২০১. যুধিষ্ঠিরের জ্ঞানযোগজিজ্ঞাসা—মনু-বৃহম্পতিসংবাদ

২০১তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের জ্ঞানযোগজিজ্ঞাসা—মনু-বৃহম্পতিসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! জ্ঞানযোগ, সমুদয় বেদ ও নিয়মের ফল কি এবং জীবাত্মাকেই বা কিরূপে জ্ঞাত হওয়া যায়, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই উপলক্ষে প্রজাপতি মনু ও মহর্ষি বৃহস্পতির সংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্বে দেবর্ষিগণগ্রগণ্য মহাত্মা বৃহস্পতি স্বীয় গুরু প্রজাপতি মনুকে নমস্কার করিয়া এই কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ভগবন্! জগতের কারণ কি? কি নিমিত্ত কর্ম্মকাণ্ডের সৃষ্টি হইয়াছে? জ্ঞানের ফল কি? কোন্ বিষয় বেদবাক্যদ্বারাও অপ্রকাশিত রহিয়াছে? ত্রিবৰ্গশাস্ত্রবিশারদ [ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামনাত্মক শাস্ত্রে সুপণ্ডিত] বেদমন্ত্রজ্ঞ মানবগণ গোদান ও বিবিধ যজ্ঞাদির অনুষ্ঠানদ্বারা যে সুখ লাভ করেন, তাহা কি প্রকার, কিরূপে উৎপন্ন হয় ও কোন্ স্থানেই বা অবস্থান করে? কোন্ মহাত্মা হইতে পৃথিবী, যাবতীয় স্থাবরজঙ্গম, বায়ু, আকাশ, জলচর, জল, স্বর্গ ও দেবগণের উৎপত্তি হইয়াছে? লোকের যে বিষয়ে জ্ঞান জন্মে, সেই বিষয়েই প্রবৃত্তি হইয়া থাকে। আমি পুরাণ পুরুষের বিষয় কিছুমাত্র পরিজ্ঞাত নহি, সুতরাং তদ্বিষয়ে আমার কিরূপে প্রবৃত্তি জন্মিবে? আমি ঋক, সাম, যজুঃ, ছন্দঃ, নক্ষত্ৰগতি [জ্যোতিষ], নিরুক্ত [বৈদিক অভিধান] ও সকল ব্যাকরণ অধ্যয়ন করিয়াছি; কিন্তু আকাশাদি মহাভূতের [অনুলোমক্রমে ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ এবং বিলোমক্রমে আকাশ, বায়ু, তেজ, জল ও ক্ষিতির সৃষ্টিকালে আকাশ হইতে বায়ু ইত্যাদি। লয়কালে ক্ষিতি হইতে জল ইত্যাদি] কারণ কি, তাহা পরিজ্ঞাত হইতে পারি নাই। এক্ষণে আপনি পূর্ব্বোক্ত সমুদয় বিষয় এবং যেরূপে জীব এক দেহ হইতে বিনির্গত হইয়া পুনরায় অন্য দেহ আশ্রয় করে, তাহা আমার নিকট সবিস্তর কীর্ত্তন করুন।

মনুকথিত কৰ্ম্মলব্ধ সুখদুঃখবিবরণ

“মনু কহিলেন, ‘মহর্ষে! লোকের যে বিষয় প্রিয়, তাহাই তাহার সুখজনক এবং যাহা অপ্রিয়, তাহাই দুঃখজনক। লোকে ইহাদ্বারা “আমার ইষ্টলাভ হইবে, অনিষ্ট হইবে না” বিবেচনা করিয়া কৰ্ম্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে। যাহার জ্ঞান জন্মে, সেই ইষ্ট বা অনিষ্ট কোন বিষয়ই লাভের ইচ্ছা করে না।

কৰ্ম্মযোগ কামাত্মক বলিয়া বেদে নির্দ্দিষ্ট আছে। লোকে জ্ঞানপ্রভাবে উহা হইতে বিমুক্ত হইতে পারিলেই পরমপদ ব্ৰহ্মপদ লাভ করিতে পারে। যাহারা সুখার্থী হইয়া বিবিধ কর্ম্মপথে [সকাম কৰ্ম্মপথে] পরিভ্রমণ করে, তাহাদিগকেই নিরয়গামী [নরকগামী—দুঃখপ্রাপ্ত] হইতে হয়।

“বৃহস্পতি কহিলেন, ‘ভগবন্! দুঃখপরিহারপূৰ্ব্বক সুখলাভ করাই সকলের উচিত । সুখ কৰ্ম্মদ্বারাই লব্ধ হইয়া থাকে। সুতরাং কৰ্ম্মই ত’ লোকের কর্ত্তব্য বলিয়া বোধ হইতেছে।

“মনু কহিলেন, ‘মহর্ষে! লোকে প্রথমে যজ্ঞাদিকার্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক ব্রহ্মজ্ঞানেচ্ছা লাভ করিয়া পরিশেষে কৰ্ম্ম পরিত্যাগপুৰ্ব্বক পরমপদার্থ লাভ করিবে, এই নিমিত্তই কর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে। যাহারা চিরকাল কামনার বশীভূত হইয়া কৰ্ম্মানুষ্ঠান করে, তাহাদের স্বর্গাদি ফললাভ হয়; আর যাহারা মোক্ষলাভার্থে কৰ্ম্ম হইতে বিমুক্ত হইয়া আত্মজ্ঞান লাভ করিতে পারে, তাহাদের অনায়াসে ব্রহ্মপদলাভ হয়। মন ও কর্ম্ম প্রজাগণের সৃষ্টির কারণ এবং উহারাই আবার প্রজাদিগের ব্রহ্মপ্রাপ্তির পথস্বরূপ। কৰ্ম্মপ্রভাবে লোকের মোক্ষ ও সামান্য ফল উভয়ই লাভ হইয়া থাকে। ফলতঃ মনে মনে কর্ম্মের ফলত্যাগ করাই মোক্ষলাভের প্রধান হেতু। চক্ষু যেমন নিশাবসানে তিমিরনির্ম্মুক্ত হইয়া স্বীয় তেজঃপ্রভাবে কণ্টকাদি দর্শন করিতে পারে, তদ্রূপ বুদ্ধি। বিবেকগুণসম্পন্ন হইলেই অশুভ কাৰ্য্যসমুদয় প্রত্যক্ষ করিয়া থাকে। মানবগণ সর্প, কুশাগ্র ও কুপ পরিজ্ঞাত হইতে পারিলে অনায়াসে তৎসমুদয় হইতে পরিত্রাণ লাভ করে, কিন্তু ঐ সকল পরিজ্ঞাত হইতে না পারিলে অজ্ঞানবশতঃ ঐ সমুদয়ে নিপতিত হয়। অতএব অজ্ঞান অপেক্ষা জ্ঞানের ফল যে কত উৎকৃষ্ট, তাহা বিবেচনা কর।

বিধিপূৰ্ব্বক মন্ত্রোচ্চারণ, যথোক্ত যজ্ঞানুষ্ঠান, দক্ষিণাদান, অন্নপ্রদান ও মনের সমাধি এই পঞ্চবিধ কর্ম্ম ফলপ্রদ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। শাস্ত্রানুসারে কাৰ্য্য সত্ত্বাদি ত্রিবিধ গুণাত্মক। এই নিমিত্ত কাৰ্য্যমূলমন্ত্রও তিন প্রকার এবং বিধিও তিন প্রকার নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। যে ব্যক্তি যেরূপ গুণানুযায়ী কর্ম্ম করে, তাহাকে তদনুরূপ ফলভোগ করিতে হয়। উৎকৃষ্ট শব্দ, রূপ, রস, স্পর্শ ও গন্ধজ্ঞানরূপ কৰ্ম্মফলসমুদয় কর্ম্মলভ্য স্বর্গলোকেই অনুভূত হইয়া থাকে; কিন্তু জ্ঞানফল জীবদ্দশাতে লাভ করা যায়। দেহিগণ শরীরদ্বারা যে কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাদিগকে পুনৰ্ব্বার দেহ ধারণ করিয়া সেই কার্য্যের ফলভোগ করিতে হয়। শরীরই লোকের সুখদুঃখের আশ্রয়। বাক্য ও মনদ্বারা কার্য্যানুষ্ঠান করিলে কখনই বাক্যমনের অগোচর পদার্থলাভের সম্ভাবনা নাই। যে ব্যক্তি যে গুণাবলম্বী হইয়া কৰ্ম্মানুষ্ঠান করে, তাহাকে তদনুরূপ শুভ বা অশুভ ফল ভোগ করিতে হয়। মৎস্য যেমন স্রোতাভিমুখে ধাবমান হয়, তদ্রূপ জন্মান্তরীণ কর্ম্মসমুদয় মনুষ্যের নিকট আগমন করিয়া থাকে। সকল লোককেই পূৰ্ব্বজন্মর্জ্জিত সুকৃতানুরূপ সুখ ও দুষ্কৃতানুরূপ দুঃখ ভোগ করিতে হয়। এক্ষণে যিনি সমুদয় জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা এবং মন্ত্র ও শব্দদ্বারা অপ্রকাশিত [মন্ত্র ও শব্দের অগোচর], তাঁহার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সেই পরাৎপর বিবিধ রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ ও রূপ হইতে পৃথগভূত হইয়াও প্ৰজাগণের নিমিত্ত ঐ সমুদয়ের সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি অব্যক্ত [বাক্যের অগোচর], বর্ণহীন ও গুণাতীত। তাঁহাকে স্ত্রী, পুরুষ বা নপুংসক অথবা পরমাণু, শূন্য বা মায়াময় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে না। কোন কালেই তাঁহার ধ্বংস নাই।। জিতচিত্ত জ্ঞানবান্ মহাত্মারাই সেই অক্ষয় পদার্থ লাভ করিতে পারেন।’ ”