২০৩তম অধ্যায়
আত্মদর্শনের উপায়নির্দ্দেশ
“মনু কহিলেন, ‘হে ব্রহ্ম! ইন্দ্রিয়সহকৃত জীবচৈতন্য [পরমাত্মার প্রভাবে চৈতন্যযুক্ত জীবাত্মা] পূর্ব্বানুভূত বিষয়সমুদয় কালান্তরে স্মরণ করিয়া থাকে এবং ইন্দ্রিয়সমুদয় বিলীন হইলে স্বপ্নযোগে পরম স্বভাবই বিষয়ানুভব করেন। সেই স্বভাব অনেক সময় এককালে ইহজন্ম ও পরজন্মে দৃষ্ট প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বিষয়সমুদয় সন্নিহিতের ন্যায় প্রকাশ করিয়া দেন এবং এই একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট স্বভাবই পরস্পর বিভিন্ন, অতীত, অনাগত প্রভৃতি তিন অবস্থাতে সাক্ষিরূপে সঞ্চরণ করিয়া থাকেন। আত্মা কেবল পরস্পরবিরুদ্ধ সত্ত্ব [আত্মা গুণাতীত, সুতরাং সত্ত্বাদি তাহার স্বভাববিরুদ্ধ], রজ ও তমোগুণজনিত সুখদুঃখাদি অবগত হইয়া থাকেন, তাঁহাকে উহা ভোগ করিতে হয় না। বায়ু যেমন কাষ্ঠসমুৎপন্ন হুতাশনে প্রবেশ করে, সেইরূপে আত্মা ইন্দ্রিয়সমুদয়ে প্রবিষ্ট হয়েন। পরমাত্মা চক্ষু বা শ্রোত্রের গম্য নহেন; স্পর্শেন্দ্রিয় তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না; তিনি ইন্দ্রিয়গণের ইন্দ্রিয়; শ্ৰোত্রাদিদ্বারা তাঁহার দর্শনাদিলাভের চেষ্টা নিতান্ত নিরর্থক; বেদ ও আপ্তবাক্য বিচারদ্বারা তাঁহার দর্শনলাভের চেষ্টা করাই সঙ্গত বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে।।
‘শ্ৰোত্রাদি ইন্দ্রিয় আত্মাকে নিরীক্ষণ করিতে পারে না, কিন্তু সৰ্ব্বজ্ঞ সৰ্ব্বদশী পরমাত্মা সততই উহাদিগকে প্রত্যক্ষ করিতেছেন। যেমন হিমালয়ের পার্শ্ব ও চন্দ্রের পৃষ্ঠ বিদ্যমান থাকিতেও কেহ কখন নিরীক্ষণ করে নাই, তদ্রূপ সূক্ষ্ম জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মার সত্তা বিদ্যমান থাকিলেও কেহ ইন্দ্রিয়দ্বারা প্রত্যক্ষ করিতে পারে না। লোকে যেমন চন্দ্রে সূক্ষ্ম, জগৎ অবলোকন করিয়াও তাহা সম্যক অবগত হইতে সমর্থ হয় না, সেইরূপ মনুষ্যের আত্মজ্ঞান থাকিলেও সে আত্মাকে সম্যক অবগত হইতে পারে না। আত্মজ্ঞান আপনা হইতেই হইয়া থাকে; তজ্জন্য বিষয়ান্তরের আশ্রয় গ্রহণ করিবার আবশ্যকতা নাই। পণ্ডিতেরা যেমন রূপবান্ বৃক্ষের আদ্যন্তে অরূপত্ব [বৃক্ষ উৎপত্তির পূৰ্ব্বে ও বিনাশের পরে রূপাভাব] বুঝিতে পারিয়া উহাকে অপরূপ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন এবং সূর্য্যের গতি প্রত্যক্ষের ন্যায় অবগত হইয়া থাকেন, তদ্রূপ তাঁহারা উহা নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয়েন এবং জ্ঞানস্বরূপ নিকটস্থ হইলেও উহা জ্ঞেয় পরমাত্মাতে বিলীন করিতে অভিলাষ করেন। উপায় উদ্ভাবন না করিলে কোন অর্থই সুসিদ্ধ হয় না। দেখ, ধীবরেরা সূত্রদ্বারা মৎস্য ধারণ করিয়া থাকে; মৃগদ্বারা মৃগ, পক্ষীদ্বারা পক্ষী ও গজদ্বারা গজ ধৃত করা যায়; সেইরূপ জ্ঞেয়পদার্থ জ্ঞানদ্বারাই গৃহীত হইয়া থাকে। এইরূপ কিংবদন্তী আছে যে, ভুজঙ্গ [সর্প] যেমন স্বয়ংই তাহার চরণ নিরীক্ষণ করিতে পারে, সেইরূপ জ্ঞানও দেহমধ্যে সূক্ষ্ম জ্ঞেয়বস্তু প্রত্যক্ষ করিয়া থাকে। যেমন ইন্দ্রিয়দ্বারা ইন্দ্রিয় অবগত হওয়া যায় না, সেইরূপ বুদ্ধিদ্বারা পরম বোধ্যকে জ্ঞাত হইবার সম্ভাবনা নাই।
‘চন্দ্র যেমন অমাবস্যাতে বিদ্যমান থাকিয়াও নিরীক্ষিত হয় না, তদ্রূপ আত্মা মনুষ্যের শরীরে বর্ত্তমান থাকিলেও কেহ উহাকে প্রত্যক্ষ করিতে পারে না। চন্দ্র অমাবস্যাতে যেমন স্থূলশরীরবিমুক্ত হইয়া প্রকাশিত হয়েন না, সেইরূপ আত্মা মনুষ্যের কলেবর পরিভ্রষ্ট হইয়া আর প্রকাশিত থাকে না। চন্দ্র যেমন স্থূল দেহ লাভ করিয়া পুনরায় বিরাজিত হয়েন, সেইরূপ আত্মা দেহান্তর প্রাপ্ত হইয়া পুনরায় প্রকাশিত হইয়া থাকে। চন্দ্রের জন্ম, বৃদ্ধি ও ক্ষয় প্রত্যক্ষ নিরীক্ষিত হয়; উহা চন্দ্রের স্থূলদেহেরই গুণ; ঐ সমস্ত গুণ মনুষ্যের স্থূলদেহেই আরোপিত করা যায়; আত্মাতে কদাচ আরোপিত করা যাইতে পারে না। চন্দ্র যেমন অমাবস্যার পর ক্রমে ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হইলেও তাহাকে চন্দ্র বলিয়া বোধ হয়, তদ্রূপ মনুষ্য ক্রমে ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হইলেই তাহাকে সেই মনুষ্য বলিয়া বোধ হইয়া থাকে। রাহু চন্দ্রকে কিরূপে আক্রমণ ও কিরূপে পরিত্যাগ করে, তাহা কেহই বুঝিতে পারে না, তদ্রূপ আত্মা যে কিরূপে লোকের দেহে প্রবেশ ও কিরূপে উহা পরিত্যাগ করে, তাহা কেহই অবগত হইতে সমর্থ হয় না। রাহু যেমন চন্দ্রসূৰ্য্যকে আক্রমণ করিয়া থাকিলেই নিরীক্ষিত হয়, তদ্রূপ আত্মা শরীরকে আশ্রয় করিয়া থাকিলেই অনুমিত হইয়া থাকে। রাহু যেমন চন্দ্রসূৰ্য্যকে পরিত্যাগ করিলে আর নিরীক্ষিত হয় না, সেইরূপ আত্মা দেহের আশ্রয় পরিত্যাগ করিলে আর অনুমিত হয় না। চন্দ্র যেমন অমাবস্যাতে অদৃশ্য হইলেও নক্ষত্রগণ তাহাকে পরিত্যাগ করে না, সেইরূপ আত্মা শরীরনির্ম্মুক্ত হইলেও কৰ্ম্মফল হইতে মুক্ত হইতে পারে না।”