১.৪ ইরনকে একটি আরামদায়ক চেয়ারে

ইরনকে একটি আরামদায়ক চেয়ারে শুইয়ে যে মেয়েটি নিওপলিমারের স্ট্র্যাপ দিয়ে তাকে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছিল তাকে মোটামুটিভাবে সুন্দরী বলা চলে। ইরন খানিকটা কৌতূহল নিয়ে তার দক্ষ হাতের কাজ দেখতে দেখতে বলল, আমি জানতাম মহাকাশযানে আর এ রকম নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।

তুমি ঠিকই জানতে।

তা হলে?

এই মহাকাশযানটা একটা পরীক্ষামূলক মহাকাশযান। তোমরা দেখবে, খুব অল্প সময়ে এটা অনেক বেগে পৌঁছে যাবে। সেইজন্য এই ব্যবস্থা।

আমাদের কী হবে?

বিশেষ কিছুই হবে না। শরীরের মাঝে বিশেষ ট্রাকিওশান দেওয়া হয়েছে। সেটা আমাদের সব তথ্য জানাবে। আর তোমাদের যে ক্যাপসুলে ঢোকানো হচ্ছে তার ভিতরে তোমরা খুব নিরাপদ। মায়ের গর্ভে ভ্রুণ যেরকম নিরাপদ অনেকটা সেরকম।

ইরন কৌতুক করে বলল, পূর্ণ বয়সে আবার আমরা মাতৃগর্ভে ফিরে যাচ্ছি?

অনেকটা সেরকম। মেয়েটা ইরনের করোটিতে সুচালো কিছু একটা প্রবেশ করিয়ে বলল, এখন কথা বোলো না, আমাদের ক্যালিব্রেশানে গোলমাল হয়ে যাবে।

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। তার দুপাশে আরো চারটি খোলা স্টেইনলেস স্টিলের ক্যাপসুল, কালচে ধাতব রং হঠাৎ দেখে মনে হয় অতিকায় ড্রাগন মুখ হাঁ করে আছে। একেকটি ক্যাপসুলে একেকজনকে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একসময় ক্যাপসুলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। মহাকাশযানের জীবনরক্ষাকারী মডিউল তখন তাদের জীবনের দায়িত্ব নিয়ে নেবে, তাদের নিশ্বাসের জন্য অক্সিজেন, জীবনরক্ষার জন্য চাপ, রক্তের মাঝে পুষ্টির নিশ্চয়তা দেবে কিছু কৌশলী যন্ত্র। মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিন একসময় গর্জন করে উঠবে, তীব্রগতিতে আয়নিত পরমাণু ছুটে আসবে আর এই মহাকাশযানটি বায়ুমণ্ডলকে ভেদ করে উঠে যাবে মহাকাশে। দেখতে দেখতে নীল আকাশ প্রথমে গাঢ় নীল, তারপর কালচে বেগুনি, সবশেষে নিকষ কালো হয়ে যাবে। পরিচিত পৃথিবী একটি নীলাভ গ্রহ হয়ে পিছনে পড়ে থাকবে। সেই গ্রহটি কি শুধু একটি স্মৃতিই হয়ে থাকবে তাদের কাছে নাকি তারা আবার ফিরে আসবে এই গ্রহে?

ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল এবং ঠিক তখন টেকনিশিয়ান মেয়েটি তার হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইরন।

ইরন মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, তোমার কথা সত্যি হোক মেয়ে?

মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে কোথায় একটা সুইচ টিপে দিতেই খুব ধীরে ধীরে স্টেইনলেস স্টিলের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল, সাথে সাথে ভিতরে আবছা অন্ধকার হয়ে আসে। পায়ের কাছে কোনো এক জায়গা থেকে মিষ্টি গন্ধের এক ধরনের শীতল বাতাস এসে ক্যাপসুলের ভিতরটা শীতল করে দিতে শুরু করেছে। ইরন হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে নীলাভ স্ক্রিনটা চালু করে দিতেই মহাকাশযানের ভিতরটা দেখতে পেল। টেকনিশিয়ানরা চারটি ক্যাপসুল বন্ধ করে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়েছে, সবকিছু শেষবার পরীক্ষা করে তারা নেমে যেতে শুরু করে। গোলাকার দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে যেতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে তাদেরকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলল। ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কে জানে সে আবার কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে কি না।

ইরন একটা মৃদু কম্পন অনুভব করে। নিশ্চয়ই মহাকাশযানের বিশাল শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলো চালু হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আয়োনিত গ্যাসের প্রবাহে বিস্তৃত প্রান্তর ভস্মীভূত হয়ে যাবে। ইরন তার মুখের সামনে নীল স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ইচ্ছে করলে সে এখানে দৃশ্যটি পাল্টে দিয়ে বাইরে থেকে মহাকাশযানটি কেমন দেখায় সেটি দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে অন্য ক্যাপসুলগুলোতে সবাই কেমন আছে সেটাও দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে কন্ট্রোল প্যানেলের ঘুঁটিনাটিও সে পর্যবেক্ষণ করতে পারে কিন্তু ইরন তার কিছুই করল না। হঠাৎ করে সে অনুভব করে তার শরীরে খুব ধীরে ধীরে একটা আরামদায়ক অবসাদ ছড়িয়ে পড়ছে, ঘুমের মতো এক ধরনের অনুভূতি কিন্তু ঠিক ঘুম নয়, প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেখান থেকে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখতে পারে না। ইরন তার মুখের কাছাকাছি রাখা নীল স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।

ইরনের জ্ঞান ফিরে এল খুব ধীরে ধীরে, চোখ খুলে সামনে নীল স্ক্রিনটাতে পরিচিত নীলাভ গ্রহটা দেখেও সে প্রথমে কিছু মনে করতে পারল না। সমস্ত শরীরে এক ধরনের অবসাদ এবং মাথায় এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা নিয়ে সে ধীরে ধীরে পুরোপুরি সজাগ হয়ে ওঠে। ক্যাপসুলের ভিতরে কনকনে এক ধরনের শীতলতা, ইরন তার দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে ক্যাপসুলের ভিতরকার কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল। মহাকাশটির অসংখ্য তথ্য সেখানে দ্রুত খেলা করে যাচ্ছে, অনভিজ্ঞ চোখে তার কিছুই অর্থবহ নয় কিন্তু ইরন খুব সহজেই সেগুলো বিশ্লেষণ করতে পারে। মিনিট দুয়েক সে তথ্যগুলো দেখে হঠাৎ চমকে উঠল, কোথাও কিছু একটা বড় গোলমাল রয়েছে। গতিবেগ অনেক কম, ত্বরণ যেটুকু থাকার কথা তার এক ভগ্নাংশও নয়, এই সময়ের মাঝে পৃথিবী থেকে যেটুকু যাবার কথা মহাকাশযানটি তার ধারেকাছেও যায় নি। মহাজাগতিক কো–অর্ডিনেট থেকে মনে হচ্ছে এটি মঙ্গল এবং বৃহস্পতির কাছাকাছি কোথাও থেমে আসছে। ক্যাপসুলের ভিতর উঠে বসার উপায় থাকলে ইরন উত্তেজনায় উঠে বসত, কিন্তু এখন তার উপায় নেই। সে সুইচ টিপে বর্গেনের ক্যাপসুলে যোগাযোগ করে এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে সেটি খালি, ভিতরে কেউ নেই। ইরন যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করতেই বর্গেনকে দেখতে পেল সে মহাকাশযানের মূল কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ডাকতে গিয়ে ইরন থেমে যায়। বর্গেনের চোখের দৃষ্টি কেমন জানি অস্বচ্ছ এবং দুর্বোধ্য। ইরন তার ক্যাপসুলের ঢাকনা খোলার জন্য জরুরি সুইচটি স্পর্শ করল, এবং ভোঁতা একটি শব্দ করে খুব ধীরে ধীরে স্টেইনলেস স্টিলের কালো ঢাকনাটা উপরে উঠতে শুরু করে। ক্যাপসুলের ভিতরে সাথে সাথে মহাকাশযানের উষ্ণ বাতাস এসে প্রবেশ করে।

ইরন উঠে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরে ওঠে, মনে হচ্ছে মহাকাশযানের বাতাসে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই। ইরন তার পোশাক থেকে অক্সিজেন মাস্কটি বের করে তার মুখের ওপর লাগিয়ে নিয়ে টলতে টলতে হাঁটতে শুরু করে। বর্গেনের খোলা ক্যাপসুলের পাশেই কীশার ক্যাপসুল, স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তার ঘুমন্ত মুখটি দেখা যাচ্ছে। যে। কোনো মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় কেন জানি অসহায় দেখায়। ইরন একমুহূর্ত দ্বিধা করে উজ্জ্বল লাল রঙের জরুরি সুইচটি স্পর্শ করতেই ক্যাপসুলটি কীশাকে জাগিয়ে তোলার কাজ শুরু করে দেয়। ইরন কীশার জন্য অপেক্ষা না করে মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কন্ট্রোল প্যানেলের হালকা নীল আলোর সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বর্গেনকে একটি অতিপ্রাকৃত মূর্তির মতো মনে হচ্ছে। ইরন দেয়াল ধরে টলতে টলতে আরো একটু এগিয়ে যেতেই বর্গেন মাথা ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকাল।

বর্গেন কয়েক মুহূর্ত ইরনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছ?

হ্যাঁ।

বের হওয়ার কথা নয়।

বর্গেন, তোমারও বের হওয়ার কথা নয়।

আমি এই প্রজেক্টের দলপতি। প্রয়োজনে আমি বের হতে পারি।

বেশ! আমি এই অভিযানের একজন সদস্য। কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ হলে আমিও বের হতে পারি।

বর্গেন হঠাৎ পুরোপুরি ঘুরে ইরনের দিকে তাকাল, বলল, তোমার কী নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে, ইরন?

যেমন মনে কর এই মহাকাশযানের ত্বরণ আর এই মহাকাশযানের গতিবেগ। যত হওয়ার কথা তার এক ভগ্নাংশও নয়। কেন?

তার কারণ আমরা এখন এস্টরয়েড বেন্ট পার হচ্ছি। এর মাঝে গতিবেগ বেশি করা যায় না। নিরাপত্তার ব্যাপার।

ইরন স্থির চোখে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে রইল–এক শ বছর আগে এই উত্তরটি যথার্থ উত্তর হত, এখন নয়। মহাকাশযান এস্টরয়েড বেল্টের১১ ভিতর দিয়ে যে কোনো বেগে যেতে পারার কথা। বর্গেন মিথ্যা কথা বলছে, কিন্তু কেন?

বর্গেন কন্ট্রোল প্যানেলের উপর আবার ঝুঁকে পড়ে বলল, ক্যাপসুলে ফিরে যাও ইরন।

আমি এখন ক্যাপসুলে ফিরে যাই কি না যাই তাতে কিছু আসে–যায় না।

বর্গেন আবার ইরনের দিকে ঘুরে তাকাল, তুমি কী বলতে চাইছ?

ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল বর্গেন, মহাকাশযানে অক্সিজেন খুব কম। আমাকে মুখে একটা মাস্ক লাগাতে হয়েছে। তোমার মুখে মাস্ক নেই কেন?

বর্গেন তীক্ষ্ণ চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। ইরন আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, বর্গেন, এই মহাকাশযানে তোমার নিশ্বাস নিতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না, কারণ তোমার আসলে নিশ্বাস নিতে হয় না। তুমি একজন রোবট।

বর্গেনের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল। ইরন বাধা দিয়ে বলল, বর্গেন, আমি রোবটকে দুই চোখে দেখতে পারি না। প্রজেক্ট আপসিলনে একটা রোবটকে পাঠানো হয়েছে জানলে আমি এখানে আসতাম না।

তোমার কথা শেষ হয়েছে ইরন?

আমি আসলে রোবটের সাথে কথাবার্তা বলতে চাই না বর্গেন। কাজেই আমার কথা শেষ হয়েছে কি না সেটা বলতে পারব যখন নিঃসন্দেহে হব যে তুমি সত্যিই একটা রোবট।

সেটা তুমি কীভাবে হবে, ইরন?

ইরন দেয়াল থেকে টাইটানিয়ামের একটা বড় রড টেনে খুলে নিয়ে বলল, এটা দিয়ে। একটা আঘাত করে তোমার খুলি ফাটিয়ে দিয়ে দেখব, ভিতরে কপোট্রন না অন্য কিছু।

বর্গেন এবারে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তুমি নেহায়েত একজন নির্বোধ মানুষ ইরন। আমি যদি সত্যিই রোবট হয়ে থাকি তা হলে আমার এই যান্ত্রিক হাত দিয়ে আমি তোমাকে পিষে ফেলতে পারব। তোমার মস্তিষ্ক আমি থেতলে দিতে পারব।

ইরন শক্ত হাতে টাইটানিয়ামের রডটা ধরে রেখে আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে–যায় না। প্রজেক্ট আপসিলন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তার কিছুই সত্যি নয়। আমাদের নিয়ে তোমরা কিছু একটা ষড়যন্ত্র করেছ। তোমাকে খুন করা গেলে কিংবা আমি খুন হয়ে গেলে সেই ষড়যন্ত্রটা কাজে লাগাতে হবে না। আপাতত সেটাই আমার উদ্দেশ্য।

ইরন হিংস্র চোখে বৰ্গেনের দিকে তাকিয়ে আরো এক পা এগিয়ে গেল। বর্গেন শীতল চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, নির্বুদ্ধিতা কোরো না, ইরন। আমি তোমাকে শেষবার সতর্ক করে দিচ্ছি

বর্গেন কথা শেষ করার আগেই ইরন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বর্গেন প্রস্তুত ছিল বলে। ইরন তাকে আঘাত করতে পারল না, বরং তার শক্ত হাতের আঘাতে সে নিজে ছিটকে গিয়ে পড়ল। কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সে এগিয়ে যায়, টাইটানিয়ামের রডটি ঘুরিয়ে আবার সে আঘাত করার চেষ্টা করে, কিন্তু বর্গেন বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে গিয়ে তার হাতে আঘাত করতেই টাইটানিয়ামের রডটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। ইরন শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং বর্গেন শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে এক পা এগিয়ে আসে। ইরন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার বর্গেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বর্গেন তার শক্ত হাতে ইরনের মুখে আঘাত করল, মুহূর্তের জন্য ইরন চোখে অন্ধকার দেখে, তাল হারিয়ে সে দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ল। ইরন তার মুখে রক্তের লোনা স্বাদ পায়, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এসেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু উঠতে পারল না। বর্গেন তার দিকে এগিয়ে আসে, দুই হাত দিয়ে নিওপলিমারের১৩ তৈরি তার বুকের কাপড় ধরে তাকে উপরে টেনে তুলল, তার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলা করতে শুরু করেছে। শক্ত লোহার মতো দুই হাতে তার গলা চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমি যদি বলতে পারতাম জীবনের শেষ মুহূর্তে তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে ইরন, তা হলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু আমার এতটুকু দুঃখ হচ্ছে না। তোমার কার্টিলেজ১৪ আমি এক হাতে ভাঙতে পারি নির্বোধ মানুষ–

ইরন বুঝতে পারে তার গলায় বর্গেনের হাত শক্ত সঁড়াশির মতো চেপে বসেছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। সমস্ত বুক বাতাসের জন্য হাহাকার করতে থাকে। প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে, দুই হাতে বর্গেনের চোখে–মুখে খামচে ধরার চেষ্টা করে, নখ বসিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পাথরের মতো শক্ত শরীরে তার হাত পিছলে আসে।

ইরনের চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ তার মাঝে সে কীশাকে দেখতে পেল। দুই হাতে টাইটানিয়ামের রডটি শক্ত করে ধরে রেখে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ইরন প্রাণপণ চেষ্টা করে তাকিয়ে থাকে, দেখতে পায় বর্গেনের পিছন থেকে। ধীরে ধীরে কীশা টাইটানিয়ামের রডটি উদ্যত করেছে। তারপর কিছু বোঝার আগে কীশা প্রচণ্ড শক্তিতে বর্গেনের মাথায় আঘাত করল।

ভয়ঙ্কর একটি চিৎকারের শব্দ শুনল ইরন, কিছু বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ ছুটে গেল এবং উষ্ণ এক ধরনের চটচটে তরল ছিটকে এসে পড়ল তার মুখে। ইরন হঠাৎ করে অনুভব করল তার গলায় বর্গেনের হাত শিথিল হয়ে এসেছে। বুকভরে একবার নিশ্বাস নিতে চাইল ইরন কিন্তু কাশির দমকে সে নিশ্বাস নিতে পারলনা। দুই হাতে বুক চেপে ধরে অনেক কষ্টে একবার নিশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকাল, পিছনে কীশা, তার চোখে বিস্ময় এবং আতঙ্ক। ইরন কীশার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝের দিকে তাকায়। সেখানে বর্গেনের মাথাটি পড়ে আছে, গলার অংশবিশেষ ছিঁড়ে এসেছে, সেখান থেকে কিছু ছেঁড়া তার, সূক্ষ্ম ফাইবার আর টিউব বের হয়ে এসেছে। চটচটে হলুদ এক ধরনের তরল সেখান থেকে গলগল করে বের হয়ে আসছে।

কীশা হতচকিতভাবে হাতের টাইটানিয়ামের রডটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, হলুদ রক্ত! হলুদ

ইরন বর্গেনের মস্তকহীন দেহ এবং শিথিল হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে সরে এসে বলল, রক্ত নয়। কপোট্রনকে শীতল করার তরল।

কপোট্রন?

হ্যাঁ।

তার মানে বর্গেন একটা রোবট?

হ্যাঁ।

কী আশ্চর্য! কীশা পা দিয়ে বর্গেনের মাথাটিকে সোজা করে দিয়ে বলল, আমাদেরকে বলেছিল এখানে কোনো রোবট নেই।

বর্গেনের বিচ্ছিন্ন মাথাটি হঠাৎ কেঁপে ওঠে এবং মুখ হাঁ করে কিছু বলার চেষ্টা করে।

ইরন মুখে একটা বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটিয়ে বলল, তুমি কিছু বলছ?

বর্গেনের মাথাটি বিচিত্র একটি শব্দ করে বলল, হা।

কী?

তোমাদের দিন শেষ। বর্পেনের বিচ্ছিন্ন মাথাটি হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করে। হাসির সাথে সাথে ঠোঁটের কষ বেয়ে হলুদ রঙের চিটচিটে তরলটি চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের হতে থাকে। ইরন অনেক কষ্ট করে একটা লাথি দিয়ে মাথাটি দূরে ছুঁড়ে ফেলার ইচ্ছে দমন করে নিচু হয়ে বসল। হাত দিয়ে বর্গেনের চুলের মুঠি ধরে মাথাটি উপরে তুলে বলল, আমাদের দিন শেষ কেন বলছ?

বর্গেন বিচিত্র এক ধরনের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, একটু পরেই তোমরা বুঝবে।

বর্গেন।

বল।

তুমি আর কতক্ষণ এভাবে থাকবে?

বেশিক্ষণ নয়। কপোট্রন শীতল করার তরলটা বের হয়ে গেছে, কপোট্রনটা কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে।

তোমার কি দুঃখ হচ্ছে?

দুঃখ? আমার? বর্গেনের মাথাটি হঠাৎ আবার কেঁপে কেঁপে হাসতে শুরু করে, আমাদের দুঃখ হয় না। একটা দায়িত্ব দিয়েছিল। দায়িত্বটা ঠিকভাবে শেষ করেছি তাই খুব আনন্দ হচ্ছে।

কীশা অবাক হয়ে বলল, দায়িত্ব ঠিকভাবে শেষ করেছ?

হ্যাঁ।

সেটা কখন করলে?

এই যে তোমাদের একটা মহা গাড্ডার মাঝে এনে ফেলেছি। মহাকাশযানের কন্ট্রোল এখন কারো কাছে নেই। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হত আমাকে দিয়ে আমাকেও তোমরা শেষ করেছ। এখন তোমরা বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণে সেখানে গিয়ে শেষ হবে! তোমরা বর্গেন কথা শেষ করার আগেই আবার খিকখিক করে অপ্রকৃতিস্থর মতো হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে হঠাৎ হেঁচকি দিয়ে সে থেমে গেল। বর্গেনের কান এবং চোখ দিয়ে কালো আঁজালো এক ধরনের ধোঁয়া বের হতে শুরু করে, ইরন তার হাতে উত্তাপ অনুভব করে বিচ্ছিন্ন মাথাটি মেঝেতে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

শেষ। কপোট্রনটা জ্বলে গেছে।

রক্ষা হয়েছে। কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী ভয়ানক ব্যাপার!

ইরন কথা না বলে চিন্তিত মুখে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যায়। কীশা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমার কাছে এখনো পুরো ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

ইরন কীশার দিকে তাকিয়ে বলল, দুঃস্বপ্ন?

হ্যাঁ। আমার কাছে কী মনে হচ্ছে জান?

কী?

পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে একটা নাটক। আমরা সবাই সেই নাটকের একটা করে চরিত্র।

কেন? কীশা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার কাছে এ রকম মনে হচ্ছে কেন?

জানি না।

কীশা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন কী করব আমরা?

প্রথমে দেখব বর্গেনের শেষ কথাগুলো সত্য কি না। অর্থাৎ আসলেই আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃহস্পতির আকর্ষণে সেদিকে যাচ্ছি কি না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যাচ্ছি।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমি দেখেছি অশুভ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আশ্চর্যভাবে সবসময় মিলে যায়। সম্ভাবনার মূল্যবান সূত্রগুলো সেখানে আশ্চর্যভাবে দুর্বল!

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

আমার মনে হয় ত্ৰালুস আর শুমান্তিকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া দরকার।

কেন?

কী করব সেটা ঠিক করা যাক। যত বেশি মানুষ বসে সিদ্ধান্তটা নেওয়া যায় ততই ভালো।