।। পাঁচ।। একখানি ছবি
হাসপাতালে বেরোবার সময়ে রীণা বলল, সন্ধের মধ্যে ফিরবে কিন্তু।
সঞ্জয় হেসে বলল, বাইরে বেশিক্ষণ থাকার তেমন কোনো আকর্ষণ এখনো পর্যন্ত নেই।
—ঠাট্টা রাখো। সন্ধেবলো লোডশেডিং হলে আমার খুব ভয় করে।
জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে সঞ্জয় বলল, খাস কলকাতা শহরে থেকেও ভয়? তাও তো তিনতলার ওপর।
উত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, রীণা বলল, আমার জিনিসগুলো আনতে ভুলো না।
—না, ভুলব না। তবে তুমিও একটা কথা মনে রেখো, রাত্তিরের ব্যাপারগুলো যেন তোমার বান্ধবীটিকে বলো না। এক কান থেকে পাঁচ কানে চলে যাবে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
—আমার আবার বান্ধবী কে? রীণার কপালে সুন্দর ভাঁজ পড়ল।
—ওই যে নীচে—বলে সঞ্জয় আঙুল দিয়ে দোতলার ঘরটা দেখিয়ে দিল।
—ওঃ! বন্দনার মা। রীণা একটু হাসল, বান্ধবী হতে যাবেন কেন? বয়েসে ঢের বড়ো। তবু ওঁরা কাছে থাকেন বলে গল্প করে বাঁচি।
—গল্প যত পারো করো। শুধু ভূতের গল্প ছাড়া।
বলতে বলতে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।
.
সন্ধের আগেই সঞ্জয় ফিরল। হাতে কিছু জিনিসপত্তর ছিল বলে ট্যাক্সি করে ফিরতে হয়েছিল। ট্যাক্সি থেকে নামতেই মহিমারঞ্জনবাবু নমস্কার করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে আরো কয়েকজন। এঁরা সবাই এ বাড়ির ভাড়াটে। সকলের সঙ্গে আলাপ নেই। আলাপ করার সময়ও নেই। একজনের সঙ্গেই মাঝে মধ্যে কথাবার্তা হয়। তিনি দোতলার নিখিলবাবু—বন্দনার বাবা। এঁদের মধ্যে সঞ্জয় তাঁকে দেখতে পেল না।
—কিছু বলবেন? সঞ্জয় প্রতি—নমস্কার করল।
—কাল রাত্তিরে আপনার ঘরে একটা যেন গোলমাল শুনলাম!
সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বললেন, আমরাও শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম সকালেই জিজ্ঞেস করব কিন্তু এত ব্যস্ত হয়ে আপনি বেরিয়ে গেলেন যে—
মহিমাবাবু কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আমার ওয়াইফ তো রাত্তিরেই খোঁজ নিতে যাচ্ছিলেন। বললেন, একই বাড়ির বাসিন্দে। বিপদ—আপদ হলে পাশে দাঁড়াতে হয়। তা আমি বারণ করলাম—এখুনি যেও না। আগে দ্যাখো গুরুতর কিছু কি না। তা ওয়াইফ আর গেলেন না। আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। আর কিছু শুনতে পেলাম না। তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম।
সঞ্জয় একটু হাসল।—ধন্যবাদ। ব্যাপার কিছুই নয়। একটা বাজে স্বপ্ন দেখে আমার স্ত্রী ভয় পেয়েছিলেন।
—তাও ভালো। আমরা ভাবলাম বুঝি চোর—ডাকাত। যা দিনকাল পড়েছে।
আর একজন বলেলেন, কিন্তু ঝনঝন করে একটা কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ পেলাম যেন।
—ও কিছু নয়। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি এড়িয়ে যেতে চাইল—টেবিলে গেলাসটা ছিল। হুলো বেড়াল লাফিয়ে উঠতে গিয়ে—
ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন, হুলো বেড়াল! বলেন কী!
মহিমাবাবু মাথা নাড়লেন, এ বাড়িতে তো এতদিন রয়েছি। বেড়াল তো দেখিনি। বিভূতিবাবু কী বলেন?
বিভূতিবাবু সিগারেট খাচ্ছিলেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, হুলো বেড়াল! আজ পর্যন্ত একটা বেড়ালছানাও তো চোখে পড়েনি, বেড়াল থাকলে তো বেঁচে যেতাম। ইঁদুরের জ্বালায় অস্থির।
সঞ্জয় এঁদের অহেতুক কৌতূহলে বিরক্ত হচ্ছিল। কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে বলল, তাহলে হয়তো ইঁদুরেই ভেঙে থাকবে। আচ্ছা, আমি এখন যাই। আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছেন।
বলেই সিঁড়ির দিকে চলে গেল। মহিমাবাবুরা কেমন একটু অবাক হয়ে সঞ্জয়কে দেখতে লাগলেন।
—ভদ্রলোক বড়ো অহংকারী।
আর একজন বললেন—ডাক্তার কি না।
খুবই বিরক্ত হয়েছিল সঞ্জয়। কাল রাত্তিরে ব্যাপারটা তাহলে জানাজানি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা যে নিতান্তই তুচ্ছ তা ওঁরা যেন মানতে চাইছেন না। আসলে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা যুক্তির ধার ধারতে চায় না। ভয় পেতে আর ভয় পাইয়ে দিতে ভালোবাসে।
পরক্ষণেই সঞ্জয়ের মনে হল, একটা গোঁজামিল কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সেটা ওই গেলাস ভাঙা নিয়ে। সত্যিই তো এখানে এসে পর্যন্ত একটা বেড়ালও কোনোদিন চোখে পড়েনি। তাহলে কাল রাত্তিরে হঠাৎ বেড়াল এল কোথা থেকে? এলই যদি তো গেল কোথায়? আর এল এমন সময়ে যখন নাকি রীণা দেখছিল কিছু একটা! নাঃ, এর কোনো মীমাংসা নেই দেখছি।
—বাবাঃ! কী এত গল্প হচ্ছিল ওঁদের সঙ্গে? হাসতে হাসতে রীণা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।
যাক, রীণাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। মুখে বললে, গল্পই বটে। কাল রাত্তিরের ব্যাপারটা সব জানাজানি হয়ে গেছে। চেঁচামেচি করে যা একটা কাণ্ড করলে!
—কাণ্ড তো আমিই করেছি! গেলাসটাও আমি ভেঙেছি না?
আবার সেই গেলাস! সঞ্জয় বিষয়টা ঝেড়ে ফেলবার জন্যে হেসে বলল, খুব খোশ মেজাজ দেখছি। আজ আর বুঝি তিনি দর্শন দেননি?
মুহূর্তে রীণার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
—দোহাই তোমার! আর মনে করিয়ে দিয়ো না। হাত মুখ ধুয়ে নাও। আজ কী জলখাবার করেছি বল দিকি?
—ঘুগনি—স্পেশালিস্টের হাতে ঘুগনি ছাড়া আর কী হবে?
—আহা! ঘুগনি ছাড়া আর যেন কিছু করি না? নিন্দুক আর কাকে বলে?
বলতে বলতে রীণা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।
এক’দিন রীণার কথাবার্তা শুনে, মুখ—চোখের অবস্থা দেখে সঞ্জয় দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। আজ ওর এই হাসিখুশি ভাব দেখে যেন নিশ্চিন্ত হল।
পুপু শুয়ে শুয়ে খেলা করছিল। সঞ্জয় কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।
গত রাত্তিরের আতঙ্ক ভোলার জন্যে আজ রীণা সারা দুপুর নানা কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল। কিছুক্ষণ দোতলায় নেমে গিয়ে নিখিলবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করেছে। মহিলাটিকে রীণার খুব ভালো লাগে। ওপরে এসে কিছুক্ষণ নতুন—কেনা টেপটা বাজিয়েছে। মেশিনে পুপুর জন্যে একটা জামা সেলাই করতে বসেছিল। সাড়ে তিনটে নাগাদ রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছিল কেক তৈরি করার জন্যে।
কেক খেয়ে সঞ্জয় ভারি খুশি।
—আঃ! দারুণ! দাঁড়াও, আমিও কিছু এনেছি তোমার জন্যে। বলে ব্যাগ থেকে কতকগুলো প্যাকেট বার করল। এই নাও তোমার ডালমুট।
খুশিতে রীণার দু—চোখ নেচে উঠল। —ঝাল নয় তো? পুপু আবার খেতে শিখেছে।
—খেয়েই দ্যাখো। আর—এই পুপুর দুধ। এই চা। এবার খুব ভালো ফ্লেভারওলা চা এনেছি। এই তোমার সার্টিফিকেটের জেরক্স কপি।
—যাক বাঁচলাম। কী ভাগ্যি সার্টিফিকেটগুলো হারাওনি।
—আমি সময়ে সময়ে হার মানি, কিন্তু চট করে কিছু হারাই না।
—থাক। হয়েছে। আজ পর্যন্ত কটা ছাতা, কটা টর্চ, কটা পেন হারিয়েছ তার হিসেব দেব? ওটা আবার কী? ব্যাগের মধ্যে!
—ওই দ্যাখো, একদম ভুলে গেছি। অবশ্য এমন—কিছু নয়। একটা ছবি।
.
গতকাল হাসপাতাল থেকেই সঞ্জয় গিয়েছিল এক বৃদ্ধ রুগিকে দেখতে। বৃদ্ধ সঞ্জয়ের চিকিৎসায় ক্রমশ উন্নতি করছেন।
রুগি দেখা হয়ে গেলে তাঁর বাড়ির লোক অনুরোধ করল এক কাপ কফি খাবার জন্যে। সঞ্জয় খুব টায়ার্ড ছিল। খেতে রাজি হল।
বাইরের ঘরে বসে বৃদ্ধের ছেলের সঙ্গে সঞ্জয় গল্প করছিল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়িটা দেখছিল। পুরোনো বাড়ি। সামনে অনেকখানি উঠোন। ওদিকে ভাঙা পুজোদালান। বাড়ির একদিকটা ভেঙে পড়েছে।
সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, গোটা বাড়িটাই আপনাদের?
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ।
—পুজোটুজো হত দেখছি।
—হ্যাঁ, সে—সব বহুকাল আগে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো দুইই হত। শুনেছি একবার বলি বেধে যাওয়ার পর থেকে পুজো বন্ধ হয়ে যায়।
—বাড়িটা কবে তৈরি হয়েছিল?
ভদ্রলোক বললেন, তা বলতে পারি না। ঠাকুর্দা কিনেছিলেন জলের দরে, সেই বম্বিং—এর সময়ে।
সঞ্জয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা, আগে তখন এই—সব জায়গা কীরকম ছিল?
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, আমি ঠিক বলতে পারব না।
সঞ্জয় একটু লজ্জিত হল। বলল, তা ঠিক। আপনি আর কী করে বলবেন? আসল কথা কী জানেন, এইরকম পুরোনো বাড়ি দেখলে আমার কেমন কৌতূহল হয় এর অতীতকে জানার জন্যে।
ভদ্রলোক বললেন, সে—সব জানতে হলে বাবার কাছে চলুন।
সঞ্জয় একটু ইতস্তত করল। রুগির কাছে ডাক্তার একই সময়ে দুবার গেলে রুগি ঘাবড়ে যেতে পারে।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি ভাববেন না। আমি বাবাকে বলে আসছি।
ভদ্রলোক ওপরে চলে গেলেন। একটু পরে এসে বললেন, আসুন।
বৃদ্ধ খাতির করে সঞ্জয়কে বসালেন। বললেন, আপনি কি এ বাড়িটা সম্বন্ধেই কিছু জানতে চান?
সঞ্জয় বলল, না, শুধু এ বাড়িটাই নয়। এরকম বোধ হয় আরো অনেক পুরোনো বাড়ি আছে। এই ধরুন আমি যে বাড়িটায় ভাড়া আছি—
—সেটা কোথায়?
—যশোর রোডের ওপরে বাঙ্গুরের কাছে। সে বাড়িটাও খুব পুরোনো। তিনতলা বাড়ি। তিনতলাটা ইনকমপ্লিট। ওপরে আবার একটা ভাঙা গম্বুজের মতো আছে।
বৃদ্ধ বললেন, পুরোনো বাড়ি সম্বন্ধে আপনার কৌতূহল আছে জেনে খুব ভালো লাগল। কলকাতায়—বিশেষ করে মারাঠা ডিচের ওপাশের জায়গাগুলো একশো—দেড়শো বছর আগে কী ছিল তা কল্পনাই করা যায় না। এ বিষয়ে আমি একজনের নাম জানি, গোটা উল্টোডিঙি এলাকার অর্থাৎ আজ যাকে বলে লেকটাউন, কালিন্দী, বাঙ্গুর, বরাট এ—সব জায়গার ঠিকুজি—কুষ্ঠী তাঁর কণ্ঠস্থ। তাঁর নাম শিবানন্দ ভট্টাচার্য। থাকেন বাগুইহাটিতে। বয়েস একশো তিন। ইচ্ছে করলে তাঁর কাছে যেতে পারেন।
—একশো তিন বছর বয়েস! সঞ্জয় অবাক হল।
—হ্যাঁ, এখনো তেতলা—একতলা করেন। সারাজীবন জ্যোতিষচর্চা নিয়ে থেকেছেন— জপ—তপ—ব্রহ্মচর্য—ওসব মশাই আলাদা স্তরের মানুষ। দাঁড়ান, ওঁর ছবি দেখাচ্ছি।
এই বলে ছেলেকে ইশারা করলেন। ভদ্রলোক তখনই ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। হাতে জীর্ণ একটা খাম। বৃদ্ধ খাম থেকে জীর্ণতর বিবর্ণ একটা ফটোগ্রাফ বের করলেন।
—এই হলেন শিবানন্দ ভট্টাচার্য। আর তাঁর পদতলে আমি।
সঞ্জয় ছবিটা দেখল। পিছনে লেখা রয়েছে—পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে স্নেহোপহার। নীচে তাঁর স্বাক্ষর। সেই সঙ্গে ঠিকানা।
—ছবিটা আপনি নিয়ে যান। বয়েসের জন্যে ওঁর মেজাজটা এখন রুক্ষ হয়ে গেছে। যদি আপনি দেখা করতে যান তাহলে এই ছবিটা দেখিয়ে বলবেন আমি পাঠিয়েছি। তা হলে উনি বোধহয় আপনাকে ফিরিয়ে দেবেন না।
.
ছবিটা কাল রাত্তিরে আর বের করা হয়নি। বাইরের ঘরে ব্যাগের মধ্যেই ছিল।
ছবিটা রীণা খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখছিল। সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, কী এত দেখছ?
—এত বয়েস কিন্তু চোখ দুটো দ্যাখো যেন জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন ত্রিকালদর্শী কোনো সাধক।
বলতে বলতে রীণার দু—চোখও যেন কেমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, অমন করে দেখছ কেন?
—এঁকে কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়—
—এঁকে আবার দেখবে কী করে? বহুকাল কলকাতার বাইরে যাননি। তুমিও বড়ো একটা কলকাতায় আসোনি।
রীণা কোনো উত্তর দিল না। হঠাৎ উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
—কী হল?
—মাথার ভেতরটা কীরকম করছে!