১.৫ কার্য্যোদ্ধার

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – কার্য্যোদ্ধার 

দূরে-এক স্থানে লুক্কায়িত হইয়া মেটা দেখিলেন যে, জাহাজ ছাড়িয়া গেল। তখন সে হাপ ছাড়িয়া বাঁচিল। তাহা হইলে খুনের কথা এখনও জাহাজে প্রকাশ পায় নাই। অন্ততঃ নয়টা পৰ্য্যন্ত কেহ মৃতব্যক্তির অনুসন্ধান করিবে না, ততক্ষণ জাহাজ অনেক দূরে চলিয়া যাইবে, সে সময়ে কাপ্তেন এতদূর ফিরিয়া আসিতে কোন মতেই সম্মত হইবেন না, সুতরাং তাহার আর কোন সন্দেহ নাই। 

প্রকৃতপক্ষে তাহাই ঘটিল, জাহাজ ফিরিল না। 

মেটা জাহাজে বোম্বে ফিরিয়া যাওয়া নিরাপদ বিবেচনা করিল না; সে তাহার দাড়ী-গোঁফ সমুদ্রে ফেলিয়া দিল। সঙ্গে টাকা ছিল, পার্শী-পোষাক সংগ্রহ করিল, তৎপরে স্থলপথে বোম্বে রওনা হইল। 

যাহা হউক, সে অবশেষে বোম্বে গিয়া উপনীত হইল। জাহাজে সে বাক্সের মধ্যে যে দৃশ্য দেখিয়াছিল, তাহাতে তাহার আর কিছুই বুঝিতে বাকী রহিল না। 

যে লোকটাকে ভুলক্রমে সে খুন করিয়াছিল, নিশ্চয়ই সে আবার কোনক্রমে হরকিষণ দাসকে খুন করিয়াছিল। 

মেটার মত লোকেরও প্রাণ শিহরিয়া উঠিল। নিশ্চয়ই তাহার হত্যাকারী তাহারই দেহ টুকরা টুকরা করিয়া বাক্সে লইয়া যাইতেছিল, নিশ্চয়ই সে-ই তাহার নোট চুরি করিয়াছিল, কিন্তু মেটা ভাবিল, সে নোট তাহার নিকট যে নাই, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, নিশ্চয়ই লোকটা এখানে কোন লোকের নিকটে নোটগুলি ভাঙাইবার জন্য রাখিয়া সে হরকিষণের দেহ কোন গতিকে বিদায় করিবার জন্য পোরবন্দর যাইতেছিল। 

তাহা হইলে নোট বোম্বেতেই আছে। এই নোটের নম্বর হরকিষণ দাস জানিত, আর মেটা জানে। এখন হরকিষণ দাস আর নাই, এই নোট এখন চোরের হাতে পড়িয়াছে, সুতরাং ইহার নম্বর বন্ধ করিয়া দিলে, ইহা আর কেহ ভাঙাইতে পারিবে না। 

মেটা ভাবিল, “যেদিক দিয়া হউক, নোট আবার আমার হাতে আসিবে। ভাঙাইতে আসিলে ধরা পড়িলে নোট আমিই পাইব, কারণ নোট যে আমি হরকিষণ দাসকে দিয়াছিলাম, তাহা সে আর আমি ব্যতীত অন্য কেহ জানে না। তাহার মামীর বিষয় যাহারা কিনিয়াছে, তাহারা এ নোট আমাকেই দিয়াছিল? যেদিক দিয়া হউক, নোট যায় কোথায়? চোর যখন দেখিবে, তাহার নোট ভাঙাইবার কোন উপায় নাই, যখন তাহার সঙ্গীর খুনের কথা জানিতে পারিবে, তখন আমার নিকট হইতে কিছু লইয়া নোটগুলি ফেরৎ দিবার চেষ্টা করিবে—আমি ইহাতে সম্মত আছি।” 

এইরূপ নানা কথা মেটা মনে মনে আন্দোলন করিল; কিন্তু কি করিবে, তাহা স্থির করিতে পারিল না।

তাহারই ন্যায় আর একজন বোম্বে সহরে দিবারাত্র ভাবিয়া ভাবিয়া উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিল। সে দন্ত-চিকিৎসক জামসেদজী। 

তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া গিয়াছিল, সে পোরবন্দরে পৌঁছিয়াই তাহাকে পত্র লিখিবে; কিন্তু জাহাজ অনেক দিন পৌঁছিয়া গিয়াছে; কিন্তু তাহার কোন পত্র এ পর্যন্ত আসে নাই। তাহার ডাক্তার ভ্রাতার ন্যায় তাহার হৃদয়ে তেমন বল ছিল না — তাহার সর্ব্বাঙ্গ দিবারাত্রি কম্পিত হইতে লাগিল। 

নোটগুলি সম্বন্ধে যাহা করিতে হইবে, তাহা তাহার ভাই বলিয়া গিয়াছিল; কিন্তু জামসেদজী সাহস করিয়া কিছুই করিতে পারিল না; ডাক্তার যাইবার সময় নোটগুলি লুকাইয়া রাখিয়াছিল, নোটগুলি এখনও সেইখানেই আছে। 

এদিকে মেটা অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া নোটবন্ধ করাই স্থির করিল, ইহাতে ভয়ের কারণ যথেষ্ট আছে খুনের সহিত এই লাখ টাকার নোট জড়িত; কিন্তু ভয় করিলে কোন কাজই এ সংসারে হয় না, যথাসময়ে সে নোট বন্ধ করিবার জন্য পত্র লিখিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – এ রমণী কে 

যে জাহাজের কথা আমরা বলিতেছি, যে জাহাজ হইতে একটু পূর্বে মেটা পলাইয়াছে, সহসা সেই জাহাজের একপ্রান্ত হইতে শব্দ হইল, “মানুষ জলে পড়িয়াছে।” 

সত্য সত্যই একজন জলে পড়িয়াছে। একটি বালিকা জাহাজের রেলে বুক দিয়া সমুদ্রবক্ষে তরঙ্গলীলা দেখিতেছিল, ঝোঁক সামলাইতে না পারিয়া একেবারে সমুদ্রে পড়িয়াছে। নিকটে তাহার মা বুক চাপড়াইয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিতেছে। 

তাহার পর মুহূর্ত্তেই আবার এক চীৎকারধ্বনি উঠিল, এবার একটি পুরুষ সত্বরহস্তে জামা জুতা খুলিয়া ফেলিয়া প্রায় বালিকার সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রে ঝম্পপ্রদান করিয়াছেন। 

বলা বাহুল্য, ইহাতে জাহাজে একটা মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। কাপ্তেন জাহাজ থামাইয়া ফেলিলেন, নিমেষমধ্যে একখানা নৌকা নামাইয়া দেওয়া হইল। পাঁচ-সাতজন বলবান নাবিক সবলে দাঁড় টানিয়া সেইদিকে চলিল। 

যিনি পরে ঝাঁপ দিয়া সমুদ্রবক্ষে পড়িয়াছিলেন—তিনি বালিকা জলমগ্ন হইবার পূর্ব্বেই গিয়া তাহাকে ধরিয়াছিলেন, তাহাকে তখনই তুলিয়া লইয়া সাঁতার দিতেছিলেন। নৌকা গিয়া তাঁহাদের উভয়কেই তুলিয়া লইল। 

নিমজ্জনে তাঁহাদের দুইজনের কাহারও অধিক অনিষ্ট হয় নাই। জননী কন্যাকে পাইয়া তাহাকে লইয়া কাঁদিতে লাগিল। জাহাজ সুদ্ধ লোক সেই পরোপকারী যুবকের যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিল। 

তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন; নিকটবর্ত্তী একজনকে বলিলেন, “আমার বাক্সে কাপড় জামা আছে, আনিয়া দাও।” 

সকলেই তখন এই পরোপকারী যুবকের সেবা ও আদেশ পালন করিতে ব্যস্ত, একজন তাঁহার জন্য কাপড় ও জামা আনিতে ছুটিল। তাঁহাকে লইয়া জাহাজ সুদ্ধ লোক বোধহয় সমস্ত দিন ব্যস্ত হইয়া থাকিত; কিন্তু এই সময়ে জাহাজে আর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটায় তাঁহার কথা তখন একদম চাপা পড়িয়া গেল। 

বেলা দশটা বাজে, তখন একটা কেবিনে একজন শয়ন করিয়া আছে, উঠে না দেখিয়া একজন খানসামা গিয়া তাহাকে ডাকিল। পুনঃ পুনঃ ডাকায় তাহার কোন উত্তর না পাইয়া সে গিয়া মশারি সরাইল, তৎপরে এক লম্ফে বাহিরে আসিয়া বলিল, “আত্মহত্যা আত্মহত্যা!” 

দেখিতে দেখিতে জাহাজময় এই সংবাদ প্রচার হইয়া গেল! সকলের মুখেই আত্মহত্যা! 

কিন্তু জাহাজের ডাক্তার মৃতদেহ দেখিয়া ঘাড় নাড়িলেন। কাপ্তেন বলিলেন, “কি, আত্মহত্যা নয় কি?” 

“না, খুন।” 

“খুন!” 

“হ্যাঁ।” 

“আর কে এ কেবিনে ছিল। সে লোক কোথায়? খোঁজ তাকে।” 

তখন একজন বলিল, “সে মারভি দেখিতে গিয়াছিল, তাহার পর ফিরিয়াছিল কিনা বলিতে পারি না।” 

তখন অনুসন্ধান আরম্ভ হইল, জাহাজে সে নাই। সে মারভি গিয়াছিল, ফিরে নাই। কাপ্তেন বলিলেন, “তাহা হইলে সে পলাইয়াছে–এখন আর উপায় নাই, আমি এখন কিছুতেই এখান হইতে আর মারভি ফিরিয়া যাইতে পারি না।” 

ডাক্তার বলিলেন, “তাহা হইলে খুনীকে পলাইবার যথেষ্ট সময় দেওয়া হয় না কি?” 

“তাহা কি করিব? এখান হইতে ফেরা সম্পূর্ণ অসম্ভব। পোর বন্দরে গিয়া পুলিসের হাতে কেস দেওয়া যাইবে, এখন যাহা যাহা হইয়াছে, ডাক্তার তুমি তাহার একটা রিপোর্ট লিখিয়া রাখ। কতকক্ষণ মরেছে, বলিয়া বোধ হয়।”

“দশ-বার ঘন্টা।” 

“আমরা সন্ধ্যার সময়ে পোর-বন্দরে পৌঁছিব–ততক্ষণ যেমন আছে, তেমনই থাক, কেবিনের দরজা বন্ধ করিয়া শীলমোহর করিয়া রাখ।” 

তাহাই হইল। দুই মৃতদেহ সেই কেবিনে বন্ধ রহিল। তবে জাহাজের লোকেরা কেবল একটি মৃতদেহের কথাই জানিতে পারিল। 

পোর-বন্দরে জাহাজ পৌঁছিলে কাপ্তেন জাহাজ হইতে কাহাকেও নামিতে দিলেন না। পুলিসকে সংবাদ পাঠাইলেন। 

পুলিস অনতিবিলম্বে আসিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করিল; কিন্তু জাহাজস্থ কাহারও উপরে কোন সন্দেহ করিবার কিছু নাই দেখিয়া সকলকে নামিতে অনুমতি দিল। তখন তাহারা হুড়ামুড়ি করিয়া জাহাজ হইতে নামিতে আরম্ভ করিল। 

একটি স্ত্রীলোক ঘাটে দাঁড়াইয়া ব্যাকুলভাবে যাত্রীদিগকে দেখিতেছিল; কিন্তু সকলে চলিয়া গেল, সে যাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল; বোধ হয়, তাহাকে দেখিতে পাইল না; কিন্তু সে তবুও নড়িল না। একজন কর্ম্মচারীর দৃষ্টি তাহার উপরে পড়িল, সে তাহার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাহারও জন্য অপেক্ষা করিতেছ?” 

“সব যাত্রী কি নামিয়াছে?” 

“হ্যাঁ, তবে দুই-একজন আছে।” 

“তাহা হইলে আমি যাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছি তিনি এখনও জাহাজে আছেন?” 

“না।” 

“কেন?” 

“তুমি যাঁহার অপেক্ষা করিতেছ, তাঁহার নাম কি?” 

“হরকিষণ দাস, তিনি কি তখনও জাহাজে আছেন?” 

“এখানে অপেক্ষা কর, আমি অনুসন্ধান করিয়া আসিয়া বলিতেছি।” 

এই বলিয়া সে ছুটিয়া কাপ্তেনের নিকটে গিয়া বলিল, “একটি স্ত্রীলোক —” 

“কি হইয়াছে?” 

“সে একজন যাত্রীর জন্য আসিয়াছে।” 

“বল, সকলেই নামিয়া গিয়াছে।”

“সে হরকিষণ দাসকে চায়।” 

“কি—কি?” 

“হরকিক্ষণ দাস।” 

পুলিস-কৰ্ম্মচারী তথায় বসিয়াছিলেন। তিনি সত্বর উঠিয়া বলিলেন, “কোথায় সে?” 

“এইদিকে আসুন।” 

পুলিস-কৰ্ম্মচারী সেই স্ত্রীলোকটির নিকট আসিয়া বলিলেন, “আপনি একজন যাত্রীর জন্য আসিয়াছেন?”

“হাঁ, হরকিষণ দাস। তিনি কি এখনও জাহাজে আছেন?” 

“দেখুন—একটা কথা –”

“আপনি কে?” 

“আমি পুলিসের লোক।” 

“পুলিস! সব প্রকাশ হয়ে পড়েছে সে গ্রেপ্তার হয়েছে?” 

পুলিস-কৰ্ম্মচারী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া ভাবিলেন, “তাহা হইলে কেবল খুন নয়, আরও গভীর রহস্য আছে।” 

রমনীও তাহার ভুল বুঝিল, সামলাইয়া লইবার জন্য বলিল, “তিনি — তিনি কি এখনও জাহাজে আছেন?” 

“হাঁ।” 

“আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে পারি কি?” 

“আপনি তাঁহার কেহ হন?” 

“স্ত্রী।” 

“আসুন।” 

এই বলিয়া তিনি তাহাকে লইয়া জাহাজের মধ্যে আসিলেন। 

রমণী ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কই তিনি?” 

“ব্যস্ত হইবেন না “তাহা আমি জানি “তাঁহার মৃতদেহ—”

“কি—কি—” 

আপনার স্বামী এই জাহাজে বোম্বাই হইতে চড়িয়াছিলেন—” এখনও তিনি কি জাহাজে রহিয়াছেন? কোথায় আছেন?” 

“তিনি মারা গিয়াছেন।” 

“মারা গিয়াছেন!” 

এই বলিয়া রমণী বসিয়া পড়িল—মূৰ্চ্ছিতপ্রায় হইল, পুলিস-কৰ্ম্মচারী তাহার মুখে-চোখে জল দিয়া বলিলেন, “অধীর হইতে নাই–মরণ-বাঁচন সকলেরই আছে, একটু স্থির হইয়াছেন? মৃতদেহ দেখিতে চাহেন — ভাল — দেখা আবশ্যক, সনাক্ত হওয়া চাই। আসুন, এইদিকে, এই ঘরে–ঐখানে আছে।” 

সপ্তম পরিচ্ছেদ – তুসলী বাঈ 

রমণী কেবল একদৃষ্টে মৃতদেহ দেখিল, তৎপরে পাগলের ন্যায় হাসিয়া উঠিল, তৎপরেই ক্রন্দন করিয়া উঠিয়া মূৰ্চ্ছিতা হইয়া ভূপতিতা হইল। 

সে তাহার স্বামিকেই মৃত দেখিবে ভাবিয়াছিল, কিন্তু দেখিল, আর এক ব্যক্তি। যখন তাহার জ্ঞান হইল, তখন সে দেখিল, সে ডেকের উপরে শয়ন করিয়া আছে। রাত্রি হইয়াছে, তাহার নিকটে কেহ নাই, জাহাজের মধ্যে মধ্যে আলো জ্বলিতেছে? সে নড়িল না, এখন কি করা উচিত, তাহাই সে ভাবিতে লাগিল। একটা কিছু ভয়ানক হইয়াছে! তাহার স্বামীর নাম ধরিয়া কেহ এই জাহাজে আসিতেছিল, কে তাহাকেই বা খুন করিল! সে তাহার স্বামীর সকল কথাই জানিত। তাহাই তাহার এত ভয়। 

হরকিষণ দাস যথার্থই চাষা ছিলেন, নাম-সই ব্যতীত তাহার আর অধিক বিদ্যা ছিল না। তাহার চিঠিপত্র লিখিবার জন্য, তাহার হিসাব-পত্র কাজ-কর্ম্ম দেখিবার জন্য সে গোপালরাম দাস নামে এক শিক্ষিত যুবককে মাহিনা দিয়া রাখিয়াছিলেন। গোপালরাম ও তাহার স্ত্রী তুলসী বাঈ তাঁহার বাড়ীতেই থাকিত। 

যখন মেটা, হরকিষণ দাসের মামীর মৃত্যু-সংবাদ ও তাঁহার সম্পত্তির কথা জানাইয়া পত্র লিখিল, তখন অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া গোপাল দাস সে পত্র গোপন করিয়া ফেলিল সে পত্রের কথা হরকিষণ দাসকে কিছুই বলিল না। রাত্রে তুলসী বাঈর সহিত পরামর্শ আঁটিতে লাগিল, সেও তাহাতেই সায় দিল। লাখ টাকা! অনায়াসেই বড় লোক হইতে পারা যাইবে, হরকিষণ দাস ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানিতে পারিবে না। আর কিরূপেই বা জানিবে? 

উভয়ে এই পরামর্শ স্থির করিয়া গোপাল দাস মনিবের নিকট হইতে ছুটি লইল। তাহার পর সে হরকিষণ দাস নাম লইয়া বোম্বাই রওনা হইল। 

তুলসী বাঈ এ সমস্তই জানিত। গোপালরাম দাস বোম্বাই হইতে তাহাকে দুই-তিনখানা পত্র লিখিয়াছিল। শেষ পত্রে সে লিখিয়াছিল, “কাজ উদ্ধার হইয়াছে, কল্যকার জাহাজে রওনা হইব।” তাহাই তুলসী বাঈ জানিতে পারিয়াছিল যে, গোপাল দাস মনিবের নাম হইয়া এই জাহাজে আসিবে, তাহাই সে-ও একদিনের ছুটি লইয়া পোর-বন্দরে আসিয়াছিল। এখন জাহাজে গোপাল দাস আসে নাই, তাহার নাম ধরিয়া আর একজন আসিয়াছে, সে-ও খুন হইয়াছে, এরূপ অবস্থায় বিশেষ সাবধান হওয়া উচিত। 

জাহাজস্থ সকলে জানিয়াছে যে, সে তাহার স্বামীকে মৃত দেখিয়া মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল, এখন সে কি বলিবে? মৃত ব্যক্তিকে তাহার স্বামী বলিয়া সনাক্ত করিতে পারে না, করিলে টিকিবে না। অনুসন্ধানে সকলই বাহির হইয়া পড়িবে। অনুসন্ধান হইলে সেও তাহার স্বামী যে কি কাণ্ড করিয়াছে, তাহাও সব প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এখন উপায়? 

তুলসী বাঈ মূৰ্চ্ছা যাইবার অজুহাতে জাহাজের ডেকের উপরে বসিয়া বহুক্ষণ ধরিয়া ভাবিতে লাগিল, এখন কি করা উচিত। সহসা সে কি একটা মলব ঠিক করিয়া সবেগে উঠিয়া বসিল। পলায়নই উচিত; নতুবা পুলিসের হাতে পড়িলে সকল কথাই প্রকাশ হইয়া পড়িবে। 

যখন সকলে ভাবিতেছিল যে, সে অজ্ঞান হইয়া আছে, সেই সময়ে তুলসী বাঈ ধীরে ধীরে নিঃশব্দে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে জাহাজ হইতে নামিয়া পলাইল। তাহার সৌভাগ্য ক্রমে কেহই তাহাকে দেখিতে পাইল না। সে শহরে অন্তর্হিত হইল। তুলসী বাঈ জাহাজ হইতে পলাইয়া সেই রাত্রেই তাহার মনিবের বাড়ীতে উপস্থিত হইল। হরকিষণ দাস ঠিক পোর-বন্দর সহরে বাস করিতেন না; সহর হইতে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূরে তাঁহার বাড়ী। তাঁহার বাড়ীর চারিদিকেই বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র, এ সমস্তই তাঁহার—অনেক লোকজন লইয়াই তাঁহার কাজ-কারবার। 

সংসারে তাঁহার সম্বল একমাত্র কন্যা হিঙ্গল বাঈ। বহুদিন হইল, হরকিষণ দাসের স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে, তিনি পিতা হইয়া মাতৃস্নেহ ঢালিয়া হিঙ্গনকে মানুষ করিয়াছেন। হিঙ্গনের এখন প্রায় ষোড়শ বৎসর বয়স হইয়াছে। হিঙ্গন সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী—ঝলমলে রূপ; যে একবার তাহাকে দেখে, সহসা অন্যদিকে চক্ষু ফিরাইতে পারে না লাবণ্যপ্রবাহে তাহার সর্ব্বাঙ্গ অভিসিক্ত। তাহার বয়স ষোড়শ হইলেও অতি শৈশবের অম্লান লাবণ্যটুকু যেন তাহাকে এখনও পরিত্যাগ করিতে পারে নাই; মুখখানিতে তাহা যেন এখনও ফুটিয়া আছে। সেই চাঞ্চল্যপূর্ণ শৈশবের ন্যায় এখনও তাহার চক্ষু কথায় কথায় হাস্যচ্ছটায় নাচিয়া উঠে। এখনও তাহার বিবাহ হয় নাই। মনের মত পাত্র না পাওয়াই তাহার বিবাহ না হইবার কারণ, বিশেষতঃ হরকিক্ষণ দাস তাহাকে ছাড়িতেও সম্পূর্ণ সম্মত নহেন। গুজরাটে সাধারণতঃ ইহাপেক্ষা কম বয়সে কোন বালিকার বিবাহ হয় না, হরকিষণ দাস তাহার কন্যাকে এখনও ক্ষুদ্র বালিকা মনে করিয়া থাকেন। 

তুলসী বাঈ পলাইলে জাহাজের লোকেরা তাহার অনেক অনুসন্ধান করিল; কিন্তু কোথাও তাহার কোন সন্ধান পাইল না। পর দিবস পুলিস মৃতদেহ ও তাহার বাক্স দুইটি লইয়া গেল। তখন বাক্স খুলিয়া তাহারা আর একজনের খণ্ড বিখণ্ড মৃতদেহ দেখিতে পাইয়া মহা বিস্মিত হইল। অনেক অনুসন্ধান হইল; কিন্তু এই দুই খুনের কোনও সন্ধান হইল না। 

তুলসী বাঈ ফিরিয়া হরকিষণ দাসের বাড়ী আসিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে আর একজন লোকও হরকিষণ দাসের বাড়ীতে আসিলেন। ইনিও এই জাহাজে বোম্বাই হইতে পোর-বন্দরে আসিয়াছিলেন। 

ইহার নাম জয়বন্ত লালজী ভাই—ইনি যুবক, সুপুরুষ, সুশিক্ষিত; কিন্তু হইলে কি হয়, তাঁহার ন্যায় অলসপ্রকৃতি এ সংসারে দ্বিতীয় দেখিতে পাওয়া যায় না। তিনি কিছুতেই কোন কাজ-কর্ম্ম করিতে চাহিতেন না। বোম্বাই থাকিলে আরও অকর্ম্মণ্য হইয়া যাইবে ভাবিয়া, তাঁহার আত্মীয়স্বজন তাঁহাকে বোম্বাই হইতে বিদায় করাই শ্রেয়ঃ মনে করিলেন। হরকিষণ দাস তাঁহাদের নিকটে পরিচিত ছিলেন। দূরে পোর-বন্দরে চাষবাসে গেলে জয়বন্ত আর অলসভাবে থাকিতে পারিবেন না ভাবিয়া, তাঁহারা হরকিষণ দাসের নামে এক পত্র দিয়া তাঁহাকে পোর-বন্দরে পাঠাইয়া দিলেন। 

জয়বন্তের পিতামাতা জীবিত নাই, আত্মীয়স্বজন এতদিন তাঁহার ভরণপোষণ, শিক্ষার খরচ-পত্র চালাইয়াছিলেন, তাঁহার পিতার এক পয়সাও ছিল না, সুতরাং তাঁহারা তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলেন। 

জয়বন্ত ইহাতে বড় দুঃখিত হইলেন না। নানা দেশ দেখিবার ইচ্ছা তাঁহার বরাবরই ছিল, তিনি পোর-বন্দরে যাইবার প্রস্তাবে দুঃখিত না হইয়া বরং মনে মনে সন্তুষ্ট হইলেন। 

তাঁহার যাহা কিছু সম্বল ছিল, তাহা সমস্তই একটা বাক্সের মধ্যে পুরিয়া জাহাজে আসিয়া, পথে তিনি একটা সৎকার্য্য করিয়া যাত্রীদিগের নিকটে ধন্যবাদার্হ হইয়াছিলেন। চলন্ত জাহাজ হইতে বালিকা পড়িয়া গেলে, তিনিই কেবল সমুদ্রবক্ষে লম্ফ দিয়া পড়িয়া তাহার প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন। পাঠক তাহা অবগত আছেন। 

যাহা হউক, যথাসময়ে তিনি হরকিষণ দাসের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। তখন অন্য কোন কাজ হাতে ছিল না। তুলসী বাঈর স্বামী লইয়া গিয়াছিল, হরকিষণ দাস তাঁহাকে তাহারই কাজে নিযুক্ত করিলেন। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ – হিঙ্গন বাঈ 

দুই মাস কাটিয়া গিয়াছে। 

একদিন হরকিষণ দাস কন্যাকে ডাকিলেন, “হিঙ্গন, এদিকে এস।” 

“কি বাবা?” বলিয়া বায়ুপ্রবাহে একখণ্ড ক্ষুদ্র পুষ্পের মত ছুটিয়া আসিয়া হিঙ্গন বাঈ পিতৃসম্মুখে দাঁড়াইল। 

পিতা বলিলেন, “বসো আমার কাছে।” 

হিঙ্গন আসিয়া তাঁহার সম্মুখে বসিল। সে পিতার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “বাবা, আমি জানি, তুমি আজ আমাকে বকিবে।” 

হরকিষণ দাস স্নেহ-কোমল হাস্যে হিঙ্গনের মুখের দিকে চাহিলেন; চাহিয়া বলিলেন, “বকিব, কিসে জানিলে?” 

“তোমার ঐ রকম মুখ দেখিলেই আমার বড় ভয় হয়।” 

“না, আমি বকিব না।”

“আমি জানি, বাবা আমায় বকে না।” 

“তবে অন্য কথা আছে।” 

“কি কথা, বাবা?” 

“বিশেষ কথা।” 

“আমি কি করিয়াছি, বাবা?” 

“এখনও কিছু কর নাই; কিন্তু ভবিষ্যতে করিতে পার, তাহাতে তোমাকে চিরজীবনের মত দুঃখী হইতে হইবে।” 

“কি বাবা?” 

“জয়বন্ত এখানে প্রায় দুই মাস আসিয়াছে—সে ইহার মধ্যে তোমায় ভালবাসে, তাহা দেখিতে পাও। তাহাতে তাহার দোষ নাই, তোমায় যে দেখিবে, সে-ই ভালবাসিবে।” 

“বাবা!” 

“সে ভালবাসুক, তাহাতে কিছু আসে-যায় না, তুমি কি তাহাকে ভালবাস?” 

হিঙ্গনের মুখ লজ্জায় কর্ণমূল পৰ্য্যন্ত লাল হইয়া গেল। হিঙ্গন অবনত নেত্রে পিতার পদপ্রতি চাহিয়া বলিল, “তিনি লোক ভাল –” 

“বাহিরে দেখিতে ভাল লোক সন্দেহ নাই — লেখাপড়া জানে — বোম্বাই সহরে শেখা ― সে সব স্বীকার করি; কিন্তু কেবল উপরে চাকিচক্য থাকিলেই জিনিষ ভাল হয় না।” 

“বাবা, এখানে কথা কহিবার মত লোক কে আছে—তাই কথা কই?” 

“তা হতে পারে।” 

“তুমি আমাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছ, এখানে যাহারা আছে, তাহারা কেবল চাষবাসই জানে, আর কিছুই জানে না।” 

“তা স্বীকার করি।” 

“ইনি শিক্ষিত—” 

(বাধা দিয়া) “সব স্বীকার করি, তবে ইহার সিকি পয়সাও নাই।” 

“নাই থাকুক।” 

“সংসারে টাকাই সব।” 

“তা হতে পারে, কিন্তু আমি তা মনে করি না।” 

“হাঁ, বুঝিয়াছি।” 

“কি বুঝিয়াছ, বাবা?” 

“না, কিছু নয়। তুমি জয়বন্তকে পছন্দ কর।” 

হিঙ্গনের মুখ আবার সেইরূপ লাল হইয়া উঠিল, সে নতনেত্রে ভূমি নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। কোন উত্তর দিল না। 

হিঙ্গনকে অধোমুখে নীরব থাকিতে দেখিয়া হরকিষণ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তিনি কন্যাকে প্রাণ অপেক্ষাও ভালবাসিতেন। কোন বড়লোকের পুত্রের সহিত তাহার বিবাহ দিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। হিঙ্গনের ভাব দেখিয়া তাঁহার সে ইচ্ছা হৃদয়ে মিলাইয়া গেল। 

হিঙ্গন বলিল, “বাবা, তুমিও ত তাঁহাকে খুব ভালবাস?”

“হাঁ, কিন্তু এই দুই ভালবাসায় অনেক প্রভেদ আছে, বেটি।” হিঙ্গন কোন কথা কহিল না। লজ্জায় রক্তিম মুখখানি নত করিল। 

হরকিষণ দাস বলিলেন, “বোম্বাই হইতে আমার কোন পরিচিত লোক জয়বন্তকে আমার নিকটে পাঠাইয়া দিয়াছে। জয়বন্তের এক পয়সাও নাই, সেখানে বসে অলস হইয়া যাইতেছিল, তাহাই তাহারা তাহাকে আমার নিকটে কাজ-কৰ্ম্ম শিখিতে পাঠাইয়াছে—যদি সে এখানে কিছু রোজগার করিতে পারে।” 

“ভালই ত — তিনি এখানে পরিশ্রম করিতেছেন।” 

হরকিষণ দাস হতাশ হইলেন। তিনি বুঝিলেন যে, তিনি ভাল করিতে গিয়া মন্দ করিতেছেন। তিনি যতই জয়বন্তকে দরিদ্র-সন্তান প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিতেছেন, হিঙ্গন ততই তাঁহার দোষভাগটা গুণের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। 

হরকিষণ অবশেষে স্পষ্ট বলিলেন, “হিঙ্গন, তুমি এখন কত সুখে আছ, তোমার কোন অভাব নাই? মনে কর, জয়বন্তের মত একজন গরীবের সঙ্গে তোমার বিবাহ হইলে তোমার কি ভয়ানক কষ্ট হইবে? 

“বাবা, গরীব যে চিরকালই সেই রকম গরীব থাকিবে, ইহার এমন মানে কি আছে?” 

“পরের কথা পরে আছে।” 

“তা হতে পারে, এখানে তিনি খুব পরিশ্রম করিতেছেন।” 

“তাও স্বীকার করি, কিন্তু এখান হইতে গিয়া সে মাসে কি রোজগার করিতে পারে — খুব বেশি পঞ্চাশ টাকা।”

 “এ বাবা, তোমার অন্যায় কথা। কোন্ মানুষের কখন কি হয়, কে বলিতে পারে?”

“গোপালরাম ছুটি লইয়া গিয়াছে বলিয়াই তাহাকে তাহার কাজ দিতে পারিয়াছি, না হইলে ইহাকে লইয়া আমি কি করিতাম?” 

“তিনি ভালই কাজ করিয়াছেন।” 

“গোপালরাম ফিরিয়া আসিলে আমি কি করিব, জানি না। আমার মনে হয়, এ এখানে না আসিলেই ভাল ছিল।” 

হরকিষণ দাস আর কিছু বলিলেন না; কন্যাকে অন্য কাজে পাঠাইয়া দিলেন। তিনি মনে মনে বলিলেন, “গোপালরাম ফিরিয়া আসিলে বাঁচি, সে ফিরিয়া আসিলেই ইহাকে বিদায় করি। কি আপদে পড়িলাম।” 

হায় গোপালরাম! তাহার খণ্ড-বিখণ্ড দেহ পুলিস অনেকক্ষণ পোর-বন্দরে জ্বালাইয়া দিয়াছে। 

নবম পরিচ্ছেদ – রমণী না রাক্ষসী 

প্রায় তিন মাস গত হইল, তুলসী বাঈ স্বামীর কোন সন্ধান পাইল না। সে স্বামীকে অত্যন্ত ভালবাসিত, তাহার জন্য উন্মত্ত হইয়া উঠিল। অথচ সে তাহার মনের কথা কাহাকেই খুলিয়া বলিতে পারিতেছে না। তাহার হৃদয়ের যন্ত্রণা অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছে; তথাপি মুখ ফুটিয়া কিছু বলিবার যো নাই। 

তাহার মনে ক্রমে ধারণা হইয়াছে যে, তাহার স্বামী আর জীবিত নাই, জীবিত থাকিলে সে যেখানেই থাকিবে, নিশ্চয়ই তাহাকে সংবাদ দিবে। ট কার জন্যই তাহার প্রাণ গিয়াছে। স্বামী লিখিয়াছিল যে, সে লাখ টাকা হস্তগত করিয়াছে। নিশ্চয়ই অন্য কেহ তাহা জানিতে পারিয়া, তাহাকে খুন করিয়া সে টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে। সে কে? তাহার নাম ধরিয়া আর একজন লোক জাহাজে আসিতেছিল; কিন্তু তাহাকেও কে খুন করিয়া পলাইয়াছে। 

সে জানিত, যুবক জয়বন্ত সেই জাহাজে আসিয়াছিলেন, কিন্তু ভয়ে তাঁহাকে তাহার কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হয় নাই। সে যতই এই সকল কথা ভাবিতে লাগিল, ততই তাহার মাথা খারাপ হইয়া যাইতে লাগিল। ক্রমে সে উন্মাদিনীর মত হইল। 

সে একদিন জয়বন্তের একখানি কাপড় দেখিয়াই প্রকৃত উন্মত্তা হইয়া গেল। সে কাপড়খানি দেখিয়া চমকিত হইয়া উঠিল, পুনঃ পুনঃ কাপড়খানি দেখিতে লাগিল, তাহার পর মনে মনে বলিল, “এ আমার স্বামীর কাপড়, এই আমার নিজের হাতের চিহ্ন দেওয়া রহিয়াছে। ও! এতদিনে বুঝিয়াছি, এই জয়বন্তই আমার স্বামীকে খুন করিয়াছে; নতুবা তাহার কাপড় এ জয়বন্তটা পাইবে কিরূপে?” 

এ বিশ্বাস তাহার হৃদয়ে দৃঢ় হইল। এত দৃঢ় হইল যে, তাহার মন হইতে আর সমস্ত কথাই একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল। তখন সে মনে মনে জয়বন্তকে কিরূপে হত্যা করিবে; তাহাই দিবারাত্রি ভাবিতে লাগিল। রাত্রে তাহার ঘুম হইত না, সে সমস্ত রাত্রি মনে মনে এই বিষয় লইয়া তোলাপাড় করিত। শেষে সে একটা উপায় স্থির করিল। একদিন সে জয়বন্তকে নিৰ্জ্জনে ডাকিয়া বলিল, “তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।” 

জয়বন্ত বলিলেন, “কি কথা?” 

তুলসী বলিল, “অত চেঁচিয়ে নয়—আস্তে।” 

স্বর-নীচু করিয়া জয়বন্ত একটু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন—কি হইয়াছে?” 

“হিঙ্গল তোমায় বলিয়াছে (নীরবে)—” 

(সাগ্রহে) “কি বলিয়াছে?” 

“পড়ো গোয়ালের পাশে কুয়াতলায় তোমায় ডাকিতেছে।” 

“পড়ো গোয়ালঘর! সেখানে সে কি করিতেছে?” 

“তা আমি জানি না বাপু, তোমার ইচ্ছা হয় যাও, না হয় না যাও।” 

“না, রাগ কর কেন? আমি এখনই যাইতেছে।” 

“এ কথা কাহাকে বলিতে সে বারণ করিয়াছে।” 

“কাহাকেও বলিব না ভয় নাই, “বলিয়া সত্বরপদে জয়বন্ত গোয়াল ঘরের দিকে চলিলেন। 

এই গোয়ালঘরে এখন গরু থাকিত না—এটা পড়িয়া ভগ্নপ্রায় হইয়াছে। বড় কেহ সেইদিকে যাইত না। সেখানে একটা পুরাতন কূপ আছে বটে; কিন্তু সেটাও ভাঙিয়া গিয়াছে, তাহাতে জল আছে কিনা, তাহারও বিশেষ সন্দেহ আছে। 

জয়বন্ত এ স্থান জানিতেন মাত্র, কিন্তু কখন এদিকে আসেন নাই। এখানে এই নির্জ্জন স্থানে হিঙ্গন আসিয়াছে, ভাবিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন! তিনি জানিতেন, হিঙ্গন বাড়ী ছাড়িয়া কখন বেশী দূরে যাইত না। 

প্রেম সৰ্ব্বদাই অন্ধ। জয়বন্ত এ সম্বন্ধে অধিক কোন আলোচনা করিলেন না। হরকিষণ দাস পাছে জানিতে পারেন বলিয়া, তিনি এদিকে-ওদিকে কিয়ৎক্ষণ ঘুরিয়া দূরবর্তী সেই পড়ো গোয়ালঘরের দিকে চলিলেন। কোনদিকে কেহ নাই, চারিদিকে তিনি চাহিয়া দেখিলেন, কোন দিকে কাহাকে দেখিতে পাইলেন না। এদিকে কখনই কেহ আসিত না। 

গোয়ালঘরটি পড়িয়া প্রকাণ্ড আবর্জ্জনা-স্তূপের মত হইয়া আছে; একপার্শ্বে একটি কূপ আছে, কুপের চারিপাশবত্তী প্রাচীর ভাঙিয়া গিয়াছে। জয়বন্ত সেখানে কাহাকেও না দেখিয়া বিস্মিত হইলেন; ভাবিলেন, “তবে কি আমার দেরি হইয়াছে আমার দেরি হওয়ায় হিঙ্গন বাড়ী ফিরিয়া গিয়াছে? নতুবা তাহাকে অবশ্যই এখানে দেখিতে পাইতাম। তুলসী বাঈ কি মিথ্যাকথা বলিল? ইহাতে তাহার স্বার্থ কি?” 

তিনি কূপের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া এইরূপ ভাবিতেছিলেন; সহসা গোয়ালঘরের ভগ্ন স্তূপের অপর পার্শ্ব হইতে কে তীরবেগে আসিয়া তাঁহাকে পশ্চাৎ হইতে প্রচণ্ডবেগে এক ধাক্কা মারিল। তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন, আত্মরক্ষায় সমর্থ হইলেন না, একেবারে কূপের মধ্যে সশব্দে নিক্ষিপ্ত হইলেন। 

তাঁহার পরম সৌভাগ্য, সে সময় কূপের মধ্যে অৰ্দ্ধ কদমাক্ত জল ছিল; নতুবা তিনি হত না হইলেও হাত পা ভাঙিতেন। কাদা ও জলে পড়িয়া তিনি সেযাত্রা রক্ষা পাইলেন। কিন্তু এই ভয়াবহ ব্যাপারটায় তিনি কিয়ৎক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হইয়া গেলেন; প্রায় সংজ্ঞাশূন্য হইলেন। ক্ষণপরে উপরে কাহার কন্ঠস্বরে তাঁহার চেতনা হইল। 

তিনি উপরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তিনি অন্ততঃ তিরিশ-চল্লিশ হাত নীচে পড়িয়াছেন। তিনি যেখানে রহিয়াছেন, সে স্থানে ঘোর অন্ধকার—কিছুই দেখিবার উপায় নাই। তবে উপরে চাহিয়া দেখিলেন, সেখানে দিনশেষের ম্লান আলো দেখা যাইতেছে। 

আবার সেই কন্ঠস্বর, প্রথমে তিনি কে কি বলিতেছে, বুঝিতে পারিলেন না; পরে বুঝিলেন, কে ডাকিতেছে, “জয়বন্ত!” 

তিনি চীৎকার করিয়া বলিলেন, “কে তুমি? তুমি যেই হও, শীঘ্র একটা দড়ী ফেলিয়া দাও — আমার প্রাণরক্ষা কর, উপরে উঠিয়া সব—”

 তাঁহার কথা শেষ হইতে-না-হইতে কে উপরে একবার অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। তৎপরে কঠিনকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “জয়বন্ত, তুমি জাহাজে আমার স্বামীকে খুন করিয়াছিলেন, সেইজন্য আমি তোমার প্রাণ লইলাম। ঐখানে থাক ধীরে ধীরে মর, অনাহারে—না খাইয়া ধীরে ধীরে সুখের মরণ মর — থাক – থাক – থাক এইখানে চিরজীবনের মত।” 

 জয়বন্ত তাহার স্বর আর শুনিতে পাইলেন না। বুঝিলেন, এ স্বর তুলসী বাঈ এর – রাক্ষসী তাঁহাকে মৃত্যুমুখে রাখিয়া প্রস্থান করিল। 

তিনি বুঝিলেন, এখান হইতে সহস্র চীৎকার করিলেও কেহ তাঁহার স্বর শুনিতে পাইবে না। বিশেষতঃ এদিকে কেহ আসে না। তাঁহার রক্ষা পাইবার আর কোন উপায় নাই। তিনি উপর হইতে চল্লিশ হাত নীচে কূপের ভিতরে রহিয়াছেন, কিরূপে উঠিবেন? উঠিবার কোন উপায় নাই। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ হইতে স্বেদশ্রুতি হইতে লাগিল। এ বয়সে এ অবস্থায় কে মরিতে চাহে? তাঁহার বিবেচনাশক্তি লোপ পাইল। তিনি বহুক্ষণ সেই কদম ও জলের মধ্যে স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলেন। 

জয়বন্ত আকস্মিক এই দুর্ঘটনায় যেন একেবারে হতভম্ব হইয়া গেলেন, ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না; তথাপি ভাবিতে লাগিলেন, “তুলসী বাঈ বলিয়াছে, জাহাজে তাহার স্বামীকে আমি খুন করিয়াছি—কি ভয়ানক দোষারোপ! কিন্তু জাহাজে প্রকৃতই খুন হইয়াছে, তাহা হইলে জাহাজে তাহার স্বামীই খুন হইয়াছে, দেখিতেছি। কিন্তু কে তোমার স্বামী? দুইজন খুন হইয়াছে। যাহার গলা কাটা—বা যাহার খণ্ড-বিখণ্ড মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে? তাহা হইলে তুলসী বাঈর স্বামী গোপালরাম সম্বন্ধে কোন গুরুতর রহস্য আছে আচ্ছা থাক, যদি আমি এ যাত্রা বাঁচিতে পারি, তবে এসব বিষয় আলোচনা করিবার অনেক অবসর পাইব; কিন্তু বাঁচিবার আশা আর কই? দেখিতেছি, অনাহারে এইখানে মরিতে হইবে।” 

তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল, তাঁহার চোখে বিশ্বের প্রলয়ান্ধকার ঘনাইয়া আসিতে লাগিল। হায় — এইরূপ অসহায় অবস্থায় অনাহারে তাঁহাকে মরিতে হইবে, সে মৃত্যু কি ভীষণ