১.৫ কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিল

কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিলটা ঘিরে চার জন বসে আছে। ইরনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট, সে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছে। ত্রালুস এবং শুমান্তি শান্তমুখে ইরনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কীশা একটা লম্বা বিশ্বাস ফেলে বলল, কিছু একটা বল ইরন।

ইরন মাথা তুলে তাকাল, বলল, বলব আমি?

হ্যাঁ।

বলার মতো কিছু আছে? আমাদের অবস্থা হচ্ছে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো। আমরা জানি আগুনে আমরা নিশ্চিতভাবে পুড়ে মরব কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।

কিন্তু এটা কি একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়? একটা মহাকাশযান পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় বৃহস্পতি গ্রহের দিকে ছুটে যাচ্ছে?

না, মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারণ এটি ইচ্ছে করে করা হয়েছে। আমরা যখন ঘুমিয়েছিলাম তখন বর্গেন উঠে এসে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণে বড় পরিবর্তন করেছে। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ মডিউলটি সরিয়ে দিয়েছে। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করেছে। কেন করেছে সেটা একটা রহস্য। আমাদেরকে মেরে ফেলাই যদি এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সেটা কি পৃথিবীতে আরো সহজে করা যেত না?

কীশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আমরা এখন বৃহস্পতির ওপর আছড়ে পড়ব?

হ্যাঁ।

আমাদের হাতে কতটুকু সময় আছে?

পৃথিবীর হিসাবে দিন সাতেক। তবে শেষের অংশটুকুর কথা ভুলে যাও, প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাব বলে আমাদের জ্ঞান থাকবে না।

মৃত্যুটি কি খুব ভয়ঙ্কর হবে?

ইরন হেসে ফেলে বলল, জানি না। আমি আগে কখনো এভাবে মারা যাই নি।

ত্রালুস এবং শুমান্তি এতক্ষণ চুপ করে দুজনের কথা শুনছিল, এবারে ত্রানুস একটু সোজা হয়ে বসে বলল, আমি একটা কথা বলতে পারি?

বল।

তোমরা আমাদের দুজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলে মহাকাশযানে কী কী আছে খুঁজে দেখতে।

হ্যাঁ।

আমরা দেখা শুরু করেছি–পুরোটা এখনো শেষ হয় নি। আর্কাইভ ঘরে কিছু জিনিস রয়েছে যার কোনো তালিকা নেই।

ইরন অবাক হয়ে বলল, তালিকা নেই?

না। শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে কোনো তালিকা নেই।

অসম্ভব! ইরন মাথা নেড়ে বলল, মহাকাশযানের প্রত্যেকটি স্কুর পর্যন্ত তালিকা থাকতে হবে।

শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু আমরা আর্কাইভ ঘরে গেছি সেখানে অনেকগুলো নানা আকারের বাক্স আছে, যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু সেগুলোতে কী আছে কোথাও বলা নেই।

কীশা মাথা নেড়ে বলল, ইরন। আমি যতই দেখছি ততই তোমার ষড়যন্ত্র থিওরিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।

ইরন টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ষড়ষন্ত্র নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রটা কী আমাদের জানা দরকার?

যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা যদি চায় তা হলে আমরা নিশ্চয়ই জানব!

ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কি মজার ব্যাপার কী জান? পুরো ব্যাপারটা যদি দেখ তা হলে মনে হবে আমরাও সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। আমি টাইটানিয়ামের রড দিয়ে বর্গেনকে মারতে গিয়েছি তুমি মেরেই ফেলেছ।

কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ওভাবে বল না, রোবটের বেলায় মেরে ফেলা কথাটা খাটে না। তা ছাড়া আমি সেটাকে মারতে চাই নি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। এত সহজে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে কে জানত?

অত্যন্ত দুর্বল ডিজাইন। ইরন মাথা নেড়ে বলল, কে জানে সেটাও নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্রের অংশ।

ত্রালুস নড়েচড়ে বলল, আমার কী মনে হয় জান?

কী?

আর্কাইভ ঘরে বাক্সগুলোতে কী আছে আমরা যদি খুলে দেখতে পারি তা হলে হয়তো কিছু একটা বুঝতে পারব।

ইরন মাথা নাড়ল, ঠিক বলেছ।

কাজটা অবশ্য খুব সহজ হবে না। তথ্যকেন্দ্রে যেহেতু এদের তালিকা নেই, এটা খোলারও কোনো উপায় নেই। বাক্সগুলো ভাঙতে হবে।

ভাঙতে হবে?

হ্যাঁ। ঠিক যন্ত্রপাতি খুঁজে বের করতে হবে।

কীশা মাথা নেড়ে বলল, যদি ভিতরে বিপজ্জনক কিছু থাকে?

ইরন হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তা হলে আমরা এক সপ্তাহের মাঝে মারা না গিয়ে হয়তো আরো দুদিন আগে মারা যাব! খুব কি ক্ষতি–বৃদ্ধি হবে?

কীশা আবার একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, না। তা হবে না।

ইরন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, শুমান্তি বাধা দিয়ে বলল, আমরা এই মহাকাশযানে আরো একটি বিচিত্র জিনিস পেয়েছি।

কী?

এন্টি ম্যাটার১৬। প্রতিপদার্থ।

ইরন চমকে সোজা হয়ে বসে বলল, এন্টি ম্যাটার? কী বলছ?

হ্যাঁ।

কতখানি?

অনেক। মহাকাশযানের সামনে পুরোটাই এন্টি ম্যাটার। চৌম্বক ক্ষেত্রে আটকে রেখেছে। মনে হয় খুব সুরক্ষিত। তারপরও প্রচুর গামা রেডিয়েশন হচ্ছে। আসলে– শুমান্তি একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি তো স্বাভাবিকভাবে বড় হই নি, পড়াশোনার সেরকম সুযোগ হয় নি, তাই বিজ্ঞান বিশেষ জানি না। কতটুকু এন্টি ম্যাটার আছে, কীভাবে আছে দেখলে তোমরা বলতে পারবে।

ইরন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি বিজ্ঞান না জেনেও চমৎকার বিজ্ঞানীর মতো কাজ করছ শুমান্তি!

কীশা একটু সামনে ঝুঁকে বলল, কিন্তু মহাকাশযানে এন্টি ম্যাটার কেন? তাও এই বিশাল পরিমাণের?

এন্টি ম্যাটার হচ্ছে শক্তি তৈরির সবচেয়ে সহজ উপায়। কোনো ম্যাটার বা পদার্থের সাথে জুড়ে দাও সাথে সাথে বুম প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।

কিন্তু সেটা তো অনিয়ন্ত্রিত শক্তি। সেটা কী কাজে লাগবে?

যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবেই থাকে তা হলে বিশেষ কোনো কাজে আসবে না। যদি ব্যবহার করার জন্য বিশেষ ইঞ্জিন থাকে সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে।

কীশা ত্রালুস আর শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কি দেখেছ সেরকম ইঞ্জিন?

দুজনে একসাথে মাথা নাড়ল, বলল, না দেখি নি।

এ রকম কি হতে পারে যে, দেখেছ কিন্তু বুঝতে পার নি?

হতে পারে। ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, তবে তার সম্ভাবনা খুব কম। মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র আর্কাইভ ঘরে কী আছে সেটা গোপন রেখেছে, কিন্তু অন্য সবকিছু খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। সেখানে নেই।

কীশা ভুরু কুঁচকে বলল, তা হলে?

ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, ধরে নাও তোমার কাছে যে পরিমাণ এন্টি ম্যাটার আছে সেটা দিয়ে আধখানা পৃথিবী কিংবা বৃহস্পতির একটা চাঁদ উড়িয়ে দিতে পারবে! পৃথিবীর কোনো মানুষ আগে এ রকম কিছু করে নি–সেটা চিন্তা করে তুমি যদি একটু আনন্দ পেতে চাও পেতে পার।

কীশা বিমর্ষ মুখে বসে রইল, তাকে দেখে মনে হল না সে ব্যাপারটি থেকে কোনো আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে।

পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা তারা আর্কাইভ ঘরের বাক্সগুলো খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রথম কয়েক ঘণ্টার মাঝেই বুঝতে পারল ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব। বাক্সগুলো অত্যন্ত যত্ন করে রাখা আছে, বাইরে থেকে সেগুলো মসৃণ এবং কোথাও খোলার মতো কোনো জায়গা নেই। ক্রোমিয়াম এবং টাইটানিয়ামের যে সংকর ধাতু দিয়ে বাক্সগুলো তৈরি করা হয়েছে সেগুলো কাটার মতো কোনো যন্ত্রপাতি মহাকাশযানে নেই। বাক্সগুলোর কোনো কোনোটি স্পর্শ করলে ভিতরে খুব সূক্ষ্ম কম্পন অনুভব করা যায়, ভিতরে কোনো এক ধরনের যন্ত্রপাতি চলছে, কিন্তু সেগুলো কী ধরনের যন্ত্রপাতি বোঝার কোনো উপায় নেই।

প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তারা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল। মহাকাশযানের যারাই এই বাক্সগুলো রেখেছে তারা চায় না এগুলো ভোলা হোক। এর মাঝে রহস্যটুকু যেন আড়াল থাকে সেটাই তাদের উদ্দেশ্য। মহাকাশযানটি এর মাঝে বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ বলের আওতার মাঝে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে তার গতিবেগ বাড়ছে এবং সবাই সেটা বুঝতে পারছে। বিশাল মহাকাশযানটি বৃহস্পতির প্রবল আকর্ষণে তার দিকে ছুটে চলছে, তাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় নেই।

আর্কাইভ ঘরের বাক্সগুলো খুলতে না পেরে মহাকাশযানের চার জন আবার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে একত্রিত হয়েছে। ত্ৰালুস এবং শুমান্তি যে করেই হোক পুরো ব্যাপারটিকে বেশ সহজভাবে নিয়েছে। জন্মের পর থেকেই ক্লোন হিসেবে বড় করার সময় সম্পূর্ণ অকারণে মৃত্যুবরণ করার জন্য তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, কাজেই এই পরিবেশটুকু তাদের জন্য একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগামী কয়েক দিনের মাঝে যে ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটবে সে সময় তারা যেন সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় থেকে মহাকাশযানের সত্যিকার মানুষ দুজনকে সাহায্য করতে পারে এখন সেটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

কীশা এর মাঝে বেশ ভেঙে পড়েছে, তার চেহারায় উদভ্রান্ত মানুষের একটি ছাপ পড়েছে। ইরন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, কীশা! তুমি মনে হয় বেশি ভেঙে পড়েছ–তুমি সম্ভবত জান না মৃত্যু খুব খারাপ কিছু নয়।

মৃত্যু নিয়ে আমার খুব একটা চিন্তা নেই ইরন। কিন্তু তার আগে আমাদের কিছু করার নেই, পুরো সময়টা বসে বসে দেখব আমরা বৃহস্পতিতে আছাড় খেয়ে পড়ছি, আমি সেটা মানতে পারছি না।

তুমি কী করতে চাও?

কিছু একটা করতে চাই। কোনোভাবে চেষ্টা করতে চাই।

আমাদের কোনোরকম চেষ্টা করার কিছু নেই। মহাকাশযানটির কক্ষপথ এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন আমরা সরাসরি বৃহস্পতিতে গিয়ে আঘাত করি। ইরন স্ক্রিনের দিকে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ, বৃহস্পতি গ্রহ। মাঝখানের লাল অংশটুকু দেখে মনে হয় না যে একটা লাল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে?

কীশা মাথা নেড়ে বলল, আমি দেখতে চাই না। একটা গ্রহ যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

ত্রালুস ইতস্তত করে বলল, কীশা, তোমাকে আমরা ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। ঘুমের মাঝেই এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না।

কীশা মাথা নাড়ল, বলল, না, আমি ঘুমাতে চাই না। আমি শেষটুকু দেখতে চাই।

ইরন অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে থাকে, তাকে খুব চিন্তিত দেখায়, কিছু একটা জিনিস তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কিন্তু সে ঠিক ধরতে পারছে না।

দেখতে দেখতে আরো চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে, মহাকাশযানের গতিবেগ আরো বেড়ে গেছে, বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডলের সূক্ষ্ম স্তরের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। মহাকাশযানের সুচালো অ্যান্টেনাগুলোতে এক ধরনের নীলাভ আলো দেখা যাচ্ছে–সম্ভবত আয়োনিত১৮ গ্যাসের কারণে। স্ক্রিনে বৃহস্পতি গ্রহটি আরো স্পষ্ট হয়েছে, তার উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রবাহ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে গ্রহটিকে জীবন্ত একটি কুৎসিত প্রাণী বলে মনে হয়। এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে সবাই গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গত চব্বিশ ঘণ্টা কীশা মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অনেকভাবে পুনরায় নতুনভাবে চালু করতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে আবার কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিলটা ঘিরে। মহাকাশযানের চার জন এসে বসেছে। ইরনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট এবং সে অন্যমনস্কতাবে আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর শব্দ করছে। কীশা খানিকটা ইরনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ইরন।

ইরন মাথা তুলে কীশার দিকে তাকাল, বল।

তুমি কী চিন্তা করছ?

সেরকম কিছু নয়।

কিছুক্ষণ আগে দেখলাম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কম্পিউটারে কিছু একটা হিসাব করছ।

হ্যাঁ।

কী হিসাব করছ?

সেরকম কিছু নয়।

আমাদের বলতে চাইছ না?

ইরন কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। কীশা একটু আহত স্বরে বলল, ইরন তুমি আমাদের মাঝে একমাত্র বিজ্ঞানী। আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচানোর যদি কোনো উপায় থাকে সেটা শুধু তুমিই ভেবে বের করতে পারবে।

কোনো উপায় নেই।

হয়তো সাধারণ হিসাবে নেই। কিন্তু কোনো অসাধারণ হিসাবে। কোনো বিচিত্র উপায়ে–যে উপায়ে সাফল্যের সম্ভাবনা খুব কম?

ইরন তীক্ষ্ণ চোখে কীশার দিকে তাকাল, বলল, তুমি কোন উপায়ের কথা বলছ?

আমি জানি না। কীশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অস্বাভাবিক কোনো উপায়।

যেমন?

যেমন একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে যাওয়া।

ওয়ার্মহোল? শুমান্তি মাথাটা একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কী?

ইরন নিচু গলায় বলল, দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থান এবং সময়কে একটা ফুটো দিয়ে জুড়ে দেওয়া যায়। সেটাকে বলে ওয়ার্মহোল।

তার মানে হঠাৎ করে সামনের স্থানটুকুর মাঝে একটা ফুটো তৈরি করা যাবে এবং সেই ফুটো দিয়ে বের হয়ে আমরা অন্য একটি জায়গায় অন্য একটি সময়ে বের হয়ে আসব?

অনেকটা সেরকম?

সেই জায়গাটা কোথায়?

অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে, অন্য কোনো শতাব্দীতে।

তুমি সেটা করতে পার?

ইরন হেসে ফেলল, বলল, না পারি না। তবে আমি এ বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। পৃথিবীতে একবার একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে গিয়ে প্রায় আধখানা শহর ধ্বংস করে ফেলেছিলাম।

কীশা সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি এখন আবার চেষ্টা করে দেখ। এখানে ধ্বংস করার কিছু নেই। আমাদের মহাকাশযানে প্রচুর এন্টি ম্যাটার আছে, স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রকে

হয়তো প্রচণ্ড চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারবে।

ইরন সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি তাই মনে কর?

চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। আমরা তো এমনিতেই মারা যাব।

যদি সত্যি সত্যি ওয়ার্মহোল দিয়ে বের হয়ে অন্য কোনো জগতে চলে যাই?

সেটা তো আর এর থেকে খারাপ হবে না।

ইরন কীশার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার তাই ধারণা?

হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা।

.

ইরন কাজে লেগে গেল। পৃথিবীর একটি সম্ভ্রান্ত ল্যাবরেটরিতে যে কাজটি করার কথা, মহাকাশযানের সীমিত সুযোগ–সুবিধার মাঝে সেই কাজটি মোটামুটি অসম্ভব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেখা গেল সেটি তত কঠিন নয়। মহাকাশযানটি যে প্রচণ্ড বেগে বৃহস্পতির দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটি ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় সঠিক বেগ হিসাবে বের হয়ে এল। এন্টি ম্যাটারকে সামনে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত হিসাবে দুটি শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন পাওয়া গেল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জন্য এন্টি ম্যাটারের সমান পরিমাণ ভরকে প্রস্তুত। করা হল। এখন বাকি রয়েছে হিসাব করে বের করা কখন ঠিক কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো এবং ওয়ার্মহোলের মুখটি খোলার পর তার ভিতরে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। মহাকাশযানের কম্পিউটারকে এই ধরনের হিসাবে বিশেষ পারদর্শী পাওয়া গেল। শুমান্তি প্রচলিত শিক্ষা পায় নি, কিন্তু এই মেয়েটি অসাধারণ বিজ্ঞানমনস্ক এবং কিছু জিনিস বুঝিয়ে দেবার পর সে প্রয়োজনীয় হিসাব করার কাজটি খুব সুচারুভাবে করতে শুরু করল। ত্রালুস এবং কীশা এন্টি ম্যাটারকে গতিপথের নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানোর জন্য রকেট ইঞ্জিন দুটিকে প্রস্তুত করতে শুরু করল।

পরবর্তী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে ইরন বৃহস্পতির পৃষ্ঠদেশে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে। তার ভিতর দিয়ে অন্য কোনো একটি জগতে পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। মহাকাশযানের কম্পিউটারের হিসাব অনুযায়ী সাফল্যের সম্ভাবনা দশমিক শূন্য তিন। যদি কিছু না করার চেষ্টা করে তা হলে বৃহস্পতির বায়বীয় পৃষ্ঠে ডুবে ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় এক শ ভাগ, কাজেই এই চেষ্টাটুকু করে দেখতেই হবে।

প্রস্তুতি পুরোপুরি শেষ করে চার জন নিজেদের ক্যাপসুলে আশ্রয় নেয়। সত্যি সত্যি যদি একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারে তা হলে মহাকাশযানটিকে যে গতিতে তার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে সেটি অচিন্তনীয়, এর আগে কেউ কখনো ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করে নি, ভিতরে কী ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। ছোটখাটো বাধার সম্মুখীন হলেই তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

ইরন সুইচ অন করে অন্য তিন জনের সাথে যোগাযোগ করল। কীশা পাথরের মতো মুখ করে অপেক্ষা করছে। ইরন জিজ্ঞেস করল, তোমার কি ভয় করছে?

হ্যাঁ।

চমৎকার–কারণ আমরা যেটা করতে চাইছি সেটা খুব ভয়ের ব্যাপার। ভয় পাওয়ারই কথা।

কীশা কোনো কথা বলল না। ইরন আবার বলল, আমরা যে ক্যাপসুলের মাঝে আছি সেটি অত্যন্ত নিরাপদ, অনেকটা মাতৃগর্ভে থাকার মতো। কাজেই তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পার।

আমি ঘুমাতে চাই না।

বেশ। যেরকম তোমার ইচ্ছা। আমরা যখন ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করব তখন কী দেখব আমি জানি না। স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় ওলটপালট হয়ে যাবে, আশা করছি এই মহাকাশযানটি এক জায়গায় থাকবে, এর একেকটি অংশ যেন একেক শতাব্দীতে একেক। গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে না পড়ে।

সেরকম হতে পারে?

ইরন হেসে ফেলল, বলল, নিশ্চয়ই হতে পারে। বিস্ফোরণের প্রচও ঝাঁপটায় আমরা ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারি। তোমরা তো শুনেছ সাফল্যের সম্ভাবনা মাত্র দশমিক শূন্য তিন!

ক্যাপসুলের ভিতরে মনোযোগ আকর্ষণ করে বিপ ধরনের একটি শব্দ হল এবং সাথে সাথে একটি যান্ত্রিক গলা শোনা গেল, মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের সতর্ক করা যাচ্ছে। আর ষাট সেকেন্ড পর এই মহাকাশযানটি একটি বিস্ফোরণের সম্মুখীন হবে।

ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল, মহাকাশযান থেকে এন্টি ম্যাটার নিয়ে রকেট দুটি রওনা দিয়েছে। মহাকাশযানের ভর কেন্দ্রের পরিবর্তন হওয়াতে পুরো মহাকাশযানটি ভয়ানকভাবে দুলে উঠল। ক্যাপসুলের বাইরে থাকলে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। সে ক্যাপসুলের ভিতরে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকায়। ভয়ঙ্করদর্শন উজ্জ্বল লাল রঙে সময় দেখানো হচ্ছে, এক মিনিট খুব বেশি সময় নয় কিন্তু সেই সময়টাকে হঠাৎ খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে।

ইরন শান্ত গলায় বলল, কীশা, ত্ৰালুস এবং শুমান্তি, আমরা সত্যি সত্যি ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব কি না জানি না, যদি না পারি তোমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছি। যদি এই মুহূর্তটিই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত হয়ে থাকে তা হলে সেই মুহূর্তটিকে অর্থবহ করার জন্য তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

ত্রালুস নিচু গলায় বলল, আমি এত সুন্দর করে বলতে পারব না কিন্তু একই জিনিস বলতে চাই। তোমাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ।

শুমান্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি বিদায় নেব না, আমি সবার জন্য শুভ কামনা করছি।

কীশা কাঁপা গলায় বলল, ধন্যবাদ শুমান্তি।

এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত মহাকাশযানটি দুলে উঠল। মহাকাশযানের আলো নিভে গিয়ে নিভুনিভু হয়ে জ্বলতে থাকে। কর্কশ এলার্মের শব্দ মহাকাশযানটিকে এক ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে নেয়।

ইরন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পদার্থ–প্রতিপদার্থের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে অচিন্তনীয় ভরকে কেন্দ্রীভূত করে স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রকে ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ছিন্ন ক্ষেত্রের অন্যপাশে এক বিচিত্র জগৎ অপেক্ষা করছে। ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন স্থান। হয়তো দূর কোনো গ্যালাক্সি, অন্য কোনো নক্ষত্র, কোনো ব্ল্যাকহোল বা কোয়াজারের কাছাকাছি। কোনো অজানা গহ, অজানা জগৎ। সেই দূর জগতে ভিন্ন এক সময়ে তারা পৌঁছাবে কয়েক মুহূর্তে। ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

চারপাশের দৃশ্য দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বৃহস্পতি গ্রহটি যেন চোখের সামনে গলে তরল পদার্থের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের গ্রহ নক্ষত্র গ্রহাণুপুঞ্জ যেন বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে, তার মাঝে ধীরে ধীরে নিকষ কালো একটি অন্ধকার গহ্বর বের হয়ে এল। সেই গহ্বরের মাঝে তাদের মহাকাশযান ছুটে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল, মহাকাশযানের আলো নিভে গেল। ইঞ্জিনের গর্জন, এলার্মের তীব্র শব্দ সবকিছু থেমে গেল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ ধদ্ধ করছে। ইরন কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, বুকের শব্দও ধীরে ধীরে থেমে আসছে। আলো নেই, অন্ধকার নেই, শব্দ নেই, নৈঃশব্দ্য নেই, বিচিত্র বোধশক্তিহীন এক জগতে সে ডুবে যাচ্ছে। পুরো মহাকাশযানটি অদৃশ্য এক জগতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইরন নিজের সমস্ত চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু বুঝতে পারে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে।

এটাই কি মৃত্যু? নাকি এটা নতুন জীবন?