২০৪. দ্রোণাচার্য্যের অভিমত, ভীষ্ম ও দ্রোণ মতে কর্ণের প্রতিবাদ
চতুরধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
দ্রোণাচাৰ্য্য কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রে শ্রবণ করিয়াছি, মন্ত্রনার্থ আনীত হিতৈষী পুরুষদিগের ধর্মার্থসঙ্গত ও যশস্কর কথা কীর্তন করা কর্তব্য। এ বিষয়ে মহাত্মা ভীষ্মের যে মত, আমারও সেই মত। কুন্তীপুত্রদিগকে রাজ্যভাগ প্রদান করাই বিধেয়, ইহা হইলেই সনাতন ধর্ম রক্ষা পায়। অতএব হে মহারাজ! পাণ্ডবদিগের নিমিত্ত প্রভূত রত্ন প্রদানপূর্বক কোন এক প্রিয়ম্বদ ব্যক্তিকে অবিলম্বে দ্রুপদ সন্নিধানে প্রেরণ করুন। সেই ব্যক্তি তথায় উপস্থিত হইয়া দ্রুপদকে বলুক যে, আপনার সহিত সম্বন্ধ লাভে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পরম সৌভাগ্য বোধ করিয়াছেন। আপনি ও দুৰ্য্যোধন উভয়েই এ বিষয়ে সাতিশয় প্রীত হইয়াছেন, ইহাও যেন দ্রুপদ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের নিকট বারংবার উল্লেখ করে। তৎপরে কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠিরাদি ও মাদ্ৰীভনয় নকুল সহদেবকে পুনঃপুনঃ সান্ত্বনা করিয়া স্বজনসম্বন্ধের ঔচিত্য ও প্রিয়ত্ব কীর্তন করিবে। হে রাজেন্দ্র! আপনার আদেশানুসারে ঐ পুরুষ সুবর্ণময়, শুভ্র, বহুবিধ আভরণ, দ্রৌপদী, দ্রুপদতনয় ও কুন্তীর সহচরীদিগকে সমর্পণ করুক। দ্রুপদ ও পাণ্ডবদিগকে এইরূপ সান্ত্বনাবাক্য প্রয়োগ করিয়া পরিশেষে পাণ্ডবদিগের আগমনের কথা উত্থাপন করুক। দ্রুপদ পাণ্ডবদিগকে প্রত্যাগমনের আদেশ করিলে, তাহাদিগকে আনয়ন করিবার নিমিত্ত দুঃশাসন, বিকর্ণ ও সুশোভিত সৈন্যমণ্ডলী গমন করুক। পাণ্ডবেরী আগমনপূর্বক প্রকৃতিগণ কর্তৃক মত হইয়া আপনার সহিত পৈতৃক পদে প্রতিষ্ঠিত হইবেন। হে মহারাজ! ভীষ্ম ও আমার মত এই যে, আপনি স্বাত্মজতুল্য পাণ্ডবদিগের প্রতি এইরূপ উপায় প্রয়োগ করেন।
কর্ণ কহিলেন,-মহারাজ! আপনি যাঁহাদিগকে সর্বদা অর্থ ও মানদ্বারা সৎকার করিয়া থাকেন এবং সর্বকাৰ্য্যে যাঁহাদিগের পরামর্শ গ্রহণ করেন, সেই ভীষ্ম ও দ্রোণ আপনাকে সন্ত্রণা প্রদান করিলেন না, ইহা অপেক্ষা অদ্ভুত ব্যাপার আর কি আছে? যিনিষ্ট মনঃ ও প্রচ্ছন্ন অন্তঃকরণদ্বারা অন্যকে হিতোপদেশ দেন, তিনি কিরূপে সাধুসম্মত হইতে পারেন। হিতার্থে হউক বা অহিতার্থে হউক, অর্থকৃচ্ছ উপস্থিত হইলে মিত্রলাভ হওয়া দুর্ঘট। অর্থবা ব্যক্তি কৃতজ্ঞ হউম বা অকৃতজ্ঞ হউন, বালক হউন বা বুদ্ধই হউন, সহায়সম্পন্ন হউন বা অসহায় হউন, সর্বত্র সমুদায়লাভ করিতে পারেন।
এরূপ কিম্বদন্তী আছে যে, পূর্বকালে রাজগৃহ নামক নগরে মগধরাজবংশীয় অম্বুবীচ-নামা এক রাজা ছিলেন। ইন্দ্রিয়বিকল ও শ্বাসরোগ গ্ৰন্ত সেই ভূপাল কেবল অমাত্যগণের সাহায্যে সমুদায় রাজকাৰ্য্য পৰ্যালোচনা করিতেন। মহাকর্ণি নামে তাঁহার এক মন্ত্রি ছিল। ঐ মুখ মন্ত্রী রাজ্য মধ্যে একাধিপত্য লাভ ও আপনাকে সর্বাপেক্ষা বলসম্পন্ন অনুমান করিয়া নানাপ্রকারে অবনীপালকে অবমাননা করিতে লাগিল এবং ভূপালভোগ্য অঙ্গনরত্ন ও ধনসম্পতি সমুদায় স্বয়ং সর্বতোভাবে অধিকার করিল। এই সমস্ত অধিকার করিয়াও সেই লুব্ধপ্রকৃতি মন্ত্রীর অন্যান্য বস্তুলাতে লোভবৃত্তি পরিবর্ধিত হইতে লাগিল। প্রভুর সর্বস্ব আত্মসাৎ করিয়াও তাহার উদরপূর্তি হইল না। পরিশেষে সমস্ত রাজ্যসম্পত্তি হস্তগত করিবার নিমিত্ত লোলুপ হইল। অমিরা শুনিয়াছি যে, ঐ মন্ত্রী বহুবিধ কৌশল করিয়াও তদীয় রাজ্যাধিকার করিতে পারিল না। ইহাতে বুঝা গেল যে, তাহার সেই পুরুষেলুত৷ কোন অনির্বচনীয় কারণ প্রযুক্ত হইবে, সন্দেহ নাই। অতএব হে মহারাজ! যদি ভাগ্যে থাকে, তবে সমুদায় লোক বিরোধী হইলেও আপনি অনায়াসে রাজ্য লাভ করিবেন; নতুবা একান্ত যত্ন করিলেও রাজ্য লাভ হওয়া দুর্ঘট হইয়া উঠিবে। এক্ষণে মন্ত্রিগণের সাধুতা ও অসাধুতা পৰ্যালোচনা করিয়া দুষ্টের ও সতের বাক্য বিবেচনা করুন।
দ্রোণ কহিলেন, কর্ণ! বুঝিলাম, তুমি কেবল আপনার মনোগত ভবিদোষে এই কথার উল্লেখ করিতেছ। হে দুষ্ট! তুমি পাণ্ডবদিগের নিমিত্ত রাজার নিকট আমাদিগের প্রতি দোষারোপ করিতেছ। হে কর্ণ! আমি পরম হিতকর বাক্য কহিয়াছি, তুমি সেই বাক্যকে দুষ্টবাক্য কহিতেছ, যদি ইহা অপেক্ষা কোন সুপরামর্শ প্রদান করতে পার, কর, কিন্তু আমার মতে ইহার অন্যথা করিলেই কুরুবংশ সমূলে ধ্বংস হইবে, সন্দেহ নাই।