২০০. বিদুরাগমন পর্বাধ্যায়, দ্রৌপদীর অপ্রাপ্তে কৌরববিষাদ, ধৃতরাষ্ট্রের কপট আনন্দ
দ্বিশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এদিকে কৌরবকুলের বিশ্বাসভূমি গূঢ়চরেরা আসিয়া রাজাদিগকে সমাচার প্রদান করিল, যে, পাণ্ডকে দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। যে মহাত্মা সেই শাসন আকর্ষণপূর্বক লক্ষ্যবিদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহার নাম অর্জুন। তিনি সমস্ত বিজয়ীর শ্রেষ্ঠ। আর যিনি সমরসাগরে অবতীর্ণ হইয়া মদ্রাধিপতি শল্যকে উৎক্ষিপ্ত ও ভূতলে পাতিত করেন এবং পাপাঘাতে অরাতি সকলকে সন্ত্রাসিত করিয়াছিলেন, সংগ্রামে যাঁহার ভয়সমের লেশমাও দেখিতে পাওয়া যায় নাই, তাঁহার স্পর্শ শক্রসেনারা অনলস্পর্শসম ভীষণ বলিয়া বোধ করিয়াছিল, সেই মহাত্মার নাম ভীম। সেই প্রশান্তভাব ব্ৰাহ্মণরূপী, পুরুষদিগকে পাণ্ডব জানিয়া রাজগণ সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। পূর্বে সকলেই শ্রবণ করিয়াছিলেন যে, কুন্তী পুত্রগণসমভিব্যাহারে জতুগৃহে দহনদগ্ধ হইয়াছে, এক্ষণে তাঁহারা জীবিত আছেন শুনিয়া, জন্মান্তর লাভ করিয়াছেন বলিয়া মনে করিতে লাগিলেন। পুরোচনকৃত নৃশংস ব্যবহার রাজাদিগের স্মৃতিপথে উদিত হওয়াতে তাঁহারা ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মকে ধিক্কার প্রদান করিতে লাগিলেন। স্বয়ম্বর সম্পন্ন হইলে সকল রাজগণ পাণ্ডবদিগকে চিনিতে পারিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।
অর্জুন লক্ষ্য বিদ্ধ করিলেন দেখিয়া, রাজা দুৰ্য্যোধন সাতিশয় বিষণ্ণ মনে ভ্রাতৃগণ অশ্বত্থামা, শকুনি, কৃপাচাৰ্য্য ও কর্ণ সমভিব্যাহারে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। দুঃশাসন লজ্জিত হইয়া ধীরে ধীরে তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, রাজ। তিনি ব্রাহ্মণরূপী না হইলে দ্রৌপদীকে লাভ করিতে পারিতেন না। তাহাকে ধনঞ্জয় বলিয়া কেহই যথার্থ চিনিতে পারেন নাই। দৈব ও পুরুষকারের মধ্যে দৈবই শ্রেষ্ঠ, পুরুষকার নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। দেখুন, আমরা পুরুষকার অবলম্বনপূর্বক পাণ্ডবগণের কতপ্রকার অনিষ্টচেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তাহারা অদ্যাপি জীবিত রহিয়াছে; অতএব পুরুষকারকে ধিক্কার প্রদান করি। তাঁহারা দুঃখিত ও বিগতচেতাঃ হইয়া এইরূপ কথোপকথন ও পুরোচনকে নিন্দা করিয়া হস্তিনাপুরে প্রবেশ করিলেন। দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি সকল মহাতেজাঃ পাণ্ডবদিগকে অগ্নি হইতে বিনিমুক্ত ও দ্রুপদের সহিত সংযুক্ত দেখিয়া এবং শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও অন্যান্য দ্রুপদপুত্রদিগকে যুদ্ধবিশারদ চিন্তা করিয়া সাতিশয় ভীত হইলেন এবং তাঁহাদিগের সংকল্প সকল শিথিল হইয়া পড়িল।
অনন্তর যখন বিদুর শ্রবণ করিলেন যে, পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীর পাণিপীড়ন করিয়াছেন এবং ধৃতরাষ্ট্রতনয়ের। লজ্জিত ও ভগ্নদর্প হইয়া প্রত্যাগত হইয়াছেন, তখন তাহার প্রীতির আর পরিসীমা রহিল না। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! ভাগ্যবলে কৌরবের বিজয়লাভ করিয়াছেন। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া আহ্লাদপূর্বক কহিলেন, কি কৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য! বিহুর! কি শুভ সমাচারই প্রদান করিলে! তৎকালে সেই প্রজ্ঞাঃ রাজা বিশেষ বুঝিতে না পারিয়া মনে করিয়াছিলেন যে, দ্রৌপদী তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র দুৰ্য্যোধনকেই বরমাল্য প্রদান করিয়াছেন; এই নিমিত্ত তিনি আজ্ঞা প্রদান করিলেন, যেন দুর্য্যোধন দ্রৌপদীকে বহুবিধ ভূষণে ভূষিত করিয়া তাহার সমীপে আনয়ন করেন। বিদুর তাহার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবেরা বরমাল্য প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাঁহারা সকলেই কুশলে আছেন, দ্রুপদরাজ তাহাদিগের যথেষ্ট সমাদর ও সম্মান করিয়াছেন। সেই স্বয়ম্বরপ্রদেশে তুল্যবলশালী অনেকানেক বন্ধুবান্ধব আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন।
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, ভালই হইয়াছে। তাহারা পাণ্ডুর পুত্র বটে, কিন্তু আমি তাহাদিগকে স্বীয় সন্তান অপেক্ষাও অধিক মনে করি, তাহাদিগের প্রতি আমার সমধিক স্নেহ আছে। যখন সেই মহাবীর পাণ্ডবেরা ক্ষেমবান্, মিত্রবান্ এবং মহাবলপরাক্রান্ত বান্ধবগণের সহিত মিলিত হইয়াছেন, তখন বিলক্ষণ প্রতীতি হইতেছে যে, আমার দুরাত্মা পুত্রদিগের আর নিস্তার নাই। সবান্ধব দ্রুপদের সহিত মিত্ৰতা করিয়া, কোন ক্ষত্রিয় কৃতকাৰ্য্য হইতে বাসনা না করে? বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে পুনর্বার কহিলেন, মহারাজ! চিরকাল যেন আপনার এইরূপ বুদ্ধি থাকে।
অনন্তর দুৰ্য্যোধন এবং কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আগমনপূর্বক নিবেদন করিলেন, তাত! বিদুরের সন্নিধানে আমরা কোনপ্রকার দোষ কীর্তন করিতে পারিব না; অতএব আমাদিগের অভিলাষ যে, বিজনপ্রদেশে আপনাকে নিবেদন করি, এ আপনার কীদৃশ ইচ্ছা, বিপক্ষের বৃদ্ধিকে আপন বৃদ্ধি বলিয়া মনে করিতেছেন? বিদুরের নিকট সপত্নদিগের স্তুতিবাদ করিতেছেন এবং কর্তব্য কর্মে মনোযোগ করিতেছেন না। হে তাত! শত্ৰুদিগের বল বিঘাত করা সৰ্বতোভাবে কর্তব্য হইয়াছে। এক্ষণে আপনার উত্তম সময় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব এমন একটি মন্ত্রণা করা আবশ্যক যে, তাহার যেন আমাদিগের পুত্রগণ ও বন্ধুবান্ধবদিগকে গ্রাস করিতে না পারে।