২০২তম অধ্যায়
মোক্ষের স্বরূপ—জীব-ঈশ্বর নিরূপণ
“মনু কহিলেন, ‘হে মহর্ষে! সেই অবিনাশী পুরুষ হইতেই আকাশ, আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে জ্যোতিঃ, জ্যোতিঃ হইতে জল, জল হইতে জগৎ এবং জগৎ হইতে জগতিস্থ সমুদয় পদার্থ উৎপন্ন হইয়াছে। এই ভূমণ্ডলস্থ যাবতীয় শরীরীর পার্থিব শরীরসমুদয় চরমাবস্থায় প্রথমতঃ সলিলে, সলিল হইতে তেজে, তেজ হইতে পবনে ও পবন হইতে অন্তরীক্ষে গমন করে। তন্মধ্যে যাঁহারা অন্তরীক্ষও অতিক্রম করিয়া পরমাত্মায় লীন হইতে পারেন, তাঁহাদেরই মোক্ষলাভ হয়, সুতরাং তাঁহারা আর প্রতিনিবৃত্ত হয়েন না। পরমাত্মা উষ্ণ, শীত, মৃদু [কোমল] বা তীক্ষ্ণ নহেন। তিনি অম্ল, কষায়, মধুর ও তিক্তাদি গুণবিরহিত [প্রকৃতির অতীত] এবং শব্দ-গন্ধ বা রূপসম্পন্নও নহেন। তিনি পরাৎপর ও স্বভাবশূন্য। ত্বক স্পর্শ, জিহ্বা রস, ঘ্রাণ, গন্ধ, কর্ণ শব্দ, চক্ষু রূপ অনুভব করিয়া থাকে। অনধ্যাত্মবিৎ মনুষ্যেরা ত্বগাদি ইন্দ্রিয়দ্বারা ঐ সমস্ত গুণের অতিরিক্ত আর কিছুই অনুভব করিতে পারে না। যে ব্যক্তি রস হইতে রসনাকে, গন্ধ হইতে নাসিকাকে, শব্দ হইতে কর্ণদ্বয়কে, স্পর্শ হইতে ত্বককে ও রূপ হইতে চক্ষুকে নিবৃত্ত করিতে পারেন, তিনিই আপনার স্বভাবকে বুদ্ধি প্রভৃতি হইতে শ্রেষ্ঠ বলিয়া অবগত হইতে সমর্থ হয়েন।
‘মহর্ষিগণ কহিয়া থাকেন, যিনি কৰ্ত্তা, কৰ্ম্ম, করণ, দেশ, কাল, সুখ, দুঃখ, প্রবৃত্তি ও অনুরাগাদির কারণ, তিনিই স্বভাব। ঐ স্বভাবই ব্যাপ্যাখ্য জীব ও ব্যাপকাখ্য [ব্যষ্টি–একাংশ জীবাত্মা] ঈশ্বর। মন্ত্রদ্বারা উহা বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইতেছে। সেই স্বভাব একাকীই সমুদয় কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিতেছেন। সুতরাং তিনিই কারণ ও তদতিরিক্ত সমুদয়ই কার্য্য। পুণ্য ও পাপ যেমন পরস্পর বিরুদ্ধ হইয়াও মনুষ্যের শরীরে একত্র বাস করিয়া থাকে, সেইরূপ জ্ঞান জড় না হইয়াও জড়দেহে নিবদ্ধ রহিয়াছে। প্রদীপ যেমন প্রদীপ হইয়া অন্যের বিষয়বোধ করিয়া দেয়, সেইরূপ জ্ঞান লোকের ইন্দ্রিয়গণের বিষয়বোধ সম্পাদন করিতেছে। অমাত্যগণ যেমন বিবিধ বিষয় রাজার গোচর করিয়া দেন, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়গণ সমুদয় বিষয় জ্ঞানের গোচর করিয়া থাকে; সুতরাং রাজার ন্যায় জ্ঞানসমুদয় ইন্দ্রিয় অপেক্ষা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ। যেমন হুতাশনের শিখা, সমীরণের বেগ, দিবাকরের করজাল ও নদীর জল বারংবার গমনাগমন করিতেছে, সেইরূপ দেহীদিগের দেহ একবার নষ্ট ও পুনর্ব্বার উদ্ভূত হইতেছে। যেমন কোন ব্যক্তি পরশু দ্বারা কাষ্ঠ ছেদন করিয়া তন্মধ্যে ধূম বা বহ্নি নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না, সেইরূপ লোকে উদর ও হস্তপদাদি অবয়ব ছেদন করিয়া তন্মধ্যে, জ্ঞানময় আত্মাকে নিরীক্ষণ করিতে পারে না। কিন্তু সেই কাষ্ঠ ভেদ করিয়া উপায়বিশেষদ্বারা যেমন তাঁহাতে ধূম ও অগ্নি উভয়ই নিরীক্ষিত হয়, সেইরূপ জীবাত্মা কৌশলক্রমে বুদ্ধি ও পরমাত্মাকে এককালে দর্শন করিয়া থাকে। যেমন মনুষ্য স্বপ্নযোগে আপনার শরীরকে আত্মা হইতে পৃথগভূত ও ভূতলে নিপতিত নিরীক্ষণ এবং পরে চৈতন্যলাভ করিয়া যেমন স্বীয় দেহকে আপনা হইতে অভিন্নভাবে দর্শন করে, সেইরূপ মনোবুদ্ধিসম্পন্ন শ্রোত্র প্রভৃতি দশ ইন্দ্রিয় ও প্রাণাদি পঞ্চবায়ুযুক্ত জীবাত্মা জীবনান্তে দেহকে একবার আপনার হইতে পৃথভাবে দর্শন করিয়াও পুনরায় উহাকে অভিন্ন বিবেচনাপূৰ্ব্বক দেহান্তরে গমন করিয়া থাকে। পরমাত্মা সুখদুঃখপ্রদ কৰ্ম্মপ্রভাবে উৎপত্তি, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও মৃত প্রাপ্ত হয়েন না। তিনি অদৃশ্য দেহ পরিগ্রহ করিয়া দেহান্তরে গমন করিয়া থাকেন; তাঁহার স্পর্শও কেহ অনুভব করিতে সমর্থ নহে; তিনি চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয়দ্বারা কোন কাৰ্য্য সাধন করেন না। চক্ষুপ্রভৃতি ইন্দ্রিয় তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ নহে; কিন্তু তিনি উহাদিগকে সতত নিরীক্ষণ করিতেছেন। যেমন সমীপস্থিত অয়ঃপিণ্ডাদিতে [লৌহপিণ্ড—লোহার বল প্রভৃতিতে] প্রজ্জ্বলিত অনলের সন্তাপজনিত রূপ নিরীক্ষিত হয়, সেইরূপ জড়দেহে পরমাত্মার চৈতন্যস্বরূপ রূপই নিরীক্ষিত হইয়া থাকে।
‘মনুষ্যের আত্মা এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া অদৃশ্যভাবে অন্য শরীরে প্রবেশপূৰ্ব্বক আপনাকে সেই দেহের গুণে গুণবান জ্ঞান করে। দেহীর মৃত্যু হইলে তাহার দেহ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, সলিল ও পৃথিবীতে প্রবেশ এবং শ্রোত্র প্রভৃতি ইন্দ্রিয়সকলও স্ব স্ব উপাদানকে আশ্রয় করে। শ্রোত্র আকাশের গুণ শব্দকে, ঘ্রাণ পৃথিবীর গুণ গন্ধকে, চক্ষু তেজের গুণ রূপকে, জিহ্বা সলিলের গুণ রসকে এবং ত্বক বায়ুর গুণ স্পর্শকে আশ্রয় করে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কাৰ্য্যসম্পাদক শব্দাদি পাঁচ গুণ আকাশ প্রভৃতি পঞ্চভূতকে এবং আকাশাদি পঞ্চভূত শ্রোত্র প্রভৃতি পাঁচ ইন্দ্রিয়কে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে। আবার শব্দাদি পাঁচ গুণ, আকাশাদি পঞ্চভূত ও শ্ৰোত্রাদি পঞ্চেন্দ্রিয় মনের, মন বুদ্ধির এবং বুদ্ধি স্বভাবের অনুগত। মনুষ্য স্বকর্ম্মোপার্জিত নূতন দেহে পূৰ্ব্বজন্মকৃত পাপপুণ্য বহন করিয়া থাকে এবং জলৌকা [জোঁক—ছিনেজোঁক] যেমন অনুকূল স্রোতের অনুসরণ করে, সেইরূপ তাহার মন বুদ্ধির অনুসরণ করিয়া থাকে। লোকে নৌকায় আরোহণ করিয়া গমনকালে যেমন তীরস্থ বৃক্ষগণকে চঞ্চল বোধ করে, কিন্তু নৌকা স্থির হইলে তাহার সে ভ্রম দূরীভূত হইয়া যায়, তদ্রূপ জ্ঞানবান ব্যক্তির বুদ্ধি স্থির হইলে তিনি অনায়াসে ঈশ্বরের যাথার্থই নির্ণয় করিতে সমর্থ হয়েন। যেমন পুস্তকস্থ অক্ষর নিতান্ত সুক্ষ্ম হইলেও উহা উপনেত্র [চশমা] প্রভাবে স্থূল বলিয়া বোধ হয় এবং স্বীয় মুখ আপনার অদৃশ্য হইলেও যেমন দর্পণ প্রভাবে উহা দর্শন করা যায়, তদ্রূপ পরমাত্মা নিতান্ত সুক্ষ্ম ও অদৃশ্য হইলেও বুদ্ধিপ্রভাবে উহাকে মহান বলিয়া বোধ ও উহার দর্শনলাভ করা যাইতে পারে।’ ”