।। আট।। রাত নটায় ফোন
হাসপাতাল থেকে ফিরে কম্পাউন্ডে ঢুকেই সঞ্জয় অভ্যাসমতো ওপর দিকে তাকাল।
না, রীণা আজ পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নেই। ঘরে আলোও জ্বলছে না।
এখনো ফেরেনি নাকি?
সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। দরজায় তালা ঝুলছে। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।
অন্ধকার ঘরে ঢুকতেই এই প্রথম হঠাৎ ওর গা ছমছম করে উঠল। অন্য কোনো কিছু ভয়ে নয়, রীণা ফেরেনি বলে।
সুইচ অন করে জামা—প্যান্ট না ছেড়েই বিছানায় গিয়ে বসল। মিনিট কয়েক চুপ করে বসে রইল। হিসেব করে দেখল বেলা একটা নাগাদ বেরিয়ে থাকলে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে নিশ্চয়ই এসে পড়বে।
সঞ্জয় খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেই চায়ের জল চড়িয়ে দিল। মিটসেফ খুলে দেখল রীণা দুখানা পরোটাও করে রেখে গেছে।
ধীরেসুস্থে চা খেতে খেতে সঞ্জয়ের মনে হল কলকাতায় এসে পর্যন্ত এই প্রথম রীণা ঘরে নেই। একটা মানুষের মাত্র কয়েক ঘণ্টার অনুপস্থিতি যে এতখানি শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে সঞ্জয়ের সে অভিজ্ঞতা ছিল না। সে যেন হাঁপিয়ে উঠল।
সাতটা বাজল! রীণার দেখা নেই।
সঞ্জয় মনকে বোঝাতে লাগল—এত ভাবনা কীসের? হাওড়া তো বিদেশ—বিভুঁই নয়। বাসের নম্বর জানা থাকলে—
তবু অস্বস্তি যায় না। যে কথাটা বার বার তাকে খোঁচাচ্ছিল তা এই যে, রীণা কলকাতায় নতুন। সঙ্গে আবার বাচ্চা। পথ ভুল করতে পারে, এক বাসে উঠতে অন্য বাসে উঠতে পারে। অবশ্য তাতেই—বা এমন আর কী বিপদ হতে পারে! ট্যাক্সি নয় যে ভুলিয়ে কোথাও নিয়ে যাবে। ট্রামে, বাসে কেউ পথ হারায় না। লোককে জিজ্ঞেস করলেই ঠিক রুট দেখিয়ে দেবে। কাজেই বাড়ি ফিরে আসা কঠিন নয়। ভয় একটাই—অ্যাক্সিডেন্টের। রাস্তা পার হওয়ার অভ্যেস নেই—ভিড় বাসে ওঠা—নামা করতেও অনভ্যস্ত। ভয়টা সেইজন্যেই।
সঞ্জয় সময় দেখল—সাড়ে সাতটা। সকালে বেরোবার আগে সে রীণাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল—তোমার বন্ধু আটকে দেবে না তো?
—আটকালেও থাকব না। সন্ধের আগেই ফিরে আসব।
সন্ধে তো কখন উতরে গেছে!
সঞ্জয় আর ঘরে বসে থাকতে পারছিল না। একবার ভাবল বাস—স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালেই কি রীণা তাড়াতাড়ি এসে পড়বে? তা তো নয়। আসলে মানুষ দুশ্চিন্তায় যখন ছটফট করে তখন আর হাত—পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। সঞ্জয় দরজায় তালা বন্ধ করে নামতে যাচ্ছে এমনি সময়ে ঝড় উঠল।
প্রথমে সঞ্জয় বুঝতেই পারেনি ঝড় উঠছে। নভেম্বরের এই পরিষ্কার আকাশ ফুঁ�ড়ে এমন ঝড় উঠবে এ যে কল্পনার বাইরে! একটা গোঁ গোঁ শব্দের পরেই ধুলোয় ধুলোয় চারদিক ছেয়ে গেল। ব্যালকনি থেকেই দেখতে পেল রাস্তার লোক ছুটছে। আশ্রয় খুঁজছে। বাড়ির দরজা—জানলা ফটাফট বন্ধ হচ্ছে।
এবার সত্যিই ভয় হল। রীণা এই মুহূর্তে কোথায় আছে কে জানে! যদি বাসে থাকে তো একরকম। তাও সমস্যা—এই ঝড়ে ঠিক স্টপেজে নামতে পারবে কি না। নামবেই বা কী করে? পুপুটাই বা কী করবে?
আর যদি রাস্তায় থাকে—
সঞ্জয় আর ভাবতে পারল না। ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে লাগল।
ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য চলল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে। ঝড় যখন থামল রাত তখন নটা। ভাগ্য ভালো। বৃষ্টি নামেনি।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সঞ্জয় দেখল যশোর রোড একদম ফাঁকা। খাঁ—খাঁ করছে। লোক চলাচল তো নেইই, বাস—ট্যাক্সিও চোখে পড়ল না।
দারুণ দুর্ভাবনায় পড়ল সঞ্জয়। নিশ্চয় রীণার কিছু বিপদ হয়েছে। আর পুপুটা? ভাবতে ভাবতে সঞ্জয় অস্থির হয়ে উঠল।
এখন কী করবে? কোথায় খবর নেবে? পরামর্শ করে এমন কেউ কাছের মানুষ নেই। একবার ভাবল দোতলায় গিয়ে খবর নেয় নিখিলবাবু ফিরেছেন কিনা। এ বাড়িতে যত ভাড়াটে আছেন তাঁদের মধ্যে নিখিলবাবুই একমাত্র সিরিয়াস লোক। ওঁর সঙ্গেই কথা বলা চলে। তবু সঞ্জয় গেল না। কে জানে ভদ্রলোক কী মনে করবেন?
অনেক ভেবে সঞ্জয় ঠিক করল মান্তুদের বাড়িই যাবে। হয়তো ওকে আটকে দিয়েছে।
কিন্তু মান্তুদের বাড়ি তো চেনে না। ঠিকানা? না, ঠিকানাও জানা নেই।
কী মনে হল উঠে ড্রয়ার টেনে মান্তুর চিঠিগুলো খুঁজতে লাগল।
একটা চিঠি পেল।—ভাই রীণা…
নাঃ, ঠিকানা নেই। শুধু ক্ষীরোদতলা, হাওড়া।
শুধু ক্ষীরোদতলা বললে কি এই রাত্তিরে কারো বাড়ি খোঁজ করা যায়? অসম্ভব।
সঞ্জয় আবার চিঠি খুঁজতে লাগল।
আরো একটা চিঠি।—
ভাই রীণা…
আহা, ঠিকানা ছিল কিন্তু খাম খুলতে গিয়ে ওই জায়গাটা ছিঁড়ে গেছে।
সঞ্জয় পাগলের মতো ড্রয়ার টেনে খুলে সব কাগজ হাতড়াতে লাগল।
এই যে আরো চিঠি রয়েছে।….
নাঃ!—কোনোটাতেই পুরো ঠিকানা নেই।
সঞ্জয় যখন একেবারে হতাশ তখন ড্রয়ারের কোণ থেকে বেরোল দুমড়ানো একটা খাম। তাড়াতাড়ি চিঠিখানা বের করল। এইটে বোধহয় মান্তুর প্রথম চিঠি।
হ্যাঁ, এই যে ঠিকানা রয়েছে।
ঠিকানা লিখে নেবার ধৈর্য তখন আর নেই। চিঠিটা পকেটে পুরেই সঞ্জয় ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দরজায় তালা লাগাচ্ছে, মনে হল কেউ দ্রুত পায়ে ওপরে আসছে।
সঞ্জয় শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াল। নিশ্চয় কোনো বিপদের—
—কাকু, আপনার ফোন।
সঞ্জয় দৌড়ে নেমে গেল।