিলেন। ঐ সময় যাহার যত দিন জীবিত থাকিবার অভিলাষ হইত, সে তত দিন জীবিত থাকিতে সমর্থ হইত। কাহাকেও শমনের শাসনশঙ্কায় শঙ্কিত হইতে হইত না। স্ত্রীসংসর্গের আবশ্যকতা ছিল না; ইচ্ছা করিলেই লোকে সন্তান উৎপাদন করিতে পারিত। ঐ সময়ের নাম সত্যযুগ। সত্যযুগের পর ত্রেতাযুগেও স্ত্রীসংসর্গের প্রথা প্রচলিত ছিল না, তৎকালে লোকে কামিনীগণকে স্পর্শ করিলেই তাহাদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করিতে সমর্থ হইত। দ্বাপরযুগ হইতেই মৈথুনযুগ প্রচলিত হইয়াছে।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি তোমার নিকট সৰ্ব্বাধীশ্বর জগৎপতি নারায়ণের বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে উচ্ছল পাপাত্মাদিগের বৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর। দক্ষিণাপথসম্ভূত নরবর অন্ত্রক, গুহ, পুলিন্দ, শবর, চুচুক ও মদ্রক এবং উত্তরাপথসম্ভূত যৌন, কম্বোজ, গান্ধার, কিরাত ও বরগণ নিয়ত পাপানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক অবনীমণ্ডলে বিচরণ করে উহাদের ব্যবহার চণ্ডাল, কাক ও গৃধ্রগণের ন্যায় নিতান্ত কদর্য্য। সত্যযুগে উহাদের নামগন্ধও ছিল না ত্রেতাযুগ হইতে ক্রমে ক্রমে উহাদিগের সংখ্যাবৃদ্ধি হইতেছিল। এক্ষণে উহাদের সংখ্যার নিতান্ত আধিক্যনিবন্ধন পৃথিবী একান্ত নিপীড়িত হওয়াতে ভগবান্ ভূতভাবনের ইচ্ছানুসারে উহারা সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইয়া পরস্পর পরস্পরকে নিহত করিয়াছে।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে মহাত্মা বাসুদেব হইতেই সমুদয় সম্ভূত হইয়াছে। সৰ্ব্বলোকদর্শী দেবর্ষি নারদও বাসুদেবকে দেবদেব বলিয়া কীৰ্ত্তন এবং তাঁহার নিত্যত্ব স্বীকার করিয়া থাকেন। ফলতঃ সত্যপরাক্রম মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ সামান্য মনুষ্য নহেন, উঁহার মহিমা অনির্ব্বচনীয়।”