।। সাত ।। ঝড়
হাওড়ার পঞ্চাননতলা—কদমতলার মধ্যে ক্ষীরোদতলা। মনেই হয় না এটা কলকাতার লাগোয়া জায়গা। জীবন এখানে ধীরে—সুস্থে, জিরিয়ে, ঢিমেতালে চলেছে। বাসিন্দারা সকলেই প্রায় সকলের পরিচিত।
এই ক্ষীরোদতলাতেই একতলা একটা বাড়ি। দরজায়, জানলায় চমৎকার রঙিন পর্দা, গেটের ওপরে মাধবীলতার বাহার। একনজর দেখলেই বোঝা যায় অন্য আর সব বাড়ির মধ্যে এ বাড়িটি একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আর এটা সম্ভব হয়েছে রুচি আর যত্নের গুণে। বাড়ির গৃহিণী স্বয়ং অক্লান্ত পরিশ্রমে বাড়িটিকে সুন্দর করে রেখেছেন।
বেলা তখন প্রায় সাড়ে চারটে। কাজের লোকের সঙ্গে সে—বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি ইস্কুল থেকে গুটিগুটি ফিরল। বইয়ের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে দিয়ে বললে, মা, আজ সন্ধের পর ভয়ানক ঝড় হবে।
মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে মা বললে, অসময়ে ঝড়! কে বললে?
মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল—শ্যামলীদি।
—শ্যামলীদি বলেছে! মা কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, তবে তো সাংঘাতিক কথা। ঝড় হবেই।
—হ্যাঁ, শ্যামলীদি রেডিয়োতে শুনেছেন। বলে দিলেন, খবরদার কেউ সন্ধের পর বাড়ি থেকে বেরিয়ো না।
—ঠিকই তো। ঝড় এলে কেউ কি বেরোয়? আচ্ছা যাও, এখন হাত—মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও গে।
মেয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
মেয়েটির বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে টাইমটেবিল দেখছিলেন। বয়েস বেশি নয়, কিন্তু ভারিক্কি চাল। তার ওপর একটু মোটা আর ধুতির সঙ্গে গোল গলা ঢিলে হাতা পাঞ্জাবি পরেন বলে একটু বেশি বয়েস মনে হয়। টাইমটেবিল ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ভ্রমণের ভারি নেশা। প্রতি বছরই কোথাও—না—কোথাও বেরোন। মাস কয়েক হল সপরিবারে পুরী ঘুরে এসেছেন। এখনই বেরোবার আর সম্ভাবনা নেই। তবুও নতুন কোথাও যাবার জন্যে এখন থেকেই প্ল্যান—পরিকল্পনা করছিলেন।
কলকাতায় ওঁর পৈতৃক ব্যবসা মদের। এ এমন ব্যবসা যার মার নেই। মদের ব্যবসা কিন্তু জীবনে কখনো উনি ও জিনিসটি আস্বাদন করেননি।
ভদ্রলোক টাইমটেবিলটি মুড়ে রেখে বললেন, কই? তোমার বান্ধবীটি তো এখনো এলেন না?
মান্তু মেয়ের ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে গুছিয়ে রাখছিল। বললে, আসবে। বলে ঘড়ির দিকে তাকাল।
—কিন্তু তোমাকে আজ অন্য ঘরে শুতে হবে বলে রাখছি। আমি রীণার সঙ্গে শোব।
ভদ্রলোক যেন বিষণ্ণভাবে বললেন, উনি কি আজ থাকবেন?
—আমি তো থাকার জন্যে বলেছি। ও বলেছে, থাকতে পারবে না। তবু যদি থেকে যায়—তা ছাড়া সত্যিই যদি ঝড় ওঠে, ফিরবে কী করে?
ভদ্রলোক বিরক্তির ভান করে বললেন, বুঝতে পারছি, মাঝে—মাঝেই এখন তোমার—আমার মধ্যে এই তৃতীয়জনটি বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।
মান্তু হেসে বলল, তা ঠিক। ওকে এখন প্রায়ই এখানে এনে রাখব।
ভদ্রলোক গাম্ভীর্যের ভান করে বললেন, বোধহয় পারবে না। ওঁরও তো একজন দাবিদার আছেন। তিনি আবার ডাক্তার! ডাক্তারদের অনেক এক্সট্রা সুবিধে আছে। বউকে তাই তাঁরা চট করে কাছ—ছাড়া করতে চান না।
শেষ কথাটার প্রচ্ছন্ন রসিকতা এড়িয়ে গিয়ে মান্তু বলল, থাকুক দাবিদার। ওকে মাঝে—মাঝে এনে না রাখলে ওর মনটা ঠিক হবে না।
ললিতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর ব্যাধিটা কী?
—কে জানে! ছোটোবেলা থেকে তো ওকে জানি। একেবারে সুস্থ, হাসিখুশি। কোনোদিন ভারী অসুখ হতে দেখিনি। সেই মেয়েরই কী যে হল!
অসুখ—বিসুখের কথা শুনতে ললিতবাবুর ভালো লাগে না। তিনি আমোদপ্রিয় মানুষ। মদ না খেয়েও সদাই ফুরফুরে। পাছে মান্তু তার বান্ধবীর রোগের জের টানে তাই তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, আর এক কাপ চা sanction করো না।
মান্তু মৃদু ধমক দিয়ে বললে, একটু আগেই চা খেয়েছ। এখন আর নয়। রীণা তো এখুনি এসে পড়বে। তখন পাবে। হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন? রীণার কথা। ওর মনটা কীরকম ছিল বলি। একদিন কী একটা উপলক্ষ্যে রীণা, রীণার মা, ঠাকমার সঙ্গে আমিও যাচ্ছিলাম গঙ্গাস্নান করতে। হঠাৎ আমার দাদাও এসে জুটল। রীণা ছিল আমার দাদার খুব ভক্ত। দাদা পার্টি করত। পড়াশোনাও ছিল খুব। কিচ্ছু মানত না। বলত, বুঝলি রীণা, লেখাপড়া শিখছিস, সংস্কারমুক্ত ছবি। ঠাকুর—দেবতা, গুরু—পুরোহিত, ভূত—প্রেত স্রেফ বোগাস।
শুনে রীণার ঠাকমা চটতেন। বলতেন, নীরেনই মেয়েটার মাথা খেল।
শ্মশানের পাশ দিয়েই স্নানের ঘাটে যেতে হয়। না তাকালেও বুঝতে পারছিলাম মড়া পুড়ছে। বিশ্রী চামসিটে গন্ধ। তার সঙ্গে ফটফট শব্দ—বাবারে! ভাবলে এখনও গা কীরকম করে।
তা দাদা হঠাৎ রীণাকে বলল, পঁচিলের গায়ে ওই ছাইগুলো কীসের বলতে পারিস?
রীণা একনজর দেখে নিয়ে বলল, চিতাভস্ম।
—পারিস ওই ছাই একমুঠো নিয়ে আসতে?
সবাই চমকে উঠল।—এ আবার কী কথা! ছিঃ!
দাদা নেহাৎ মজা করেই কথাটা বলেছিল। কিন্তু রীণা করল কী—সবাইকে হকচকিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে এক মুঠো ছাই নিয়ে এল।
দাদা যে দাদা, সেও তাজ্জব হয়ে গেল। রীণার সাহস দেখে বলল—সাবাস! এই তো চাই।
দাদা তো খুব বাহবা দিল। কিন্তু আর সবার মুখ হাঁড়ি। গঙ্গাস্নানের আনন্দ মাথায় উঠল। রীণা সেদিন সবার কাছে খুব বকুনি খেল। দাদা লজ্জায় পালালো।
ভাবতে পারা যায় সেই মেয়েই এখন নাকি রোজ ভূত দেখছে। শুধু ভূত দেখাই নয়—ভূতের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইছে।
শুনে ললিতবাবু মন্তব্য করলেন, কলকাতা শহরে ভূত!
—বোঝো, তাহলে ওর মানসিক অবস্থাটা কীরকম হয়েছে? আমি ওকে একটার পর একটা চিঠি দিয়ে, নিজে ওর সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ওই এক কথা—না, ভুল দেখি না। মানসিক রোগও নয়। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার!
মান্তু একটু থামল। তারপর বলল—এই কমাসের মধ্যে মূর্তিটা বেশ কয়েকবার নাকি দেখা দিয়েছে। দেখা দেওয়াই শুধু নয়, নাকি হুমকিও দিয়েছে।
—আবার হুমকিও দিয়েছে! বাবাঃ! ললিতবাবু হাসলেন।
মান্তু রাগ করে বলল, ওর হাজব্যান্ডের মতো তোমারও দেখছি অবিশ্বাস। মেয়েটার জন্যে তোমাদের কারো এতটুকু ভাবনা হয় না!
স্ত্রীর এই তিরস্কার ললিতবাবু নিঃশব্দে হজম করতে পারলেন না। বললেন, ও—সব ভয়ের কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া যে মেয়ে হাসতে হাসতে মড়ার ছাই মুঠোয় ভরে আনতে পারে সে আবার নররাক্ষস দেখে অজ্ঞান হয় কী করে?
মান্তু বলল, দুটো আলাদা ব্যাপার না? একটা—বীভৎস জিনিস সহ্য করতে না পারা। আর একটা—কুসংস্কার না মানা। দুটোয় গুলিয়ে ফেললে কী করে হবে?
—কী জানি। তোমার বান্ধবীর মনস্তত্ত্ব বুঝি না। আমার মনে হয় স্রেফ মানসিক ব্যাধি।
—বেশ! মানসিক ব্যাধি হলেও তো তার প্রতিকার করতে হবে।
—স্বামী যখন ডাক্তার তখন ব্যবস্থা তিনিই করছেন।
—ছাই করছে। শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রুপ।
ললিতবাবু আলিস্যি ভেঙে উঠে পড়লেন, যাই একটু ঘুরে আসি।
—ওমা! যাবে কী! এখুনি রীণা এসে পড়বে।
ললিতবাবু উঠছিলেন, বসে পড়লেন। টাইমটেবিলটা আবার তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। একসময়ে বললেন, এবার আমরা রাজস্থানের দিকে যাব। কী বলো?
মান্তু বলল, তার তো এখনো ঢের দেরি। পরে ভাবলেও চলবে। বলে আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের মনেই বলল, সাড়ে পাঁচটা বাজতে চলল। এখনো এল না।
এমন সময়ে পিওন এসে লেটার—বক্সে চিঠি ফেলে গেল।
মান্তু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে লেটার—বক্স খুলে চিঠিঠা বের করে নিয়ে এল। খামে চিঠি। অপরিচিত হাতে ইংরিজিতে ঠিকানা লেখা।
—কার চিঠি?
মান্তু খামটা ললিতবাবুর হাতে দিয়ে পাশে বসল।
চিঠি পড়ে ললিতবাবু নড়েচড়ে বসলেন। খুশি—খুশি গলায় বললেন, মিস থাম্পিকে মনে আছে?
—খুব আছে। কেন?
—তিনি কলকাতায় আসছেন।
—ওমা! কবে?
—পড়ে দেখো।
মান্তু চিঠিটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। মিস থাম্পি লিখছেন, আগামী ২৭ নভেম্বর ম্যাড্রাস মেলে কলকাতা পৌঁছোচ্ছেন। সেখান থেকে সোজা ললিতবাবুর বাড়ি চলে আসবেন। দু—তিন দিন থাকবেন। কলকাতায় থিওজফিক্যাল সোসাইটি এবং আরও কয়েকটি জায়গায় ঘুরবেন। সে সময়ে এঁদের সাহায্য দরকার হবে। কেন—না কলকাতার রাস্তাঘাট তাঁর ভালো জানা নেই।
মান্তু আনন্দে লাফিয়ে উঠল—মিস থাম্পি তাহলে কথা রেখেছেন!
তারপর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, ২৭ নভেম্বর মানে সামনের বুধবারের পরের বুধবার। ওদিন তোমার কোথাও বেরোনো হবে না।
ললিতবাবু হেসে বললেন, বেরোতে হবে না মানে? বেরোতে আমায় হবেই, অন্তত হাওড়া স্টেশনে ওঁকে রিসিভ করতে।
মান্তু রসিকতাটা বুঝল। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুজনেই মিস থাম্পির কথা ভাবছিল। অনেক কথাই মনে পড়ছিল।
দু—বছর আগে তিরুপতির পাহাড়ে এই মহিলার দর্শন পান ওঁরা।
তিরুপতি পাহাড়টা ছিল বেশ উঁচু। দীর্ঘ পিচঢালা বাস—রাস্তাটা ওপরে উঠে গেছে পাহাড়টাকে ঘিরে ঘিরে—মেয়েরা যেমন পাক দিয়ে শাড়ি পরে তেমনিভাবে। রাস্তার দু—ধারে পাহাড়ে ঝোপ—জঙ্গল। সে—সব জঙ্গলে কেউ বোধহয় কোনোদিন যায় না। যাবার দরকারও হয় না।
কিন্তু পাহাড়ের ওপর উঠে মান্তুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শহর! ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। দু—পাশে হালফ্যাশানের বাড়ি, বাজার, দোকান। এমনকি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্ক পর্যন্ত।
দু—একদিন আগে কী একটা বিশেষ উৎসব হয়ে গিয়েছে বলে তিরুপতির মন্দিরে তেমন ভিড় ছিল না। তাই তিরুপতি দর্শন হয়ে গেল বেলা তিনটের মধ্যেই। পাহাড় থেকে নামার লাস্ট বাস পাঁচটায়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে নীচে নামতে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মান্তুদের বাস। সেটা ছাড়বে সন্ধে ছটায়। কাজেই হাতে যথেষ্ট সময়।
মান্তুদের সঙ্গে আরো যাঁরা ছিলেন তাঁরা পাহাড়ের ওপরে কেনাকাটা করতে লাগলেন। মান্তুরা সামান্য কিছু কিনে জায়গাটা ঘুরতে বেরোল। ললিতবাবুর কী খেয়াল হল টাউন ছেড়ে নেমে এলেন পাহাড়ের ধারে। বললেন, লোকে তো এদিকে বড়ো একটা আসে না, চলো আমরা ওদিকটা দেখে আসি।
একটু নেমেই ওঁদের নজরে পড়ল একটা ছোটোখাটো আশ্রম।
এখানে আবার আশ্রম কীসের!
কৌতূহলী হয়ে ওঁরা একটু এগোতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে ওঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। দেখলেন আশ্রমের পিছনে একটা গাছের ডালে অনেকগুলো মড়ার মাথার খুলি ঝুলছে। খুলিগুলো নানা আকারের। সবচেয়ে ছোটাটা হাতের মুঠোয় ধরা যায়। আর সবচেয়ে বড়োটা যে মানুষের মাথা তা ভাবা যায় না।
এঁরা যখন অবাক হয়ে খুলিগুলো দেখছেন তখনই একজন মহিলা আশ্রম—কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মান্তু আঁতকে উঠেছিল। কালো লম্বা চেহারা। একটা দাঁত ঠোঁট থেকে সামান্য একটু বেরিয়ে। পুরু ঠোঁট। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা একমাথা পাকা চুল। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গায়ে কালো সোয়েটার। গলায় লাল পাথরের মালা। মোটামোটা আঙুলে দামি পাথর। সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ে তা হচ্ছে তাঁর ঝকঝকে চোখ দুটো।
মিস থাম্পি ওদের সাদর অভ্যর্থনা করলেন। এইভাবেই আলাপ হল।
ভদ্রমহিলা ইংরিজিতেই কথা বললেন। জানা গেল, উনি সেখানে আছেন চল্লিশ বছর। একাই থাকেন।
কী করেন জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে একটু হেসেছিলেন মাত্র। শেষে তিনি যা বললেন তার অর্থ হল প্রেতচর্চা!
শুনে তো মান্তুর বাকরোধ হবার জোগাড়। সে থিওজফিস্টদের কথা শুনেছে বটে কিন্তু কখনো থিওজফিস্ট চোখে দেখেনি। তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, বা তাদের চর্চার বিষয় ঠিক কী জিনিস, সে সম্বন্ধে তার কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিল না। এই প্রথম একজন থিওজফিস্ট—এর সঙ্গে আলাপ হল।
দেখতে যেমনই হোক, ক্রিয়াকলাপ যাই হোক, মানুষটি ভালো। খুবই অতিথিপরায়ণ। তিনি তাঁদের সাদরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আসন পেতে বসালেন। কফি খাওয়ালেন। মান্তুর ইচ্ছে ছিল প্রেতচর্চার ব্যাপারটা একটু শোনে। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারল না। ললিতবাবুও অবশ্য দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে কেবলই উঠি—উঠি করছিলেন। তাঁরা কলকাতায় থাকেন জেনে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার একবার কলকাতা যাবার দরকার হবে।
মান্তু তখনই ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল, যদি যান তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়ি উঠবেন। আমরা খুশি হব।
—ধন্যবাদ। বলে মিস থাম্পি ঠিকানাটা রেখে দিলেন।
ব্যস এই পর্যন্ত। তারপর আর যোগাযোগ নেই। অমন একজন বিচিত্র মহিলার সঙ্গে কে আর যোগাযোগ রাখতে চায়!
প্রায় আড়াই বছর পর সেই মিস থাম্পি কলকাতায় আসছেন। আর আসছেন কিনা তাঁদেরই বাড়ি! এ খবরে যেমন আনন্দ পেল তেমনই কেমন ভয়—ভয়ও করল। ভূত—প্রেত নিয়ে কারবার তো মহিলাটির!
মান্তুদের এক বিশেষ প্রতিবেশী বন্ধু আছে। দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরে এসে মান্তু তাদের কাছে মিস থাম্পির গল্পও করেছিল। মিস থাম্পি সম্বন্ধে তাদেরও খুব কৌতূহল। বলেছিল, কোনোদিন উনি কলকাতায় এলে যেন তাদেরও জানানো হয়। তারা দেখা করবে।
মান্তু ঠিক করল খবরটা ওদের কালই দেবে।
মিস থাম্পি আসছেন। কীভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করা হবে, কোন ঘরে থাকার ব্যবস্থা করবে—ওঁর খাবার ব্যবস্থাই—বা কীরকম হবে এই নিয়ে অনেকক্ষণ স্বামী—স্ত্রীতে আলোচনা হল। কিছুক্ষণের জন্যে রীণার কথা ভুলেই গিয়েছিল। তারপর হঠাৎই মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মান্তুর দুর্ভাবনা বাড়ল—রীণা তো এখনো এল না!
ললিতবাবু বললেন, উনি একাই আসবেন?
—হাঁ, ভালো করে ডিরেকশান দিয়ে দিয়েছিল। অসুবিধে হবে না।
—পথ হারিয়ে ফেলবেন না তো?
—নাঃ! খুব চালাক—চতুর মেয়ে। তা ছাড়া একই বাসে বাঙ্গুর থেকে টানা হাওড়া। তারপর আবার একটা বাসে হাওড়া স্টেশন থেকে টানা ক্ষীরোদতলা। ভুল হবার তো কোনো কারণ নেই।
ললিতবাবু বললেন, তবে হয়তো কাজে আটকে গেছেন। কিংবা বাচ্চাটার শরীর খারাপ।
মান্তু আর কিছু বলল না। আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। তারপর যখন মনে হল আসার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই তখন ধীরে ধীরে সোফায় এসে বসল।
ললিতবাবু পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বললেন, মাঝখান থেকে আমার বেরোনো হল না।
পাশের ঘরে মেয়ে পড়ছিল। বললে, বেরোবে বইকী। এখুনি না ঝড় উঠবে!
কথা শেষ হতে—না—হতেই হঠাৎ দিকদিগন্ত কাঁপিয়ে প্রচণ্ড একটা ঝড় শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজ্যের ছেঁড়া কাগজ আর রাস্তার ধুলো যেন মুহূর্তে তাণ্ডব নৃত্যে মেতে উঠল।