জাহাজের ডেকে মেয়েগুলো শুয়ে-বসে আছে। তারা কাছাকাছি থাকলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, হাঁটুর ওপর মুখ রেখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুই একজন রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে, এই আলোতে সমুদ্রটিকে কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়।
জহুর তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনের মেয়েটিকে খুঁজে বের করল-সেও রেলিংয়ে কনুই রেখে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির চেহারায় এক ধরনের গভীর বিষাদের চিত্র, ঠিক কী কারণে জানা নেই তাকে দেখলেই জহুরের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে।
জাহাজের কর্কশ ভেঁপু বেজে ওঠে এবং প্রায় সাথে সাথেই তার। ইঞ্জিনগুলো চালু হয়ে যায়, জহুঁ ডেকে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনের মৃদু কম্পনটুকু অনুভব করল। ঘরঘর শব্দ করে জেটি থেকে সিঁড়িটা সরিয়ে নেয়া হয়, সেনাবাহিনীর একজন মানুষ মোটা দড়ির বাঁধন খুলে জাহাজটিকে মুক্ত করে দেয়। জাহাজের প্রপেলার পেছনে পানির একটা প্রবল ঢেউয়ের জন্ম দিয়ে নড়ে উঠল।
তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনের মেয়েটি হঠাৎ করে কেমন যেন একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে, সে সতর্ক দৃষ্টিতে এদিকে সেদিকে তাকালো, তারপর খুব শান্তভাবে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।
জহুর একটু অবাক হয়ে মেয়েটির পেছনে পেছনে এগিয়ে যায়। মেয়েটি সবার চোখ এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে—আলাদা করে কেউ তাকে লক্ষ করল না। জহুর একটু দ্রুত পা চালিয়ে তার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি দ্রুত নিচে নেমে ইঞ্জিন ঘরের পাশে দিয়ে জাহাজের পেছনে পৌঁছে গেল। এখানে রেলিং নেই এবং জায়গাটা বেশ বিপজ্জনক। কেউ অসতর্ক হলে পেছনে পানির প্রবল আলোড়নের ভেতর মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। জায়গাটি নির্জন, মেয়েটি সেখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে—ভোররাতের আবছা আলোতে দৃশ্যটিকে জহুরের কাছে কেমন জানি পরাবাস্তব মনে হতে থাকে।
জহুর পায়ে পায়ে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যেতে থাকে-হঠাৎ করে তার মাথায় একটা ভয়ঙ্কর চিন্তার কথা উঁকি দিতে শুরু করেছে।
জাহাজটা খুব ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে, একই সাথে গতি সঞ্চয় করতে শুরু করেছে, জেটি থেকে এটা এর মাঝে বেশ খানিকটা সরে এসেছে। মেয়েটি একবার উপরে আকাশের দিকে তাকালো, দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এলো তারপর কিছু বোঝার আগেই সে হঠাৎ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জহুর একটা চিৎকার করে সামনে ছুটে গেল কিন্তু ইঞ্জিনঘরের বিকট শব্দে কেউ তার চিৎকারটি শুনতে পেল না। জহুর জাহাজের শেষে ছুটে গিয়ে পানির দিকে তাকালো, ঘোলা পানির আবর্তনে মেয়েটির শরীরটা এক মুহূর্তের জন্যে ভেসে উঠে আবার পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। জহুর একবার পানির দিকে তাকালো একবার জাহাজটির দিকে তাকালো, সে ছুটে গিয়ে কাউকে বলে জাহাজটি থামাতে থামাতে এই হতভাগা মেয়েটি পানিতে ড়ুবে যাবে। জহুর ঠান্ডা মাথার মানুষ, কখনোই সে বিচলিত হয় না, আজকেও হলো না। মেয়েটাকে বাঁচাতে হলে কিছু একটা করতে হবে, তারপরেও তাকে বাঁচানো যাবে কি না কেউ জানে না। কিন্তু কিছু করা না হলে মেয়েটি নিশ্চিতভাবেই মারা যাবে তাই জহুর এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জাহাজটি তখন বেগ সঞ্চয় করে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, সেখানে কেউ জানতেও পারল না এখান থেকে দুজন মানুষ পর পর সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একজন আত্মহত্যা করতে, অন্যজন তাকে উদ্ধার করতে।
জহুর পানির প্রবল আলোড়নের ভেতর থেকে বের হয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে সামনে এগিয়ে যায়, মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার কাছে পৌঁছাতে হবে। পানি থেকে মাথা বের করে সে একবার চারপাশে দেখার চেষ্টা করল, পানির ঢেউ ছাড়া সে আর কিছুই দেখতে পেল না। জহুর পানিতে ড়ুব দিয়ে দ্রুত আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার মাথা তুলে তাকালো—কেউ কোথাও নেই। জহুর আরো একটু এগিয়ে আবার মাথা তুলে তাকালো। এবারে হঠাৎ করে তার মনে হলো বাম দিকে পানির ভেতর সে খানিকটা আলোড়ন দেখতে পেয়েছে। সেটি সত্যিই মেয়েটি কি না বা এটি চোখের ভুল কি না জহুর সেটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল—সে দুই হাত নেড়ে অদৃশ্য কিছু খুঁজতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার হাত একজন মানুষের শরীর স্পর্শ করে। জহুর সাথে সাথে তাকে জাপটে ধরে পানির ওপর টেনে আনে। মেয়েটির শরীর নেতিয়ে আছে, জহুর তাকে তুলে ধরে তার মুখের দিকে তাকালো, চোখ দুটো বন্ধ এবং মুখে প্রাণের চিহ্ন নেই। জহুর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না, মেয়েটাকে চিৎ করে ভাসিয়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে থাকে।
সমুদ্রের তীরে এসে সে মেয়েটাকে পাজাকোলা করে এনে বালুবেলায়। শুইয়ে দেয়। মেয়েটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি না ভালো করে বোঝা গেল না, জহুর তার মাথাটা একটু ঘুরিয়ে দেয়, যেন নিঃশ্বাস নেয়া সহজ হয়। তারপর তাকে ধরে একটা ছোট ঝাকুনি দিল, ঠিক তখন মেয়েটি খকখক করে কেশে নড়ে ওঠে। জহুর মেয়েটাকে একটু সোজা করে বসিয়ে দেয়, কাশতে কাশতে মেয়েটা বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ খুলে তাকালো, তাকিয়ে জহুরকে দেখে সে একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে। জহুর জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই মেয়ে।
মেয়েটা তীব্র দৃষ্টিতে জহুরের দিকে তাকিয়ে থেকে কাশতে কাশতে বলল, আমাকে কেন তুলে এনেছ?
জহুর মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, কেন আনব না? একজন মানুষ পানিতে ড়ুবে মারা যাবে আর আমি সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব, সেটা তো হতে পারে না।
মেয়েটা চোখ বন্ধ করে বলল, আমাকে মরে যেতে হবে। আমাকে এক্ষুনি মরে যেতে হবে।
কেন?
আমার পেটের ভেতরে একটা রাক্ষস। কিলবিল কিলবিল করছে বের হওয়ার জন্যে। বের হয়ে সে সবাইকে মেরে ফেলবে। সে বের হবার আগে আমাকে মরে যেতে হবে যেন সে বের হতে না পারে।
জহুর কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, তুমি এসব কী বলছ?
আমি সত্যি বলছি। পারুলের পেটে একটা বাচ্চা ছিল তার অর্ধেকটা মানুষ অর্ধেকটা সাপের মতো। রাহেলরি পেটে একটা রাক্ষস ছিল তার দুইটা মাথা এত বড় বড় দাঁত। বিলকিসের পেটের বাচ্চাটার ছিল লম্বা লম্বা শুঁড়। আমার পেটের বাচ্চাটা শকুনের মতো—
ছি! তুমি কী বলছ এসব। তোমাদের নিয়ে চিকিৎসা করে সবকিছু ঠিক করে দেবে।
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, আমাদের কেমন করে চিকিৎসা করবে? আমাদের বিয়ে হয়নি পেটে বাচ্চা এসেছে, আমরা সব হচ্ছি শয়তানি। আমরা সব রাক্ষুসী। আমরা সব—
মেয়েটা হঠাৎ বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো কাঁদতে শুরু করে। জহুর কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না। সে বহুদিন নরম গলায় কারো সাথে কথা বলেনি, কোমল গলায় কাউকে সান্ত্বনা দেয়নি। কেমন করে দিতে হয় সে ভুলেই গেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখবে তুমি সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
হবে না। হবে না। হবে না—
হবে। জহুর জোর গলায় বলল, আমার একটা মেয়ে ছিল তোমার মতোন, তাকে আমি বাঁচাতে পারি নাই। বেঁচে থাকলে সে এখন তোমার বয়সী হতো। তুমি আমার সেই মেয়ের মতোন, আমি তোমাকে আমার মেয়ের মতোন রাখব।
মেয়েটি হঠাৎ ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করে। জহুর কী করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে রাখল।
মেয়েটি হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে রাজি হয়নি বলে জহুর তাকে মারকেল গাছের নিচে একটা বিছানা করে দিল। শুকনো কাপড় পরিয়ে একটা কম্বল দিয়ে তাকে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে, সে শক্ত করে কম্বলটা ধরে উদভ্রান্তে র মতো সামনে কোথায় জানি তাকিয়ে রইল। জহুর মেয়েটার কাছে চুপচাপ বসে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে মেয়েটি কেন জানি চুপ করে গেছে।
জহুর বলল, মানুষের জীবনে আসলে অনেক দুঃখ-কষ্ট আসে। ধৈর্য ধরে সেইগুলো সহ্য করতে হয়। যদি মানুষ সেটা সহ্য করে তাহলে দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।
মেয়েটা জহুরের কথা শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না সে একদৃষ্টে বহুদূরে তাকিয়ে রইল। জহুর বলল, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। এই দ্বীপটাতে এখন কেউ নাই, শুধু তুমি আর আমি। একটু পরে নিশ্চয়ই কেউ আসবে তখন আমরা যাব। তোমার কোনো ভয় নাই। বড় বড় ডাক্তারের তোমাকে দেখবে। তোমার চিকিৎসা হবে।
মেয়েটা এবারেও কোনো কথা বলল না। জহুর বলল, তুমি যদি আমাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও তাহলে আমি তোমার বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিতে পারি, তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। একটু থেমে যোগ করল, এখন যদি তাদের কাছে যেতে না চাও তুমি ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থাকতে পার। আমার সংসার ঘর বাড়ি কিছু নাই, তুমি হবে আমার মেয়ে। আমার সাথে তুমি থাকবে—
মেয়েটা হঠাৎ যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। জহুর চমকে তার দিকে তাকায়, মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জহুর তার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে?
মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, আমি মরে যাচ্ছি।
কেন তুমি মরে যাবে?
ব্যথা। মেয়েটা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, ভয়ানক ব্যথা।
কোথায় ব্যথা?
পেটে।
ব্যথাটা কী আসছে যাচ্ছে?
মেয়েটা মাথা নাড়ল। জহুর জিজ্ঞেস করল, একটু পরে পরে আসছে? আস্তে আস্তে ব্যথাটা বাড়ছে?
মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।
জহুর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটি এখন তার পেটে ধরে রাখা সন্তানটি জন্ম দিতে যাচ্ছে। উক্টর কাদের তার ভয়ঙ্কর গবেষণা করে এই অসহায় মেয়েটির পেটে যে হতভাগ্য একটা শিশুর জন্ম দিয়েছে সেই শিশুটি এখন পৃথিবীতে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। মানুষের জন্ম প্রক্রিয়াটি সহজ নয়, এর মাঝে কষ্ট আছে, যন্ত্রণা আছে এবং মনে হয় খানিকটা বিপদের আশঙ্কাও আছে। সন্তান জন্ম হওয়ার পর সন্তানটিকে দেখে সেই দুঃখ-কষ্ট আর বিপদের কথা মায়েরা ভুলে যায়। এই মেয়েটির বেলায় সেই কথাটি সত্যি নয়। এই মেয়েটি কষ্ট আর যন্ত্রণার মাঝে দিয়ে যাবে। তারপর যে শিশুটির জন্ম নেবে তাকে দেখে তার কষ্ট আর যন্ত্রণা সে ভুলতে পারবে না। সবচেয়ে ভয়ের কথা, এই মেয়েটি এখন যে বিকলাঙ্গ এবং ভয়াবহ শিশুটির জন্ম দেবে তাকে জন্ম দিতে সাহায্য করার জন্য কোনো ডাক্তার দূরে থাকুক একজন ধাত্রীও নেই। এমন কি একজন মহিলা পর্যন্ত নেই। মেয়েটি কীভাবে তার সন্তানের জন্ম দেবে জহুর জানে না। জন্মানোর পর সেই বিকলাঙ্গ শিশুটিকে নিয়ে সে কী করবে? সেই শিশুটিকে দেখে এই মেয়েটির কী প্রতিক্রিয়া হবে?
জহুর তার মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে দিল। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় কী কী করতে হয় তার কিছু জানা নেই। যদি সত্যি সত্যি একটা মানব শিশু জন্ম নিত তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কিছু ব্যাপার করার দরকার হতো, নাড়ি কাটতে হতো, গরম কাপড়ে জড়িয়ে রাখতে হতো, খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হতো। কিন্তু এখন সেসব কিছু নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। বিকলাঙ্গ একটা মাংসপিণ্ড জন্ম দেয়ার পর মেয়েটিকে সুস্থ রাখাই হবে তার একমাত্র দায়িত্ব। তখন কী করতে হাবে সে কিছু জানে না, কিন্তু মানুষ অত্যন্ত বিচিত্র একটা প্রাণী, কখন কী করতে হয় না জানলেও তারা সেটা কীভাবে কীভাবে জানি বের করে ফেলতে পারে। জহুর সেটা বের করে ফেলবে।
জহুর মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাতটি ধরল। হাতটি শীতল এবং ঘামে ভেজা, জহুর বুঝতে পারে হাতটি থরথর করে কাঁপছে। সে নরম গলায় বলল, তোমার কোনো ভয় নেই, মা।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, আমি মারা যাচ্ছি।
তুমি মোটেই মারা যাচ্ছ না। তুমি তোমার শরীরে যে বাচ্চাটা আছে তার জন্ম দিতে যাচ্ছ।
মেয়েটা দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে থরথর করে কাপতে থাকে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে ওঠে। জহুর মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে দুই দিন আগেও এই মেয়েটার কথা জানত না, এই মেয়েটাকে চিনত না। সে এখনো এই মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানে না, অথচ এই দুর্ভাগা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুকের ভেতর গভীর বেদনা অনুভব করছে। তার ইচ্ছে করছে তার সকল যন্ত্রণা সকল কষ্ট নিয়ে নিতে—সেটি সম্ভব নয়, তাই সে মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে রাখল।
নবজাতক একটা শিশুর তীক্ষ্ণ কান্না কানে যেতেই মেয়েটি দুই হাতে তার মুখ ঢেকে বলল, সরিয়ে নিয়ে যাও। এই রাক্ষসটাকে সরিয়ে নিয়ে যাও।
রক্ত এবং ক্লেদে মাখা শিশুটার দিকে জহুর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। ফুটফুটে ফুলের মতো অনিন্দ্য সুন্দর একটা শিশু, মাথায় রেশমের মতো চুল, বড় বড় চোখ, টিকালো নাক, ছোট ছোট হাত-পা। উপুড় হয়ে রক্ত এবং ক্লেদে পড়েছিল, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পিঠে দুটো ছোট ছোট পাখা। হাত এবং পায়ের সাথে সাথে তার পাখাগুলো তিরতির করে নড়ছে। জহুর এগিয়ে গিয়ে শিশুটিকে তুলে নেয়—শিশুটি পাখির পালকের মতো হালকা।
মেয়েটি মুখ ঢেকে চিৎকার করে বলল, সরিয়ে নাও। সরিয়ে নাও!
জহুর তার শটটা খুলে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে নেয়, তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো! দেখো বাচ্চাটাকে। কী সুন্দর!
মেয়েটি খুব ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকালো এবং এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে অনিন্দ্য সুন্দরা শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব সাবধানে শিশুটির হাতটা স্পর্শ করে বলল, সব কিছু ঠিক আছে?
হ্যাঁ আছে।
আঙুলগুলি?
জহুর ঠিক বুঝতে পারল না এই মেয়েটি শিশুটির সবকিছু ভুলে শুধু আঙুলগুলোর কথা কেন জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু সে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, হ্যাঁ। ঠিক আছে।
মনে হলো আঙুলগুলো ঠিক আছে শুনেই মেয়েটির সব দুশ্চিন্তার যেন অবসান হয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করে আছে এবং এই প্রথমবার তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে। জহুর ঠিক বুঝতে পারল না এই শিশুটির পিঠে ছোট দুটি পাখা আছে সেটি এখন তাকে বলবে কি না—কী ভেবে শেষ পর্যন্ত জহুর সেটি বলল না। জহুর লক্ষ করল মেয়েটি ফিসফিস করে কিছু বলছে, জহুর নিচু হয়ে তার মুখের কাছে তার মাথাটি নামিয়ে আনে, শুনতে পায় মেয়েটি ফিসফিস করে বলছে, আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমার ছেলেটিকে দেখে রেখো?
জহুর বলল, না। তুমি মারা যাবে না। তুমি বেঁচে থাকবে।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, আমি মারা যাচ্ছি।
সত্যি সত্যি মেয়েটি মারা গেল সূর্য ডোবার আগে। পাখির পালকের মতো হালকা শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে রেখে জহুর মেয়েটার মাথার কাছে বসে রইল।
হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল, মেয়েটার নামটি তার জানা হয়নি।