ছোট বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু কাউকেই সেটা নিয়ে বিচলিত হতে দেখা গেল না। বাচ্চাটার সারা শরীরে নানা ধরনের মনিটর লাগিয়ে তাকে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হয়েছে, নানারকম যন্ত্রপাতিতে তার শরীরের সব ধরনের জৈবিক কাজকর্মের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কয়েকটা ভিডিও ক্যামেরা তার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। এর মাঝে তাকে নানা দিক থেকে এক্সরে করা হয়েছে, আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার জন্যে প্রস্তুতি চলছে।
বাচ্চার কান্নাকাটি ধীরে ধীরে নাসরীনের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। সে টেকনিশিয়ানকে বলল, বাচ্চাটার মনে হয় খিদে লেগেছে।
কার?
এই বাচ্চাটার।
টেকনিশিয়ানের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, বলে বাচ্চা? কোথায় বাচ্চা?
নাসরীন অবাক হয়ে বলল, এই যে।
টেকনিশিয়ান হা হা করে হেসে বলল, এইটা? এইটা তো মানুষের বাচ্চা না। এইটা শয়তানের বাচ্চা। মানুষের বাচ্চার কখনো পাখা থাকে?
নাসরীন অবাক হয়ে টেকনিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকল, কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, শয়তানের বাচ্চা হলেও তো বাচ্চা। একটা বাচ্চার খিদে লাগে।
হ্যাঁ খিদে তো লাগেই। কিন্তু শয়তানের বাচ্চা কী খায় তা তো জানি না। কী খেতে দেব? রক্ত? টেকনিশিয়ানটি হা হা করে হাসতে লাগল যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে।
নাসরীন নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে ডক্টর সেলিমের চেম্বারের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে ডক্টর সেলিম টেলিফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। কথাগুলো বলছে ইংরেজিতে কাজেই মনে হয় অন্য পাশে দেশের বাইরের কোনো মানুষ।
নাসরীন শুনল ডক্টর সেলিম বলছে, তুমি ভিডিও ফুটেজটা দেখেছ? কী মনে হয়?
অন্য পাশ থেকে কী বলেছে নাসরীন শুনতে পেল না কিন্তু ডক্টর সেলিমের হা হা হাসি শুনে বুঝতে পারল কথাটি নিশ্চয়ই খুব মজার। ডক্টর সেলিম বলল, তাহলে তুমি আমার এই শয়তানের বাচ্চার একটা টুকরো চাও?… কোন টুকরা…?… উঁহু। তুমি সবকিছুর এক টুকরা পাবে না। যে কোনো একটা জায়গার একটা টুকরো। হয় ফুসফুসের একটা টুকরো, তা না হয় হৃৎপিণ্ডের, না হয় মস্তিষ্কের, না হয় লিভার কিংবা রক্তের স্যাম্পলবল তুমি কী চাও?
নাসরীনের মনে হলো হড়হড় করে সে বমি করে দেবে, কোনোমতে মুখ ঢেকে সে নিঃশব্দে বের হয়ে আসে। লাউঞ্জুের একটা চেয়ারে সে কিছুক্ষণ নিজের মাথা চেপে বসে থাকে। যে মানুষটি এই বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিল সে তাহলে ঠিকই অনুমান করেছে যে বাচ্চাটিকে এরা মেরে ফেলবে। এ রকম ফুটফুটে বাচ্চাকে কেমন করে মানুষ মেরে ফেলতে পারে? কেমন করে তাকে শয়তানের বাচ্চা বলতে পারে?
নাসরীন হঠাৎ করে বুঝতে পারে তার হাতগুলো থরথর করে কাঁপছে। মানুষটি এই বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল, নাসরীনের কথা বিশ্বাস করে রেখে গেছে। নাসরীন যদি না বলত তাহলে মানুষটা এই বাচ্চাটাকে নিয়ে যেত, বাচ্চাটা বেঁচে যেত। তার কথা বিশ্বাস করে মানুষটা বাচ্চাটাকে নিয়ে থেকে গিয়েছিল। এই ছোট শিশুটাকে হত্যা করার জন্যে যদি একটা মানুষ দায়ী হয়ে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে সে নিজে। নাসরীন তার হাতের দিকে তাকায়, তার মনে হতে থাকে তার হাতে বুঝি ছোপ ছোপ রক্ত।
নাসরীন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, তার মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে একজন। ডাক্তার, মানুষকে বাঁচানোর জন্যে সে শপথ নিয়েছে, মানুষকে হত্যা করার জন্যে নয়। যেভাবে হোক তার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। নাসরীন লাউঞ্জ থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে আবার আইসি, ইউনিটের দিকে উঁকি দিল, একটু আগেই বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছিল এখন নেতিয়ে ঘুমিয়ে আছে। নাসরীন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? বাচ্চাটা ঘুমুচ্ছে কেন?
ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। চিৎকার করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ফুসফুসে কী জোর বাবারে বাবা।
ইনজেকশন? কীসের ইনজেকশন?
ঘুম। কিছুক্ষণ ঘুমাক শয়তানের বাচ্চা। আমরা একটু খেয়ে আসি।
মানুষগুলো বের হওয়ার সাথে সাথে নাসরীনের হঠাৎ মনে হলো বাচ্চাটাকে বাঁচানোর সে একটা সুযোগ পেয়েছে। দৈব সুযোগ। শুধু সেই পারবে বাচ্চাটাকে এখান থেকে বের করতে। সে বিছানার কাছে ছুটে গেল, বাচ্চাটার শরীরে লাগানো নানা ধরনের মনিটরগুলো খোলার আগে সে অ্যালার্মগুলো বিকল করে দিল। বাচ্চাটা পাখির পালকের মতো হালকা, একটা বালিশের ওয়ার খুলে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে সে তার ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে উপরে তার অ্যাপ্রনটা পরে নেয়। কেউ যদি সন্দেহ করে তাকে সার্চ করে শুধু তাহলেই বাচ্চাটাকে পাবে। নাসরীন আই.সি.ইউ থেকে বের হয়ে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। লিফটের কাছে এসে বোতাম টিপে সে অপেক্ষা করেনাসরীনের মনে হয় লিফটটা আসতে বুঝি কয়েক যুগ সময় লেগে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করে উঠে চিৎকার করে কঁাদা শুরু করার সম্ভাবনা নেই, তবু তার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে।
লিফট আসার পর ভেতর থেকে কয়েকজন বের হয়ে এলো, নাসরীন তখন সাবধানে লিফটের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, ভাগ্যিস তাদের মাঝে পরিচিত কেউ নেই।
লিফটটা বিভিন্ন তলায় থামতে থামতে নিচে এসে দাঁড়াল। নাসরীন নিঃশব্দে নেমে আসে, গেটে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। নাসরীন তাদের পাশ কাটিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এলো। বাচ্চাটাকে বের করে এখন। কোলে নিতে হবে, তারপর একটা রিক্সা কিংবা স্কুটারে করে যেতে হবে—কোথায় যেতে হবে সে এখনো জানে না।
ঠিক তখন নাসরীনের চোখ পড়ল হাসপাতালের গেটের কাছে গুটিগুটি মেরে বসে থাকা মানুষটির দিকে। জাত্র সেখানে চুপচাপ বসে আছে, কেন বসে আছে কে জানে। নাসরীন একটু এগিয়ে গেল, বলল, আপনি?
জহুর মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল, মেরে ফেলেছে?
নাসরীন মাথা নাড়ল, না।
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মেয়েটা আমাকে বাচ্চাটার দায়িত্ব। দিয়েছিল। আমি পারলাম না। আমার নিজের ভুলের জন্যে।
কী ভুল?
আপনাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম—ভেবেছিলাম—
নাসরীন একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছি। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছি।
জহুরের একটু সময় লাগল কথাটা বুঝতে। যখন বুঝতে পারল তখন। সে উঠে দাঁড়াল, খুব ধীরে ধীরে তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসতে অভ্যস্ত নয়, তার মুখে হাসিটাকে অত্যন্ত বেমানান মনে হয়। জহুর হাত বাড়িয়ে বলল, কোথায়?
নাসরীন হাতের পাশ থেকে ঝোলানো বালিশের ওয়ারে রাখা ছোট বাচ্চাটাকে বের করে দিল, বলল, ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। এখন উঠবে না—আপনি যত দূর সম্ভব নিয়ে যান, দেরি করবেন না।
না দেরি করব না। জহুর বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে নাসরীনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে কী বলবে সে বুঝতে পারছে না, অনুভূতির নরম কোমল কথাগুলো সে বলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সেটাই সে বলল, আমি আসলে কী বলব বুঝতে পারছি না।
নাসরীন বলল, কিছু বলতে হবে না। আপনি যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন যান।
আপনার হয়তো ঝামেলা হবে–
হলে হবে। আপনি যান।
যাচ্ছি।
নাসরীন দেখল, জহুর বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ডক্টর সেলিমকে কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো দেখায়, সে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কী করেছ?
আমি বাচ্চাটাকে সেই মানুষটার কাছে দিয়ে দিয়েছি।
মনে হলো ডক্টর সেলিম কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না, কয়েকবার তার ঠোঁট নড়ল, কোনো শব্দ বের হলো না। একটু চেষ্টা করে বলল, বাচ্চাটাকে দিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনারা যেন বাচ্চাটাকে খুন করে না ফেলেন সে জন্যে।
তুমি জান তুমি কী করেছ? তুমি জান?
নাসরীন মাথা নাড়ল, বলল, জানি। মানুষটা আমার কথা বিশ্বাস করে বাচ্চাটাকে রেখে গিয়েছিল, আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছি।
ডক্টর সেলিম হঠাৎ উন্মাদের মতো চিৎকার করে নাসরীনের দিকে এগিয়ে এলো, বলল, আমি তোমাকে খুন করে ফেলব। খুন করে ফেলব।
নাসরীন কষ্ট করে একটু হাসল, বলল, করতে চাইলে করেন স্যার। কিন্তু সেই বাচ্চাটাকে খুন করতে পারবেন না।
বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? ওইটা কি মানুষের বাচ্চা ছিল?
জি স্যার। মানুষের বাচ্চা ছিল।
না। এটা ছিল পাখির বাচ্চা-পাখি! মানুষের বাচ্চাকে খুন করা যায় —কিন্তু পাখির বাচ্চাকে দরকার হলে কেটে কুটে দেখা যায়। বুঝেছ?
না স্যার বুঝিনি!
শুনে রাখো মেয়ে। ঐ পাখির বাচ্চাটাকে আমি খুঁজে বের করব। করবই করব। আর তোমাকে–
আমাকে স্যার?
আমি দেখব তুমি কীভাবে তোমার ক্যারিয়ার তৈরি কর। এই দেশের মাটিতে তোমাকে আমি থাকতে দিব না।
নাসরীন তার দুই হাত সামনে মেলে ধরে বলল, দেখেন স্যার।
কী দেখব?
আমার হাত! পরিষ্কার। একটু আগে মনে হচ্ছিল এখানে ছোপ ছোপ রক্ত! এখন আর নাই। আমার ক্যারিয়ারের দরকার নাই স্যার, আমি মানুষের বাসায় বাসন ধুয়ে জীবন কাটিয়ে দেব। কিন্তু রাত্রে যখন ঘুমাতে যাব দেখব আমার হাত ধবধবে পরিষ্কার। সেখান এক ফোঁটা রক্ত নাই।
ডক্টর সেলিম চিকার করে বলল, বেরিয়ে যাও। বেরিয়ে যাও তুমি আমার সামনে থেকে। এই হাসপাতালে আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না।
নাসরীন বলল, আপনি আমার মুখ দেখবেন না স্যার। আর কোনো দিন দেখবেন না। তুরি মানে বুঝতে পারছেন তো?
কী মানে?
আপনার মুখটাও আমার আর কোনো দিন দেখতে হবে না!
হাতে একটা কুপি বাতি নিয়ে আনোয়ারা ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ঘরের ভেতরে কে? জহুর নাকি?
জহুর বলল, হ্যাঁ। আনোয়ারা বুবু? তুমি?
হ্যাঁ, জহুর। তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে এসেছ? সন্ধ্যেবেলা দেখি তোমার ঘরে আলো, ভাবলাম কে আবার ঘরে বাতি দেয়। তোমাকে দেখব ভাবি নাই।
আমিও ভাবি নাই। বস আনোয়ারা বুবু। বসার কিছু নাই, মাটিতেই বস।
জহুর বহুদিন পর নিজের ভিটেতে ফিরে এসেছে। ফিরে এসে সন্ধ্যেবেলা ঘরে আলো জ্বালিয়েছে। আলো দেখে তার পাশের বাড়ির আনোয়ারা দেখতে এসেছে। আনোয়ারার সাথে জহুরের কোনো রক্তের সম্পর্ক নাই কিন্তু তার নিজের বোনের মতো।
আনোয়ারা কুপি বাতিটা মাটিতে রেখে দাওয়ায় হেলান দিয়ে বসে। আবছা অন্ধকারে সে জহুরকে একটু দেখার চেষ্টা করে। বিড়বিড় করে বলে, বাপ দাদার ভিটার মাঝে শেয়াল কুকুর দৌড়ায়, ব্যাপারটা ঠিক না জহুর। তোমার ভাবসাব দেখে মনে হয় দুনিয়ায় যেন কারো বউ মরে না। ঝি মরে না।
জহুর কোনো উত্তর দিল না। আনোয়ারা বিড়বিড় করে বলল, এখন একটা বিয়ে করে সংসারী হও। ছেলেমেয়ে থাকলে তারা মৃত্যুর পরে দোয়া করে। গোর আজাব মাফ হয়।
জহুর নিচু গলায় হাসার মতো একটা শব্দ করে বলল, আনোয়ারা বুবু তোমার শরীরটা কেমন?
আনোয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে বলল, আমার আবার শরীর। এক পা কবরে এক পা মাটিতে। আজরাইল সবার দিকে নজর দেয়, আমার দিকে নজর দেয় না।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, না আনোয়ারা বুবু। আজরাইল এখন তোমার দিকে নজর দিলে হবে না। তোমার আরো কয় বৎসর বাঁচা লাগবে।
কেন? আমার বাঁচা লাগবে কেন?
জহুর উঠে দাঁড়াল, ঘরের কোনায় মাচার ওপর শুইয়ে রাখা শিশুটাকে সাবধানে তুলে এনে আনোয়ারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই বাচ্চাটাকে তোমার মানুষ করে দিতে হবে।
আনোয়ারা বিস্ফারিত চোখে জহুরের দিকে তাকিয়ে থাকে, বলে, এইটা কার বাচ্চা?
সেইটা অনেক লম্বা ইতিহাস আনোয়ারা বুবু।
এত ছোট বাচ্চা তুমি কোথায় পেয়েছ? বাবা কী করে? মা কী করে?
বাবা নাই, মা নাই। বাচ্চার মাকে আমি নিজের হাতে কবর দিয়েছি।
আনোয়ার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাচ্চা দেখি পরীর মতোন সুন্দর। ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
তুমি পুরুষ মানুষ এত ছোট বাচ্চা নিয়ে আসছ কেন? এতিমখানায় রেখে আসলে না কেন? কত বড়লোকের পরিরার বাচ্চা নেয়—
জহুর বলল, সেইটা অনেক বড় ইতিহাস। তুমি বাচ্চাটাকে কোলে নাও তাহলে বুঝতে পারবে।
তাহলে কী বুঝতে পারব?
আগে একবার কোলে নাও তো।
আনোয়ারা হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে, ইয়া মাবুদ! বাচ্চার কোনো ওজন নাই!
জহুর মাথা নাড়ে, নাই আনোয়ারী বুবু। এর কোনো ওজন নাই।
কেন? ওজন নাই কেন? আনোয়ারা বিস্ময় এবং আতঙ্ক নিয়ে শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
তুমি বাচ্চাটার কাপড় খুলো, খুলে দেখো। পিঠের দিকে দেখে।
আনোয়ারা সাবধানে পেঁচানো কাপড়টা খুলে বাচ্চাটার পিঠের দিকে তাকিয়ে অতিঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, ইয়া মাবুদ! এ তো জিনের বাচ্চা
জহুর হাসার চেষ্টা করল, বলল, না আনোয়ারা বুবু। এইটা জিনের বাচ্চা না—
আনোয়ারা বাচ্চাটাকে দুই হাতে ধরে আতঙ্কে কাঁপতে থাকে, জিনের বাচ্চা! ইয়া মাবুদ! জিনের বাচ্চা!
জুহুর হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিজে কোলে নিয়ে বলল, না আনোয়ারা বুবু, এইটা জিনের বাচ্চা না। এইটা মানুষেরই বাচ্চা। আমার সামনে এই বাচ্চার জন্ম হয়েছে। বাচ্চার মাকে আমি নিজের হাতে কবর দিয়েছি।
আনোয়ারা তখনো থরথর করে কাঁপছে। জহুর হাসার চেষ্টা করে বলল, ভয়ের কিছু নাই বুবু। এইটা মানুষের বাচ্চা। বাচ্চাটার পাখা আছে সেইটাই হচ্ছে বিপদ। শহরের ডাক্তার এই মাসুম বাচ্চাটাকে নিয়ে মেরে ফেলতে চায়। কেটে কুটে দেখতে চায়। অনেক কষ্টে উদ্ধার করে এনেছি আনোয়ারা বুবু।
আনোয়ারা তখনো কোনো কথা বলল না, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। জহুর বলল, আনোয়ারা বুবু, জন্মের আগে থেকেই এই বাচ্চাটা বিপদে। যেই দেখে সেই তারে কেটে কুটে ফেলতে চায়। এর মা আমার হাত ধরে বলেছে একে বাঁচিয়ে রাখতে। সেই জন্যে চেষ্টা করছি!
আনোয়ারা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এইটা আসলেই মানুষের বাচ্চা?
হ্যাঁ। শহরের মানুষজনের হাত থেকে অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে এনেছি। এই চরে মানুষজন কম, এইখানে একে বড় করতে হবে। আনোয়ার বুবু তুমি বাচ্চাটাকে একটু বড় করে দাও।
আনোয়ারা আবার ভয়ে ভয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকালো। বাচ্চাটা তখন হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়, দাঁতহীন মাঢ়ির সেই হাসি দেখে খুব ধীরে ধীরে আনোয়ারার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। ফিসফিস করে বলল, বাচ্চাটার হাসি কত সুন্দর।
জহুর বলল, শুধু হাসি না আনোয়ারা বুবু, এই বাচ্চার সবকিছু সুন্দর। শুধু একটা জিনিস সুন্দর না। সেটা হচ্ছে কপাল।
আনোয়ারা আবার হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নেয়, নিজের গালের সাথে তার গাল স্পর্শ করে বলল, এই বাচ্চাটার কোনো নাম আছে?
জহুর নাথা নাড়ল, বলল, আমি তাকে বুলবুলি ডাকি। বুলবুলি পাখির মতোন শরীর সেই জন্যে নাম বুলবুল!
বুলবুল?
হ্যাঁ।
আনোয়ারা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বুলবুল নামটা সুন্দর। তোমার কী মনে হয় জহুর? এই বাচ্চা কি একদিন আকাশে উড়বে?
জানি না আনোয়ারা বুবু। আমি কিছুই জানি না।
আনোয়ারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বুলবুল নামের পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর বাচ্চাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।