২০১. নারায়ণাস্ত্র ভীমরক্ষার্থে বিষ্ণুমায়াবিস্তার

২০১তম অধ্যায়

নারায়ণাস্ত্র ভীমরক্ষার্থে বিষ্ণুমায়াবিস্তার

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। ঐ সময় অর্জ্জুন ভীমসেনকে নারায়ণাস্ত্রে সমাচ্ছন্ন দেখিয়া অস্ত্রের তেজ ধ্বংস করিবার মানসে বৃকোদরকে বারুণাস্ত্রে পরিবৃত করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুনের লঘুহস্ততাপ্রভাবে মুহূৰ্তমধ্যে নারায়ণাস্ত্র বারুণাস্ত্রে পরিবৃত হইলে উহা কাহারও নেত্রগোচর হইল না। ক্ষণৈক পরে ভীমসেন পুনরায় দ্রোণপুত্রের অস্ত্রপ্রভাবে অশ্ব, সারথি ও রথে সমাচ্ছন্ন হইয়া পাবকমধ্যস্থিত জ্বালাব্যাপ্ত দুর্লক্ষ্য অনলের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। হে মহারাজ! নিশাবসানে জ্যোতিঃপদার্থসকল যেমন অস্তগিরিতে গমন করে, তদ্রূপ অসংখ্য শরজাল ভীমসেনরথে নিপতিত হইতে লাগিল। এইরূপে বৃকোদর অশ্বত্থামার অস্ত্রে সারথি, রথ ও অশ্বগণের সহিত সমাচ্ছন্ন হইয়া প্রদীপ্ত অনলে পরিবেষ্টিত হইলেন। প্রলয়কালীন হুতাশন যেমন এই চরাচর জগৎ ধ্বংস করিয়া বিশ্বস্রষ্টার মুখমণ্ডলে প্রবেশ করে, তদ্রূপ অশ্বত্থামার ভীষণাস্ত্র ভীমশরীরে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিলে, উহা কি সূৰ্য্যপ্রবিষ্ট অনলের ন্যায় বা অনলে প্রবিষ্ট সুৰ্য্যের ন্যায়, কাহারও তাহা বোধগম্য হইল না।

“তখন মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব সেই ভীষণ অস্ত্রে ভীমের রথ সমাকীর্ণ, দ্রোণপুত্রকে প্রতিদ্বন্দ্বীবিবর্জিত, পাণ্ডবপক্ষীয় সেনাগণকে নিক্ষিপ্তাস্ত্র ও যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ মহারথগণকে সমরবিমুখ অবলোকন করিয়া রথ হইতে অবরোহণ ও ভীমসমীপে গমনপূর্ব্বক মায়াবলে সেই অস্ত্রবলসম্ভূত তেজোরাশিমধ্যে অবগাহন করিলেন। নারায়ণাস্ত্রসম্ভূত হুতাশন সেই বীরদ্বয়ের অস্ত্রপরিত্যাগ, বীৰ্য্যবেত্তা ও বারুণাস্ত্রের প্রভাবনিবন্ধন তাঁহাদিগকে দগ্ধ করিতে সমর্থ হইল না। তখন সেই নর ও নারায়ণ নারায়ণাস্ত্রের শাস্তির নিমিত্ত বলপূর্ব্বক ভীমসেনকে ও তাঁহার অস্ত্রশস্ত্রসকল আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহারথ বৃকোদর সেই বীরদ্বয়কর্ত্তৃক আকৃষ্যমাণ হইয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন; দ্রোণনন্দনের সুদুর্জ্জয় অস্ত্রও পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। তখন বাসুদেব ভীমসেনকে কহিলেন, ‘হে পাণ্ডুনন্দন! তুমি নিবারিত হইয়াও কি নিমিত্ত যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইতেছ না? যদি এক্ষণে যুদ্ধদ্বারা কৌরবগণকে পরাজিত করিবার সম্ভাবনা থাকিত, তাহা হইলে আমরা অবশ্যই যুদ্ধ করিতাম এবং এই মহারথগণও সমরে পরাঙ্মুখ হইতেন না। ঐ দেখ, তোমার পক্ষীয় সমুদয় বীরগণই রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছেন; অতএব তুমিও অবিলম্বে রথ হইতে অবতরণ কর।’ বাসুদেব ইহা কহিয়া বৃকোদরকে রথ হইতে ভূতলে আনয়ন করিলে, ভীমসেন সর্পের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগ করিয়া রোষে লোহিতনেত্র হইয়া আয়ুধ পরিত্যাগ করিলেন; নারায়ণাস্ত্রও প্রশান্ত হইল।

পাণ্ডবাস্ত্ৰত্যাগে নারায়ণাস্ত্রবিফলতা

“হে মহারাজ! এইরূপে বিধিনির্ব্বন্ধের অনুল্লঙ্ঘনীয়তানিবন্ধন সেই ভীষণ নারায়ণাস্ত্রের সুদুঃসহ তেজ প্রশান্ত হইলে সমুদয় দিগবিদিক্‌ নির্ম্মল হইল; বায়ু অনুকূল হইয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল; কুরঙ্গ ও বিহঙ্গগণ শান্তভাব অবলম্বন করিল; যোধ ও বাহনগণ আনন্দিত হইলেন এবং ভীমসেন প্রাতঃকালীন সূর্যের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন হতাবশিষ্ট পাণ্ডবসেনাগণ সেই নারায়ণাস্ত্রের সংহার অবলোকন করিয়া দুর্য্যোধনের বিনাশার্থ সমরে প্রবৃত্ত হইল। রাজা দুৰ্য্যোধন তদ্দর্শনে দ্রোণপুত্রকে কহিলেন, ‘হে অশ্বত্থাম! পাঞ্চালগণ বিজয়বাসনায় পুনরায় সংগ্রামে উপস্থিত হইয়াছে। অতএব তুমিও পুনর্ব্বার সেই অস্ত্র পরিত্যাগ কর।’ দ্রোণনন্দন দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মহারাজ! সেই অস্ত্র আর প্রত্যাবর্ত্তিত করা সাধ্যায়ত্ত নহে। উহা প্রত্যাবর্ত্তিত হইলে প্রযোক্তার প্রাণসংহার করে। বাসুদেব কৌশলক্রমে সেই অস্ত্রের প্রতিঘাত করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত শত্ৰুসংহার হইল না। যাহা হউক, পরাজয় ও মৃত্যু উভয়ই সমান। বরং পরাজয় অপেক্ষা প্রাণত্যাগই শ্রেয়স্কর। ঐ দেখ, শত্রুগণ শস্ত্রপ্রভাবে পরাজিত হইয়া মৃতকল্প হইয়াছে।’ তখন দুৰ্য্যোধন কহিলেন, ‘হে আচাৰ্য্যকুমার! যদি এক্ষণে পুনরায় সেই অস্ত্রপ্রয়োগের সম্ভাবনা না থাকে, তবে অন্য অস্ত্রদ্বারা গুরুহান্তা পাণ্ডবগণকে নিপাতিত কর। দিব্যাস্ত্রসকল তোমাতে ও অমিততেজাঃ মহাদেবে বিদ্যমান রহিয়াছে। তুমি ইচ্ছা করিলে ক্রুদ্ধ পুরন্দরকেও পরাভূত করিতে পার।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! দ্রোণাচাৰ্য্য নিহত ও নারায়ণাস্ত্র প্রতিহত হইলে অশ্বত্থামা দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া যুদ্ধার্থ সমাগত পাণ্ডবগণকে অবলোকনপূর্ব্বক পুনর্ব্বার কি কাৰ্য্য করিলেন?”

যুদ্ধে অশ্বত্থামার পুনঃ অভ্যুত্থান—পাণ্ডবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সিংহলাঙ্গুলকেতন মহাবীর অশ্বত্থামা পিতৃবিনাশে ক্রোধান্বিত হইয়া ভয়পরিত্যাগপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং মহাবেগে পঞ্চবিংশতি ক্ষুদ্রকবাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রজ্বলিত পাবকসদৃশ চতুঃষষ্টিশরে দ্রোণপুত্রকে, সুবর্ণপুঙ্খ সুশাণিত পঞ্চবিংশতিশরে তাঁহার সারথিকে ও চারিবাণে তাহার চারি অশ্বকে বিদ্ধ করিয়া, সিংহনাদে মেদিনী কম্পিত করিয়া, তাঁহাকে বারংবার বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তৎপরে অস্ত্রবিশারদ মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া অশ্বত্থামার প্রতি গমনপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহার মস্তকোপরি শরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা পিতৃবধস্মরণে ক্রোধান্বিত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া দশবাণে বিদ্ধ করিলেন এবং দুই ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার শর ও শরাসন ছেদনপুর্ব্বক তাঁহাকে শরনিকরে পীড়িত করিয়া তাঁহার সারথি, রথ ও অসমুদয় বিনষ্ট করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের অনুচরগণও অশ্বত্থামার শরজালে সমাচ্ছন্ন হইল। তখন পাঞ্চালসৈন্যগণ নিশিতশরপ্রহারে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ ও নিতান্ত কাতর হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল।

“হে মহারাজ! ঐ সময়ে মহাবীর সাত্যকি যোধগণকে পরাঙ্মুখ ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিতান্ত নিপীড়িত নিরীক্ষণ করিয়া তৎক্ষণাৎ অশ্বত্থামার অভিমুখে স্বীয় রথ সঞ্চালন করিলেন এবং অবিলম্বে তথায় সমুপস্থিত হইয়া প্রথমতঃ আট ও তৎপরে বিংশতিবাণে অশ্বত্থামা ও তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার চারি অশ্বের উপর চারি বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক সত্বর তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া ধনু ও ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। পরে দ্রোণপুত্রের সুবর্ণমণ্ডিত ও অশ্বযুক্ত রথ চূর্ণিত করিয়া তাহার বক্ষঃস্থলে ত্রিংশৎ শর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত অশ্বত্থামা এইরূপে শরজালে সংবৃত ও নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন।

“হে মহারাজ! তখন মহারথ দুৰ্য্যোধন আচাৰ্য্যপুত্রকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া কৃপ ও কর্ণপ্রমুখ বীরগণের সহিত সাত্যকির উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দুৰ্য্যোধন বিংশতি, কৃপাচার্য্য তিন, কর্ণ পঞ্চাশৎ, দুঃশাসন একশত ও বৃষসেন সাতশরে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর সাত্যকি এইরূপে সেই মহারথগণকর্ত্তৃক বিদ্ধ হইয়া ক্রোধভরে ক্ষণকালমধ্যে তাঁহাদিগকে রথবিহীন ও সমরপরাঙ্মুখ করিলেন। ঐ সময়ে অশ্বত্থামা সংজ্ঞালাভ করিয়া বারংবার নিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক দুঃখিতমনে চিন্তা করিতে লাগিলেন এবং তৎপরে অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক শত শত শরবর্ষণ করিয়া সাত্যকির নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন। মহারথ সাত্যকি অশ্বত্থামাকে সমাগত সন্দর্শন করিয়া পুনরায় তাঁহাকে রথবিহীন ও সমরপরাঙ্মুখ করিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবগণ সাত্যকির পরাক্রমদর্শনে প্রীত হইয়া শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। সত্যবিক্রম সাত্যকি এইরূপে ভারদ্বাজতনয়কে রথবিহীন করিয়া বৃষসেনের অনুগামী ত্রিসহস্র মহারথ, কৃপাচায্যের সার্দ্ধ-অযুত হস্তী ও শকুনির পাঁচ অযুত অশ্ব বিনাশ করিয়া ফেলিলেন।

“অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক রোষাবিষ্টচিত্তে সাত্যকির বিনাশবাসনায় ধাবমান হইলেন। অরাতিপাতন সাত্যকি পুনরায় দ্রোণপুত্রকে সমাগত সন্দর্শন করিয়া উপর্য্যুপরি নিশিতশরনিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ করিতে লাগিলেন। মহাধনুর্দ্ধর অশ্বত্থামা এইরূপে অতিমাত্র বিদ্ধ ও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সহাস্যবদনে কহিতে লাগিলেন, ‘হে সাত্যকে! আচাৰ্য্যঘাতী দুষ্ট ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি যে তোমার পক্ষপাত আছে, তাহা আমার অবিদিত নাই; কিন্তু তুমি কখনই আমার হস্ত হইতে উহাকে পরিত্রাণ করিতে বা স্বয়ং পরিত্রাণ প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হইবে না। আমি সত্য ও তপস্যাদ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি যে, সমস্ত পাঞ্চালগণকে বিনাশ না করিয়া কখনই শান্তিলাভ করিব না। তুমি পাণ্ডবসৈন্য, বৃষ্ণিসৈন্য ও সোমকদিগকে একত্র করিলেও আমি তাহাদের সকলকে বিনষ্ট করিব।’

অশ্বত্থামার শরে সুদর্শনাদিসংহার

“হে মহারাজ! মহাবীর অশ্বত্থামা এইরূপ কহিয়া পুরন্দর যেমন বৃত্রাসুরের প্রতি বজ্র নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সাত্যকির প্রতি এক সূৰ্য্যরশ্মিসদৃশ সুপর্ব্ব উৎকৃষ্ট শর নিক্ষেপ করিলেন। অশ্বত্থামার শরাসননিক্ষিপ্ত সায়ক সাত্যকির বর্ম্মসংবৃত দেহ ভেদ করিয়া ভুজঙ্গ যেমন নিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক বিলমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। মহারাজ! মহাবীর সাত্যকি সেই বাণের আঘাতেই অঙ্কুশাহত মাতঙ্গের ন্যায় অতিমাত্র কাতর ও রুধিরাক্ত কলেবর হইয়া সশর শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক রথোপরি অবসন্ন হইলেন। তখন সারথি সত্বর তাঁহাকে লইয়া অশ্বত্থামার নিকট হইতে পলায়ন করিল। তখন ভারদ্বাজতনয় ধৃষ্টদ্যুম্নের ক্রুদ্বয়ের মধ্যস্থলে এক আনতপর্ব্ব সুপুঙ্খ শরনিক্ষেপ করিলেন। পাঞ্চালতনয় পূর্ব্বেই অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়াছিলেন, এক্ষণে পুনরায় শরপীড়িত হইয়া ধ্বজযষ্ঠি অবলম্বনপূর্ব্বক রথোপরি অবসন্ন হইলেন। এইরূপে ধৃষ্টদ্যুম্ন সিংহার্দ্দিত কুঞ্জরের ন্যায় অশ্বত্থামার শরনিকরে নিপীড়িত হইলে পাণ্ডবপক্ষ হইতে মহাবীর অর্জ্জুন, ভীমসেন, পুরুবংশোদ্ভব বৃহৎক্ষত্র, চেদিদেশীয় যুবরাজ ও অবন্তীনাথ সুদর্শন—এই পাঁচমহারথ শরাসনগ্রহণপূর্ব্বক হাহাকার করিতে করিতে দ্রুতবেগে অশ্বত্থামার অভিমুখে গমনপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। পরে তাঁহারা সকলেই বিংশতি পদ গমনপূর্ব্বক যত্নসহকারে ক্রোধাবিষ্ট গুরুপুত্রের উপর যুগপৎ পাঁচ পাঁচ শর নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা আশীবিষসদৃশ পঞ্চবিংশতি শরদ্বারা একেবারে তাঁহাদিগের পঞ্চবিংশতি বাণ ছেদন করিয়া ফেলিলেন; পরে বৃহৎক্ষত্রকে সাত, অবন্তীনাথকে তিন, অর্জ্জুনকে এক ও বৃকোদরকে ছয়শরে নিপীড়িত করিলেন। মহারথগণ অশ্বত্থামার শরে বিদ্ধ হইয়া কখন সকলে যুগপৎ, কখন পৃথক পৃথক সুবর্ণপুঙ্খ শাণিতশরনিকরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। পরে যুবরাজ বিংশতি, অর্জ্জুন আট ও অন্য তিনজনে তিন তিন শরে অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা অর্জ্জুনকে ছয়, বাসুদেবকে দশ, ভীমসেনকে পাঁচ, যুবরাজকে চারি এবং মালব ও পৌরবকে দুই দুই বাণে আহত করিয়া ভীমসেনের সারথির উপর ছয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন এবং দুইবাণে তাঁহার কাৰ্ম্মক ও ধ্বজ ছেদনপূর্ব্বক পুনৰ্ব্বার পার্থের প্রতি শরজাল বর্ষণ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। ইন্দ্ৰতুল্যপরাক্রম উগ্রতেজাঃ দ্রোণতনয়ের অগ্র ও পশ্চাদভাগে নিক্ষিপ্ত সুনিশিত শরজালে ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইল। তখন তিনি সুনিশিত তিনশরে সন্নিহিত রথারূঢ় সুদর্শনের ইন্দ্রকেতুসদৃশ ভুজদ্বয় ও মস্তক যুগপৎ ছেদনপূর্ব্বক রথশক্তিদ্বারা পৌরবকে আহত এবং শরনিকরে তাঁহার হরিচন্দনচর্চিত বাহুদ্বয় ও রথ খণ্ড খণ্ড করিয়া ভল্লদ্বারা মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় নীলোৎপলসমদ্যুতি চেদিদেশীয় যুবরাজ সারথি এবং অশ্বগণের সহিত অশ্বত্থামার প্রজ্বলিত অনলতুল্য শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন।

ভীম-অশ্বত্থামার যুদ্ধ—পাণ্ডবপরাজয়

“তখন মহাবাহু ভীমসেন মালব, পৌরব ও চেদিদেশীয় যুবরাজকে দ্রোণপুত্রের শরে নিহত দেখিয়া সরোষনয়নে ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গসদৃশ সুনিশিত শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক অশ্বত্থামাকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। মহাতেজাঃ দ্রোণতনয় সেই ভীমনিক্ষিপ্ত শরজাল নিবারণপূর্ব্বক তাঁহাকে নিশিতশরনিকরে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর ক্ষুরপ্ৰদ্বারা অশ্বত্থামার শাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে শরবিক্ষত করিতে লাগিলেন। মহামনাঃ দ্রোণনন্দন তৎক্ষণাৎ সেই ছিন্নচাপ পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া ভীমসেনকে শরজালে নিপীড়িত করিলেন। এইরূপে মহাবলপরাক্রান্ত অশ্বত্থামা ও ভীমসেন জলধারাবর্ষী জলধরদ্বয়ের ন্যায় শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। যেরূপ দিনকর মেঘজালে আবৃত হইয়া থাকেন, তদ্রূপ দ্রোণকুমার ভীমনামাঙ্কিত সুবর্ণপুঙ্খ সুনিশিতশরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইলেন, ভীমসেনও দ্রোণপুত্ৰত্যক্ত নতপর্ব্বশরজালে আহত হইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় বৃকোদর দ্রোণপুত্রের অসংখ্যশরে আহত হইয়াও কিছুমাত্র ব্যথিত হইলেন না দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইল। অনন্তর মহাবীর পাণ্ডুতনয় সুবর্ণবিভূষিত যমদণ্ডসদৃশ নিশিত দশ নারাচ পরিত্যাগ করিলেন। ভুজঙ্গমগণ যেমন বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই নারাচসকল দ্রোণপুত্রের জত্রুদেশ ভেদ করিয়া দেহমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। অশ্বত্থামা এইরূপে মহাত্মা ভীমসেনকর্ত্তৃক বিদ্ধ হইয়া ধ্বজযষ্ঠি অবলম্বনপূর্ব্বক নয়নদ্বয় নিমীলিত করিলেন এবং মুহূৰ্ত্তমধ্যে পুনরায় সংজ্ঞালাভ করিয়া সরোষনয়নে ও শোণিতাক্তকলেবরে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইয়া আকর্ণপূর্ণ আশীবিষসদৃশ শত বাণ পরিত্যাগ করিলেন; সমরশ্লাঘী ভীমসেনও তাঁহার বলবীৰ্য্য স্মরণ করিয়া ভীষণ শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন অশ্বত্থামা নিশিতশরজালে ভীমসেনের কামুক ছেদন ও কলেবর ক্ষতবিক্ষত করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর বৃকোদর তৎক্ষণাৎ অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শাণিতপাঁচবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে সেই রোষতাম্ৰাক্ষ বীরদ্বয় বর্ষাকালীন বারিবর্ষী মেঘদ্বয়ের ন্যায় শরজালবর্ষণপূর্ব্বক পরস্পরকে সমাচ্ছন্ন ও ভীষণ তলশব্দে মেদিনীমণ্ডল কম্পিত করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন শরকালীন মধ্যাহ্নগত দিনকরসদৃশ প্রতাপশালী দ্রোণনন্দন সুবর্ণভূষিত শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক শরবর্ষী ভীমসেনের প্রতি সরোষ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় তিনি যে কখন শরনিকর গ্রহণ, কখন সন্ধান, কখন আকর্ষণ ও কখনই বা বিসৰ্জন করিতে লাগিলেন, তাহা কিছুমাত্র দৃষ্টিগোচর হইল না। তাঁহার চাপমণ্ডল অলাতচক্রের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল এবং শরাসনচ্যুত সহস্র সহস্র শর আকাশমার্গে শলভশ্রেণীর ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তখন ভীমসেনের রথ দ্রোণপুত্রের সেই সুবর্ণালঙ্কৃত. শরজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। হে মহারাজ! ঐ সময় আমরা ভীমপরাক্রম ভীমসেনের অদ্ভুত বলবীৰ্য্য ও কাৰ্য্য অৱলোকন করিলাম। তিনি অশ্বত্থামার সেই শরবৃষ্টি জলধারার ন্যায় জ্ঞান করিয়া তাঁহার বিনাশার্থ সুতীক্ষ্ণ শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার সুবর্ণপৃষ্ঠ ভীষণ শরাসন সমাকৃষ্ট হইয়া, দ্বিতীয় ইন্দ্রচাপের ন্যায় শোভমান হইল এবং ঐ চাপ হইতে সহস্র সহস্র শর, বিনির্গত হইয়া রণবিশারদ দ্রোণপুত্রকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিল।

“হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীরদ্বয় মহাবেগে শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে বোধ হইতে লাগিল যেন, সমীরণও সেই শরবৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করিতে সমর্থ নহে। তৎপরে দ্রোণনন্দন ভীমসেনের বিনাশকামনায় কাঞ্চনমণ্ডিত তৈলধৌত শরনিকর পরিত্যাগ করিলেন। বলবান্ ভীমসেন বিশিখদ্বারা অন্তরীক্ষে তাঁহার প্রত্যেক শর ত্রিধা ছেদনপূর্ব্বক দ্রোণপুত্রকে ‘থাক থাক্‌’ বলিয়া তাঁহার বিনাশার্থ পুনরায় ভীষণ শরসমূহ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাস্ত্রবেত্তা অশ্বত্থামা অস্ত্রদ্বারা সেই ভীমনির্মুক্ত শরবৃষ্টি নিবারণপূর্ব্বক ভীমসেনের শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহাকে অসংখ্যশরে নিপীড়িত করিলেন। তখন বলবান্ বৃকোদর চাপবিহীন হইয়া ক্রোধভরে অশ্বত্থামার রথের প্রতি সুদারুণ রথশক্তি নিক্ষেপ করিলেন; দ্রোণকুমারও পাণিলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক নিশিতশরনিকরে মহোল্কাসদৃশ, সহসা সমাগত রথশক্তি ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ইত্যবসরে মহাবীর ভীমসেন সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক হাসিতে হাসিতে বিশিখজালে অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন দ্রোণতনয় আনতপর্ব্বশরদ্বারা ভীমসেনের সারথির ললাট বিদারণ করিলেন। সারথি অশ্বত্থামার শরে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া অশ্মরশ্মি পরিত্যাগপূর্ব্বক বিমোহিত হইল। সারথি মোহিত হইলে অশ্বগণ ধনুর্দ্ধরগণের সমক্ষে পলায়ন করিতে লাগিল। তখন অপরাজিত অশ্বত্থামা ভীমসেনকে পলায়মান ও অশ্বগণকর্ত্তৃক সমর হইতে অপনীত অবলোকন করিয়া আহ্লাদিতচিত্তে বিপুল শঙ্খ বাদিত করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ভীমসেন পলায়নপরায়ণ হইলে পাঞ্চালগণও ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক শঙ্কিতচিত্তে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল। তখন দ্রোণতনয় সেই পলায়মান পাণ্ডবসেনাগণকে শরনিকরে নিপীড়িত করিয়া মহাবেগে তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ অশ্বত্থামার শরনিকরে ব্যথিত হইয়া ভীতমনে দশদিকে পলায়ন করিতে লাগিলেন।”