ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

১.৩ শেষ-দুপুরে আগন্তুক

।। তিন।। শেষ—দুপুরে আগন্তুক

ভাই মান্তু, শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এলাম। তুই তো জানিস এ আমার কতদিনের সাধ! সেই সাধ এতদিনে পূর্ণ হল। এবার আশা করছি তোর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হবে। বাসাটা বেশ দূরে হল—বাঙ্গুর—কালিন্দীর কাছে। তবু তো কলকাতা। এখান থেকে হাওড়া এমন আর কি দূর? রাস্তাটা চিনে নিলে যে কোনো সময়ে তোর কাছে চলে যেতে পারব।

দু—সপ্তাহ হল এসেছি। এখনো ঠিকমতো গুছিয়ে বসতে পারিনি। পিসিমা এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বলে পুপুকে তাঁর কাছে রেখে ক’দিন খুব সিনেমা—থিয়েটার দেখে নিলাম। কিন্তু গোল বাধল ম্যাজিক দেখতে গিয়ে। ম্যাজিক দেখায় আমার বড্ড ভয়। শুনে ডাক্তার খুব হাসে। কিন্তু ওকে বোঝাই কী করে ম্যাজিশিয়ানদের দেখলেই আমার বুকের মধ্যে কেমন করে। কারণ আর কিছুই নয় ছোটোবেলায় ‘নররাক্ষস’ দেখার বীভৎস অভিজ্ঞতা। এই এতদিন পরে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। ভাবতে পারিনি ম্যাজিক দেখতে গিয়ে এই বয়েসে অজ্ঞান হয়ে যাব। তারপর থেকে শরীরটা দুর্বল। মনটাও অকারণে বিষণ্ণ হয়ে আছে। কেবলই মনে হচ্ছে কি যেন ঘটবে—এমন কিছু যা মোটেই শুভ নয়। এরকম মনে হবার কোনো কারণ খুঁজে পাই না।

যাই হোক বাড়িটার কথা বলি। পুরনো বাড়ি। তিনতলা। বাড়িটা একটা গলির ভেতর। এখানে বড়ো রাস্তার ধারে, আশেপাশে প্রচুর নতুন বাড়ি উঠেছে। আমাদের কপালেই পুরোনো বাড়ি জুটল। যাক, তবু তো জুটেছে। একতলায়, দোতলায় মোট চার ঘর ভাড়াটে। আমরা তিনতলায়। তিনতলাটা দেখলেই বোঝা যায় incomplete। কবে কোনকাল থেকে কেন যে এরকম অসম্পূর্ণ হয়ে আছে কে জানে! ছাদের ওপর একটা ভাঙা গম্বুজমতো আছে। সেটাই আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগে। ঠিক যেন সেকালের রাজা—রাজড়াদের দুর্গ! সেদিন ম্যাজিক দেখে ফেরার সময় চাঁদের আলোয় গম্বুজটাকে দেখেও কেন জানি না বেশ ভয় পেয়েছিলাম।

তবু মন্দ লাগে না। শান্ত পরিবেশ। বাড়ির পিছনে সার সার দেবদারু গাছ। কম্পাউন্ডের মধ্যে অনেকগুলো সুপুরিগাছও আছে। বাড়ির পিছনের দিকটা যেন রহস্যপুরী। এই কলকাতা শহরেও রাত্তিরবেলায় ঝিঁঝিঁ ডাকে।

তুই একদিন চলে আয়। ও হাসপাতালে চলে গেলে সারা দুপুর বড্ড একা লাগে। পিসিমা চলে গেছেন। আমার সঙ্গী শুধু পুপু। ঘুমোতে চেষ্টা করি। ঘুম হলে বেশ ভালো থাকি। ঘুম না হলে কেমন ভয় করে। চোর—ডাকাতের ভয় নয়। আবার বলছি—কীসের ভয় জানি না।

ও হ্যাঁ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। প্রথম যেদিন মনের আনন্দে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিলাম, তখন ডাক্তার আমায় সাবধান করে দিল যেন তড়বড়িয়ে না উঠি। পড়ে যেতে পারি। আশ্চর্য! ঠিক তখনই মাথাটা কীরকম করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে চার ধাপ নীচে পড়ে গেলাম। ভাগ্যি ও ধরে ফেলেছিল!

কিন্তু তোকে সত্যি কথা বলি। পড়বার আগের মুহূর্তেও ভাবতে পারিনি আমি পড়ে যাব! কী করে পড়লাম কে জানে!

কলকাতায় এসে এরই মধ্যে দুটো ধাক্কা খেলাম। প্রথম সিঁড়ি থেকে পড়া। দ্বিতীয় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে….

চিঠি লেখায় বাধা পড়ল। শুনতে পেল সিঁড়িতে জুতোর অস্পষ্ট শব্দ। ওপরে কেউ আসছে। অবাক হল। কেউ তো আসে না।

ঠিক এই সময়ে পুপু ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ কেঁদে উঠল।

চিঠি ফেলে রেখে রীণা বিছানায় গিয়ে পুপুর পিঠে হাত রাখল। কিন্তু কান্না থামল না।

কী হল? কিছু কামড়াল নাকি? রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে তুলে নিয়ে বিছানা ওলোট—পালোট করে ফেলল। নাঃ, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন বিছানা। কোথাও একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত নেই।

পুপুকে কোলে নিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে রীণা আবার বাইরের ঘরে এসে বসল। ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে তিনটে।

যাক, বিকেল হয়ে এল। এর মধ্যে চিঠিটা শেষ করে ফেলতে হবে।

সবেমাত্র একটি শব্দ লিখেছে, অমনি দেখল স্যুটপরা কেউ একজন যেন সিঁড়ির দিকের জানলার পাশ থেকে চকিতে সরে গেল।

—কে?

সাড়া নেই।

রীণা আবার ডাকল—কে?

এবারও উত্তর নেই।

রীণা ভাবল জানাশোনা কেউ দেখা করতে এসেছে। লুকিয়ে একটু মজা করছে।

রীণা উঠে দরজার কাছে গেল। ঠিক তখনই পুপু আবার কেঁদে উঠল। তবু রীণা দরজা খুলে দিল।

না, কেউ নেই। শুধু জ্যৈষ্ঠের একফালি রোদ দেওয়ালের একটা জায়গায় বর্শার ফলার মতো এসে পড়েছে।

রীণা ঝুল—বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীচের কম্পাউন্ড ফাঁকা। জনপ্রাণী নেই। অল্প দূরে যশোর রোডের ওপর দিয়ে সশব্দে বাস, ট্যাক্সি, লরি ছুটে চলেছে।

রীণা অবাক হল। কে এল এই অসময়ে? গেলই—বা কোথায়?

কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না। পুপু তখনও কাঁদছে। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়ল।

না, আর কাঁদছে না। বিছানার চাদরটা মুঠো করে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রীণা আবার বাইরের ঘরে এসে বসল। চিঠিটা শেষ করল কোনোরকমে। কিন্তু চিঠি লিখতে লিখতেও ভাবনাটা কিছুতেই সরিয়ে ফেলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল—কে ওই স্যুটপরা ভদ্রলোক? তার মুখ দেখতে পায়নি। দেখেছে শুধু কোটের একটা প্রান্ত। কেনই—বা অসময়ে এল! কেনই—বা চুপচাপ চলে গেল!

ভদ্রলোক কে হতে পারে, রীণা সম্ভব—অসম্ভব অনেকের কথাই মনে করার চেষ্টা করছিল, এমনি সময়ে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।

রীণার হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল।

—কে?

এইটুকু উচ্চারণ করতেই গলার স্বর কেঁপে উঠল।

—আপনার টেলিফোন।

—আমার টেলিফোন!

রীণা দরজা খুলে দিল। দেখল দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনা। বন্দনা বলল, আমাদের ঘরে আপনার ফোন এসেছে।

রীণা একে চেনে।

—কে ফোন করছে? অন্যমনস্কভাবে কথা কটা উচ্চারণ করেই রীণা তাড়াতাড়ি নেমে গেল। ঘরটা খোলাই পড়ে রইল।

কে তাকে হঠাৎ ফোন করতে পারে? ডাক্তার ছাড়া আর তো কেউ এ বাড়ির নম্বর জানে না। ডাক্তারই বা শুধু শুধু ফোন করতে যাবে কেন? তাহলে নিশ্চয় ডাক্তার কাউকে ফোন নম্বর দিয়েছে জরুরি কোনো খবর জানাবার জন্য। কী সে জরুরি খবর? তবে কি ওর কিছু হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট? হাসপাতাল থেকে করছে? স্যুটপরা ভদ্রলোক কি সেই খবর দেবার জন্যেই এসেছিলেন? নিজে মুখে খবরটা দিতে না পেরে ফোন করেছেন?

রীণা ঘামতে ঘামতে রিসিভার তুলে নিল।

—হ্যালো—হ্যালো—আমি রীণা বলছি। রীণা গুপ্ত—ডাক্তার সঞ্জয় গুপ্তর স্ত্রী—

ওপার থেকে হাসি শোনা গেল।

—তুমি যে আমার স্ত্রী, তোমার কাছ থেকে এই প্রথম শুনতে পেলাম। ডাক্তারেরই গলা। রীণার বুকটা হালকা হল।

—ও তুমি! বাব্বা! বাঁচলাম!

—কেমন অবাক করে দিলাম!

—উঃ! যা ভয় পেয়েছিলাম!

—ভয়! কীসের ভয়?

—সে অনেক কথা। তুমি এলে বলব।

—আমার আজ ফিরতে দেরি হবে। চিন্তা করো না।

—দেরি? না—না, মোটেই আজ দেরি করো না। লক্ষ্মীটি।

—একটা জরুরি কাজ আছে যে।

—তা থাক। আমারও বিশেষ দরকার আছে।

ওপার থেকে এবার চট করে উত্তর এল না।

—হ্যা—লো—

ডাক্তার মৃদু ধমক দিল।—অত চেঁচাচ্ছ কেন? আস্তে বলো।

সে কথায় কান না দিয়ে রীণা আবার চেঁচিয়ে উঠল—তাড়াতাড়ি আসছ তো?

—আচ্ছা, চেষ্টা করব। ছেড়ে দিচ্ছি।

রীণাও ফোনটা রেখে দিল। বন্দনার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ একটু হেসে বলল, চলি।

বন্দনাও একটু হাসল, খুব ভয় পেয়েছিলেন?

—হ্যাঁ। হঠাৎ টেলিফোন পেলে—রীণার মুখটা একটু লাল হল।—চলি। সময় পেলে এসো। কেমন?

রীণা তিনতলায় উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে কী মনে হওয়ায় আবার নেমে এল।

—এই শোনো।

বন্দনা ফিরে দাঁড়াল।

—দুপুরে তুমি বাড়ি ছিলে?

—হ্যাঁ, ইস্কুলের ছুটি।

—কী করছিলে? ঘুমোচ্ছিলে?

—দুপুরে আমি ঘুমোই না। সেলাই করছিলাম।

—কোন ঘরে?

—এই ঘরে।

—আচ্ছা, কেউ একটু আগে—এই তিনটে নাগাদ তিনতলায় গিয়েছিল?

—কই? না তো।

—তুমি তো দরজা বন্ধ ক’রে সেলাই করছিলে। কী করে দেখবে?

বন্দনা বলল, কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে জুতোর শব্দ শুনতে পেতাম।

রীণা মুহূর্তখানেক কী ভাবল। জুতোর শব্দ বন্দনা শুনতে পায়নি। কিন্তু সে নিজে পেয়েছিল। তাহলে ব্যাপারটা কী? ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। কেমন যেন একটা চাপা ভয়—তারপর ‘আচ্ছা চলি’ বলে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এল। বেশ বুঝতে পারল বন্দনা অবাক হয়ে তাকে দেখছে। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ল—তাড়াতাড়িতে দরজা খুলে রেখেই এসেছে। ঘরে একা পুপু। তখনই রীণা হুুমুড় করে ঘরে এসে ঢুকল।

না, পুপু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

রীণা তবু ঘুমন্ত ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।

আবার মনে মনে সেই চিন্তা—এই যে পুপু একা আছে বলে পড়িমরি করে ছুটে এল—কীসের ভয়ে? শুধু তো ক’ধাপ নেমে দোতলায় গিয়েছিল। এর মধ্যে এমন কী আর ঘটতে পারত? চোর—টোর? তাহলেও তো দোতলার ঘর থেকেই দেখতে পেত।

তাহলে?

তাহলেও সেই এক প্রশ্ন—বেলা পৌনে তিনটে নাগাদ সে যে জুতোর শব্দ শুনেছিল, চকিতের জন্য যার পরনের স্যুট চোখে পড়েছিল সে কে? কেন এসেছিল? কেনই—বা দেখা না করে মুহূর্তে কোথায় চলে গেল?

.

সন্ধে হবার আগেই সঞ্জয় ফিরল। কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে ওপরের দিকে তাকাল। দেখল রীণা পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।

সঞ্জয় ডাক্তার মানুষ। স্বাভাবিক নিয়মেই একটু কঠিন। ভয়, ভাবনা, ভাবাবেগ কম। তবু আজ টেলিফোনে রীণার গলার স্বরটা শুনে একটু চিন্তায় পড়েছিল। কেমন যেন ভয়—পাওয়া গলা। কিন্তু কীসের ভয় বুঝতে পারছিল না। এখন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশ্চিন্ত হল। সেই সঙ্গে একটু রাগও।

ঘরে ঢুকেই তাই বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল—কী ব্যাপার বলো তো?

—বলছি। আগে চা খাও।

সঞ্জয় লক্ষ করল রীণার চোখে—মুখে সত্যিই ক্লান্তির ছাপ। কিছু যে ঘটেছে তা বুঝতে পারল।

একটু পরেই রীণা ফিরল দু—কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে। সঞ্জয়কে কাপ এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা কাপ তুলে নিল।

—হ্যাঁ, বলো কী ব্যাপার? সঞ্জয়ের স্বরে কৌতূহল।

রীণা তখন দুপুরের সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল। শুনে সঞ্জয় খুব খানিকটা হাসল।

—এই কথা শোনাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বললে?

রীণা মাথা নীচু করে বলল—কথাটা কি ভাববার মতো নয়?

—পাগল হয়ে গেলে নাকি? বলেই সঞ্জয় উঠে শার্ট খুলে ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিল।

রীণা মুখ লাল। সে বলল—হ্যাঁ, পাগল বৈকি! আমি নিজে কানে জুতোর শব্দ শুনলাম। নিজে চোখে দেখলাম।

—কী দেখলে? কালো স্যুটপরা এক সুদর্শন পুরুষ বারান্দার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তোমায় নীরবে নিরীক্ষণ করছেন?

রীণা ধমকে উঠে বলল—বাজে বোকো না তো! আমি কচি খুকি নই যে আজে—বাজে বকব। আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিও না।

—বেশ, এই আমি চুপ করলাম। বলেই ছেলেকে কোলে টেনে নিল।

—এসো তো পুপু সোনা! তোমায় একটু আদর করি। বড়ো হলে তোমায় আমি একটা কালো স্যুট তৈরি করে দেব। তোমার মামণি কালো স্যুট খুব ভালোবাসে। বলেই রীণার দিকে তাকাল।

রীণা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ঠাট্টা হচ্ছে? বলে হঠাৎ উঠে গিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।

—আরে! এই দ্যাখো! রাগ করে একেবারে শয্যাশায়ী! বলতে বলতে ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠে এল সঞ্জয়।

সঞ্জয় পুপুকে শুইয়ে দিয়ে রীণার গা ঘেঁষে বসল। ওর ওপর ঝুঁঁকে পড়ে দু—হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরবার চেষ্টা করল।

—আঃ! বিরক্ত কোরো না। বলে রীণা ছিটকে উঠে বসল।

—ঠিক আছে। আমি কাছে থাকলে এতই যখন বিরক্তি তখন বাইরের জরুরি কাজটা সেরেই আসি।

বলে সঞ্জয় উঠে পড়ল। রীণা ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে পথ আগলে দাঁড়াল, যাবে বৈকি!

সঞ্জয় হেসে বলল, তাহলে কুমড়োর মতো একটা গোমড়া মুখের সামনে বসে কী করব?

—কুমড়োর মতো মুখ বৈকি! এই মুখের জন্যেই তো একদিন—পুপুকে দ্যাখো। আমি জলখাবার নিয়ে আসি। বলেই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।

সঞ্জয় একটা জিনিস লক্ষ করল—রীণা যেন আজ একটুতেই রেগে যাচ্ছে। ঠাট্টাটুকুও বুঝতে চাইছে না।

তখনকার মতো শান্তি। কিন্তু জের চলল রাত্রে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত।

চুপচাপ শুয়েছিল রীণা। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল পাখার দিকে। কেমন উন্মনা দৃষ্টি। অথচ অন্যদিন ওর সারাদিনের যত গল্প—সব শোনায় এই সময়। সে সব গল্প এ বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের নিয়ে।

—এখনো রাগ পড়েনি?

—কীসের রাগ?

—ওই যে তখন পাগল—টাগল বললাম, কুমড়োর মতো মুখ—।

রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলো—নাগো, রাগের কথা নয়। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না। কিন্তু—আমি কী করে বোঝাব—

—তুমি কি সেই আবির্ভাবটিকে এখনো ভুলতে পারোনি?

—কী করে ভুলব? প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মীয়দের কেউ দেখা করতে এসেছে। একটু মজা করছে। কিন্তু দরজা খুলে যখন দেখলাম কেউ নেই তখন—

বাধা দিয়ে সঞ্জয় বলল, আরে বাবা, নিশ্চয়ই কেউ ভুল করে তিনতলায় উঠে এসেছিল। তারপর নিজের ভুল বুঝে চুপি চুপি নীচে চলে গেছে। এই তো ব্যাপার। এই নিয়ে—

রীণা এ উত্তরে নিশ্চিন্ত হল না। বলল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নামেনি। আমি এক মুহূর্তের জন্যে লোকটাকে জানলার সামনে দিয়ে বাঁ দিকে যেতে দেখেছি। আর ফিরতে দেখিনি। তুমি নিশ্চয়ই জানো ওদিকটা একেবারে ব্লাইন্ড। ওদিক দিয়ে চলে যাবার উপায় নেই।

সঞ্জয় চুপ করে শুনল।

—তাছাড়া আমি বন্দনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও সারা দুপুর সিঁড়ির সামনের ঘরে বসেছিল। কাউকে উঠতে দেখেনি বা জুতোর শব্দ পায়নি।

রীণার এত কথার পর সঞ্জয় শুধু একটা প্রশ্ন করল, বন্দনা আবার কে?

রীণা বিরক্ত হয়ে বলল, দোতলার নিখিলবাবুর মেয়ে বন্দনাকে চেন না? কতবার এসেছে। দেখেছ।

—আমি নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে তাকাই না।

—ওঃ! ভারি সাধু—পুরুষদের চিনতে আমার বাকি নেই।

বলে পাশ ফিরে শুলো।

ঘরের মধ্যে হালকা নীল আলো। মাথার ওপর পাখার ঝড়। বাইরে অন্ধকার আকাশে লক্ষ তারার চোখ—টেপা হাসি।

—ঘুমোলে? গাঢ়স্বরে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।

—ঘুম আসছে না।

সঞ্জয় পাশ ফিরে ডান হাতটা ঝুলিয়ে দিল রীণার বুকের ওপর। একটু আকর্ষণ করল। রীণার হালকা দেহটা এসে পড়ল তার নিশ্বাসের মধ্যে।

—এবার ঘুমোও।

—অমন করলে ঘুম হয়? বলে রীণা সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরল।