২০৭তম অধ্যায়
ধর্ম্মব্যাধিকর্ত্তৃক স্বধর্ম্ম প্রশংসা
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! তৎপরে ধর্ম্মব্যাধ পুনরায় ব্রাহ্মণকে কহিতে লাগিল, “হে ব্ৰহ্মন! আমি যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকি উহা নিতান্ত নিদারুণ, সন্দেহ নাই। বিধিই সর্ব্বাপেক্ষা বলবান, পূর্ব্বজন্মের কর্ম্মফল অবশ্যই ভোগ করিতে হয়। দেখুন, আমি পূর্ব্বকৃত কাৰ্য্যদোষেই এই কুক্রিয়ানুষ্ঠান করিতেছি। হে বিপ্ৰ! আমি এই দোষ পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত যথাসাধ্য যত্ন করিতেছি, কিন্তু কি অনুল্লঙ্ঘনীয় প্রভাব! কোনক্রমেই উহা পরিহার করিতে পারিতেছি না। হে দ্বিজসত্তম! বিধিই প্রাণীগণকে সংহার করে, ঘাতক কেবল নিমিত্তমাত্ৰ; তদনুসারে আমরাও পশুবধে কেবল নিমিত্তভুত হইয়াছি। হে ব্ৰহ্মন! আমরা যে সমুদয় পশুমাংস বিক্রয় করি, উহা ভক্ষণ করিলে ধর্ম্ম হয়, কারণ, উহাদ্বারা দেব, অতিথি, ভৃত্য ও পিতৃগণের পূজা হইয়া থাকে। আরও, ওষধি, লতা, পশু, মৃগ ও পক্ষি-সকল যে লোকের ভক্ষ্য, ইহা শ্রুতিসিদ্ধ। হে দ্বিজসত্তম! উশীনরনন্দন শিবি আপনার মাংস প্রদান করিয়া দুস্তপ্রাপ্য স্বর্গ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। পূর্ব্বে মহারাজ রন্তিদেবের মহানসে প্রত্যহ দুই সহস্ৰ পশুবধ করিয়া প্রতিদিন অতিথি ও অন্যান্য জনগণকে সমাংস অন্নপ্রদান-পূর্ব্বক লোকে অতুল কীর্ত্তি লাভ করিয়াছেন।
‘হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! চাতুৰ্ম্মস্যে পশুবধের বিধান আছে; শ্রুতিতেও অগ্নি মাংসাভিলাষী বলিয়া পরিকীর্ত্তিত হইয়াছেন। ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞে মন্ত্রসংস্কৃত পশু-সকল বধ করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন। হে ব্ৰহ্মন! পূর্ব্বে অগ্নি যদি মাংসকাম না হইতেন, তাহা হইলে মাংস কদাপি লোকের ভক্ষ্য হইত না। আর মুণিগণও এ বিষয়ের বিলক্ষণ বিধান করিয়া গিয়াছেন। যে ব্যক্তি সর্ব্বদা বিধানানুসারে শ্রাদ্ধে দেবতা ও পিতৃগণের উদ্দেশে মাংস প্ৰদান করিয়া ভক্ষণ করে, তাহার মাংসভোজন দোষাবহ নহে, প্রত্যুত শ্রুতানুসারে তাহাকে অমাংসাশী বলা যায়। যেমন ব্ৰহ্মচারী ব্রাহ্মণ ঋতুকালে স্বীয় পত্নীতে গমন করিলে তাহার ব্ৰহ্মচর্য্যের হানি হয় না, তদ্রূপ বিধিবোধিত মাংসভক্ষণ করিলে কোনক্রমে তাঁহাকে পাপ স্পর্শ করিতে পারে না। এ স্থলে সত্য ও অনূত বিশেষরূপে বিনিশ্চয় করিয়া এই বিধি অভিহিত হইয়াছে। কিন্তু মহারাজ সৌদাস শাপাভিভূত হইয়া যে মনুষ্যগণকে ভক্ষণ করিয়াছিলেন, উহা আমার নিতান্ত ঘৃণাকর বলিয়া বোধ হয়।
‘হে দ্বিজোত্তম! আমি স্বধর্ম্ম বিবেচনা করিয়া আপনার ব্যবহার পরিত্যাগ করি না, প্রত্যুত আপনার পূর্ব্বকৃত কর্ম্মের ফল বলিয়া উহাদ্বারাই জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকি। হে ব্ৰহ্মন! স্বকর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে অধর্ম্ম হয়, যে ব্যক্তি স্বকর্ম্মনিরত তাহাকে ধার্ম্মিক বলা যায়। জন্মান্তরীণ কর্ম্মফল অবশ্যই ভোগ করিতে হয়, বিধাতা কর্ম্মনির্ণয়ে এইরূপ বিধিই নির্দ্দিষ্ট করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু সেই কর্ম্মনিৰ্ণয় নানা প্রকার, কোন অশুভকাৰ্য্য উপস্থিত হইলে কি প্রকারে তাহা হইতে বিমুক্ত হইব ও কিরূপেই বা শুভকাৰ্যের অনুষ্ঠান করিব, তাহা বুদ্ধিপূর্ব্বক পৰ্য্যালোচনা করা উচিত। হে দ্বিজসত্তম! আমি দান, সত্যবাক্য কথন, গুরুশুশ্রূষা ও দ্বিজাতিপূজন প্রভৃতি ধর্ম্মে সতত নিরত থাকি এবং কখন অভিমান বা কাহারও নিন্দা করি না।
‘হে মহাত্মন! অনেকে কৃষিকর্ম্মকে উৎকৃষ্ট বলিয়া থাকেন, কিন্তু ঐ কর্ম্মের অনুষ্ঠানকালে অনেক হিংসা করিতে হয়, দেখুন, পুরুষগণ লাঙ্গলদ্বারা ভূমিকৰ্ষণ করিতে করিতে বহুবিধ প্রাণীগণের প্রাণসংহার করে; অতএব এ বিষয়ে আপনার কি বিবেচনা হয়? ব্রীহি প্রভৃতি যে-সমস্ত বস্তুকে লোকে বীজ কহে, তৎসমুদয়ই জীব, অতএব এ বিষয়ে আপনার কি বিবেচনা হয়?
‘লোকে পশুগণকে আক্রমণপূর্ব্বক বধ ও তাহাদের মাংস ভক্ষণ এবং বৃক্ষ ও ওষধি-সমুদয় ছিন্ন করে। হে ব্ৰহ্মন! কি বৃক্ষ, কি ফল, কি জল, সকল বস্তুতেই বহুবিধ জীব আছে, অতএব এ বিষয়ে আপনি কি বিবেচনা করেন? অনেক প্ৰাণী প্রাণীভক্ষণদ্বারা জীবনধারণ করে এবং এমন অনেক জীবজন্তু আছে, যাহারা পরস্পর পরস্পরকে পাইলে ভক্ষণ করে; দেখুন, মৎস্যগণ মৎস্য ভক্ষণ করিয়া থাকে; অতএব এ বিষয়ে আপনার কি বিবেচনা হয়? এই জগৎ বহুবিধ অসংখ্য জীবে পরিপূর্ণ রহিয়াছে; এই নিমিত্ত মনুষ্যগণ ভ্ৰমণ করিতে করিতে পদাঘাতে কত শত জীবজন্তুর প্রাণসংহার করে এবং উপবিষ্ট ও শয়ান হইয়া জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অনেকানেক প্রাণীকে বিনষ্ট করে, অতএব এ বিষয়ে আপনার কি বিবেচনা হয়? সমুদয় পৃথিবী ও আকাশ জীবে পরিপূর্ণ, অণুমাত্রও প্রাণীগণশূন্য স্থান নাই, এই নিমিত্ত লোকে অজ্ঞাতসারে অবশ্যই তাহাদিগকে বিনষ্ট করে; অতএব এ বিষয়ে আপনার কি বিবেচনা হয়?
‘পূর্ব্বে মহাত্মারা অহিংসা পরমধর্ম্ম বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু দেখুন, এই লোকমধ্যে কোন ব্যক্তি হিংসা না করে? বিশেষরূপে বিবেচনা করিয়া দেখিলে কেহই অহিংসক নাই; অহিংসানিরত যতিগণও হিংসা করিয়া থাকেন, তবে অহিংসার নিমিত্ত সাতিশয় যত্নবান থাকেন বলিয়া তাঁহাদের হিংসাদোষ অতি অল্প পরিমাণে উৎপন্ন হইয়া থাকে। আর দেখুন, সৎকুলজাত বহুগুণশালী পুরুষগণ অতিশয় নিন্দনীয় কর্ম্ম করিয়াও লজ্জিত হন না, মনুষ্যগণ কি সুহৃদ, কি অমিত্র, কি সম্যকপ্রবৃত্ত [সর্ব্ববিষয়ে বিবেচনাশালী] লোক, কি সমৃদ্ধ বান্ধব, কাহাকেও অভিনন্দন করে না। পাণ্ডিত্যাভিমানী মূঢ়গণ গুরুজনের নিন্দা করে। এইরূপে বিপৰ্য্যয়বশতঃ লোকে নানাপ্রকার ধর্ম্মাধর্ম্ম দৃষ্ট হয়। হে দ্বিজবর! ধর্ম্মাধর্ম্মমূলক কর্ম্মের বিষয় বর্ণনা করিতে অনেক অবশিষ্ট রহিল, কিন্তু যে-সকল ব্যক্তিরা স্বকর্ম্মনিরত, তাহারাই যশস্বী ও মান্য হয়।’ ”