ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

১.৬ আবার রহস্য

।।ছয়।। আবার রহস্য

আবার সেই নিঃসঙ্গ দুপুর।

সকালবেলায় সঞ্জয় চলে গেছে। তারপর রীণা পুপুকে স্নান করাল, খাওয়াল, ঘুম পাড়াল। এক ফাঁকে নিজের নাওয়া—খাওয়াও সেরে নিল। সব চুকতে চুকতে বেলা একটা। এই পর্যন্ত বেশ কাটে। এর পরের চারটে ঘণ্টাই এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্তু দুপুরে একটু ঘুমোত কিংবা বন্দনার মায়ের সঙ্গে গল্প করত। কিন্তু এখন ঘুম তেমন আসে না। দোতলায় যেতেও ইচ্ছে করে না। বন্দনার মা মানুষটি খুবই ভালো। সরল সাদাসিধে। অনেক মহিলার যেমন পরের সংসারের ব্যাপারে অহেতুক কৌতূহল থাকে এঁর সেরকম কিছু নেই। যে যা বলে শুনে যান। নিজের সংসারের সাধারণ ব্যাপার অকপটে বলেন। তাই এঁকে ভালো লাগে। মনে প্যাঁচ নেই। কিন্তু ইদানীং তাঁর কাছেও আর যাচ্ছে না। সঞ্জয় বলে দিয়েছে, সাবধান, ওসব কথা যেন বলে ফেলো না। রীণার ভয়, কথায় কথায় যদি বলে ফেলে!

ফলে দুপুরটা কাটানো এখন সমস্যা হয়ে উঠেছে। অবশ্য নতুন একটা অবলম্বন পেয়েছে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের সেই ছবিখানা।

ইচ্ছে ছিল ওটা বাঁধিয়ে রাখবে। কিন্তু পরের জিনিস। হয়তো ফেরত দিতে হবে। তাই বাঁধাতে পারেনি।

না বাঁধালেও ছবিটা টেবিলের কাছে একটা তাকের ওপর রেখে রোজ দুপুরে ফুল—পাতা দিয়ে পুজো করে। কেন পুজো করে তা ও জানে না। তবে ওর কেমন মনে হয় এ মানুষ সাধারণ লোক নয়।

এই নিয়েও সঞ্জয় তাকে খুব ঠাট্টা করে। রীণা চুপ করে থাকে। পুরুষমানুষের সব কথায় কান দিলে চলে না।

কিন্তু নির্বাক ছবি নিয়েই বা কতক্ষণ ভুলে থাকা যায়? একসময়ে শ্রান্তি আসে। তখনই আবার মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে।

আজও তেমনি হল। হঠাৎই একটা অস্থিরতা মনের ভেতর যেন কীরকম করছে। মনে হচ্ছে কিছু বুঝি ঘটতে চলেছে। বুঝি এখনই কারো জুতোর শব্দ পাওয়া যাবে সিঁড়িতে। কেউ বুঝি ভারী পা ফেলে উঠে আসবে।

রীণা তখনই নিজেকে ঝটকা মেরে ঠিক করে নিতে চায়। এসব কী আবোলতাবোল চিন্তা? কবে একদিন কী দেখেছিল সেই ভুলটাই শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসল নাকি? শেষ পর্যন্ত একটা মানসিক ব্যাধির শিকার হয়ে দাঁড়াবে?

তখনই মনে পড়ল সেদিন রাত্তিরের ব্যাপারটা। সেটাও কি ভুল? সেটাও কি মানসিক বিকার?

ভাবতে ভাবতে রীণার হাত দুটো কীরকম ঠান্ডা হয়ে গেল। কপালে চিনচিনে ঘাম। ও তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।

সামনেই যশোর রোড। শেষ আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ। বাস ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। লোক হাঁটছে ফুটপাথ উপচে।

একটা নীল রঙের বাস চলে গেল। ওটা বোধহয় কোনো ইস্কুলের বাস। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কলকাকলি। আঃ! রীণা যেন নিশ্বাস নিয়ে বাঁচল। বাচ্চারাই সংসার ভরে রাখে, একমাত্র ওরাই পারে শোক—দুঃখ ভুলিয়ে দিতে। তার পুপুসোনাও একদিন এমনি করে বাসে চেপে ইস্কুলে যাবে।

এমনি সময়ে দরজায় শব্দ হল—ঠুক—ঠুক। কে যেন অতি সন্তর্পণে দরজায় কড়া নাড়ছে। রীণা চমকে উঠল।

—কে? বলে সাড়া দিতে গেল। কিন্তু প্রথমে গলা থেকে স্বর বেরোল না।

তারপর অস্বাভাবিক তীক্ষ্ন আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল—কে?

—আমি বন্দনা।

তাও ভালো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল হঠাৎ বন্দনা কেন? ও তো বড়ো—একটা ওপরে আসে না। তবে কি কোনো ফোন—কোনো খারাপ খবর—

রীণা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

—আপনার চিঠি।

চিঠি! চিঠি আবার এখানে কে দেবে? কেন দেবে?

চিঠি নিতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল।

—কার চিঠি?

কথাটা স্বগতোক্তি। কিন্তু বন্দনার মনে হল যেন তাকেই জিজ্ঞেস করছে। সে অবাক হয়ে রীণার দিকে একবার তাকাল। তারপর নীচে নেমে গেল।

এবার চিঠি খোলার পালা। কিছুতেই আর রীণা চিঠিটা খুলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল কে লিখেছে? কী লিখেছে?

শেষ পর্যন্ত চিঠিটা খুলল। প্রথমেই দেখে নিল নামটা।—ও মান্তু! বাবাঃ! যা ভয় করেছিল।

চিঠিটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল।

ভাই রীণা,

তোর চিঠি পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি তা লিখে বোঝাতে পারব না।

কিছুদিনের জন্য আমরা সকলে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেইজন্যে চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। জানি আমার এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য কিছু মনে করবি না।

যাক, শেষ পর্যন্ত তুই কলকাতায় এলি। অনেক দিন পর আবার আমাদের দেখা হবে। অনেক গল্প জমে আছে।

কিন্তু তোর চিঠির শেষ দিকটার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। কলকাতার মতো জায়গায় নির্জন দুপুরে কীসের এত ভয়? এ তো আর আমাদের দেশের বাড়ি নয়! তবু তো বাঙ্গুরের মতো জায়গায় চট করে বাড়ি পেয়ে গেছিস। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

একটা ভয় অবশ্য আছে, চোর—ডাকাতের। তার চেয়েও ভয় ঠগ—জোচ্চেচারদের। কত ছুতো করেই—না ওরা বাড়ি বাড়ি ঢোকে। এসব ভয় এখন সব জায়গাতেই। খুব সাবধান। দরজা সব সময় বন্ধ করে রাখবি। সাড়া না নিয়ে দরজা খুলবি না। দরজায় আই—হোল নেই? না থাকলে ব্যবস্থা করে নিবি।

হ্যাঁ, তারপর লিখেছিস ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। সেটা নিশ্চয় স্বাভাবিক কোনো কারণে। হয়তো তোর লো প্রেশার আছে। কিংবা অন্য কিছু। সে তো ভালো বলতে পারবে তোর নিজের ডাক্তার।

ছোটোবেলায় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে নররাক্ষসের কথা হঠাৎ এতদিন পর মনে পড়ল কেন? নররাক্ষসের খেলা তো আমিও দেখেছিলাম। সত্যিই বীভৎস খেলা…

এই পর্যন্ত পড়েই রীণা আর পড়তে পারল না। শরীরটা কীরকম করে উঠল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।

.

সেই দিনই—

মাঝরাতে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে জেগে উঠল রীণা। এ সেই কান্না। যেন কিছুতে কামড়েছে।

রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে বুকে টেনে নিল। মায়ের বুকে নির্ভয় আশ্রয়ে থেকে কান্নাটা একটু কমল কিন্তু একেবারে থামল না।

রীণা পুপুকে চাপড়াতে চাপড়াতে ঘুম পাড়াতে লাগল বটে কিন্তু কান ছিল সজাগ। প্রতি মুহূর্তে একটা কিছুর প্রতীক্ষা!

কীসের প্রতীক্ষা?

একটু পরেই সেই শব্দ! নীচে কোথায় যেন কার ঘরের দেওয়ালে কে পেরেক পুঁতছে ঠক—ঠক—ঠক—

ক্রমশ সেই শব্দটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। কে যেন—পেরেক নয়—কিছু একটা পুঁততে পুঁততে ওপরে উঠে আসছে।….

তারপরেই সব চুপ।

কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই পরিষ্কার শুনতে পেলে জুতোর শব্দ। বাইরের বন্ধ দরজার কাছে এসে শব্দটা থামল। সঙ্গে সঙ্গে পুপু আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

আজ কিন্তু রীণা এতটুকু আত্মহারা হয়ে যায়নি। পুপুর এই যে কান্না এটা যে স্বাভাবিক নয় তা সে বুঝে নিয়েছে। যে এসেছে তার সঙ্গে এই কান্নার যোগ আছে। সে এও জানে বাইরে যে এসে দাঁড়িয়েছে বাইরে থেকেই সে চলে যাবে না। সে ভেতরে আসবেই।

রীণা তাই পুপুর কান্না শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারছিল।

এবার রীণা দুরু দুরু বুকে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল। অন্ধকার বাইরের ঘরে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ল সেটা হচ্ছে দুটো জ্বলন্ত চোখ। অন্ধকারে ভাসছে।

রীণা চেঁচাল না—কিংবা চেঁচাতে পারল না। এক হাতে পুপুকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে রইল।

রীণা দেখছে তো দেখছেই। সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেবার উপায় নেই।

একটু পরেই অন্ধকারের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম শরীর ভেসে উঠল। ক্রমে সেই শরীরের ওপর দেখা দিল কোট—প্যান্ট। কালো পোশাকটা অন্ধকারে যেন মিশে ছিল। এতক্ষণে ফুটে উঠল।

এই অবস্থাতেও—আশ্চর্য—রীণা তুলনা করছিল আগের রাতে দেখার সঙ্গে আজকের এই দেখা। সেদিন যেন সবই বড়ো তাড়াতাড়ি। সবই যেন অতর্কিতে। আর আজ? আজ যা ঘটছে সব ধীরে ধীরে—সময় মেপে মেপে।

কিন্তু এ দেখাও কি চোখের ভুল?

না, সে স্বপ্ন দেখছে না। জেগে আছে। এই তো পুপু বুকের মধ্যে মুখ গুঁজেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই তো মশারি টাঙানো। মেঝেতে মশারির মধ্যে পুপুর বাবা শুয়ে। ওই তো রাস্তায় লরির শব্দ…কোনোটাই তো ভুল নয়। তাহলে?

হঠাৎই দেখল মূর্তিটা টেবিলের কাছে পাক খাচ্ছে। একবার, দু’বার, তিনবার। তারপরেই জ্বলন্ত চোখ দুটো শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসতে লাগল। রীণা আর চুপ করে থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল—ওগো! শু—ন—ছ—

ধড়মড় করে উঠে বসল সঞ্জয়।

—অ্যাঁ, কি হয়েছে?

—আবার এসেছে—আবার এসেছে।

বলতে বলতে রীণা কেঁদে উঠল। পুপুও ঠিক তখনই ককিয়ে কাঁদতে লাগল।

মুহূর্তমাত্র।

সঞ্জয় টর্চ হাতে মশারি তুলে বাইরের ঘরে ছুটে গেল। সুইচ অন করার সময়ও পেল না।

অন্ধকারের মধ্যে ডাক্তারের হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ছিটকে পড়ল।

—না, কেউ কোথাও নেই।

এবার সঞ্জয় সব ঘরের সুইচ অন করে দিল। দু—খানা ঘর আলোয় ভরে গেল। দেখা গেল দরজা যেমন ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তেমনই বন্ধ রয়েছে।

—কই? কোথায় কে? বিরক্তির সঙ্গে বিদ্রুপ ঝলকে উঠল সঞ্জয়ের গলায়। রোজ রোজ এইভাবে Scene create করবে? ঘুম নষ্ট—তাছাড়া লোকেই বা কী বলবে? তোমার বোঝা উচিত—

রীণা শুধু ক্লান্ত স্বরে বলল—ও এসেছিল গো—সত্যিই এসেছিল। তুমি বিশ্বাস করো। উঃ! বুকের মধ্যে এখনো কীরকম করছে।

বলতে বলতে রীণা হঠাৎ মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

—কী হল? রীণা—রীণা—

রীণার বুকের ভেতর থেকে একটা ঘড়ঘড়ে স্বর বেরিয়ে এল। তারপর সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ইশারা করল।

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে এল। রীণা কোনোরকমে সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরে উঠে বসে গেলাস নিঃশেষ করে জল খেল। তারপর দেহ এলিয়ে খনখনে গলায় বলল, আমি মরে যাব। ও আমাকে মারবে। বেশ বুঝতে পারছিলাম লোকটা চোখে ইশারা করে আমাকে ডাকছিল। আমি জানি ওটা হচ্ছে মরণডাক। আমাকে বোধহয় মরতে হবে।

সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল, কী যা তা বকছ! এরকম করলে কালই তোমায় হাসপাতালে ভরতি করে দিয়ে আসব।

—তোমার যা ইচ্ছে তাই কর, যেখানে খুশি পাঠাও, আমি এখানে আর টিঁকতে পারব না।

—বেশ, তাই হবে। এখন বলো তো ঠিক কী দেখেছিলে।

সঞ্জয় একটা সিগারেট ধরাল।

রীণা সব ঘটনা বলে গেল।

ধৈর্য ধরে সঞ্জয় সব শুনে গেল। কথার মধ্যে নিজে একটি কথাও বলেনি।

রীণার কথা শেষ হলে বলল, টেবিলের কাছে ঘুরছিল?

—হ্যাঁ। টেবিল থেকে দেওয়াল। একবার মনে হল যেন দেওয়ালের মধ্যে মিশে গেল। তারপরেই দেখি আবার বেরিয়ে এসেছে। তারপরেই আমার দিকে চোখের ইশারা করতে করতে তাড়া করে এল।

শেষের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সঞ্জয় শুধু জিজ্ঞেস করল, আগের দিনও টেবিলের কাছে ঘুরছিল না?

—হ্যাঁ।

সঞ্জয় আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল।

দুটো ঘরেই এমনকি বাথরুমেও আলো জ্বলছিল। ভাড়াটেদের ঘুম ভেঙে থাকলে হয় তো ছুটে আসবে। সঞ্জয় তাই তাড়াতাড়ি সব আলো নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে শুধু জ্বলতে লাগল সঞ্জয়ের সিগারেটের আগুন।

মনে মনে বলল, নাঃ, একেবারে Psychopathic Patient হয়ে গেল! একই জনকে একজনেই প্রায় দেখছে। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত কি আমাকে অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করতে হবে?

পরের দিন সকালে বেশ একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙল সঞ্জয়ের। দেখল রীণা তখনো ঘুমোচ্ছে। জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে মশারির ওপর। এত বেলা পর্যন্ত রীণা কখনো ঘুমোয় না।

কিন্তু এই কি ঘুমন্ত চেহারা?

মেয়েদের স্বাভাবিক ঘুমের মধ্যেও একটা সুন্দর আকর্ষণী শক্তি থাকে। শোয়ার ভঙ্গিটি, শরীর জড়িয়ে শাড়ির বিন্যাস, শান্ত স্নিগ্ধ মুখের ওপর বন্ধ চোখের নিবিড় পাতা দুটি কেমন যেন মোহ সৃষ্টি করে। গভীর রাতে এই রীণাই যখন ক্লান্ত, পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমোয় তখন কতদিন সঞ্জয় অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে নিঃশব্দে লোভীর মতো দেখেছে। আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।

আর আজ? সেই রীণাই ঘুমোচ্ছে। কিন্তু পাণ্ডুর মুখের ওপর কীসের যেন ছায়া। হঠাৎ দেখলে মনে হবে রীণা যেন তার দেহটা ফেলে কোথায় কত দূরে চলে গেছে।

সঞ্জয়ের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ঠিক করল আজই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ডাঃ রুদ্রের সঙ্গে পরামর্শ করবে।

পুপু তখন জেগে। বিছানায় শুয়ে বেচারি একাই খেলা করছিল। তাকে একটু আদর করে সঞ্জয় মুখ ধুতে গেল।

মুখ ধুয়ে এসে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। পুপুর জন্যেও দুধ তৈরি করল।

বেলা যখন সাড়ে আটটা—সঞ্জয় যখন হাসপাতালে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন রীণা আলিস্যি ভেঙে পাশ ফিরল।

—ঘুম ভাঙল? আজ বেশ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ। বলে সঞ্জয় এক পেয়ালা চা নিয়ে এল।

—ইস! কত বেলা হয়ে গেছে। বলে রীণা ধড়মড় করে উঠে বসল।

—চা তুমি করলে?

—তা ছাড়া আর কে করবে? ভুতে আর যাই পারুক চা করতে পারে না। দ্যাখো, চিনি ঠিক হয়েছে কি না!

রীণা ধীরে ধীরে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিল।

—তোমার আজ দেরি হয়ে যাবে। আমি এখুনি যাচ্ছি।

সঞ্জয় কাছে বসে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমি এদিকের সব গুছিয়ে নিয়েছি। তুমি বরং হাত—মুখ ধুয়ে আর একটু শুয়ে থাকো।

—হ্যাঁ শরীরটাও যেন কেমন লাগছে।

—ও কিছু নয়। রাত্তিরে একটা ধকল গেছে। স্নানটান করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

—কী জানি! বলে চোখ নীচু করে অন্যমনস্কভাবে চা খেতে লাগল।

আধঘণ্টা পরে নীচে নেমে সঞ্জয় একবার এদিক—ওদিক দেখল। নাঃ, ভাড়াটেরা কেউ চড়াও করতে আসছে না। তখনকার মতো নিশ্চিন্ত হয়ে হাসপাতাল রওনা হলেও মনে মনে অস্বস্তি থেকেই গেল। বিকেলে নিশ্চয় ওরা এসে বলবে, কাল রাত্তিরেও আপনার ঘরে গণ্ডগোল হচ্ছিল ডাক্তারবাবু!

সঞ্জয়ের মনটা কুঁকড়ে গেল। সত্যি! রোজ রাত্তিরে রীণা যা কাণ্ড করতে আরম্ভ করেছে!

বিকেলে সঞ্জয় কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল চোখ—কান বুজে। না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল মহিমাবাবু—বিভূতিবাবুরা রোজকার মতো লোহার বেঞ্চিতে পা তুলে বসে গল্প করছে। বোধ হয় তাকে দেখেওছে। তারপর এখনই হয়তো মধুর সম্ভাষণ করবে—ডাক্তারবাবু, নমস্কার। ভালো আছেন তো?

সেই সম্ভাষণটুকু কানে পৌঁছোবার আগেই সঞ্জয় মুখ নীচু করে হনহন করে সিঁড়িতে গিয়ে উঠল।

যাক, আজকের মতো ফাঁড়া কাটল।

সঞ্জয় জোরে জোরে পা ফেলে ওপরে উঠতে লাগল। রীণা কেমন আছে? আজ দুপুরে আর ভয় পায়নি তো?

ফেরার পথে ডাক্তার রুদ্রের সঙ্গেও দেখা করে এসেছে। উনি ঠিকই বলেছেন—অ্যাডজাস্ট করার স্বাভাবিক শক্তির অভাব থেকেই এটা হচ্ছে। মফসসল থেকে শহরে কিংবা শহর থেকে মফসসলে নতুন পরিবেশে এসে পড়লে—সে পরিবেশ যদি মনের মতো না হয় তা হলে বিশেষ করে মেয়েদের নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। তা থেকেই এইরকম অনেক কিছু হয়। পরে জায়গাটা অভ্যস্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যায়।

—কিন্তু বাড়িটা তো ওর প্রথম থেকেই পছন্দ হয়েছিল।

ডাক্তার রুদ্র হেসেছিলেন।—ওটা তোমাকে খুশি করার জন্য।

সঞ্জয় চুপ করে ছিল। কথাটা তার মনঃপূত হয়নি।

ওপরে দরজার মুখেই পুপুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রীণা।

—কেমন আছ?

রীণা তার উত্তর না দিয়ে একটু ভারী গলায় বলল, কম্পাউন্ডে ঢুকে ওপরে তাকালে না যে?

কথাটার মানে সঞ্জয় প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল তখন মনে মনে খুশিই হল। অনেকদিন পর যেন সেই কুমারী রীণাকে দেখছে। সে—সব সময়ে নবদ্বীপে মামার বাড়ি এলে রীণার সঙ্গে একদিনও চোখের দেখাটুকু না হলে চলত না। মফসসল শহরে খুব স্বাভাবিক কারণেই রীণার বাড়িতে এই অনাত্মীয় যুবকটির কারণে—অকারণে যাওয়া, গল্প করায় কিছুটা বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। অগত্যা রাস্তার ধারে দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত রীণাকে। কখন সঞ্জয় রাস্তা দিয়ে যাবে।

ওই রাস্তা দিয়েই যখন—তখন কারণে—অকারণে সঞ্জয়কেও যেতে—আসতে হত। তখনই হত মিষ্টি হাসি—বিনিময়ের সঙ্গে চার চক্ষের গোপন মিলন। নিরুপায় নীরব প্রেমের এই মুষ্টি—ভিক্ষাটুকুই তখন ছিল যথেষ্ট।

একদিন ঠিক ওই বিশেষ মুহূর্তেই সামনে এসে পড়েছিল পাড়ার চক্রবর্তীমশাই। সঞ্জয় ওপরের দিকে তাকাতে পারেনি।

পরের দিন গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে রীণার সঙ্গে নিরিবিলিতে দেখা হয়েছিল। সঞ্জয় স্বভাবমতো হেসেছিল। রীণা কিন্তু হাসেনি। অভিমানক্ষুব্ধ স্বরে শুধু বলেছিল—কাল তাকালে না যে বড়ো?…

এ—সব অনেক দিনের কথা। তখন রীণা স্কুলে পড়ছে। সঞ্জয় পড়ছিল ডাক্তারি।

সেই রীণা বহুদিন পর আজ সেই একই সুরে জিজ্ঞেস করল, ওপরে তাকালে না যে?

সঞ্জয় হেসে বলল, তাকাবার ফুরসত পেলাম কই? নীচে তখন মহিমাবাবুরা আমাকে পাকড়াবার তালে। ধরতে পারলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করত, ডাক্তারবাবু, কাল রাত্তিরে আপনার ঘরে কীসের চেঁচামেচি হচ্ছিল? আগের দিন বেড়ালের ওপর দোষ চাপিয়েছি। আজ আর হাতের কাছে তেমন কিছু খুঁজে পেতাম না। তাই অধোবদনে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি।

বলেই রীণার কোল থেকে পুপুকে কেড়ে নিল।

রীণার মুডটা ভালো দেখে সঞ্জয় খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার এমন সরস বাচনভঙ্গি শুনে রীণা না হেসেই রান্নাঘরে চলে গেল। সঞ্জয়ের ঠিক ভালো লাগল না।

চা—জলখাবারের পাট চুকল একরকম নিঃশব্দেই। মন—মেজাজ ভালো থাকলে এই সময়ে রীণা বেশ গল্প করে। ও একাই বকে যায়। শ্রোতাকে শুধু মাঝে—মধ্যে ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ’ বলে সাড়া দিয়ে গেলেই হল। সেটাও খারাপ লাগে না।

কিন্তু আজ কেমন ব্যতিক্রম। রীণার হঠাৎ এরকম বাকসংযম দেখে সঞ্জয় অবাক হল।

কথা না বললেও রীণার মুখে কিন্তু এক টুকরো হাসি লেগেই ছিল। গল্প করছিল না, কিন্তু পুপুকে আদর করার মাত্রাটা একটু অস্বাভাবিক হচ্ছিল। আদরের সঙ্গে হাসি। শিশুর সঙ্গে এই রকম হাসির অর্থ কী? এই হাসির অন্য মানে আছে। এ একরকম উপেক্ষা।

রীণার এই উপেক্ষা—নীতির সঙ্গেও সঞ্জয়ের পরিচয় ছিল।

মান্তু রীণার বন্ধু। নবদ্বীপে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। সঞ্জয়ের মামা থাকত রীণাদের বাড়ির কাছাকাছি। সঞ্জয় মাঝেমাঝেই মামার বাড়ি নবদ্বীপে আসত। এই আসা—যাওয়ার সুযোগেই রীণা আর রীণার বান্ধবীটির সঙ্গে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা।

বাড়িতে কথা বলা সুযোগ হত না। তাই রীণাই একদিন সঞ্জয়কে মান্তুর বাড়ি যাবার জন্য বলেছিল।

রীণা গিয়েছিল যথাসময়ের অনেক আগে। সঞ্জয়ের যেতে দেরি হয়েছিল। এই হল তার অপরাধ! ব্যস! শ্রীমতী রীণা হলেন ভীষণ ক্রুদ্ধ। রাগটা অবশ্য মুখে প্রকাশ করল না। করল বিচিত্রভাবে। চৌকিতে বসে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে অনর্গল কথা বলে গেল মান্তুরই সঙ্গে। সামনে যে আর একজন বসে আছে—যাকে নাকি বিশেষ করে ডেকে আনা হয়েছে—তাকে চিনতেই পারল না।

রীণার আজকের আচরণটাও অনেকটা সেইরকম। সঞ্জয় যেন কেউ না।

—কী ব্যাপার? আজ যে আমার সঙ্গে বড়ো একটা কথা বলছ না?

রীণার মুখে ফুটে উঠল আবার বিচিত্র হাসি।—আমি রুগি, তুমি ডাক্তার। ডাক্তারের সামনে রুগিকে রুগির মতোই থাকতে হয়। তাই না? কথাগুলো রীণা বলল যেন দাঁতে কেটে কেটে।

—যা বাবাঃ! আজ হল কী?

—হাসপাতালে—মানে মেন্টাল হসপিটালে কোনো বেডটেডের ব্যবস্থা করতে পারলে নাকি?

রীণার কথায় যেন বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল।

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, কার জন্যে?

—সে কী! এরই মধ্যে ভুলে গেলে? তোমার স্ত্রীর জন্যে গো! যার মাথার ব্যামো হয়েছে, নার্ভ ফেল করে। বলেই পুপুকে রেখে রীণা হঠাৎ উঠে চলে গেল।

এক—একটা সময়ে এই—সব মান—অভিমান স্বামীদের ভালোই লাগে। কিন্তু তাই বলে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে এই মানসিক কসরত আর ভালো লাগে না।

সঞ্জয় একটু রাগ করেই পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল।

—কোথায় যাচ্ছ?

—পুপুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।

—এই সন্ধেবেলায়?

—কী করব? রুগির সামনে বসে থাকতে থাকতে সুস্থ মানুষও রুগি হয়ে যায়।

রীণা আবার একটু হাসল। সেই কেমন—কেমন হাসি। নীচে যাবে তো? কিন্তু মহিমবাবুরা এখনও বসে আছেন।

—মাই গড! সঞ্জয় এক লাফে সিঁড়ি থেকে ঘরে এসে ঢুকল।

—কফি খাবে?

—আবার কষ্ট করে করবে?

—আমিও খাব। বলেই রীণা চলে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর দু—কাপ কফি নিয়ে এসে বসল। একটা কাপ যেন একটু অতিরিক্ত যত্নে সঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিল। চোখাচোখি হল।

—তখন থেকে তুমি অমন ঠোঁট টিপে টিপে হাসছ কেন বলো তো।

রীণা হেসেই বলল, বাঃ রে! রুগি বলে কি হাসতেও মানা নাকি?

—তা নয়। হাসিটা যেন কেমন—কেমন লাগছে।

রীণা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে উদাস সুরে বলল, তা হবে। মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ।

কফিতে আরাম করে একটা চুমুক দিয়ে সঞ্জয় সিগারেট ধরাল।

—না, ও হাসি আর যাই হোক মাথা খারাপের লক্ষণ নয়।

—তবে? রীণা খুব হালকা করে কফিতে চুমুক দিল।

—মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাইছ। এমন কিছু যা শুনে আমি অপ্রস্তুতে পড়ি।

—ও মা! সে কী কথা!—ইস! কফিতে চিনি কম হয়েছে। আমার সত্যি মাথার ঠিক নেই। বলে রীণা হঠাৎই উঠে গেল। তারপর বেশ একটু দেরি করে সুগার—পটটা এনে টেবিলে রাখল। তা থেকে সামান্য একটু চিনি তুলে কফিতে মিশয়ে নিয়ে বলল, তুমি ডাক্তার মানুষ! তোমায় আমি অপ্রস্তুতে ফেলতে পারি? না হয় আমি মানসিক রুগিই। তা বলে নিজের স্বামীকে অপ্রস্ততে ফেলা। ছিঃ!

সঞ্জয়ের পক্ষে ধৈর্য ধরা অসম্ভব হয়ে উঠল। বলল, দোহাই তোমার! আর রহস্য কোরো না। ব্যাপারটা কী আমায় খুলে বলো।

—ব্যাপার আবার কী? যথা পূর্বং তথা পরম।

—সারা দুপুর কী করলে?

রীণা আবার একটু হাসল।—অ—নে—ক কাজ। তুমি চলে গেলে দরজায় ভালো করে খিল দিলাম। তারপর পুপুকে চান করালাম, খাওয়ালাম। নিজে চান করলাম, খেলাম। একটু ঘুমোলাম।

—ঘুম হল?

—হুঁ—হুঁ বলে আদুরে মেয়ের মতো মাথা দোলাল। তারপর ঘুম থেকে উঠে ট্রানজিস্টারটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম।

—ভয়টয় পাওনি তো?

—ভয়? কী জানি। মনে নেই।

—ভেরি গুড! মনে না থাকাই ভালো।

—ততক্ষণে পুপু উঠে পড়েছে। ওকে নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে দোতলায় গেলাম। বন্দনার মায়ের সঙ্গে একটু গল্পও করলাম। তারপর ওপরে এসে জলখাবার করতে বসলাম। জলখাবার হয়ে গেলে পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তুমি এলে। ব্যস! আমার কথাটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল। ও হ্যাঁ, এর মধ্যে মান্তুকে একটা চিঠিও লিখলাম।

—কী লিখলে?

—সে—সব আমাদের প্রাইভেট কথা। তোমায় বলব কেন? বলে কফির পেয়ালাটা সরিয়ে রাখল।

—অবশ্য তোমার কথাও ছিল। হাসপাতালের ডিউটির পর পেশেন্ট দেখতে গিয়েছিলে। মহিলা পেশেন্ট বোধহয়, নইলে রাত নটা পর্যন্ত থাকবে কেন? বুক, পেট, তলপেট ভালো করে দেখতে হয়েছিল তো।

—ইস! এইসব বাজে কথা লিখেছ!

—হুঁ—উ। তারপর লিখেছি, কে একজন তোমাকে একটা বুড়োর ছবি দিয়েছিল। সেই ছবির কথাও লিখেছি। সাংঘাতিক চোখ, যেন ত্রিকালদর্শী তান্ত্রিক।

—সেই ছবিটা পুজো করছ লিখেছ নাকি?

—ইস! অ্যাশট্রে রয়েছে তবু কাপে ছাই ফেলছ! কী যে বদ অভ্যেস! বলে তাড়াতাড়ি কাপটা সরিয়ে নিল।

—সরি।

—হ্যাঁ, পুজো করছি, ফুলের মালা পরাচ্ছি সবই লিখেছি। বন্ধুর কাছে কিছুই লুকোনো উচিত নয়।

—তা বেশ করেছ। কিন্তু ছবিটা নিয়েও তুমি একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছ। কী এমন আছে ছবির মধ্যে?

—তা দেখার চোখ তোমার নেই। থাকলে একথা বলতে পারতে না।

—ছবিটা নিয়ে এসো তো। ভালো করে দেখি একবার।

—কি হবে দেখে?

—নিয়েই এসো না।

রীণা চেয়ারে দু—পা তুলে হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকোল।

—তুমি নিয়ে এসো।

—আমি ছুঁলে ছবিটা অশুদ্ধ হবে না তো? বলে সঞ্জয় হাসতে হাসতে উঠে গেল। রীণা কোনো উত্তর দিল না। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল।

বাইরের ঘর থেকে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ছবিটা কোথায়?

রীণা উত্তর দিল না।

—এই শুনছ? ছবিটা তো তুমি তাকের ওপর রেখেছিলে। দেখছি না তো।

—তাহলে নেই।

—নেই মানে? অন্য কোথাও রেখেছ?

—জানি না।

সঞ্জয় যেন হোঁচট খেল—জানি না মানে?

রীণা এবার চেয়ার থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে গেল—বলো কী বলছ?

—ছবিটা কোথায় গেল?

রীণা উত্তর না দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ওটা আর পাওয়া যাবে না। হারিয়ে গেছে।

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, হারিয়ে গেছে মানে?

রীণা ধীর—স্থিরভাবে বলল, হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।

—অসম্ভব। আগের দিন ছবিটা তাকের ওপর রাখলে, এরই মধ্যে হারিয়ে গেল? আর হারাবেই বা কোথায়?

রীণা গম্ভীর গলায় বলল, তাহলে চুরি গেছে।

—চুরি! কে চুরি করল? বাড়িতে কে—ই—বা আসে? কেনই—বা চুরি করবে?

রীণা হালকা মেজাজে টেবিল থেকে ট্রানজিস্টারটা তুলে নিয়ে কাঁটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, গেলাসটা সেদিন কে ভাঙল! কী করে ভাঙল?

সঞ্জয় যেন অন্ধকারে চলতে চলতে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেল।

মিনিট কয়েক দুজনেই চুপচাপ। তারপর রীণা ট্রানজিস্টারটা রেখে দিয়ে যেন আপন মনেই বলল, শুধু একটা গেলাস ভাঙা বা ছবি চুরি যাওয়া নয়। আরো কিছু যাবে। তার মধ্যে আমার প্রাণ একটি। অবশ্য তাতে তোমার কিছু এসে যাবে না। পুপুটারই কষ্ট হবে।

—বাজে কথা ছাড়ো তো। ছবিটা কি সত্যিই কেউ নিল?

—আমায় জিজ্ঞেস করছ? রীণা এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।

—হ্যাঁ—হ্যাঁ তোমাকে। তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে?

—তাহলে আমি বলছি—হ্যাঁ, ছবিটা সত্যিই কেউ নিল। যে নিতে এসেছিল সে নিয়ে গেল।

—কিন্তু কেন নিয়ে গেল?

রীণার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি।—কে নিয়ে গেল ভাবছ না?

সঞ্জয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, না হয় ধরেই নিলাম ভূতে নিয়েছে। কিন্তু কেন? এত জিনিস থাকতে শিবানন্দর ছবিটার ওপরই তেনার দৃষ্টি পড়ল!

রীণা বলল, তুমি বোধহয় ভুলে যাওনি আমি বলেছিলাম—আগের দিনও সে টেবিলের কাছে ঘুরছিল। অসাবধানেই হোক বা ভয় দেখাবার জন্যেই হোক সেদিন গেলাসটা ভেঙেছিল।

এই পর্যন্ত বলে রীণা একটু থামল। সঞ্জয়ও চুপ করে রইল।

—তুমি কি বলতে চাইছ সেদিনও ছবিটা নেবার জন্যেই এসেছিল?

—হ্যাঁ।

—নিল না কেন?

—বোধহয় ওটা টেবিলে বা টেবিলের কাছে ছিল না।

—হ্যাঁ, ওটা ভুল করে ব্যাগেই থেকে গিয়েছিল।

সঞ্জয় আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল, বেশ। না হয় প্রেতাত্মাটি ছবিটার জন্যই এসেছিল। কিন্তু কেন? নিশ্চয় বৃদ্ধের প্রেমে পড়েনি?

রীণা কষ্টে একটু হাসল। বলল, এখনো রসিকতা করতে পারছ? ভাবতে পারছ না, কী সর্বনাশ এগিয়ে আসছে!

সঞ্জয় হাসল না। বলল—আমি যা জানতে চাইলাম ওটা তার উত্তর হল না।

রীণা বলল, ঠিক উত্তর আমিই বা কী করে জানব?

—আচ্ছা, ছবিটার পেছনে কী যেন লেখা ছিল? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।

—পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে স্নেহোপহার।

—আরও যেন কিছু লেখা ছিল মনে হচ্ছে।

—হ্যাঁ, শিবানন্দর স্বাক্ষর।

—আর কিছু ছিল না?

—ছিল। শিবানন্দ ভট্টাচার্যর ঠিকানা।

সঞ্জয় হঠাৎ বলে উঠল—তাহলে কি ঠিকানার জন্যেই? কিন্ত ঠিকানা নিয়ে ও কি করবে? শিবানন্দর সঙ্গে দেখা করবে! বলে একটু হাসবার চেষ্টা করল।

রীণা শান্ত গলায় বলল—অন্যরকমও হতে পারে। তুমি যেন দেখা করতে না পার।

সঞ্জয় বিছানায় একটা ঘুসি মেরে বলল—দেখা করি এটাই বা চায় না কেন? তোমার ওই প্রেতাত্মাটির সঙ্গে শিবানন্দর সম্পর্ক কী?

রীণা কোনো কথা বলল না। একটা রহস্যময়ী ছায়ার মতো ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ভেতরের ঘরে চলে গেল।