ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

১.৪ রাত তখন গভীর

।। চার।। রাত তখন গভীর

নতুন জায়গায় নতুন সংসারে রীণা কিছুটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তবু বেলা তিনটে বাজলেই ও একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। একদিন যে এসেছিল সে কি আবার কোনোদিন আসবে? কিন্তু না, বেশ কিছুদিন তো হয়ে গেল আর কাউকে দেখা যায়নি, জুতোর শব্দটুকুও না।

রীণা এখন বেশ নিশ্চিন্ত। কিন্তু ভারি লজ্জা করে সেদিনের কথা ভাবতে। কী যে হয়েছিল—শুধু শুধু ভয় পেয়ে গেল। ছিঃ।

গত রবিবার প্রফেসার রুদ্র এসেছিলেন। ইনি ডাক্তারের ছোটোকাকার বন্ধু। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে ওঁর কাছে ওকে প্রায়ই যেতে হত। তাই সম্পর্কটা খুব ঘনিষ্ঠ।

প্রফেসার রুদ্র কলকাতার এক নম্বর ডাক্তারদের মধ্যে একজন। মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। কলকাতায় এসে পর্যন্ত ডাক্তার ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎই গত রবিবার ও প্রফেসারকে নিয়ে এল।

বেশ ভালোই লাগছিল। এই প্রথম একজন চেনাশোনা বিশিষ্ট লোক তাদের বাড়িতে এল। কিন্তু ডাক্তার যখন খুব মজা করে সেদিনের ঘটনাটা প্রফেসার রুদ্রকে বলছিল, রীণার তখন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।

প্রফেসার অবশ্য কোনো ঠাট্টা করলেন না। হাসলেন একটু।

এখন তাই সেদিনের কথা মনে হলে রীণার ভারি অস্বস্তি হয়।

কিন্তু সেদিন যা দেখেছিল তা কি ভুল? চোখ কি এত বিশ্বাসঘাতকতা করে? হবেও বা। ইংরিজিতে ‘ইলিউশান’ নামে যে একটা কথা আছে তা বোধহয় এটাই।

.

সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের বেশ রাত হয়ে গেল।

ওরা বেশি রাত জাগে না। সাড়ে নটার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ে। এদিন ওর ফিরতে রাত হওয়ায় রীণা ভয় পাচ্ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরতে সঞ্জয়ের প্রায়ই রাত হয়। কিন্তু কোনোদিন ভয়—টয় করত না। আজ হঠাৎই কেমন ভয় করল। সে কথাটা আর বলল না। খেয়েদেয়ে ওরা শুয়ে পড়ল। রীণা পুপুকে নিয়ে খাটে শোয়। ডাক্তার শোয় মেঝেতে।

অনেক রাত্রে হঠাৎ রীণার ঘুম ভেঙে গেল। কেন যে ঘুম ভাঙল রীণা ঠিক বুঝতে পারল না। শুনতে পেল যশোর রোড দিয়ে একটা মাতাল চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে। মাতালটা বোধহয় রোজই এই সময়ে যায়। এর আগেও শুনেছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে অশ্রাব্য গাল দিতে দিতে যায়। পরিচিত পরিবেশ। তবু কীরকম যেন গা—ছমছম করতে লাগল। মনে হল ঘরে বুঝি সে একা! সঞ্জয় বুঝি রুগি দেখে এখনও ফেরেনি। ঘোরটা কেটে যেতেই মনে পড়ল—না, সঞ্জয় অনেকক্ষণ ফিরেছে। ওইতো মেঝেতে শুয়ে আছে।

এমনি সময় পুপু হঠাৎ কেঁদে উঠল। ঠিক এইরকম ভাবেই কেঁদেছিল সেই সেদিন বেলা তিনটের সময়ে! কাঁদতে কাঁদতে পুপু ককিয়ে গেল। রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে টর্চ জ্বেলে বিছানা, বালিশের তলা দেখে নিল। না, কিছু নেই।

রীণা তখন পুপুকে বুকে চেপে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করল। পুপু ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে কাঁদছে। রীণা তখন ওকে শুইয়ে চাপড়াতে লাগল। তখনি হঠাৎ রীণার মনে হল কোথায় যেন কীসের শব্দ হচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দ। মনে হল নীচের তলার কোনো ঘরে কেউ যেন দেওয়ালে পেরেক পুঁতছে।

হবেও বা। হয়তো মশারির দড়িসুদ্ধু পেরেক উঠে এসেছে কারো ঘরে। তাই পেরেক ঠুকছে। রীণা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু একটু পরেই আবার শব্দ—এবার সেই হালকা পেরেক পোঁতার শব্দটা ভারী হয়ে উঠছে। কেউ যেন কাঠের জুতো পরে একটা একটা পা ফেলে গুনে গুনে সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠে আসছে। রীণা কান খাড়া করে রইল। এত রাতে কে আসছে অমন করে?

হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল।

শব্দটা কোথায় এসে থামল দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতেই রীণার শরীরটা হিম হয়ে গেল। দেখল আবছা একটা মূর্তি তাদের বসার ঘরে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে যেন কালো কোট, কালো প্যান্ট।

রীণা শুয়ে শুয়েই মানুষটাকে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল। না, চোখের ভুল নয়। একটা মানুষই। কিন্তু এত আবছা কেন? লোকটা কে হতে পারে?

পুপু আবার কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রীণা সচেতন হয়ে উঠল।

—ওগো, শুনছ! রীণা চাপা গলায় সঞ্জয়কে ডাকল। ওঠো না। তোমায় বোধহয় কেউ ডাকতে এসেছে।

—আমায়? কোথায়?

—ওই যে বাইরের ঘরে। টেবিলের কাছে।

অন্ধকারের মধ্যে যতদূর সম্ভব দৃষ্টি তীক্ষ্ন করে সঞ্জয় তাকাল, কই? কেউ তো নেই।

রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, ওই তো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে কীসে যেন ধাক্কা খেল। মশারির দড়িটা ছিঁড়ে গেল। অন্ধকারে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ নামিয়ে দিল। আলো জ্বালল না। লোডশেডিং।

সঞ্জয় বিছানা থেকে বড়ো টর্চটা নিয়ে জ্বালল। আর ঠিক তখনই কী যেন পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।

টর্চের আলো অন্ধকার দু—ফাঁক করে সোজা সিঁড়ির মুখে গিয়ে পড়ল।

—কই? কোথায়?

—ওই যে—বাথরুমের দিকে। ওই যে ছুটছে—রীণা চিৎকার করে উঠল।

সঞ্জয় টর্চ হাতে সেই দিকে ছুটল।

—যেয়ো না, যেয়ো না—

সে কথায় কান না দিয়ে সঞ্জয় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল।

কিন্তু কোথায় কে? শুধু ফ্ল্যাশের পুরানো ট্যাঙ্ক চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে যাচ্ছে।

—তোমার যত আজগুবি কাণ্ড! বলতে বলতে সঞ্জয় ঘরে ফিরে এল।

—কী আজগুবি কাণ্ড? কেমন একরকম তীব্র তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে রীণা তাকাল। সে দৃষ্টি অস্বাভাবিক। সঞ্জয় সতর্ক হল। আর কিছু বলল না।

সে রাত্তিরে দুজনের কারোরই ভালো করে ঘুম হল না। সঞ্জয় খুবই বিরক্ত। বিরক্ত হবার কারণও আছে। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি গেছে। ডিউটির পরও রুগি দেখতে ছুটতে হয়েছে। তারপর আবার এই ব্যাপার। রাত্তিরটুকুতেও যদি ঘুম না হয় তাহলে তো আর পারা যায় না।

অন্ধকারেই কোনোরকমে মশারির দড়ি ঠিক করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঠিক কী দেখেছ বলো তো?

রীণা তখন অনেকটা স্বাভাবিক। সব ব্যাপারটা বলল।

সঞ্জয় কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলল, আবার সেই ব্ল্যাক স্যুট! কী করে ভাবতে পারলে রাত দুপুরে একজন লোক এসে বাইরের ঘরে ঢুকেছে? এটা কি সম্ভব? দরজাটাও তো তুমি নিজে বন্ধ করেছিলে? ওই দ্যাখো, দরজা এখনো বন্ধ। বলেই মশারির ভেতর থেকেই দরজার ওপর টর্চ ফেলল।

রীণা চুপ করে রইল। তারপর শুকনো গলায় বলল, কী একটা পড়ে ভেঙেছে।

সঞ্জয় বলল—হ্যাঁ, সেও তোমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কই আমি তো ভাঙার চিহ্নমাত্রও দেখতে পেলাম না।

রীণা কোনো একটিরও উত্তর দিতে পারল না। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।

সঞ্জয় হেসে বলল, নাঃ, তোমার দেখছি নার্ভ ফেল করছে। এরপর মাথাটা একেবারে যাবে।

—বিশ্বাস করো—

রীণা মিনতির স্বরে আরো কী বোঝাতে যাচ্ছিল, সঞ্জয় বলল, ও সব কথা থাক। এখন একটু ঘুমোও তো। বলে নিজেই পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়ল।

.

সকালের রোদ খাটের ওপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছে। হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমোত। কিন্তু রীণার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।

—এ—ই শুনছ!

—উঁ।

—একবার এসো না।

—দূর বাবা, ওখান থেকেই বলো না।

—বললে হবে না। তাড়াতাড়ি এসো।

—উঃ! জ্বালালে! সকাল থেকেই—

ঘুম—জড়ানো চোখে সঞ্জয় উঠে এল।

—এসো এইখানে। এটা কী? রীণা আঙুল দিয়ে মেঝেটা দেখল।

সঞ্জয় দেখল টেবিলের নীচে একটা গেলাস ভেঙে পড়ে আছে।

রীণা দু—হাত কোমরে রেখে বলল, খুব তো বলেছিলে আমি পাগল হয়ে গেছি। এখন নিজের চোখেই দ্যাখো।

সঞ্জয় হেঁট হয়ে কাচগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। গেলাসটা উঁচু জায়গা থেকেই পড়ে ভেঙেছে। কেউ যেন টেবিল থেকে গেলাসটা ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে!

—এখন বুঝছ?

সঞ্জয় বাসি মুখেই একটা সিগারেট ধরাল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, বলতে চাও ভূতে গেলাস ভেঙেছে?

—আমি আর কী বলব? তুমি নিজেই দ্যাখো।

—টেবিলের ধারে গেলাসটা রেখেছিলে, টিকটিকি—ফিকটিকিতে ফেলে দিয়েছে।

—না কক্ষনো ধারে রাখিনি। গেলাস কেউ টেবিলের ধারে রাখে না।

সঞ্জয় কোনো উত্তর দিল না। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হেসে বলল, এতে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। বেড়ালের কাজ। যাও, এখন বেশ ফার্স্ট ক্লাস করে চা করো দিকি। মেজাজটা আসুক। আমি ততক্ষণে আর একটু শুই। বলে সঞ্জয় আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রীণা দাঁড়িয়ে রইল জানালার সামনে। উদভ্রান্ত মন। শহর কলকাতা জেগেছে। অতি পরিচিত সকাল। কিন্তু দিনের শুরু থেকেই মনটা ভারী হয়ে রইল।