ডক্টর সেলিম বিস্ফারিত চোখে কেবিনেটে উপুড় করে রাখা শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। ছোট বাচ্চাটি তার মাথাটি উঁচু করার চেষ্টা করছে, ঘাড় এখনো শক্ত হয়নি তাই মাথাটা অল্প অল্প দুলছে। একটা হাতে নিজেকে ভর দিয়ে রেখেছে, অন্য হাতটা নিজের মুখে। ছোট মুখে তার হাতটা ঢোকানো সম্ভব নয়, বাচ্চাটি সেটা জানে না, সে প্রাণপণে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তার বড় বড় চোখ, সে সামনে তাকিয়ে আছে কিন্তু আলাদা করে কিছু একটা দেখছে বলে মনে হয় না।
ডক্টর সেলিম অবশ্যি ছোট শিশুটির এসব কিছুই দেখছিল না, সে হতবাক হয়ে বাচ্চাটির পিঠের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেখানে ছোট ছোট দুটি পাখা এবং পাখাগুলো মাঝে মাঝে নড়ছে। ডক্টর সেলিম সাবধানে একটা পাখাকে স্পর্শ করতেই পাখাটা একটা ছোট ঝাঁপটা দিল এবং ডক্টর সেলিম সাথে সাথে তার হাত সরিয়ে নিল। সে ঝুঁকে পড়ে পিঠের ঠিক যেখান থেকে পাখাটা বের হয়ে এসেছে সে জায়গাটুকু লক্ষ করল, তারপর সোজা হয়ে। দাঁড়িয়ে জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কার বাচ্চা? কোথা থেকে এসেছে?
বাচ্চার দায়িত্ব কার, সেটা যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলা যায় দায়িত্ব আমার।
বাচ্চাটার পাখা কোথা থেকে এসেছে?
জহুর জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, সেইটা অনেক বড় ইতিহাস।
ইতিহাসটা কী? বাচ্চাটা কার? বাবা-মা কে?
বাবা নাই। টেস্টটিউব বেবি না কী বলে সেইটা—আপনারা ভালো বুঝবেন। আর মা–
মা?
মা মারা গেছে। বাচ্চাটা জন্ম দেয়ার পরই মারা গেছে। মারা যাওয়ার সময় আমার হাত ধরে আমাকে বাচ্চাটা দিয়ে গেছে। বলেছে দেখে শুনে রাখতে। বলেছে—
শিশুটির মা মৃত্যুর ঠিক আগে জহুরকে কী বলে গেছে ডক্টর সেলিম সেটা শুনতে কোনো আগ্রহ দেখাল না, জিজ্ঞেস করল, এই বাচ্চাটাকে দেখে ডাক্তাররা কী বলেছে?
জহুর বলল, কোনো ডাক্তার বাচ্চাটারে দেখে নাই। আপনি প্রথম।
ডক্টর সেলিম কেমন যেন চমকে উঠল, বলল, আমি প্রথম? এর আগে কেউ দেখে নাই?
না।
বাচ্চাটার যখন জন্ম হয়—
কেউ ছিল না। শুধু আমি।
শুধু আপনি? কেন?
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস।
ডক্টর সেলিমের লম্বা ইতিহাস শোনার ধৈর্য নেই, জিজ্ঞেস করল, আমার আগে কোনো ডাক্তার এই বাচ্চাকে দেখে নাই?
শুধু ডাক্তার না, কোনো মানুষও দেখে নাই।
ডক্টর সেলিমের চোখ দুটি চকচক করে ওঠে, কোনো মানুষ দেখে নাই?
নাহ। জহুর ইতস্তত করে বলল, বুঝতেই পারছেন। এই বাচ্চাটাকে কেউ দেখলেই হইচই শুরু করে দেবে।
ডক্টর সেলিম মাথা নাড়ল, বলল, সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি আর কাউকে না দেখিয়ে যে আমার কাছে এনেছেন সেটা ঠিকই করেছেন।
জহুর বলল, জি। আমি চাই না এটা জানাজানি হোক। যাই হোক আমি আপনার কাছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছি।
কী উদ্দেশ্য।
জহুর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এর ডানা দুটি কেটে দিবেন।
ডক্টর সেলিম একটু চমকে উঠল, কেটে দিব?
জি স্যার। এর পাখা দুটি কেটে দিলে তাকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না। তা না হলে এর জীবনটা অসহ্য হয়ে উঠবে।
ডক্টর সেলিম সাবধানে বাচ্চাটার পাখাটা স্পর্শ করে জুহুৱের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। পাখা নিয়ে বড় হলে এর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
এই অপারেশন করতে কত লাগবে আমাকে বলবেন? আমি খুব গরিব মানুষ, অনেক কষ্টে কিছু টাকার ব্যবস্থা করেছি।
ডক্টর সেলিম বলল, আরে! কী বলছেন আপনি। এই বাচ্চাটাকে ঠিক করে দেয়ার টাকা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন?
জহুর ডক্টর সেলিমের মুখের দিকে তাকালো, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এই মানুষটি আসলে তার সাথে মিথ্যা কথা বলছে। বাচ্চাটার অপারেশন করা থেকে অন্য কিছুতে তার আগ্রহ বেশি। সাথে সাথে তার মুখ কঠিন হয়ে যায়। সে শীতল গলায় বলল, ডাক্তার সাহেব।
বলেন।
আপনি আমাকে বলেন কত খরচ হবে। আমি তারপর অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যাব।
ডক্টর সেলিম ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে কেন?
একটা বাচ্চার পিঠে পাখা থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার না, সেটা কয়েকজনকে দেখিয়ে ঠিক করা ভালো।
ডক্টর সেলিম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হলো, মেয়ের গলায় কেউ একজন বলল, স্যার।
ডক্টর সেলিম অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে একটা টাওয়েল দিয়ে বাচ্চাটার ঘাড় পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে বলল, কে? নাসরীন?
জি স্যার। ডক্টর সেলিম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে কম বয়সী একটা মেয়ে ডক্টর সেলিমের চেম্বারে ঢুকে গেল। তার শরীরে ডাক্তারের সবুজ রঙের অ্যাপ্রন, গলায় স্টেথিস্কোপ। চোখে চশমা, চেহারায় কেমন জানি এক ধরনের সজীবতা রয়েছে।
ডক্টর সেলিম বলল, কী ব্যাপার?।
নাসরীন নামের ডাক্তার মেয়েটা বলল, চার নম্বর কেবিনের বাচ্চাটা। আমার মনে হয় সার্জারি না করাটাই ঠিক হবে যেহেতু ফিফটি ফিফটি চান্স, ফেমিলির ওপর বার্ডেন না দেয়াই ভালো।
ডক্টর সেলিম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে নাসরীন হঠাৎ করে ক্যাবিনেটে শুইয়ে রাখা বাচ্চাটাকে দেখে এবং সাথে সাথে তার মুখে মধুর এক ধরনের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সে কাছে এগিয়ে বলে, ও মা! কী সুন্দর বাচ্চাটা! একেবারে পরীর মতো চেহারা!
ডক্টর সেলিম হাত দিয়ে নাসরীনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাছে যেয়ো না।
নাসরীন অবাক হয়ে বলল, কেন স্যার?
ডক্টর সেলিম আমতা আমতা করে বলল, এটা স্পেশাল কেস। এটার জন্যে বিশেষ একটা ব্যবস্থা দরকার।
নাসরীন জহুরের দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, স্পেশাল কেস? কী হয়েছে?
জহুর মেয়েটির মুখের দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে কেমন যেন আশ্বস্ত অনুভব করে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, আপা। আপনিও দেখেন।
ডক্টর সেলিম জহুরকে থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু জহুর তাকে ঠেলে সরিয়ে কাছে গিয়ে বাচ্চাটার উপর থেকে টাওয়েলটা সরিয়ে নেয়।
নাসরীন বাচ্চাটাকে দেখে বিস্ময়ে একটা চিৎকার করে ওঠে। অনেকক্ষণ সে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে রাখে, তারপর কাছে গিয়ে প্রথমে তাকে আলতোভাবে স্পর্শ করে, তারপর সাবধানে তাকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটি নাসরীনকে দেখে তার দাঁতহীন মুখে একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার চশমাটা ধরার চেষ্টা করল।
কয়েক মুহূর্ত নাসরীন কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর একটু চেষ্টা করে বলল, একেবারে পাখির পালকের মতো হালকা!
জহুর মাথা নাড়ল, কি আপা। একেবারে হালকা, কিন্তু বাচ্চাটা অনেক শক্ত।
এটা কার বাচ্চা?
জহুর বলল, সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস।
নাসরীনের ইতিহাসটা শোনার কৌতূহলের অভাব নেই, জিজ্ঞেস করল, কী ইতিহাস শুনি। বলেন।
ডক্টর সেলিম এই বারে বাধা দিল, বলল, নাসরীন, তুমি বাচ্চাটাকে ক্যাবিনেটে রেখে দাও। আর খবরদার এর কথা কাউকে বলবে না। কাউকে না। নেভার।
নাসরীন সাবধানে বাচ্চাটাকে ক্যাবিনেটে রেখে বলল, ঠিক আছে স্যার বলব না। কিন্তু স্যার এটা কেমন করে সম্ভব?
সেটা আমি এখনো জানি না, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ এটা সম্ভব।
জহুর নাসরীনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা। আপনিও তো ডাক্তার। তাই না?
হ্যাঁ। আমিও ডাক্তার তবে খুবই ছোট ডাক্তার। মাত্র পাস করেছি। সে ডক্টর সেলিমকে দেখিয়ে বলল, স্যার আমাদের মাঝে সবচেয়ে বড় ডাক্তার। ডাক্তারদেরও ডাক্তার।
জহুর কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বড় ডাক্তারের চেয়ে এই ছোট ডাক্তারের মাঝে এক ধরনের ভরসা খুঁজে পেল। সে নিচু গলায় বলল, আপা। এই বাচ্চাটার ডানা দুটি আমি অপারেশন করে কাটতে চাই–
নাসরীন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি আমাদের কাছে এনেছেন, যেটা তার জন্যে ভালো হয় সেটাই করা হবে।
জহুর সাথে সাথে কেমন করে জানি বুঝতে পারল এই মেয়েটি যে কথাগুলো বলছে সেটা সে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেই বলছে। সে এবারে ঘুরে নাসরীনের দিকে তাকালো, বলল, আপা আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি। এই ছেলেটার জন্যে এই পাখা দুইটা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো গতি নাই। যদি তার পাখা থাকে সে হবে একটা চিড়িয়া। যেই তাকে দেখবে সেই তাকে ধরে সার্কাসে বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করবে।
নাসরীন মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এ রকম একটা বাচ্চা এত আশ্চর্য যে সায়েন্টিফিক কমিউনিটি যখন জানবে তখন একেবারে পাগল হয়ে যাবে!
পাগল হয়ে যাবে?
হ্যাঁ।
পাগল হয়ে কী করবে?
দেখতে চাইবে। বুঝতে চাইবে।
কেমন করে দেখাতে চাইবে?
নাসরীন বলল, সেটা আমি ঠিক জানি না। বৈজ্ঞানিকদের সবকিছু নিয়ে কৌতূহল থাকে।
জহুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপা, বৈজ্ঞানিকরা যেন এই বাচ্চার খোঁজ না পায়।
কেন?
বাচ্চার মা আমার হাত ধরে দায়িত্বটা দিয়ে গেছে। মারা যাবার ঠিক আগে আমাকে বলেছে—
জহুর একটু আগেই ঘটনাটা ডক্টর সেলিমকে বলার চেষ্টা করেছিল সে শুনতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, নাসরীন খুব আগ্রহ নিয়ে শুনল এবং শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, শুনে আমার খুবই খারাপ লাগছে, বেচারি এত কম বয়সে এত বড় কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। আহারে!
জহুর বলল, আমি চাই না বাচ্চাটাও কষ্টের ভেতর দিয়ে যাক। সেই জন্যে বড় হবার আগেই তার পাখা দুটি কেটে ফেলতে চাই।
নাসরীন একবার ডক্টর সেলিমের দিকে তাকালো তারপর ইতস্তত করে বলল, আপনার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমরা তো এত ছোট বাচ্চার ওপর হঠাৎ করে এ রকম একটা অপারেশন করে ফেলতে পারি না। কিছু করার আগে এর এনাটমিটা বুঝতে হবে। মানুষের শরীরে কোথায় কী আমরা জানি কোন গুরুত্বপূর্ণ আর্টারি কোন দিক দিয়ে গিয়েছে সেটা। আমাদের শিখানো হয়। কিন্তু এই বাচ্চাটা তো অন্য রকম, কোনো রকম স্টাডি না করে চট করে পাখা দুটি তো কেটে ফেলতে পারি না।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে। সেটা আমি বুঝতে পারছি। আপনি তাহলে একটু দেখেন, দেখে বলেন—
ডক্টর সেলিম এবারে আলোচনায় যোগ দেয়ার চেষ্টা করল, বলল, আমিও তো আপনাকে সেটাই বলছিলাম। আমরা একটু স্টাডি করে দেখি।
জহুর ডক্টর সেলিমের দৃষ্টি এড়িয়ে নাসরীনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ লাগবে বলতে?
নাসরীন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ডক্টর সেলিম বাধা দিয়ে বলল, এক সপ্তাহ তো মিনিমাম।
উঁহু। জহুর মাথা নাড়ল, এই বাচ্চাকে এক সপ্তাহ হাসপাতালে রাখার ক্ষমতা আমার নাই–
সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। এইটা আমাদের নিজস্ব হাসপাতাল, আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেব। আপনি বাচ্চাটাকে রেখে যান, এক সপ্তাহ পরে আসেন।
জহুর ডক্টর সেলিমের দিকে তাকিয়ে তার কথাটি শুনল, কিন্তু উত্তর দিল নাসরীনের দিকে তাকিয়ে, বলল, আপা! এই বাচ্চাটার তো মা নাই, আমি বুকে ধরে মানুষ করেছি। আমি তো তারে এক সপ্তাহের জন্যে রেখে যেতে পারব না।
নাসরীন বলল, ছোট বাচ্চাদের বেলায় আমরা মাদের সাথে থাকতে দেই। এই বাচ্চাটার জন্যে আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে থাকতে দেব।
ডক্টর সেলিম বাধা দিয়ে বলল, না-না-না সেটা এখনই বলা যাবে। আমাদের স্টাডি করতে সময় নেবে, সব সময় আপনি থাকতে পারবেন না। এটা খুবই আনয়ুজুয়াল কেস।
জহুর এবার এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটিকে কাপড়ে জড়িয়ে কোলে তুলে নিতে থাকে, ডক্টর সেলিম অবাক হয়ে বলল, কী করছেন? আপনি কী করছেন?
আমি এই বাচ্চাকে এক সেকেন্ডের জন্যেও চোখের আড়াল করব না। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছি। অন্য কোথাও যাব।
ডক্টর সেলিম বলল, দাঁড়ান। দাঁড়ান আগেই এত ব্যস্ত হবেন না। দেখি অমির কী করা যায়।
জহুর নাসরীনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা। আপনি যদি বলেন তাহলে আমি থাকব, তা না হলে আমি আমার এই বাচ্চাকে নিয়ে চলে যাব।
নাসরীন একটু অবাক হয়ে একবার ডক্টর সেলিমের দিকে আরেকবার জহুরের দিকে তাকালো, তারপর ইতস্তত করে বলল, আমি খুব জুনিয়র ডাক্তার। এই স্যারের আন্ডারে কাজ করি, কাজ শিখি। আমার কথার কোনো গুরুত্ব নাই, আপনাকে এই স্যারের কথা বিশ্বাস করতে হবে।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, আমি খুব গরিব মানুষ, সাধারণ মানুষ। কে কী করে আমি জানি না। আমি মানুষের মুখের কথায় বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত নেই। আপা, আপনি আমাকে যদি বলেন আমি থাকব, তা না হলে আমি চলে যাব।
ডক্টর সেলিম জহুরকে বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে-আপনি পাঁচ মিনিট এই ঘরে বসেন। আমি নাসরীনের সাথে দুই মিনিট কথা বলে আসছি।
ডক্টর সেলিম নাসরীনকে একরকম জোর করে পাশের ঘরে নিয়ে গেল, তার চোখে-মুখে উত্তেজনা, বড় বড় করে নিঃশ্বাস পড়ছে, নাসরীনের হাত ধরে চাপা গলায় বলল, নাসরীন।
জি স্যার।
তুমি নিশ্চয়ই ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছ।
জি স্যার।
এই বাচ্চাটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাইজ। একে আমাদের দরকার। যে কোনো মূল্যে।
নাসরীন ভুরু কুঁচকে বলল, যে কোনো মূল্যে?
হ্যাঁ। কোনো একটা কারণে এই মানুষটা আমাকে বিশ্বাস করছে না কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করছে। বুঝেছ?
জি স্যার।
কাজেই তুমি তাকে বোঝাও। শান্ত কর, যেন বাচ্চাটাকে নিয়ে না যায়। আমার দুই ঘণ্টা সময় দরকার।
দুই ঘণ্টা!
হ্যাঁ।
নাসরীন ইতস্তত করে বলল, কিন্তু স্যার—
ডক্টর সেলিম অধৈর্য গলায় বলল, এর মাঝে কোনো কিন্তু নাই। তুমি যাও, মানুষটার সাথে কথা বল, তাকে আশ্বস্ত কর। আমি এর মাঝে ব্যবস্থা করছি।
কী ব্যবস্থা? সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তুমি যাও।
নাসরীন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ডক্টর সেলিম তাকে সেই সুযোগ দিল না। একরকম ধাক্কা দিয়ে তার চেম্বারে পাঠিয়ে দিল।
চেম্বারের মাঝামাঝি জহুর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখ পাথরের মতো কঠিন। নাসরীনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, আপা।
জি।
আমি কি বাচ্চাটাকে নিয়ে থাকব নাকি চলে যাব?
নাসরীন ইতস্তত করে বলল, এই বাচ্চাটাকে নিয়ে দশ জায়গায় যাওয়া হয়তো ঠিক হবে না। যত কম মানুষ এই বাচ্চাটার কথা জানে তত ভালো। আপনি যখন এখানে এসেছেন মনে হয় আপাতত এখানেই থাকেন। এটা একটা খুব সম্রান্ত হাসপাতাল, বড় বড় মানুষেরা থাকে। তারা মিলে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারবেন।
জহুর নাসরীনের চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে আপা। আমি আপনার কথায় বিশ্বাস করে থাকলাম।
ঠিক কী কারণে জানা নেই, নাসরীন নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে কোনো একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে, যেটা সঠিক নয়—সেটা কী হতে পারে সে ঠিক বুঝতে পারছিল না।
ঘণ্টা দুয়েক পরে নাসরীন অবশ্যি ব্যাপারটা বুঝতে পারল। একটা পুলিশের গাড়ি হাসপাতালের পাশে এসে দাঁড়াল এবং গুরুত্ত্বপূর্ণ চেহারার কয়েকজন মানুষ ডক্টর সেলিমের সাথে এসে দেখা করল। তারা অফিসে কিছুক্ষণ নিচু গলায় কথা বলল, তারপর সবাই মিলে ডক্টর সেলিমের চেম্বারে হাজির হলো। বাচ্চাটি অনেকক্ষণ নিজে নিজে খেলা করে এখন উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে গেছে—ঘুমানোর ভঙ্গিটা একটু বিচিত্র, পেছন দিকটা উঁচু দুই পা গুটিশুটি হয়ে আছে। মুখে বিচিত্র একটা হাসি, পিঠের পাখা দুটি মাঝে মাঝে নড়ছে। ডক্টর সেলিম বাচ্চাটিকে এক নজর দেখে জহুরের দিকে তাকালো, বলল, আমরা আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।
জহুর মানুষগুলোর দিকে তাকালো, নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়েই সে ব্যাপারটা বুঝে যায়। সে ক্লান্ত গলায় বলল, কী কথা।
ডক্টর সেলিম মুখটা অনাবশ্যকভাবে কঠিন করে বলল, এই বাচ্চাটাকে আপনাকে আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে।
কেন?
এটি আপনার বাচ্চা না। এই বাচ্চার উপরে আপনার কোনো আইনগত অধিকার নেই। শুধু তাই না—আপনি বাচ্চাটির পাখা কেটে ফেলতে গেছেন, সেটা অমানবিক। আপনি এই বাচ্চাটির প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে চাইছেন।
জহুর শীতল চোখে কিছুক্ষণ ডক্টর সেলিমের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, এই বাচ্চাটির মা আমাকে এই বাচ্চাটা দিয়ে গেছে। দিয়ে বলেছে দেখে-শুনে রাখতে
ডক্টর সেলিম এবারে হাসার মতো এক ধরনের শব্দ করল, বলল, আপনি কয়েকবার এই কথাটা বলেছেন। আমার মনে হয় এটার তদন্ত হওয়া দরকার। এর মায়ের মৃত্যু কেমন করে হয়েছে? সেটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল? তাকে কি খুন করা হয়েছিল? ডেথ সার্টিফিকেট কোথায়? তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে? এসব প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। এর যে কোনো একটি প্রশ্ন করা হলেই আপনি কিন্তু বড় ঝামেলায় পড়ে যাবেন।
জহুর শীতল গলায় বলল, আপনি প্রশ্ন করেন। দেখি আমি ঝামেলায় পড়ি কি না।
ডক্টর সেলিম জহুরের দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, সেই প্রশ্ন তো আমি করব না। করবে পুলিশ—
কোথায় পুলিশ?
গুরুত্ত্বপূর্ণ চেহারার একজন মানুষ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ডক্টর সেলিম তাকে সুযোগ না দিয়ে বলল, আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমি চেষ্টা করছি আপনাকে যেন পুলিশের সাথে ঝামেলায় পড়তে না হয়। এই বাচ্চাটা আপনার কেউ নয়। ঘটনাক্রমে বাচ্চাটা আপনার হাতে এসে পড়েছে-আপনার পক্ষে এর দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। প্রফেশনালদের এর দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি প্রফেশনাল নন, এই বাচ্চাটির কখন কী প্রয়োজন হবে আপনি জানেন না। আমরা জানি। শুধু আমরাই পারি এর দায়িত্ব নিতে।
জহুর কোনো কথা না বলে শীতল চোখে ডক্টর সেলিমের দিকে তাকিয়ে রইল। ডক্টর সেলিম আবার তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অকারণেই কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলে, বাচ্চাটার কোনো সমস্যা আছে কি না কেউ জানে না। একে ভালো করে পরীক্ষা করা দরকার। যদি শরীরে জটিল সমস্যা থাকে তাহলে চিকিৎসা করা দরকার। আপনি এত বড় দায়িত্ব কেমন করে নেবেন? আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই, এই বাচ্চাটার দায়িত্ব আমরা নিতে চাই।
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনারা কি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবেন?
ডক্টর সেলিম চমকে উঠল, থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, মেরে ফেলব? মেরে ফেলব কেন?
এই বাচ্চাটার পাখা কেন আছে সেটা বোঝার জন্যে তাকে কেটে কুটে দেখতে হবে না? কেটে কুটে দেখার জন্যে তাকে আগে মেরে ফেলতে হবে না?
ডক্টর সেলিম থতমত খেয়ে বলল, এটা আপনি কেন বলছেন? আমি আপনার এ রকম একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না।
জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।
আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা চাই আপনি কোনো রকম ঝামেলা না করে চলে যান। বাচ্চাটার ব্যাপারটা আমরা দেখব।
জহুর উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকালো, নাসরীনের মুখের দিকে সে কয়েক সেকেন্ড বেশি তাকিয়ে রইল, নাসরীন চোখ নামিয়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত। কিন্তু আসলে মানে আসলে— সে বাক্যটা শেষ না করে থেমে যায়।
জহুর ক্যাবিনেটে পেছনটা উঁচু করে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটার কাছে যায়, মাথা নিচু করে বাচ্চাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি অনেক কষ্ট করে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে তুলেছি। আসলে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে না তুললেই ভালো হতো। তার মায়ের পাশে তাকে কবর দিতে পারতাম। আপনাদের মতো শকুনেরা তাহলে তার শরীরটাকে খুবলে খুবলে খেতে পারত না।।
বড় বড় শক্তিশালী দুজন মানুষ কোথা থেকে এসে তখন জহুরের দুই হাত ধরে তাকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। জহুর যেতে চাচ্ছিল কিন্তু মানুষ দুজন তাকে জোর করে টেনে নিতে থাকে। দরজার কাছে জহুর একবার দাঁড়িয়ে গেল, পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বলল, খোদা আপনাদের মাফ করবে কি না জানি না, আমি কোনোদিন আপনাদের মাফ করব না।
জহুরকে বের করে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ডক্টর সেলিম চুপ করে বসে রইল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সবার দিকে ঘুরে তাকালো, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সবাইকে থ্যাংকস। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। যে রকম গোয়াড় ধরনের মানুষ আমি ভেবেছিলাম কী না কী করে।
গুরুত্বপূর্ণ চেহারার একজন মানুষ বলল, কিছু করতে পারত না, আমি সঙ্গে অনেক আর্মড গার্ড এনেছি।
আমি জানি। আপনাদের সাহায্য ছাড়া আমি একা এটা করতে পারতাম কি না জানি না। যাই হোক আপনারা একটা ঐতিহাসিক ঘটনার অংশ হয়ে থাকলেন। এই বাচ্চাটার অস্তিত্ব পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতে একটা ঝড় তুলবে। একটা নূতন দিগন্ত তৈরি হবে। আপনারা দোয়া করবেন আমরা যেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারি।
উপস্থিত যারা ছিল তাদের কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু গম্ভীরভাবে কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল।