২০৬. সমাধিতে আত্মসাক্ষাৎকার

২০৬তম অধ্যায়

সমাধিতে আত্মসাক্ষাৎকার

“মনু কহিলেন, ‘হে মহর্ষে! শব্দাদি পঞ্চগুণের সহিত পাঁচ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করিতে পারিলেই আত্মাকে মণিমধ্যে নিহিত সূত্রের ন্যায় দর্শন করিতে পারা যায়। আর সূত্র যেমন সুবর্ণ, মুক্তা, প্রবাল, রজত ও মৃন্ময় বস্তুতে নিহিত থাকে, তদ্রূপ আত্মা স্বীয় কর্ম্মপ্রভাবে গো, অশ্ব, মনুষ্য, হস্তী, মৃগ, কীট ও পতঙ্গ প্রভৃতি যোনিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। যে প্রাণী যে দেহ লাভ করিবার নিমিত্ত যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে সেই দেহ প্রাপ্ত হইয়া সেই কার্য্যের ফলভোগ করিয়া থাকে। বুদ্ধি অন্তরাত্মাকর্তৃক পরিচালিত হইয়াও আপনার পূর্ব্বকৃত কর্ম্মের অনুসরণ করে। জ্ঞান হইতে অনুরাগ, অনুরাগ হইতে অভিসন্ধি, অভিসন্ধি হইতে কাৰ্য্য ও কাৰ্য্য হইতে ফল উৎপন্ন হয়। এই নিমিত্ত ফল কৰ্ম্মসম্ভূত, কৰ্ম্ম বুদ্ধিসম্ভূত, বুদ্ধি জ্ঞানসম্ভূত ও জ্ঞান আত্মসম্ভূত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। দেহ ও আত্মার ভেদজ্ঞান, ফল, বুদ্ধি ও কর্ম্মক্ষয় হইলে যে দিব্যজ্ঞান জন্মে, তাহাই ব্ৰহ্মজ্ঞান; যোগিগণ মুক্তিলাভ করিয়া নিত্যসিদ্ধ পরমপদার্থকে দর্শন করিতে পারেন, বিষয়াসক্ত নির্বোধেরা কখনই তাঁহার দর্শনলাভে সমর্থ হয় না। পৃথিবী হইতে জল, জল হইতে তেজ, তেজ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে আকাশ, আকাশ হইতে মন, মন হইতে বুদ্ধি, বুদ্ধি হইতে কাল ও কাল হইতে জগকর্ত্তা ব্রহ্মরূপ ভগবান বিষ্ণুর সমধিক মহত্ত্ব বিদ্যমান রহিয়াছে। ঐ ব্ৰহ্মরূপী ভগবান্ অনাদি, অমধ্য ও অনন্ত বলিয়া অব্যয়নামে অভিহিত হইয়া থাকেন। দুঃখ বিনশ্বর পদার্থ সুতরাং উহা কদাচ তাঁহাকে স্পর্শ করিতে সমর্থ হয় না তিনিই পরমব্রহ্ম ও পরমপদ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকেন। মুমুক্ষু ব্যক্তিরা তাঁহাকে অবগত ও বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়া পরমপদ মুক্তিপদ লাভ করেন। নিবৃত্তিই সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট ধৰ্ম্ম। যে ব্যক্তি ঐ ধৰ্ম্ম পরিজ্ঞাত হইতে পারে, সে নিঃসন্দেহ মোক্ষলাভে সমর্থ হয়। ঋক্, যজুঃ ও সামবেদ লোকের লিঙ্গশরীর আশ্রয় করিয়া জিহ্বাগ্রে অবস্থান করে। ঐ সমুদয় যত্নসাধ্য ও বিনশ্বর; কিন্তু ব্রহ্মপদার্থ লোকের জ্ঞানদেহে আবির্ভূত হয়। উহার আদি, মধ্য বা অন্ত নাই; সুতরাং উহা যত্নসাধ্য নহে। ঋক্, সাম ও যজুৰ্ব্বেদের আদি ও অন্ত নির্দ্দিষ্ট রহিয়াছে; কিন্তু ব্রহ্মের আদি ও অন্ত নাই। সেই পরমপদার্থ অনাদিত্বপ্রযুক্ত সৰ্ব্বব্যাপী ও শূন্যময় হইয়াছেন। শূন্যময়ত্বপ্রযুক্ত তাঁহাকে দুঃখবিহীন ও মানাপমানাদিশূন্য বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়; মনুষ্যগণ অদৃষ্ট ও বিষয়লালসাপ্রভাবে ব্ৰহ্মপদার্থপ্রাপ্তির উপায় উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হয় না।

‘সিদ্ধপুরুষেরা সমাধিপ্রভাবে ব্রহ্মজ্ঞানলাভের উপযুক্ত হইয়াও যদি মনে মনে অণিমাদি যোগৈশ্বৰ্য্যলাভের প্রত্যাশা করেন, তাহা হইলে তাঁহারা নিশ্চয়ই ব্রহ্মদর্শনে বঞ্চিত হয়েন। বিষয়ার্থী ব্যক্তিদিগের বিষয়দর্শননিবন্ধন বিষয়ভোগলালসা উৎপন্ন হয়; সুতরাং তাহারা কোনরূপেই বিষয়াতীত পরমব্রহ্ম লাভ করিতে বাঞ্ছা করে না। নিকৃষ্ট বাহ্যগুণাসক্ত মূঢ় ব্যক্তিরা কি কখন যোগিগণের জ্ঞাতব্য: পরমগুণ জ্ঞাত হইতে পারে? ব্রহ্মের স্বরূপভূত উৎকৃষ্ট আন্তরিক গুণসমূহদ্বারাই পরমব্রহ্ম লাভ করা যায়। আমরা সূক্ষ্ম মনদ্বারা ব্ৰহ্মতত্ত্ব জ্ঞাত হইতে পারি; বাক্যদ্বারা কখনই উহা প্রকাশ করিতে পারি না। মনদ্বারা মনকে ও দর্শনদ্বারা দর্শনকে নিগৃহীত এবং জ্ঞানদ্বারা বুদ্ধিকে সংশয়বিহীন, বুদ্ধিদ্বারা মনকে বিশুদ্ধ ও মনদ্বারা ইন্দ্রিয়সমুদয়কে স্থির করিতে পারিলেই ব্রহ্মপদার্থ প্রাপ্ত হওয়া যায়। ধ্যানের পরিপাকনিবন্ধন যাহার বিষয়বাসনা তিরোহিত ও মন উন্নত হয়, তিনি প্রার্থনাশূন্য নির্গুণ আত্মাকে প্রাপ্ত হইতে পারেন। বায়ু যেমন কাষ্ঠান্তৰ্গত হুতাশনকে পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা পরমাত্মার দর্শন পরিত্যাগ করিয়া থাকে। ধ্যানবলে বিষয়সমুদয় আত্মাতে লীন করিতে পারিলে বুদ্ধির অতীত ব্ৰহ্মকে লাভ করা যায়। ধ্যানকালে বিষয়সমুদয় আত্মা হইতে পৃথক বলিয়া জ্ঞান হইলে বুদ্ধিকল্পিত ঐশ্বৰ্য্যপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি এইরূপ বিবেচনা করিয়া বিষয়সমুদয় আশাতে লীন করে, সে ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়। আশা অব্যক্তস্বরূপ [বাক্যদ্বারা প্রকাশের অযোগ্য] ও অব্যক্তকৰ্ম্মা [অনিয়ত কৰ্ম্মের কল্পনাপ্রবর্ত্তক নিরন্তর এটা ওটা করিয়াই থাকে]। লোকের নিধনসময়ে উহা অব্যক্তভাবেই তাহার দেহ হইতে বহির্গত হয়। আমরা কেবল ইন্দ্রিয়গণের কাৰ্য্য ও সুখদুঃখ অবগত হইয়া ঐ কাৰ্য্য ও সুখদুঃখ আশার বলিয়া বিবেচনা করি; কিন্তু বস্তুতঃ আশা কোন কর্ম্মে লিপ্ত বা দুঃখভাজন নহে। আশা মনুষ্যের দেহে অবস্থান করিয়া ইন্দ্রিয়গণের প্রভাবেই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা না থাকিলে সে আর কোন কৰ্ম্মই করিতে সমর্থ হয় না। যেমন মনুষ্য পৃথিবীর অন্ত দেখিতে পায় না, কিন্তু কোন না কোন সময়ে অবশ্যই তাহার অন্ত হয়, তদ্রূপ আপাততঃ সুখদুঃখাদির অন্ত প্রতীয়মান হয় না বটে, কিন্তু সুখদুঃখাদির অন্ত যখন জন্য [কাৰ্য্যকারণে উৎপত্তিশীল] পদার্থ, তখন অবশ্যই উহার অন্ত নির্দ্দিষ্ট আছে। বায়ু যেমন অর্ণবস্থ [সমুদ্রস্থিত] তৃণাদিকে প্রবাহদ্বারা পরপারে লইয়া যায়, তদ্রূপ কৰ্ম্ম সংসারে লিপ্ত জীবকে পরব্রহ্মে লীন করিয়া থাকে। দিবাকর যেমন কিরণজাল বিস্তারপূৰ্ব্বক ক্রমে ক্রমে উহা সঙ্কুচিত করেন, তদ্রূপ মনুষ্য বিষয়ভোগ করিয়া ক্রমে ক্রমে বিষয়বাসনা সঙ্কুচিত করে এবং পরিশেষে নিরহঙ্কার হইয়া গুণাতীত পরমব্রহ্মে লীন হয়। ফলতঃ যাহার জন্ম নাই, ধামও নাই, যিনি পুণ্যবাদিগের পরমগতি, কাৰ্য্যসমুদয় যাহাতে লীন হইয়া থাকে, মোক্ষস্বরূপ অবিনশ্বর এবং আদি, মধ্য ও অন্তবিহীন, সেই পরমব্রহ্মকে জ্ঞাত হইতে পারিলেই মোক্ষলাভ করা যাইতে পারে।”