১.৩ বড় হলঘরের দরজা খুলে

বড় হলঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে ইরন তার বুকের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে–এই ঘরটিতে প্রজেক্ট আপসিলনের অন্যান্য অভিযাত্রীদের থাকার কথা। ঘরটি বড়, উঁচু ছাদ, অর্ধস্বচ্ছ দেয়াল এবং বিশাল কোয়ার্টজের জানালা। জানালা দিয়ে বাইরে যে নীল হ্রদ, তুষার ঢাকা পর্বতশ্রেণী এবং পাইন গাছের সারি দেখা যাচ্ছে সেগুলো নিঃসন্দেহে কৃত্রিম একটি ছবি, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি বোঝার উপায় নেই। কিছু একটাকে যদি এত জীবন্ত মনে হয় তা হলে সেটা কৃত্রিম হলেই কি কিছু আসে–যায়? ঘরের মাঝামাঝি কালো গ্রানাইটের মসৃণ টেবিল এবং সেই টেবিলকে ঘিরে বেশ কিছু সুদৃশ্য চেয়ার। টেবিলের দুপাশের দুটি চেয়ারের একটিতে একজন সুদর্শন সপ্রতিভ যুবক এবং অন্যটিতে কোমল চেহারার একজন তরুণী বসে আছে। জানালার কাছে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, মানুষটির সোনালি চুল তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য নিয়ে এসেছে। মানুষটির আকাশের মতো নীল চোখ কিন্তু সেই চোখেও এক ধরনের আনন্দহীন দৃষ্টি।

ইরন দরজা খুলে ঢুকতেই ঘরের তিন জন তার দিকে মাথা ঘুরে তাকাল। ইরন জোর করে মুখে একটা স্বচ্ছন্দ ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই প্রজেক্ট আপসিলনের সদস্য।

সুদর্শন তরুণ এবং কোমল চেহারার মেয়েটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, যা। ক্রিস্টাল ডিস্কের তথ্য অনুযায়ী এখানে অবশ্য আরো এক জনের আসার কথা।

ইরন হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি এসে বলল, সে নিশ্চয়ই এসে যাবে।

কেউ কোনো কথা বলল না, ইরন একটা নরম চেয়ারে গা ডুবিয়ে বসে বলল, আমি তোমাদের কথা জানি না, কিন্তু আমার খুব কৌতূহল ছিল তোমাদের দেখার।

সোনালি চুলের মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন?

কারণ প্রজেক্ট আপসিলনে যারা যাবে তাদের সবার মাঝে এক ধরনের মিল থাকার কথা।

সোনালি চুলের মানুষটি হঠাৎ এক ধরনের আনন্দহীন হাসি হাসতে শুরু করে। ইরন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে। 

আমি কি হাসির কোনো কথা বলেছি?

সেটা নির্ভর করবে একজনের রসবোধের ওপর।

তোমার রসবোধ খুব তীক্ষ্ণ?

না। উল্টোটা, আমার রসবোধ নেই।

তা হলে?

তুমি বলছ আমাদের সবার মাঝে এক ধরনের মিল রয়েছে। মিলটি কী জান?

ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

আমি বলতে চাইছি যে মিলটি হচ্ছে আমরা সবাই আগামী ছিয়ানব্বই ঘণ্টার মাঝে মারা যাব।

ইরন হঠাৎ কেমন জানি শিউরে ওঠে। সে আবার মাথা ঘুরিয়ে সোনালি চুলের মানুষটির দিকে ভালো করে তাকাল। মানুষটির চেহারা যেরকম কঠোর, তার কথার মাঝেও এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় রূঢ়তা রয়েছে। এটি কি তার চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নাকি প্রথম পরিচয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার সূক্ষ্ম একটা প্রচেষ্টা কে জানে।

ইরন মুখের মাংসপেশি শক্ত করে বলল, তুমি কেমন করে এত নিশ্চিত হলে যে আমরা সবাই মারা যাব?

সোনালি চুলের মানুষটি এক পা এগিয়ে এসে কালো গ্রানাইটের টেবিলের দুই পাশে বসে থাকা তরুণ–তরুণীকে দেখিয়ে বলল, ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ।

ইরন ঠিক বুঝতে পারল না, ভুরু কুঁচকে বলল, কী জিজ্ঞেস করব?

ওরা কারা?

ইরন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুদর্শন তরুণ এবং কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকাল। তারা দুজনেই হঠাৎ কেমন জানি অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তরুণটি ইতস্তত করে বলল, আমরা, আসলে প্রকৃত মানুষ নই।

ইরন চমকে উঠে বলল, তোমরা রোবট?।

না। যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, আমরা ক্লোন।

ক্লোন?

হা, বিভিন্ন বিপজ্জনক অভিযানে পাঠানোর জন্য আমাদের পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করা হয়েছে।

ইরন বিস্ফারিত চোখে এই সুদর্শন যুবক এবং কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আমি–আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মানুষকে ক্লোন করা সম্পূর্ণ বেআইনি। একবিংশ শতাব্দীতে।

সোনালি চুলের মানুষটি বলল, তুমি নেহায়েত সাদাসিধে একজন মানুষ। পৃথিবীর কোনো খবর রাখ না।

এই রূঢ় কথাটি শুনে যতটুকু ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত ছিল, ইরন কেন জানি ততটুকু ক্রুদ্ধ হতে পারল না। সে সবিস্ময়ে এই ক্লোন তরুণ এবং তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইল।

তুমি এখন বুঝতে পারছ আমি কেন বলেছি যে আমরা সবাই আগামী ছিয়ানব্বই ঘন্টার মাঝে মারা যাব?।

ইরন মানুষটির কথার কোনো উত্তর দিল না। সোনালি চুলের মানুষটি স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রথমত আমরা এমন একটা জিনিস জেনেছি যেটি পৃথিবীর মানুষের জানার কথা নয়–বিপজ্জনক অভিযানের জন্য মানুষকে ক্লোন করা হয়। দ্বিতীয়ত এই অভিযানে মানুষের ক্লোন পাঠানো হচ্ছে। যার অর্থ–

যার অর্থ?

যার অর্থ এখানে মানুষ ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা পড়বে। মানুষ যেখানে ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যায় সেখানে ক্লোনকে পাঠানো হয়। কারণ মানুষের ক্লোন আসলে মানুষ নয়।

অবশ্যই মানুষ। ইরন গলা উঁচিয়ে বলল, অবশ্যই তারা পরিপূর্ণ মানুষ। তারা সত্যিকার একজন মানুষের পরিপূর্ণ কপি। তাদের বুকে হৃৎপিণ্ড স্পন্দন করছে, ধমনিতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।

হ্যাঁ। যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু পৃথিবীর সংবিধান অনুযায়ী আমরা মানুষ নই। যার জিনেটিক কোড ব্যবহার করে আমাকে তৈরি করা হয়েছিল তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমরা নই।

আমি বুঝতে পারছি না। ইরন বিভ্রান্তের মতো বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সোনালি চুলের মানুষটি ইরনের কাছে এক পা এগিয়ে এসে বলল, এর মাঝে না বোঝার কিছু নেই। আমি যদি তোমাকে আঘাত করি সাথে সাথে প্রতিরক্ষা দপ্তরের লোক এসে আমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে। শরীরে ট্রাকিওশান১০ ঢুকিয়ে বিচারের জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু যদি মনে কর আমি একটা শক্ত টাইটেনিয়ামের রড দিয়ে এই দুজনের কারো মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দিই–আমার কোনো অপরাধ হবে না।

কী বলছ?

হ্যাঁ। ঘরের মেঝে নোংরা করার জন্য কয়েক শ ইউনিট জরিমানা হতে পারে কিন্তু মানুষ হত্যা করার জন্য বিচার হবে না।

কী বলছ তুমি?

সোনালি চুলের মানুষটি হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখতে চাও আমি সত্যি কথা বলছি কি না?

ইরন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে সোনালি চুলের নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল ঠিক তখন ঘরটির দরজা খুলে যায় এবং প্রজেক্ট আপসিলনের অন্য অভিযাত্রী ঘরে এসে ঢুকল। ইরন মাথা ঘুরিয়ে দেখল, লালচে চুলের একজন মহিলা। বয়স অনুমান করা কঠিন, চব্বিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ যে কোনো কিছু হতে পারে, কিন্তু যেরকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রবেশ করেছে বয়স খুব কম হবার সম্ভাবনা কম। মহিলাটিকে সুন্দরী বলা যাবে না তবে আকর্ষণীয় বলা যেতে পারে, চেহারায় একটা ভিন্ন ধরনের সতেজ ভাব রয়েছে। মহিলাটি এগিয়ে এসে সবার দিকে তাকাল এবং একটি চেয়ার টেনে বসে বলল, আমি তোমাদের আলোচনার মাঝে বিঘ্ন করে ফেললাম বলে মনে হচ্ছে।

ইরন বিড়বিড় করে বলল, সেজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আরেকটু হলে আমাদের একজন সদস্য আমাদের আরেকজন সদস্যের মাথার ঘিলু বের করে একটা। উদাহরণ তৈরি করতে চাইছিল।

লাল চুলের মহিলাটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। তবে সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, পুরোটা শুনলে নিশ্চয়ই বুঝব। আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি কীশা। আমি প্রজেক্ট আপসিলনের একজন অভিযাত্রী। তোমাদের সাথে এই অভিযানে অংশ নিতে পেরে আমি গৌরব অনুভব করছি।

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ইরন। আমি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। ঠিক কী কারণে জানি না আমার জীবন পুরোপুরি ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল, এই অভিযানে অংশ নিয়ে আমি আবার আমার জীবনে খানিকটা সমন্বয় ফিরিয়ে আনতে চাই।

সোনালি চুলের মানুষটি আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠল। ইরন তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে।

আমার কোন কথাটি তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?

জীবনের সমন্বয় ফিরিয়ে আনার অংশটা। জীবন একটা দ্বিঘাত সমীকরণ নয় যে সেটাকে সমন্বয় করে সেখান থেকে সমাধান বের করে আনা যায়। যারা জীবনকে সমন্বয় করার কথা বলে তারা জীবনের অর্থ বোঝে না, সমন্বয়ের অর্থও বোঝে না।

কীশা সোনালি চুলের মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কী?

আমার নাম বর্গেন।

বর্গেন, প্রথম পরিচয়ে যারা এভাবে কথা বলতে পারে ধরে নেওয়া যেতে পারে তারা সামাজিক পরিবেশে অভ্যস্ত নয়। আমার ধারণা তুমি সম্ভবত একটি রোবট।

বর্গেনের মুখে একটা ক্রোধের ছায়া পড়ে, আমি রোবট নই।

তা হলে তোমাকে নিয়ে আমাদের একটু সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে।

বর্গেন কোনো কথা না বলে কুদ্ধ চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন জিজ্ঞাসু চোখে কীশার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, আমাদের কেন সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে?

বর্গেন সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন আসামি। এই অভিযানে যারা এসেছে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকে।

ইরন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে বর্গেনের মুখের দিকে তাকাল, মানুষটির মুখে সত্যি এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুরতার ছাপ রয়েছে। সে ঘুরে কীশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই অভিযানে কেন এসেছ?

আমার ভাগ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর জন্য। আমার খুব আপনজন ছিল, ভালবাসার মানুষ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি দুর্ঘটনায় তারা শেষ হয়ে গেছে। কীশা পাথরের মতো মুখ করে একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে পালাতে চাই। তোমরা আমাকে একটু সাহায্য কোরো।

করব কীশা।

কালো গ্রানাইটের টেবিলের দুই পাশে বসে থাকা সপ্রতিভ চেহারার যুবকটি কীশার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত কীশা। খুবই দুঃখিত। কিন্তু এ রকম পরিবেশে কী বলতে হয় আমি জানি না।

কীশা একটু অবাক হয়ে যুবকটির দিকে তাকাল, ইরন নিচু গলায় বলল, এরা দুজন ক্লোন।

ক্লোন?

যুবকটি মাথা নাড়ল–হ্যাঁ। আমরা ক্লোন। আমাদের যে মানুষ থেকে ক্লোন করা হয়েছে তারা অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং সফল মানুষ। তাদের ভিতর সহজাত নেতৃত্ববোধ রয়েছে, তারা সহানুভূতিশীল এবং উদাসী। তাই আশা করা হচ্ছে আমরাও তাদের মতো চরিত্রের মানুষ হব। এই অভিযানে তোমাদের সাহায্য করতে পারব।

নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবে। কীশা মাথা নেড়ে বলল, আমি নিশ্চিত তোমরা চমৎকার সহযোগী হবে।

জীবন সম্পর্কে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে আমাদের বড় করা হয়েছে তাই আমরা স্বাভাবিক সামাজিক ব্যাপারগুলো জানি না।

কী বললে–তোমরা কোথায় বড় হয়েছ?

গবেষণাগারে। আমরা সব মিলিয়ে আঠার জন ক্লোন ছিলাম।

আঠার জন? ইরন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, একই মানুষের আঠার জন ক্লোন?

হ্যাঁ। আমরা সবাই এক জন মানুষের ক্লোন ছিলাম।

কীশা কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আর তুমি? মেয়েটির চোখে এক ধরনের ভয়ের ছায়া পড়ে, কাঁপা গলায় বলল, আমিও ক্লোন। আমি অত্যন্ত নগণ্য একজন ক্লোন।

এখানে কেউ নগণ্য নয়। এখানে সবাই প্রয়োজনীয়।

মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, না, আমরা জানি আমরা নগণ্য। মানুষের প্রয়োজনে আমাদের তৈরি করা হয়। সত্যিকারের মানুষের জীবন খুব মূল্যবান, কিন্তু আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। সহজে খরচ করে ফেলবার জন্য আমাদের তৈরি করা হয়।

ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ তোমরা?

আমরা সত্যি বলছি। আমাকে যে গবেষণাগারে বড় করা হয়েছে সেখানে আমরা ছিলাম একুশ জন। পরের বার তৈরি করা হয়েছে আরো চব্বিশ জন। আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। যার জিনস ব্যবহার করে আমাদের ক্লোন করা হয়েছে সে অত্যন্ত চমৎকার একজন মহিলা ছিল। আমরা সবাই তার সম্মান রাখার চেষ্টা করি। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। আমরা–_

তোমার নাম কী মেয়ে?

কীশার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি থতমত খেয়ে থেমে গেল। নাম? আমার নাম?

হ্যাঁ।

আমাদের কোনো নাম থাকে না। শুধু নম্বর দেওয়া থাকে। আমার নম্বর সতের।

ইরন এক ধরনের বেদনাতুর দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু একজন মানুষের নাম নেই, সেটা তো হতে পারে না।

আমরা মানুষ নই, মানুষের ক্লোন।

মানুষের ক্লোনও মানুষ। তোমার একটা নাম থাকতে হবে। আমি তোমাকে একটা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করব না।

মেয়েটি খানিকটা হতচকিত হয়ে পুরুষসঙ্গীর দিকে তাকাল। দুজন দুজনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার ইরনের দিকে ঘুরে তাকাল। যুবকটি ইতস্তত করে বলল, সত্যি যদি কোনো একটি নাম দিয়ে ডাকতে চাও তা হলে একটি নাম দিতে হবে। কারণ আমাদের কোনো নাম নেই।

তুমি যে মানুষটির ক্লোন তার নাম কী?

আমি যতদূর জানি তার নাম ত্ৰালুস।

বেশ তা হলে তুমিও ত্রালুস।

ইরন এবারে কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আর তোমার?

আমাকে ক্লোন করা হয়েছে মহামান্যা শুমান্তি থেকে।

বেশ। আজ থেকে তা হলে তুমিও হচ্ছ শুমান্তি।

কীশা মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলল, চমৎকার! তা হলে প্রজেক্ট আপসিলনের সকল সদস্যের নামকরণ করা হয়ে গেল।

বর্গেন আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে বলল, সেই নাম কতক্ষণ কাজে লাগবে দেখা যাক।

কীশা ভুরু কুঁচকে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

বর্গেন কিছু একটা বলতে চাইছিল, ইরন বাধা দিয়ে বলল, ওর কথা থাক। ওর কথা। শুনলে মন খারাপ হয়ে যাবে।

কেন?

কারণ বর্গেন দাবি করে এই অভিযানে আমরা নাকি ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যাব।

কীশা বর্গেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেন এ রকম বলছ?

আমি জানি তাই বলছি।

তুমি কেমন করে জান?

কারণ আমি এই প্রজেক্টের দলপতি।

সবাই একসঙ্গে চমকে উঠে বর্গেনের দিকে তাকাল। বর্গেন আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে মাথা নেড়ে বলল, না, তোমরা যেটা ডাবছ সেটা আর হবার নয়।

আমরা কী ভাবছি?

তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ যে এই অভিযানে তোমরা যাবে না। তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাকে তোমাদের খুব পছন্দ হয় নি।

ইরন এবং কীশা স্থির চোখে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে রইল। বর্গেন তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, কিন্তু তোমাদের আমার ভারি পছন্দ হয়েছে। এ রকম ক্রু না নিয়ে আমি এই অভিযানে যাচ্ছি না।

বর্গেন আবার আনন্দহীন একটি হাসি হাসতে শুরু করে। যেভাবে হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেরকমভাবে হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, তোমরা এখন চল। মহাকাশে অভিযানের আগে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অত্যন্ত নিরানন্দ একঘেয়ে প্রশিক্ষণ–কিন্তু জরুরি, খুব জরুরি। কারণ মানুষ আসলে ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যেতে পছন্দ করে না। বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে যায়। সে জন্য তোমাদের নানারকম প্রশিক্ষণ নিতে। হবে। তোমাদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য কয়েক ডজন টেকনিশিয়ান, ডাক্তার, নার্স আর রোবট অপেক্ষা করছে।

ইরন পাথরের মতো মুখ করে বলল, আমরা যদি না যাই?

বর্গেন হাসিমুখে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই যাবে। কারণ যারা প্রজেক্ট আপন্সিলনে নাম লিখিয়েছে তাদের নিজের ইচ্ছা–অনিচ্ছার বিশেষ কোনো মূল্য নেই! মানুষের আর ক্লোনের মাঝে সে ব্যাপারে এখন আর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।   ইরন স্থির চোখে বর্গনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে খুব অবাক হয়ে লক্ষ করল তার ভিতরে অসহ্য ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছে না, বরং বিচিত্র এক ধরনের কৌতূহল দানা বেঁধে উঠছে।