১-৩. ব্রেকফাস্টের পর

হাঙরের পেটে হিরে (২০১৩)
অর্জুন সমগ্র ৬ – সমরেশ মজুমদার

আজ ব্রেকফাস্টের পর অনেকটা সময় গেল শুধু মিটিং করতে। মেজরের মানহাটান ফ্ল্যাটে এসেছিলেন এফবিআই-এর দু’জন বড় অফিসার। লাইটার উদ্ধার করার পর অর্জুনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা বেশ চিন্তিত। যে দলটা ওই লাইটার-চক্রান্তে সক্রিয় ছিল, তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছে বটে, তবে নিশ্চয় তাদের আক্রোশ থাকবে অর্জুনের ওপর। সেক্ষেত্রে নিউইয়র্কের রাস্তায় যদি ওর কিছু হয়ে যায়, তবে তা হবে আমেরিকান সরকারের লজ্জা। মিস্টার হোপ, অফিসারদের একজন, বারংবার বলছিলেন, অর্জুন যদি আগেভাগে তার ট্যুর-প্রোগ্রামটা ওঁদের জানিয়ে দেয়, তা হলে ওঁরা সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেন।

কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্জুনের খুব হাসি পাচ্ছিল। জলপাইগুড়ির বেকার ছেলে নিউইয়র্কে এসে হঠাৎ খাতির পাবে, তা কে জানত। তারও আবার ট্যুর-প্রোগ্রাম। মেজর অবশ্য খুব গম্ভীর মুখে আলোচনা চালাচ্ছেন, কিন্তু সে হাঁপিয়ে উঠছিল। পুলিশের পাহারায় এদেশে থাকার চাইতে দেশে ফিরে যাওয়া অনেক ভাল। দিন-দশেক হল সে আমেরিকায়। এসেছে। নিউইয়র্কটাই ভাল করে দেখা হয়নি। মেজরের হাতের রান্না আর ম্যাকডোনাল্ডের হ্যামবার্গার খেয়ে পেটে ইতিমধ্যেই চড়া পড়ে গেছে। শুধু ওই ম্যাকডোনাল্ডে যে বিশাল মুখবন্ধ কাগজের গ্লাসে মিল্কশেক নামের জমানো মিষ্টি দুধ পাওয়া যায়, তার জন্যেই এদেশে থাকা যায় বলে তার মনে হচ্ছে। তা পুলিশ পাহারায় থাকতে হলে সে ওই মিল্কশেকের লোভও ত্যাগ করতে পারে।

মিস্টার হোপ বললেন, আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের দেশের সুন্দর জায়গাগুলো বেড়িয়ে আসতে পারেন। এই ধরুন, লস অ্যাঞ্জেলিস। আপনার আপত্তি না থাকলে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারি। ওখানে গেলে মনে হয় কোনওরকম ঝামেলার আশঙ্কা কম।

লস অ্যাঞ্জেলিস। নামটা কানে যাওয়ামাত্র মন চনমনে হয়ে উঠল। পরিরা হারিয়ে গেছে নাকি সেখানে? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল অফিসাররা অনর্থক চিন্তা করছেন। অমল সোম কখনওই কোনও অপরাধীকে ধরার পর তার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন না। রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন তিনি প্রায়ই বলতেন, অন্যায়ের ছুরির কোনও বাঁট নেই। যে আঘাত করে, সে নিজেও রক্তাক্ত হয়।

অফিসাররা ওঠার আগে ওদের চিন্তা করতে বললেন। মিস্টার হোপ অর্জুনকে একটা কার্ড দিয়ে গেলেন। সেই কার্ডে লেখা রয়েছে, এই ভদ্রলোককে সাহায্য করা মানে, তা আমেরিকান সরকারকে সাহায্য করার সামিল হবে। বললেন, কখনও বিপদে পড়লে যে-কোনও পুলিশ অফিসারকে ওটা দেখালেই কাজ হবে।

ওঁরা বিদায় নেওয়ার পর মেজর সোজা উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত ওপরে ছুঁড়ে আলস্য ভাঙলেন। তারপর একটা কোকাকোলার টিন ফুটো করে পুরোটা গলায় ঢাললেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার খিদে পায়নি?

পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে বকর বকর করতে করতে। ভিজিয়ে নিলাম। আঃ। এবার বলো তো কী রাধি?

অর্জুন আতঙ্কিত হল, রান্নার কী দরকার। চলুন না বাইরে গিয়ে খাই।

ম্যাকডোলান্ডে? মিল্কশেক? মেজর গলা ফাটিয়ে হাসলেন, কত ক্যালোরি আছে জানো ওতে! রোজ খেলে পিপে হয়ে যাবে দু’দিনে।

অর্জুনের মেজাজ খারাপ হল। যেন মিল্কশেক না-খেয়ে উনি মোটা হচ্ছেন না। মেজর বললেন, আমি হেনরিকে আসতে বলেছি এখানে। ওকে লাঞ্চ খাওয়াবে।

কে হেনরি?

হেনরি! চোখ বড় করলেন মেজর, আমার বন্ধু। আমার অভিযানের পার্টনার। ওর জন্যে কালিম্পং থেকে সেই রেয়ার পপিটা এনেছি। তিরিশ দিন আমি আর হেনরি আমাজনে ডিঙিনৌকোতে ছিলাম, আল্পসের তুষারঝড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম সাতদিন, হেনরি আমাকে খুঁজে বার করেছিল। হেনরি ডিমক। এক নম্বরের পাগল। কিন্তু ও তো লেট করে না। দাঁড়াও দেখছি। মেজর উঠে টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। তার ছাড়াই ঘরের যে-কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে এখানে ফোন করা যায়।

হাই হেনরি! পাজি পা-ঝাড়া! আমার এখানে লাঞ্চ খেতে আসবে বলে ওখানে কোন রাজকার্য করছ।… কী?… কথা বলতে পারছ না? এত বড় আস্পর্দা?… কী?… ওয়াচ করছ? ছাইমাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।… চলে আসব? বয়ে গেছে আমার। রাবিশ’ টেলিফোন নামিয়ে রেখে নিজের মনেই মেজর চিৎকার করে উঠলেন, বন্ধু না ঘেঁচু! সেবার গ্লেসিয়ার থেকে যখন পড়ে গিয়েছিল, তখন আমি না টেনে তুললে আজকে ওয়াচ করা বেরিয়ে যেত!

অর্জুন অবাক হয়ে শুনছিল। মেজরকে সত্যি খুব রাগী দেখাচ্ছে। আঙুলের ডগায় দাড়ি চুলকোচ্ছেন আর গজর গজর করছেন। সে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, উনি কী ওয়াচ করছেন?

হিরে। কাচ ভেবে কিনেছিল। মেজর মুখ বিকৃত করলেন।

মানে? অর্জুন হতভম্ব। এতদিন শুনে এসেছে লোকে হিরে ভেবে কাচ কেনে, আর এ যে শুনছে উলটো।

মেজর আর একটা কোকাকোলা গলায় ঢাললেন। অকৃতজ্ঞ, বেইমান! এত বড় একটা এক্সপেরিমেন্ট আমাকে বাদ দিয়ে করছে। অথচ আমার প্রতিটি ব্যাপারে আমি ওকে আগেভাগে খবর দিই। লেটস গো! চলো তো, মুখের ওপর কথাগুলো শুনিয়ে আসি। এরকম বন্ধু দরকার নেই আমার।

মেজর লাফিয়ে উঠতেই টেলিফোন বেজে উঠল। ব্যাটা বোধহয় আমাকে চাইছে। বলবে, বাড়িতে নেই, কথা বলতে চাই না!

অগত্যা অর্জুন রিসিভার কানে তুলল, হ্যালো?

কে? তৃতীয় পাণ্ডব? কেমন আছ? বিসাহেবের গলা।

অর্জুন অবাক, ভাল। আপনি কেমন? কোত্থেকে বলছেন?

হাসপাতাল থেকে। বেডে শুয়েই এদেশে টেলিফোন করা যায়।

আপনি ঠিক আছেন?

না হে। এ বন্দিদশা আর সহ্য হচ্ছে না। কালিম্পং বড় টানছে আমাকে। ডাক্তার বলছে আমি ভাল হব। কবে হব কে জানে! তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? বিদেশ বিভুঁই! বিষ্ঠুসাহেবর গলার স্বর অর্জুনের মন জুড়িয়ে দিল।

বলছেটা কে? মেজর এগিয়ে এলেন।

বিষ্টসাহেব! অর্জুন মেজরকে রিসিভারটা দিল।

অ। শুনুন। হাসপাতালে শুয়ে বকর বকর করাটা ঠিক নয়।… কী বললেন?…না, না, আমার মেজাজ ঠিক আছে।… অর্জুনকে ভাল-মন্দ খাওয়াচ্ছি কিনা? আশ্চর্য। আপনি আমাকে কী ভাবেন বলুন তো? কাল ডিনারে চিংড়ি মাছের সসপ্যান চচ্চড়ি করেছিলাম তা জানেন?… যাব দেখতে আপনাকে।–নো, নো, নো এক্সপিডিশন!

মানহাটান থেকে বেরিয়ে সোজা টাইম স্কোয়ারের দিকে হনহনিয়ে হাঁটছিলেন মেজর, পিছনে অর্জুন। কোথায় যাচ্ছে, তা সে জানে না। খিদেয় পেট চোর্চো করছে। টাইম স্কোয়ারটা ঠিক কলকাতার মতো। ফুটপাথে হকার, চিৎকার চেঁচামেচি। বেশিরভাগ নিগ্রো এ-তল্লাটে। সে দ্রুত পা চালিয়ে মেজরকে জিজ্ঞেস করল, হার্লেমটা কতদূর?

মেজর থমকে দাঁড়ালেন, কেন? সেখানে কী দরকার?

চার্লসের খোঁজে গেলে হয়। চার্লস বলেছিল সে হার্লেমে থাকে।

অ। দ্যাট গ্রেট থিফ। জোন্স অ্যান্ড জোন্সের পুরস্কারের টাকাটার শেয়ার নিয়ে ব্যাটা হাওয়া হয়ে গেছে না? কিন্তু হার্লেম পরে হবে। ডেঞ্জারাস জায়গা।

মেজর কেন ডেঞ্জারাস’ বললেন, তা জানে অর্জুন। হার্লেম হল নিউইয়র্কের একটা অঞ্চল, যেখানে নিগ্রোরা থাকে। সাদা চামড়ার লোকজন বলে, সেখানে নাকি পৃথিবীর সবরকমের অপরাধ নিত্য ঘটছে। খুন-জখম তো জলভাত। সাদা চামড়ার মানুষ সহজে যায় না সেখানে। লাইটার উদ্ধারে যার সাহায্য পেয়েছি, সেই চার্লস অবশ্য তাকে বলেছে, এসব সাদাদের বানানো গল্প। তিলকে তাল করা।

ভিড় ছাড়িয়ে দু’পা এগোতেই ডাক ভেসে এল, হেই মিস্টার।

মেজর দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। অর্জুন দেখল, ওপাশের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে তিনজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে। দু’জন সাদা, একজন কালো। তিনজনের শরীরেই ময়লা সুট। মুখে না-কামানো দাড়ি। বয়স্কতম যিনি, তিনি কালো প্রৌঢ়টিকে দেখিয়ে মেজরকে বললেন, হোয়াই ডোঞ্চ হেল্প ইয়োর ব্রাদার? ওকে তিনটে ডলার দাও।

সঙ্গে সঙ্গে মেজর পা চালালেন, চলে এসো। ব্যাটারা ভিখিরি।

ভিখিরি? অর্জুন হা হয়ে গেল। এ কীরকম ভিক্ষের ধরন! ওরা চলে যাচ্ছে দেখে তিনজনেই তারস্বরে গালাগাল দিতে লাগল। যার একটা শব্দ কানে গেলে নিজেকে সামলানো দায় হয়, তা শুনেও মেজর জায়গাটা পেরোতে পেরোতে বললেন, মেরে ব্যাটাদের ক্যালেন্ডার করে দিতে পারতাম। কিন্তু কাকে মারব? কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়। একটু থমকালেন তিনি, তারপরের লাইনটা যেন কী হে?

অর্জুন জবাব দিল না। তার নিজেরই রাগ হচ্ছিল। ভিক্ষে না পেয়ে যে দেশের ভিখিরিরা অমন গালাগাল করে, তাদের ক্ষমা করাটা কখনওই উচিত নয়, মানুষের শোভা না পেলেও।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন একশো পয়সায় এক টাকা। অবশ্যই সেই সেই দেশের মুদ্রায়। এতে হিসেব করতে সুবিধে হয়। একশো সেন্টে এক ডলার। নব্বই সেন্ট খরচ করলে পাতাল রেলের যে-কোনও দুরত্বে যাওয়া যায়। জীবনে প্রথমবার পাতালরেলে চাপল অর্জুন। আসনের পাশেই স্টেশনের নাম লেখা আছে। যে স্টেশন আসছে তার পাশে আলো জ্বলে উঠে বুঝিয়ে দিচ্ছে। ওরা চলে এল সোজা কুইন্সে। মানহাটান থেকেও পাতালরেলে চেপে এখানে আসা যেত, ম্যাপ দেখে বুঝতে পারল অর্জুন। মেজর কেন টাইম স্কোয়ার পর্যন্ত হাঁটলেন, তা প্রথমে ধরতে না পারলেও একটু একটু অনুমান করছে। এই হাঁটার জন্যেই সম্ভবত মেজরের মেজাজটা একটু ঠান্ডা হয়েছে।

মাটির ওপরে উঠে এসে মেজর বললেন, সামনেই ম্যাকডোনাল্ড। যাও, গিয়ে খেয়ে এসো। ওহো, না, চলো, আমিও সঙ্গে যাই। তোমার নিরাপত্তার প্রয়োজন।

অর্জুন অনেক কষ্টে হাসি চাপল, আপনি খাবেন না?

না। ইচ্ছে নেই। তুমি ভাবতে পারো অর্জুন, লোকটা পরশুদিন টাইম স্কোয়ার থেকে কাচ কিনেছে তিরিশ সেন্টে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখেছে, সেই কাচ দিয়ে আলো বের হচ্ছে। পরদিনই জহুরিকে দেখিয়ে জেনেছে ওটা বিরল শ্রেণির হিরে। জহুরি দাম দিতে চেয়েছিল আট হাজার ডলার। ও দেয়নি, কারণ হিরেটা ঘোরালে নাকি নানান রকমের আলো বের হচ্ছে। অথচ এসব আমায় জানায়নি। করুণ মুখে বললেন মেজর।

হয়তো জানাতেন। ব্যাপারটায় এত মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন…’।

বলছ? মেজরকে অন্যমনস্ক দেখাল একটু, কিন্তু তারপরেই দু’প্লেট মুরগির মাংসভাজা, দুটো হ্যামবার্গার আর দুটো বড় সাইজের মিল্কশেক কিনে ম্যাকডোনাল্ডের গোল টেবিলে রেখে বললেন, পেট পুরে খেয়ে নেওয়াই ভাল। হেনরিটা হাড়কিপটে। কফি ছাড়া কিছু খাওয়ায় না।

ম্যাকডোনাল্ড কোম্পানি সারাদেশে, দেশের বাইরেও সস্তায় ভাল খাবার পরিবেশন করার জন্যে ছিমছাম অথচ সুন্দর রেস্তোরাঁ তৈরি করেছে। কাউন্টারের ওপাশে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা সাদা অ্যাপ্রনে শরীর মুড়ে হাসিমুখে খাবার পরিবেশন করে। দেওয়ালে টাঙানো বোর্ডের মেনু দেখে অর্ডার দিয়ে নিজেই নিয়ে বসে যাও টেবিলে।

বাইরে বেশ ঠান্ডা, ঝোড়ো বাতাস বইছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। এ তল্লাটে কেউ সচরাচর ফুটপাথে হাঁটে না। গাড়ির ভিড় লেগেই আছে। আরাম করে খেতে খেতে অর্জুন কাঁচের দেওয়াল দিয়ে কুইন্সের রাস্তা দেখছিল। মেজর চোখ বন্ধ করে খেয়ে যাচ্ছেন। বিশাল চেহারার এই মানুষটিকে শিশুর মতো দেখাচ্ছিল। অর্জুন দেখল, একটা গাড়ি এসে ম্যাকডোনাল্ডের পার্কিং লটে থামল। এখানে কত সুন্দর সুন্দর গাড়ি দেখা যায়। দেশটা বড়লোকের কিন্তু অহংকার দেখানোর বালাই বিশেষ নেই। সেদিন সে একটা কাণ্ড করেছিল। এবার আসবার সময় মেজর একটা পল্লিসংগীতের রেকর্ড কিনে এনেছিলেন। একদিন মেজর বাড়িতে ছিলেন না, সে মনের সুখে জানলা খুলে গানটা জোর ভমে শুনছিল। পশ্চিমবাংলার অনেক দূরে বসে বাংলাদেশের গ্রামের ছবি যখন মনের ক্যানভাসে আঁকা হচ্ছে, তখন বেল বেজেছিল। দরজা খুলতেই সে অবাক হয়ে দেখেছিল, একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। গম্ভীর মুখে অফিসার জিজ্ঞেস করেছিল, রেকর্ডটা কে বাজাচ্ছে?

বাংলা গান এদেশে বাজানো অন্যায় কি না বুঝতে না পেরে সে বলেছিল, আমি।

তা হলে আমার সাহায্য তোমাকে নিতে হয়!

সাহায্য?

হ্যাঁ। আমার মনে হচ্ছে তোমার কানে কোনও গোলমাল হয়েছে। কাছেই হাসপাতাল আছে। চলো সেখানে।

আমার কানে তো কোনও গোলমাল নেই! সে অবাক হয়েছিল আরও।

সে কী! গোলমাল নেই, তবু অত জোরে গান বাজাচ্ছ? তুমি দেখছি পাড়াসুদ্ধ লোকের কান খারাপ করে ছাড়বে। কবে এসেছ এ-দেশে?

অর্জুন দিনটা বলার পর অফিসার ঘরে ঢুকে জানলা বন্ধ করে বললেন, তোমার পাশের ফ্ল্যাটে একজন হার্টের রুগি আছেন। যখনই গান বাজাবে, তার কথা ভাববে। ভল্মটা কমিয়ে দিলে তো শুনতে অসুবিধে হয় না।

অফিসার চলে গেলে সে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। সে বইতে পড়েছে বিখ্যাত লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি টেনিদার জনক, পাড়ার ছেলেদের মাইকের অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে লিখেছিলেন যে, তিনি আর বাঁচতে পারবেন না। আমাদের দেশে পুজোপার্বণে যখন মাইক চালানো হয়, তখন কোনও পুলিশ তো আসে না। মানুষই বা প্রতিবেশীর কথা কখন ভাবে?

অর্জুন দেখল লোক দুটো কথা বলতে বলতে ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকছে। তাদের মধ্যে একজন এদিকে তাকিয়েই খুব অবাক হল। দ্রুত পায়ে কাছে ছুটে এসে চিৎকার করে উঠল, অ্যাই মেজর। তুমি, তুমি এখানে?

.

২.

মেজর চোখ খুলে একবার তাকালেন, তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বললেন, খাচ্ছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমাকে আমি ফোন করে করে হাল্লাক। কেউ ফোন ধরছেই না।

বাড়িতে কেউ না থাকলে ফোন বেজেই যায়।

আঃ। এভাবে কথা বলছ কেন? এই মেজর?

বন্ধু যখন বন্ধুর মতো আচরণ করে না তখন… তুমি কী ভেবেছ বলো। তো, অ্যাঁ? হঠাৎ মেজর চিৎকার করে উঠলেন।

ভদ্রলোকের মুখে এবার হাসি ফুটল। এই তো! এতক্ষণে তুমি নর্মাল হয়েছ। মিট দিস জেন্টলম্যান। মিস্টার জর্জ রেগ। মেজর, আমার বন্ধু।

লম্বা-চওড়া শরীরটা টেনে তুলে মেজর পেপার ন্যাপকিনে আঙুল মুছে হাত বাড়ালেন, আমি আশা করব আপনি এ-দেশের প্রেসিডেন্টের কোনও আত্মীয়ও নন?

না, না। ভদ্রলোক বেঁটেখাটো, সুন্দর চেহারার, লজ্জিত হলেন, আমি সোনা-রুপো মণি-মুক্তোর ব্যাবসা করি মাত্র। তার ডান হাতে একটি লাল পাথরের আংটি চমৎকার দেখাচ্ছিল।

মেজর এবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বললেন, যে হতচ্ছাড়াটার জন্যে অ্যাদুর এলাম এ হল সেই, হেনরি ডিমক। হেনরি। হি ইজ অর্জুন।

হেনরি ডিমক মাথা দুলিয়ে হাত বাড়ালেন। বোঝা গেল, মেজর ইচ্ছে করেই অর্জুনের পরিচয় বিশদে জানালেন না। অবশ্য পরিচয় বলতে তো ওই একটাই, যা লাইটারকেন্দ্রিক। কিন্তু এত অন্তরঙ্গ বন্ধুকে মেজর এতদিন তার কথা বলেননি কেন? অর্জুনের মনে হল, হয়তো মেজর হেনরি ডিমককে বলেছিলেন, কিন্তু সেটা তার মনে আছে কি না যাচাই করার জন্যে শুধু নামটা বলেই চেপে গেলেন। রেগনসাহেব ততক্ষণে কাউন্টারে চলে গেছেন। কাগজের গ্লাসে দু’কাপ কফি নিয়ে ফেরত এলেন ভদ্রলোক। একবারও জিজ্ঞাসা করলেন না অর্জুনরা কফি খাবে কি না। হয়তো তাতে মিল্কশেকের গ্লাস দেখেই তা করেননি। চিনি, নুন এবং ঝালমশলা আলাদা আলাদা ছোট প্যাকেটে স্তূপ করে রাখা আছে। প্রয়োজন মতো নিয়ে নাও। দেখা গেল, রেগনসাহেব চিনি বেশি খান, ডিমক আদৌ খান না। ডিমক কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, মিস্টার রেগন একটা অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। টেলিফোনে তোমাকে যে হিরেটার কথা বলেছিলাম, সেটা উনি কিনতে চান। এখন দশ হাজার পর্যন্ত উঠতে রাজি আছেন।

দশ হাজার ডলারের হিরে কেউ তিরিশ সেন্টে বিক্রি করে না। ওটা স্রেফ কাচ। মেজর মন্তব্য করতেই রেগনসাহেব কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন, আমি আমার প্রফেশনটা বুঝি। কোন হকার ওঁকে বিক্রি করছে, কীভাবে তার হাতে এল ও-জিনিস, তা আমি জানি না। কিন্তু ওর একটা পেয়ার আছে লস অ্যাঞ্জেলিসে। দিনের বেলায় ঠিক কাচ বলে মনে হলেও, রাত্রে বিচিত্র আলো বের হয়।

হেনরি জিজ্ঞেস করলেন, লস অ্যাঞ্জেলিসের কোথায়?

স্যার ডিয়াগোর সি-ওয়ার্ল্ডে। জলের মধ্যে দিয়ে ওই হিরের আলো প্রবাহিত হয়। গভর্নমেন্ট স্পেশাল সিকিউরিটি রেখেছে হিরেটার জন্যে।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম কথা, দুটো জিনিস এক কি না, তাতেই আমার সন্দেহ হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা, আপনি এত ইন্টারেস্টেড কেন?

কারণ আমি এসব জিনিসের ব্যাবসাদার। সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি নিন, মিস্টার ডিমক।

খবরটা চাউর হতে বেশি দেরি হবে না। আর জানেনই তো, যত মানুষ জানবে, তত সমস্যা বাড়বে। রেগন সাহেব বললেন।

কিন্তু মিস্টার ডিমক কোনও স্থির সিদ্ধান্ত জানালেন না। তিনি আরও দু’দিন ভাববার সময় নিলেন। ব্যাপারটা পছন্দ হল না রেগন সাহেবের। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা বুঝিয়ে বলে চলে যাওয়ার পর ওরা হেনরি ডিমকের বাড়িতে এল।

নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল অর্জুনের। ঠান্ডা জোরবাতাসে চুল উড়ছিল। রঙিন বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে ওরা পৌঁছোল মিস্টার ডিমকের বাড়িতে। এদিকে দোকানপাট নেই। ছাড়া ছাড়া একতলা ছবির মতো বাড়ি। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে মিস্টার ডিমক ওদের ভেতরে আসতে বললেন। ম্যাকডোনাল্ড থেকে বেরিয়ে পুরো রাস্তাটা হেঁটে আসার সময় সারাক্ষণ তিনি মেজরের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। অর্জুন ছিল খানিকটা পিছিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখল, দেওয়ালময় যেসব জিনিস টাঙানো তাতে মানুষটির শখ অথবা জীবিকার কথা বোঝা যায়। বিভিন্ন অভিযানের নানান স্মারক ওগুলো। ওদের বসবার ঘরে বসতে বলে কয়েক পা এগিয়ে মিস্টার ডিমক চিৎকার করে উঠলেন, মাই গড!

মেজর আরাম করে বসতে যাচ্ছিলেন, না বসে বললেন, কী হল?

কেউ এসেছিল। এপাশের দরজাটা ভেজানো। অথচ গত এক সপ্তাহ ধরে ওটা বন্ধ ছিল।

হেনরি ডিমক প্রায় ছুটে গিয়ে দরজায় চাপ দিতে খুলে গেল। ওপাশটায় বারান্দা এবং এক চিলতে ঘেরা বাগান। বাগানের পাঁচিলটা বড়জোর পাঁচ ফুট উঁচু।

তিরের মতো হেনরি ডিমক পাশের ঘরে ঢুকলেন, অফ কোর্স কেউ এসেছিল। মাই গড। আমি তো মাত্র মিনিট পঁয়তাল্লিশেক বাড়ির বাইরে ছিলাম।

ঘরের সমস্ত জিনিস ওলট পালট করেছে কেউ। দু’দুটো আলমারির পাল্লা ভাঙা। তার সব জিনিস ঘরের মধ্যে উঁই করে রাখা। মেজর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বউ কখন বেরিয়ছে হেনরি?

সে তো ব্রেকফাস্ট খেয়েই অফিসে চলে গিয়েছে। কিন্তু কী নিতে এসেছিল লোকটা? বলতে বলতে হেনরি ছুটল পাশের দরজা নিয়ে। অর্জুন অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে মাটির তলার ঘরে নেমে এল। ঘরটা বিশাল। হয়তো এ-পাড়ায় দোতলা করার নিয়ম নেই বলেই মাটির তলায় এই ঘর করা হয়েছে। পুরোটা কার্পেট এবং ওয়ালপেপারে মোড়া। টিভি, পড়ার টেবিল, বইয়ের আলমারি থেকে ডিভান পর্যন্ত রয়েছে। ওপাশে একটা মিনি টয়লেট।

এখানেও আগন্তুক পা রেখেছিল। হেনরি ডিমক টেবিল থেকে কঁপা হাতে একটা কালির দোয়াত তুলে নিলেন। একটু নাড়ালেন কানের কাছে এনে। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আর একটা পাত্রে দোয়াতটা উপুড় করতেই মেজরের গলা পাওয়া গেল, বলিহারি বুদ্ধি! কাচটাকে দোয়াতে রেখেছ?

কাচ নয়, হিরে। রেগনকে দেখানোর পর মনে হয়েছিল কালির ভেতর রাখলে আলো বের হয় কি না এসে দেখব। রেখেছিলাম বলেই বেঁচে গেল।

মেজর ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, চোর এই বস্তুর জন্যে এসেছিল এটা মনে করার কী যুক্তি আছে? তুমি যে ফুটপাথ থেকে কাচটা কিনেছ…’

কাচ নয়, হিরে। হেনরি বাধা দিলেন।

ওই হল। যে ফুটপাথ থেকে কিনেছ, তা এই কুইন্স থেকে অনেক দূরে। অতএব কারও জানার কথা নয় জিনিসটা তোমার কাছে এসেছে। জহুরি এবং আমাকে ছাড়া কাউকে বলেছ?

মেজরের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়ে না বললেন হেনরি। মেজর বললেন, তা হলেই বুঝতে পারছ, যখন কেউ জানেই না যে, ওটা তোমার কাছে। আছে, তখন খামোখা নিতে আসবে কেন? চোর এসেছিল নিশ্চয়ই অন্য ধান্দায়। এই নাও। বলে একটা খাম পকেট থেকে বের করে উঁচিয়ে ধরলেন মেজর।

কী ওটা? হেনরির চোখ ছোট হয়ে এল।

রেয়ার টাইপ অব পপি। কালিম্পঙের পাহাড়ে দেখতে পেয়ে তোমার জন্যে নিয়ে এলাম।

কাচটা অথবা সত্যিকারের হিরেটাকে টেবিলের ওপর রেখে হেনরি যেভাবে খামটা নিলেন অর্জুন তাতে অবাক হয়ে গেল। মহার্ঘ কোনও বস্তু পাচ্ছেন এইরকম ভঙ্গিতে তিনি খামটা খুলতে লাগলেন। অর্জুনের মনে পড়ল, কালিম্পঙের বিষ্টসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে সে মেজরকে প্রথম দেখেছিল পপি খুঁজতে। এখন দুই প্রৌঢ় যেভাবে তন্ময় হয়ে পপির গুণাগুণ নিয়ে কথা বলছেন, তাতে কে বলবে একটু আগেই ওঁরা হিরের ব্যাপারে বিব্রত ছিলেন।

অর্জুন টেবিলে রাখা হিরেটার কাছে চোখ নিয়ে গেল। এখনও কালির সামান্য দাগ হয়ে গেছে ওর শরীরে, কিন্তু আলো-ফালো তো কিছু বের হচ্ছে না। সে আঙুলের ডগায় বস্তুটিকে ধরল। সাধারণ কাঁচের মতো। রাস্তায় পড়ে থাকলে সে নিজেও এটাকে গুরুত্ব দিত না। অথচ এর দাম এখন উঠেছে দশ হাজার ডলার। ভাবা যায়?

মেজর ব্যাপারটা লক্ষ করে এগিয়ে এলেন, কী ভাবছ মিস্টার ডিটেকটিভ?

হেনরি অবাক হলেন, ডিটেকটিভ?

মেজর বললেন, তোমার স্মৃতি খুব খারাপ টাইপের। তোমাকে সেদিন বললাম না, ভারত থেকে যে তরুণ ছেলেটি এদেশে এসে জোন্স অ্যান্ড জোন্সের লাইটার খুঁজে বের করছে, সে আমার কাছেই উঠেছে? এই সেই ছেলে।

হঠাৎ যেন এতক্ষণ বাদে হেনরি ডিমক তাকে নজর করলেন। উচ্ছ্বসিত হাসি নিয়ে হাত বাড়ালেন হেনরি ডিমক, ওহ, ইউ আর দ্যাট ডিটেকটিভ। তোমার বয়স এত কম আমি ভাবতে পারিনি। তোমার কি মনে হয় লোকটা ওই হিরের জন্যে এসেছিল?

অর্জুন বলল, আমরা এখনও জানি না, একজন না অনেকে। তা ছাড়া জহুরি ভদ্রলোক যদি কাউকে গল্প করে থাকেন যে, ওটা আপনার কাছে আছে, তা হলেই… আপনি একবার জহুরিকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

হেনরি বললেন, দ্যাটস এ গুড আইডিয়া। পুলিশকেও বলতেই হবে। আমার বাড়িতে অজানা লোক এভাবে ঢুকুক আমি পছন্দ করি না।

হঠাৎ অর্জুনের মাথায় একটা মতলব ঢুকল। কেন ঢুকল সে জানে না, হেনরি যখন রিসিভারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন সে বলল, রেগন সাহেবকে বলুন, মেজর হিরেটা কিনতে চাইছেন। উনি আপনাকে পনেরো হাজার ডলার দাম দিচ্ছেন।

আমি? মেজর আঁতকে উঠলেন, নো! নেভার! পনেরো ডলার পর্যন্ত নয়। ওসব মণিমুক্তো থেকে আমি দশ মাইল দূরে থাকতে চাই।

হেনরি যখন কথা বলছিলেন, তখন অর্জুন ঘুরে ঘুরে ঘরটাকে দেখছিল। পুলিশ কি এখানে আগন্তুকের হাতের ছাপ পাবে? এতটা কাঁচা এদেশের মানুষ হবে বলে মনে হয় না। সে এমন কিছু পাচ্ছিল না যা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। হেনরি টেলিফোন নামিয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে তাকালেন, এ কী কথা! রেগন এখন বিশ হাজার বলছে। লস অ্যাঞ্জেলিসে যেটা আছে, তার দামও নাকি তাই। সাত বছর আগে একটা হাঙর পাগল হয়ে কাচ ভেঙে ফেলবার পর এই হিরেটা নাকি খোয়া গিয়েছিল। তিনটে মার্ডার হয়েছে হিরেটাকে কেন্দ্র করে। শেষ মৃত মানুষটি পৃথিবীতে ছিল আড়াই বছর আগে। তারপর হিরেটার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মেজর বললেন, কিন্তু রেগন কি কাউকে বলেছে যে, হিরেটা তোমার কাছে আছে?

হেনরি ডিমক মাথা নাড়লেন, বললেন, বোকারাই এ নিয়ে আলোচনা করে। বাট আই ডোন্ট বিলিভ। চোর অন্তর্যামী নয়। কিন্তু আমার এসব ভাল লাগছে না, মেজর। বিশ হাজারে দিয়েই দিই। টাকাটা সামনের বছর আমাদের ইয়েতির অনুসন্ধানে কাজে লাগবে।

অর্জুন ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এল। চোর দ্বিতীয় এবং নীচের ঘরটাই তছনছ করেছে, কিন্তু ওপাশের বন্ধ ঘরটায় ঢোকেনি। দরজাটা ভাঙারও চেষ্টা করেনি। কেন? সময় কম ছিল বলে? তা হলে ওরা এবাড়িতে ঢোকার কাছাকাছি সময়ে চোর পালিয়েছে। বন্ধ ঘরটায় কে থাকে? অর্জুন ওপরের বিধ্বস্ত ঘরটায় কিছু খুঁজে পেল না। তারপর পাশের দরজাটা খুলে বারান্দায় এল। সরু লম্বা বারান্দা। সবুজ ঘাসের লন গা ঘেঁষে। তারপরই ফুলের গাছ। অর্জুন ঝুঁকে দেখতে লাগল। ঘাসের ওপর পায়ের চাপ পড়েছে। দরজাটা যদি সাতদিন বন্ধ থাকে, তা হলে হেনরি এদিকে আসেননি। চাপটা চোরের শরীরের। ঘাস যেখানে হয়েছে, সেখানে নরম মাটির ওপর জুতোর দাগ। অর্জুন লক্ষ করল, জুতোর হিলে অর্ধগোলাকৃতি কিছু বসানো ছিল বলে সেটা মাটিতে ঢুকেছে পা ফেলার সময়। অল্প মাটি উঠে গেছে তাই জুতোর তলায়। দাগটা অনুসরণ করে সে পাঁচিলটা পর্যন্ত গেল। তারপর লাফিয়ে পাঁচিলে উঠে বসল। ওপাশে ঢালু মাঠ, পপলার গাছ, ছবির মতো সুন্দর রাস্তা। কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। সে শরীর ঝুলিয়ে এপাশে নেমে এল। মাটি শক্ত, জুতোর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। সোজা এগিয়ে এসে রাস্তায় পড়তেই ও পার্কিং লটটা দেখতে পেল। এখানে গাড়ি রেখে স্বচ্ছন্দে ওপরে ওঠা যায়। অর্জুন চারপাশে তাকাল। পার্কিং লটের পাশেই টেলিফোন-বুথের মতো একটা ঘর। ওপর থেকে গাছপালার আড়াল থাকায় এটাকে চোখ পড়েনি। অর্জুন একটু এগিয়ে যেতেই গলা ভেসে এল, ইয়েস সার! হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

বুথের ভেতর টুলে বসা একটি বৃদ্ধ হাসিমুখে প্রশ্নটা ছুড়লেন। অর্জুন মাথা নাড়ল, আমি এক ভদ্রলোককে খুঁজছি, যিনি এখানে গাড়ি রেখেছিলেন একটু আগে।

ভদ্রলোক? বৃদ্ধ খিঁচিয়ে উঠলেন, ওকে ভদ্রলোক বোলো না। পনেরো সেন্ট কম দিয়ে গেছে। পার্কিং ফি দিতে যাদের গায়ে লাগে, তারা গাড়ি রাখে কেন?

কীরকম দেখতে বলুন তো ওকে?

ওই তো লম্বা, ভারী চেহারা, একটা পা সামান্য টেনে হাঁটছিল। আরে, লাল টয়োটা গাড়ি, দু’চক্ষে দেখতে পারি না। বৃদ্ধ বিড়বিড় করছিলেন।

গাড়িটার নাম্বার মনে আছে?

না। খাতায় লেখা আছে। কিন্তু আপনাকে বলব কেন?

অর্জুনের হঠাৎ খেয়াল হল কার্ডটার কথা, যেখানে লেখা আছে, তাকে সাহায্য করা মানে সরকারকে সাহায্য করা হবে। সেটা দেখাতেই বৃদ্ধের মুখের চেহারা পালটে গেল। তিনি খাতা দেখে নম্বর বললেন, এটা রিনসেক কোম্পানির গাড়ি। ওরা গাড়ি ভাড়া দেয়।

সামান্য ঘুরে হেনরি ডিমকের বাড়িতে যখন ফিরে এল অর্জুন, তখন মেজর খুব চিন্তিত। দেখামাত্র চিৎকার করে উঠলেন, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

একটু পায়চারি করে এলাম। মিস্টার ডিমক, রিনসেক বলে কোনও কোম্পানি আছে যারা গাড়ি ভাড়া দেয়? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

থাকতে পারে। কেন?

অর্জুন ব্যাপারটা বলল। হেনরি ডিমক গাইড দেখে নম্বর বের করে বোতাম টিপলেন টেলিফোনের। রিনসেক জানাল, ওই নাম্বারের গাড়িটা তিনদিন হল এক ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছিলেন। একটু আগে তিনি ফেরত দিয়ে গেছেন ভাড়া মিটিয়ে।

অর্জুন বলল, ব্যাপারটা সুবিধের নয়, মিস্টার ডিমক। আপনি পুলিশকে জানান।

হেনরি বললেন, জানাব। কিন্তু আমার খুব লোভ হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলিসের হাঙরের বাক্সে অন্য যে হিরেটা আছে, সেটাকে দেখতে। আমারটা যদি ওটার জোড়া হয়, তা হলে সমান্তরালভাবে দুটোকে রাখলে যে আলো বের হবে, সেই আলো জলের মধ্যে মিলিত হলে নাকি কোনও হাঙর তা অতিক্রম করতে পারে না। রেগন বলেছিল এটা। পুলিশকে জানালে হিরেটার কথাও বলতে হবে। বললে ওরা জাতীয় সম্পত্তি বলে এখনই নিয়ে নেবে। লস অ্যাঞ্জেলিসের ব্যাপারটা দেখার পর এটা পুলিশের হাতে তুলে দেব।

কিন্তু হিরেটা আপনার কাছে রাখা বিপজ্জনক।

আমার কাছে নেই।

নেই মানে? অর্জুন হতভম্ব হতেই মেজর হাতের ছড়িটা নাচালেন। এখানে আসার সময় মেজরের হাতে ছড়ি ছিল না। কাজ-করা দামি ছড়িটা তিনি হেনরির ডিমকের কাছ থেকেই পেয়েছেন। অর্জুন বলল, ওতে ঠিক থাকবে তো?

মেজর হাসলেন, লুকোনো গর্ত। আট-পাঁচ না খুললে পড়ার চান্স নেই।

.

৩.

কেনেডি এয়ারপোর্টটা এত বড় যে, সামলে ওঠা মুশকিল। যেসব এয়ারলাইনস দেশের মধ্যে চলাচল করে, তাদের মধ্যে আমেরিকান এয়ারলাইনসের সুনাম বেশি। টিকিটের দাম ট্রেনের টিকিটের চেয়ে কম অবশ্য পিপলস এয়ারওয়েজে। জনতা এক্সপ্রেস আর কী! ওতে টিকিট নিতে হয় আকাশে ওড়ার পর কনডাক্টারের হাতে ডলার দিয়ে। সস্তা বলেই বিনি পয়সায় কিছু খেতে দেয় না। মেজর এবং হেনরি ডিমক অবশ্য আমেরিকান এয়ারলাইনসেই যাচ্ছেন। লাইটার’-এর কল্যাণে অর্জুনের টিকিটের অসুবিধে হয়নি।

এর মধ্যে একদিন হেনরি ডিমকের বাড়িতে হামলা হয়েছে। সেটা হয়েছে, যখন তিনি বা তার স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। টেলিফোন এসেছিল হুমকি দিয়ে যে, যদি তিনি হিরেটা কাউকে বিক্রি করেন, তা হলে পৃথিবীর মায়া কাটাতে হবে। হেনরি ডিমক অম্লান বদনে বলেছেন, হিরেটা তার কাছে নেই।

সেদিন ডিমসাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেজরকে নিয়ে অর্জুন গিয়েছিল রিনসেক কোম্পানিতে। যে-লোকটা ডিউটিতে ছিল, সে কার্ডটা দেখার পর মাটির তলায় গ্যারেজ ওদের নিয়ে গিয়েছিল। শখানেক গাড়ির মধ্যে সেই নাম্বারের গাড়িটা বের করে দেখিয়েছিল ওদের। দামি এয়ারকন্ডিশনড গাড়ি। কোথাও কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি লোকটা। কিন্তু ড্রাইভিং সিটের পাদানিতে অর্জুন এক টুকরো মাটি দেখতে পেয়েছিল। লোকটার সম্পর্কে মেজর খোঁজখবর নিতে কর্মচারীটি বিশদ বলতে পারল না। শুধু জানিয়েছিল, ওই গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলিস থেকে, টেলিফোনে।

কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনটা উড়েছিল দুপুরে। টানা পাঁচ ঘণ্টা ওড়ার পর লস অ্যাঞ্জেলিসে থামবে। মেজর এবং হেনরি ডিমক পাশাপাশি বসেছেন। মেজর খুব উত্তেজিত। না হলে ছড়িটাকে ওইভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতেন না। সিকিউরিটি চেকিং-এর সময় বেশ মজার ব্যাপার ঘটেছিল। মেজর যখনই ছড়ি হাতে মেটাল ডিটেক্টারের মধ্যে দিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন, তখনই টুংটাং শব্দ বাজছিল। সিকিউরিটির লোকজন ওঁকে ছড়ি ছাড়া হাঁটতে বলায় মেজর অভিনয় করলেন যেন তিনি সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না। ছড়িটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তলার লোহার নালটাকে আবিষ্কার করে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, লোহার জন্যেই শব্দটা হচ্ছে। পরে একা হলে মেজর বলেছিলেন, অ্যাকটিং করলে, বুঝলে, আলেক গিনেসকে হার মানিয়ে দিতাম। বলার সময় যদিও গলা কঁপছিল।

পাশাপাশি বসে মেজর এবং হেনরি খুব গল্পে মশগুল। অর্জুন বসেছে। কিছুটা পিছিয়ে। সুন্দরী এয়ারহোস্টেসরা হাসিমুখে খাবার সার্ভ করছে। অর্জুন তার সামনের খাপ থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল। আমেরিকান এয়ারলাইনসের নিজস্ব পত্রিকা। রঙিন বিজ্ঞাপন দেখতে মন্দ লাগে না। ওর পাশে যে ছেলেটি বসে আছে, সে বেশ স্বাস্থ্যবান। বসা অবধি উসখুস করছে। একসময় সে উঠে টয়লেটের দিকে চলে গেল। অর্জুন নিজের আসন ছেড়ে মেজরের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে এসে দেখল এয়ারহোস্টেস তাদের সিটের সামনের ট্রে টেনে খাবার দিয়ে গেছে। ছেলেটি টয়লেট থেকে ফিরে এসে নিজের খাবার গপগপিয়ে খাচ্ছে। খিদে ছিল না। একটা প্যাস্ট্রি তুলে– অর্জুন নিজের প্লেট থেকে হাত গোটাবার আগেই ছেলেটা বলেছিল, মে আই হেলপ ইউ? যেন অর্জুনের খাবার শেষ করার দায়টা ও নিতে চাইছে। মজা লেগেছিল, প্লেটটা এগিয়ে দিয়েছিল অর্জুন। সেটাও সাবাড় করে ছেলেটা চোখ বন্ধ করেছিল, কিন্তু শান্ত হয়নি। সাহেবরা যে কারও এঁটো খাবার চেয়ে খেতে পারে, তা আগে কেউ বললে অর্জুনের বিশ্বাস হত না। এখন ম্যাগাজিন দেখতে দেখতে সে ছেলেটির অস্বস্তি আর একবার লক্ষ করল। হেসে বলল, কী ব্যাপার, তোমার কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে?

কে বলেছে অসুবিধে হচ্ছে? আমি তোমাকে বলতে গিয়েছি? ছেলেটা রাগী গলায় বলল।

অর্জুন আর কথা বাড়াল । যারা ভাল ব্যবহারের এমন জবাব দেয়, তাদের এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। প্লেন উড়ছে অন্তত তিরিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে। চারধারে পরিষ্কার আকাশ। নীচে মেঘের মাঠ। এই প্লেন সোজা উড়ে গিয়ে থামবে লস অ্যাঞ্জেলিসে, যে শহরে আছে হলিউড। সঙ্গে সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিন, লরেল হার্ডি থেকে হিচককের মুখ মনে পড়তেই সে সোজা হয়ে বসল। মেজরকে বলতে হবে হলিউড ঘুরে দেখাবার কথা।

পাশের ছেলেটা উঠে গিয়েছে টয়লেটে। অনেকক্ষণ। এয়ারহোস্টেসরা জানলা বন্ধ করতে বলল যাত্রীদের। তারপর ভিডিওতে ছবি শুরু হল। জেমস। বন্ডের ডক্টর নো’। ছবি চলছে। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকারে প্লেনটা কেঁপে উঠল। চমকে সমস্ত যাত্রী উঠে দাঁড়িয়েছে। পেছন দিকে খুব ব্যস্ততা, উঁচু গলায় উত্তেজিত সংলাপ। ছবি বন্ধ হয়ে গেল। তারপরেই ক্যাপ্টেনের গলা শোনা গেল, ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলাগণ, আপনারা যে যার আসনে বসে থাকুন। প্লেনের মাঝখানের টয়লেট আপাতত বন্ধ থাকছে। আমরা আপনাদের সাহায্য চাইছি।

একজন এয়ারহোস্টেস ছুটে আসছিলেন, পেছনের সিটের দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাবে জানিয়ে গেলেন, টয়লেটে একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। কথাটা কানে যাওয়ামাত্র যাত্রীরা যে-যার আসনে বসে পড়ল। অর্জুনের শরীরে হিম-ছোঁয়া লাগল। ছেলেটা এখনও আসছে না। তা হলে কি…। সে উঠে এগিয়ে যেতেই একজন বিমান-কর্মচারী বলল, ওদিকে যাবেন না। আপনার পাশের ছেলেটা ওখানে মারা গিয়েছে।

অর্জুন যেন অসাড় হয়ে গেল। সে কোনওমতে মুখ ফেরাতে দেখল পেছনের সিটের দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ালেন।

লস অ্যাঞ্জেলিস এয়ারপোর্টে ওদের তিন ঘণ্টা আটকে থাকতে হল। প্লেনের সমস্ত যাত্রীকেই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। যেহেতু ছেলেটির আসন ছিল অর্জুনের পাশে, তাই তাকে একটু বেশি। একটা ছেলে নিজেরটা অন্যেরটা খেয়ে টয়লেটে গিয়ে আত্মহত্যা করবে, এটা ভাবতেও অবাক লাগছিল অর্জুনের। অথচ মৃতদেহে হত্যার কোনও চিহ্ন নেই।

যে অফিসার অর্জুনকে ডেকে নিয়ে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন, তাঁর সামনে যে ব্যাগটা পড়ে রয়েছে, সেটা মৃত ছেলেটির। ওটাকে মাথার ওপরের ল্যাগেজ-র্যাকে রাখতে সে দেখেছিল ছেলেটিকে। অফিসার বললেন, আপনি বলছেন মৃত মানুষটি আপনার কাছ থেকে খাবার নিয়ে খেয়েছিল। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

অর্জুন হাসল, আমি মিথ্যে বলি না। তারপর সে পকেট থেকে কার্ডটা দেখাল।

কার্ড দেখে সামান্য ভাবান্তর হল অফিসারের। তিনি বললেন, সরকারি অতিথিরা যে সম্মান পান, আপনি তাই পাচ্ছেন। কিন্তু… আপনি এর আগে লস অ্যাঞ্জেলিস এসেছেন?

আমি এই প্রথম আমেরিকায় এসেছি। পাসপোর্ট দেখুন।

মুশকিল কী জানেন, একবার আমেরিকায় এসে বার কয়েক নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলিস ঘুরে যাওয়া যায়। ঠিক আছে, আমরা সবাইকে যা বলছি আপনিও তা-ই করুন। আপনার ঠিকানা রেখে যান, দরকার হলে যোগাযোগ করতে পারি।

অর্জুন মেজরের ঠিকানা লিখে দিল। তারপর একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ওর ব্যাগে কোনও ক্ল পাওয়া যায়নি?

না। শুধু রিনসেক কোম্পানির কার হায়ারের রসিদ ছাড়া।

রিনসেক কোম্পানি? অর্জুন চমকে উঠল।

কী ব্যাপার বলুন তো?

উনি কবে রিনসেক কোম্পানিতে গাড়ি ভাড়া করেছিলেন?

অফিসার হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা টেনে নিয়ে রসিদ বের করে তারিখটা বললেন। চোখ বন্ধ করে অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর বলল, অফিসার, আমি বোধহয় আপনাকে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু ওর মৃতদেহ কোথায়?

এয়ারপোর্টের মর্গে আছে এখনও।

আমি দেখতে পারি একবার?

কেন?

আমি আপনাকে বলব, কিন্তু তার আগে আমি দেখতে চাই।

অফিসার আর একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চালাবার নির্দেশ দিয়ে অর্জুনকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলেন। পুরো বাড়িটাই নিশ্চয়ই এয়ারকন্ডিশন্ড। কারণ, নামার সময় প্লেনে শহরের টেম্পারেচার যা বলেছিল, আগস্ট মাসে জলপাইগুড়িতে তা-ই থাকে। অথচ তার একফোঁটাও গরম লাগছে না। অনেকটা যাওয়ার পর ওরা যে-ঘরে ঢুকল, সেখানে একটা লম্বা ট্রে-র ওপরে ছেলেটা শুয়ে আছে। ধীরে ধীরে অর্জুন ওর সামনে দাঁড়াল। একটা চোখ বন্ধ, একটা চোখ আধ খোলা। কিছুক্ষণ আগেও ও তার খাবার চেয়ে খেয়েছিল। মুখে কোনও বিকৃতি নেই। পোস্টমর্টেম না করলে মৃত্যুর কারণ বোঝা যাবে না। অর্জুন ওর পায়ের দিকে চলে এল। তারপর নিচু হয়ে জুতোর হিলটা লক্ষ করে উত্তেজিত হয়ে উঠল। মৃত মানুষটার জুতোর তলায় অর্ধগোলাকৃতি লোহা বসানো। এবং লম্বা খাঁজে মাটি চাপ হয়ে বসে আছে। দুটো পায়ের জুতোতেই এক ব্যাপার।

অর্জুন বুঝল অফিসার তার দিকে তাকিয়ে আছেন। লস অ্যাঞ্জেলিস থেকে টেলিফোনে নিউইয়র্কের রিনসেক কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া করে হেনরি ডিমকের বাড়িতে যে হানা দিয়েছিল সে এই ব্যক্তি, তা প্রমাণ করতে ওর জুতো নিয়ে যেতে হয় হেনরি ডিমকের বাগানে। সেখানে জুতোর ছাপ এখনও আছে কিনা সন্দেহ, কিন্তু জুতোর ভেতর ঢুকে থাকা মাটি আর বাগানের মাটি যে এক, তা প্রমাণিত হবে। কিন্তু যদি না হয়, এই ছেলেটি যদি অন্য কারণে। গাড়ি ব্যবহার করে থাকে, অন্য জায়গার মাটি ওর জুতোয় লেগে যায়, তা হলে? আর এবার সেই সত্যিটা বলতে হয় অফিসারকে। হেনরি ডিমকের কেনা কাচ কী করে হিরে হয়ে গিয়েছে, কী উদ্দেশ্যে ওরা লস অ্যাঞ্জেলিসে এসেছে, এবং, সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার,… হিরেটা ওরা লাঠিতে ভরে নিয়ে এসেছে।

জুতোর শব্দ করে অফিসার এগিয়ে এলেন, ব্যাপারটা কী?

এই লোকটি রিনসেক কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া করে কুইন্সের একটা পার্কিং লটে ঝামেলা করেছিল পার্কিং ফি দেওয়া নিয়ে। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

সেটা আপনি মুখ দেখে বলতে পারলেন না, জুতোর তলা দেখে বলতে হল?

কারণ মুখটা মনে ছিল না। ওর পায়ের জুতোর হিলে লোহাটা সেদিন খুব শব্দ করছিল। এইটুকু স্মরণে আছে।

কুইন্সের কোন পার্কিং লটে?

অর্জুন হেনরি ডিমকের বাড়ির পেছনের এলাকাটা বুঝিয়ে দিল। ওরা অফিসে ফিরে এলে অফিসার ইতিমধ্যে-আসা একটা কাগজ টেবিল থেকে তুলে নিলেন। সেটা পড়ে চাপা গলায় বললেন, দিস ম্যান ওয়াজ এ প্রফেশনাল থিফ। এর আগে তিনবার জেল খেটেছে। একটা চোরের মৃত্যু হলে আমাকে বেশি চিন্তা করতে হবে না।

পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ওরা যখন ট্যাক্সিতে চেপে শহরে ঢুকছিল, তখন অর্জুনের মাথায় নানান চিন্তা ধাক্কা খেয়ে চলেছে। এখনও পর্যন্ত সে হেনরি সাহেবকে বলেনি যে তার বাড়িতে যে চোর ঢুকেছিল, সে-ই মারা গেছে। ও যদি প্রফেশনাল চোর হয়, তা হলে কেউ কি তাকে ভাড়া করে নিউইয়র্কে পাঠিয়েছিল? যদি তা-ই হয়, তা হলে প্লেনে কি কেউ ওকে খুন করেছে? খুন করলে তো তার চিহ্ন থাকবে শরীরে। আত্মহত্যা করলেও। এরকম ভদ্রলোকের মতো কেউ মরে যেতে পারে?

সে বিষয়টা নিয়ে এমন মগ্ন ছিল যে, শহরটাকে ভাল করে দেখছিল না। মেজরের কথায় তার খেয়াল হল। তুমি লস অ্যাঞ্জেলিসে নামামাত্র একটা খুন হয়ে গেল হে!

নামার আগেই। কিন্তু মেজর, আমাদের সাবধানে থাকতে হবে।

সাবধানে! আমি কখনও ভয় পাই না। হেনরি, তুমি কি ভয় পাও?

হেনরি নীরবে মাথা নাড়লেন। অর্জুন কিছু বলল না। মেজর দু’হাতে লাঠিটা আঁকড়ে ধরে আছেন। যাঁরা লাঠি ব্যবহার করেন, তারা কখনওই ওই ভঙ্গিতে লাঠি ধরেন না।

সেই একই দৃশ্য। বিরাট চওড়া রাস্তা, ফুটপাথে মানুষ নেই, অথচ মিনিটে হয়তো একশোটা গাড়ি ছুটছে। যেতে যেতে দুটো মোটেল দেখল অর্জুন। মোটরে যারা ঘুরে বেড়ায়, তাদের জন্যে থাকার ব্যবস্থা মোটেলে। মোটর ছাড়া মানুষ ওখানে থাকতে পারে কিনা কে জানে। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ল। ছেলেবেলায় জলপাইগুড়িতে মোটর কথাটা খুব চালু ছিল। এখন সচরাচর কেউ বলে না। কিন্তু মোটেল শব্দটাকে তো বেশ রোমান্টিক লাগছে।

ওরা যে হোটেলে উঠল, তার নাম এঞ্জেলস। সুন্দর ঝকঝকে হোটেল। আটতলা। প্রতিটি ডাবল-বেড ঘরের জন্য নেবে পঞ্চাশ ডলার। মেজর ও হেনরি একটি ঘর নিলেন। অর্জুনকে সিঙ্গল বেড দেওয়া হল, যার দাম তিরিশ ডলার। এখন আর সে টাকার হিসাবে ডলারকে দেখে না, ওতে খুব কষ্ট হয়। এই এত টাকা নিচ্ছে, কিন্তু শোওয়ার জায়গা ছাড়া এক কাপ চা পর্যন্ত বিনি পয়সায় দিচ্ছে না।

নিজের ঘরে ঢুকে অর্জুন নরম সাদা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। মেজর বলেছেন ঠিক আটটায় তৈরি থাকতে, ডিনার খেতে বের হবেন। দীর্ঘ বিমানযাত্রা, মৃত্যু নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, অর্জুনকে কাহিল করেছিল। সে চুপচাপ শুয়ে ব্যাপারটা ভাবছিল। হেনরি ডিমকের হিরের প্রতি কোনও লোভ নেই। তিনি ওটা পুলিশের হাতে স্বচ্ছন্দে তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু জোড়া হিরের আলো দেখবার লোভে একটা বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গের মাথায় পা রাখা অথবা উত্তরমেরুর শেষ বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ার লোভে মানুষ যে ঝুঁকি নেয়, তাতে একমাত্র আনন্দ ছাড়া অন্য কোনও বাস্তব লাভ হয় না। তবু মানুষ ছুটছে। মেজর কিংবা ডিমক সেই জাতের মানুষ। কিন্তু যারা বা যে ওই হিরেটার দখল পেতে চাইছে, তারা যে সুবোধ ব্যক্তি

হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। লস অ্যাঞ্জেলিস থেকে নিউইয়র্কে ভাড়াটে চোর পাঠায় যারা হিরেটার সন্ধানে, না পেয়ে ফিরে আসার পথে প্লেনে সেই চোরটাকে যারা স্বচ্ছন্দে মেরে ফেলতে পারে, তারা খুব সহজে পিছু ছাড়বে এমন ভাববার কোনও কারণ নেই। প্রথম প্রশ্ন, হিরেটা হেনরি ডিমকের কাছে। রয়েছে এই তথা এরা জানল কী করে? স্পষ্টত, সেই জহুরি ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে তা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। চোরটা এত প্লেন থাকতে ঠিক আজকেই এবং একই প্লেনে এল কেন মরতে?

এই সময় টেবিলের ওপর রাখা রিসিভারের তলার আলোটা দপদপ করতে লাগল, এবং যন্ত্রটা থেকে বিপ বিপ শব্দ ছড়িয়ে পড়ল। এরকম টেলিফোন অর্জুন জীবনে দেখেনি। সে রিসিভার তুলে নিতেই ওপাশ থেকে জড়ানো মার্কিং ঢঙের ইংরেজিতে কেউ প্রশ্ন করল, আমি কি সেই ইন্ডিয়ান ছোকরার সঙ্গে কথা বলছি, যার পাশের ছেলেটি আজ প্লেনে মারা গিয়েছে?

হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?

চমৎকার। মৃত্যু বারবার খালি হাতে ফিরে যায় না। কথাটা শেষ হওয়ামাত্র লাইনটা কেটে গেল। হতভম্বের মতো কয়েক সেকেন্ড বসে থাকল। অর্জুন। তারপর রিসিভার রেখে ধীরে ধীরে চেয়ারে এসে বসল। অর্থাৎ তারা যে এখানে উঠেছে, আলাদা ঘরে আছে, তা প্রতিপক্ষের জানা। ব্যাপারটা আর সহজ জায়গায় নেই। টেলিফোনে ভয় দেখানোর কায়দা খুব পুরনো। কিন্তু সতর্ক থাকতেই হবে। যারা আগ্রহী, তারা ধরা না দিক, দর্শন দিতে দেরি করবে না। ওর খুব ইচ্ছে করছিল হিরেটাকে একবার নেড়েচেড়ে দেখতে।